ইবনে খলদুন ও তাঁর আসাবিয়া তত্ত্বের উপর 'চিন্তা পাঠচক্র'র আলোচনা

২২ জানুয়ারি ‘চিন্তা পাঠচক্র’র বিষয় ছিল ইবনে খলদুন-এর ইতিহাস চিন্তা।মুল আলোচক জোবায়ের আল মাহমুদ।

জোবায়ের- ইবনে খলদুনের জন্ম ১৩৩২ সালে আর মৃত্যু ১৪০৬ সালে। মূলত চারটা বিষয়ে আগ্রহের জায়গা ছিল উনার।সমাজ বিজ্ঞান,ইতিহাসের দর্শন,অর্থনীতি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। মোটা দাগে তাঁর মৌলিক অবদানের জায়গা হল ‘আসাবিয়া’ বা গোত্রপ্রীতি, শাসকের উত্থান পতনের বৃত্ত, অর্থনীতির চাহিদা ও যোগান ইত্যাদি।

আজ আমরা যে আর্টিকেলগুলো নিয়ে আলোচনা করব, তা মূলত নেয়া হয়েছে ইবনে খলদুনের ‘কিতাবুল ইবার ওয়া দিওয়ান আল-মুবতাদা ওয়াল খবর ফি আইয়ামিল আরব ওয়াল-আজম ওয়াল-বারবার’ নামক বইয়ের ভূমিকা থেকে। ভূমিকা আমরা এক দুই পৃষ্ঠা লিখি সাধারণত। কিন্তু ইবনে খলদুন লম্বা একটা ভূমিকা লিখেছেন। ঐ ভূমিকায় তিনি অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আর্টিকেল লিখছেন। সেখানে তিনি বলছেন, আমরা যখন ইতিহাস আলোচনা করি তখন আমাদের কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। তিনি শুরু করছেন এইভাবে, ইতিহাস হচ্ছে এমন একটা কমন জিনিস যা সবাই আলোচনা করতে চায় এবং ইতিহাস পাঠ করে সবাই মজা পায়। তিনি বলেন, এই যে ইতিহাসের চর্চা এটা কিন্তু একক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি হয় না। ইতিহাস চর্চা হওয়ার নানা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। অতীতে যত ইতিহাসের চর্চা হয়েছে সবগুলো অনেক ভ্রান্তির উপরে চর্চা হয়েছে। এর পিছনে মুল কারণ হচ্ছে যারা ইতিহাস লেখেন তাদের  উপর জনগণের একটা চাপ থাকে তাদের মন মত একটা ইতিহাস লেখার জন্যে। যে শাসকের অধীনে ইতিহাস লিখছে তারও একটা চাপ থাকে। ফলে ইতিহাসে অনেক ধরনের ভুল-ভ্রান্তি প্রবেশ করে।

ইবনে খলদুন অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটা বলি, ঐতিহাসিক মাসুদি একটা জায়গায় লিখছেন যে, মিশর থেকে মুসা যখন ইসরাইলে পালিয়ে গেলেন তখন ইহুদির সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। খলদুন বললেন, এটা কিভাবে সম্ভব? তিনি দেখালেন যে মুসার বাবা ছিলেন ইমরান, ইমরানের বাবা ছিলেন কোহাস, কোহাসের বাবা ছিলেন লোবি, লোবির বাবা ছিলেন ইয়াকুব, ইয়াকুবের বাবা ছিলেন ইসরাইল। এখানে মাত্র ছয়টা পুরুষ গেছে। ইয়াকুব যখন মিশরে গেলেন তখন তাদের সংখ্যা ছিল সত্তর জন। কিন্তু এই অল্প সময়ের ব্যবধানে জনসংখ্যা ছয় লক্ষ কিভাবে হল? এটা তো অসম্ভব বিষয়। তিনি দেখিয়েছেন, ঐতিহাসিকরা সাধারণত দুইটা জায়গায় ভুল করেন, এক হচ্ছে যখনই সৈন্যদের সংখ্যার ব্যাপার আসে আর দুই হচ্ছে যখনই রাজাদের ধন দৌলতের ব্যাপার আসে। অর্থাৎ যখনই সংখ্যাগত জায়গা আসে তখনই ঐতিহাসিকরা এটাকে বাড়িয়ে বলেন। -এর অনেকগুলো কারণ ব্যাখ্যা করেন ইবনে খলদুন।

খলদুন বলেন, আমি যে ইতিহাসটা লিখব তা অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, আমরা যে ইতিহাসই শুরু করি না কেন আমাদেরকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তিনি দেখাচ্ছেন মানুষের ক্রম বিকাশটা হয়েছে পানি থেকে। পানির সর্বোচ্চ স্তর আর গাছগাছালির সর্বনিম্ন স্তর দুইটা প্রায় এক। আবার গাছগাছালির সর্বোচ্চ স্তর প্রাণীদের সর্বনিম্ন স্তরের সমান। প্রাণীদের সর্বোচ্চ স্তর মানুষের সর্বোচ্চ স্তরের সমান। এরপর মানুষের মধ্যে আলাদা করে আকল, বুদ্ধি এগুলো দেয়া হয়েছে। যখনই প্রাণী আর মানুষ আলাদা হল মানুষ খাদ্য আর আত্মরক্ষা এই দুইটা কারণে অস্ত্র তৈরি করা শুরু করল। আস্তে আস্তে মানুষ সামাজিকভাবে চলা শুরু করল। কিন্তু এবার দেখা গেল, মানুষ একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করল। তারপর যে একটু পাওয়ারফুল তাকে ক্ষমতার আসনে বসানো হল, যাতে সবার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা-বোধ আসে। মানুষ তখন দুইটা গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। একটা হল শহরের আরেকটা হচ্ছে বেদুইন। যারা ক্ষমতা পেল তারা আরাম আয়েশের মধ্য দিয়ে একটা গ্রুপ গড়ে তুলল যেটাকে আমরা শহুরে গ্রুপ বলতে পারি। আরেকটা হচ্ছে বেদুইন যারা ক্ষমতা দিল। এ দুই গ্রুপের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন খলদুন। শহুরে এবং বেদুইনদের একত্র রাখতে যে জিনিসটা কাজ করে সেটাকে উনি বললেন ‘আসাবিয়া’ বা সামষ্টিক অনুভূতি। আসাবিয়া সৃষ্টি হয় প্রধানত রক্তের ভিত্তিতে, দ্বিতীয়ত ভাষা এরপরে হচ্ছে গোত্র বা জায়গা। এ সবগুলোর উপরই নির্ভর করে ‘আসাবিয়া’। খলদুন দেখাচ্ছেন, অধিকাংশ সময় যারা অধীনস্থ তারা ক্ষমতাবানদের বাইরের যে চাকচিক্যকে অনুকরণ করে। অনুকরণ করতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষমতাবানরা কিভাবে ক্ষমতা পেল, সেই মৌলিক জায়গা ফলোয়াররা ধরতে পারে না। ফলে তারা ক্ষমতাবানদের কাউন্টারও করতে পারে না। কাউন্টার তখনই করতে পারে যখন তাদের সামষ্টিক অনুভূতি বা আসাবিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এখানে এসে তিনি ধর্ম ও আসাবিয়ার মধ্যে একটা পার্থক্য দেখিয়েছেন। সাধারণত আমারা দেখি যে, বর্তমান পলিটিকাল ইসলাম নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের মধ্যে একটা কনসেপ্ট আছে যে, দেশ বা গোত্র প্রীতিটা হচ্ছে জাহেলিয়াত। কিন্তু এক্ষেত্রে খলদুন একটু ব্যতিক্রম। তার কথা হচ্ছে, যখন এই গোত্র প্রীতিটা ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে তখন সেটা ভাল কাজে দেবে। ধর্ম যদি আসাবিয়াকে ব্যবহার না করতে পারে তাহলে ধর্ম ধর্মের জায়গা থেকে হয়ত কাজ করতে পারবে, কিন্তু রাজনৈতিক যে লাভ তা পাবে না। তিনি অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে- ইয়ারমুকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলিম ছিল ত্রিশ হাজার কিন্তু বিপক্ষ শক্তির সৈন্য সংখ্যা ছিল কয়েক লক্ষ। তারপরেও এই ত্রিশ হাজার সৈন্য বিজয় লাভ করেছে। তখন ধর্মের সাথে আসাবিয়া মিশে এমন একটা মনোবল তৈরি হইছে যার কারণে এ বিজয় সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে আমরা ইরানের উদাহরণ দিতে পারি, ইরানে আসাবিয়া আর ধর্মের মিলনের ফলে সেখানে বিপ্লবটা সফল হয়েছে। খলদুন বলছেন, ধর্ম যখন এরকমভাবে মিশে যায় তখন আসাবিয়াটা অনেক শক্তিশালী হয়।

তারপর খলদুন সাম্রাজ্য বিস্তারের যে সীমাবদ্ধতা সেগুলা নিয়ে বলেন। ক্ষমতা পাওয়ার পরে আশে পাশের রাষ্ট্রগুলোকে নিজের আওতায় আনতে গেলে একটা সমস্যা দেখা দেয়। তা হল, সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকের তুলনায় যদি জনসংখ্যা বেশি হয়ে যায় তখন আসাবিয়া বা সামষ্টিক অনুভূতি হ্রাস পেতে থাকে। ফলে একসময় তারা থেমে পড়ে এবং তাদের রাষ্ট্রের ধ্বংস শুরু হয়। রাষ্ট্রে সামষ্টিক অনুভূতি বা আসাবিয়া না থাকলে দুইটা সমস্যা হয়। একটা হচ্ছে বাহির থেকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, আরেকটা হল ঐ গোত্রের ভিতর থেকেই আলাদা একটি বিদ্রোহী শক্তি বের হয়। রাজ বংশের স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে খলদুন বলেন, একটা রাজবংশ সাধারণত চার প্রজন্ম পর্যন্ত থাকে। বিভিন্ন প্রজন্মগুলো কেমন হয়, তার বৈশিষ্ট্য তিনি আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করছেন। এরপর রাজবংশের পাঁচটা স্তরের কথা বলছেন। প্রথমে স্তরে সে অন্য থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়, এসময় সবাই তাঁর প্রতি পজিটিভ থাকে। দ্বিতীয় স্তরে শাসক জনগণের উপর আধিপত্য কায়েম করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এসময় তার আশেপাশের লোকজন অনেক আর্থিক সুবিধা লাভ করে। তৃতীয় স্তরে এসে যখন আশে-পাশের লোকেরা তার থেকে চলে যায় তখন সে একা হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে সে অন্যদের ভীত রাখার জন্য আলাদা করে একটা পোশাকি জৌলুস দেখাতে থাকে। চতুর্থ স্তরে সে পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে। আর পঞ্চম হচ্ছে সে ব্যাপক আকারে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে এবং তার ধ্বংস শুরু হয়। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তার স্থাপনাগুলো হয়ত টিকে থাকে আর টিকে থাকে কিছু গল্প কাহিনী। খলদুন বলেন, এই যে একজন রাজার উত্থান এবং ধ্বংস হল এবং এরপর যে স্থাপনা এবং গল্পগুলো থেকে গেল; এগুলো থেকেই পরবর্তীতে ইতিহাস রচিত হয়। সে ধ্বংস হওয়ার আগে যে বিলাসী জীবন যাপন করছিল এটাকেই লোকেরা তার শাসনকাল হিসেবে মনে করে। এটা ধরে নিয়ে ঐতিহাসিকরা যখন ইতিহাস লিখে তখন অনেক কিছুই বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখে। খলদুন বলছেন যে আমরা যখন ইতিহাস লিখব তখন এই ব্যাপারগুলো আমরা চিন্তা বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখব। তখন ইতিহাস অনেক বেশি কংক্রিট হবে।

খলদুন এখানে খিলাফত ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপারগুলো আনলেন। খলদুন বলতে চান, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা কোরআনের আদেশও না, নিষেধও না। ক্ষমতার কিছু খারাপ স্বভাব যেমন একক কর্তৃত্ব, বিলাসিতা, একনায়কতন্ত্র, আরামপ্রিয়তা এগুলো থেকে যদি শাসকরা দূরে থাকতে পারে তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে। তিনি মোটা দাগে একটা মন্তব্য করছেন, তা হচ্ছে, খেলাফত পরবর্তী সময় যত মুসলিম শাসক আছেন সবাই কমবেশি শরীয়াকে যতটুকু রাখা যায় রেখে নিজেদের স্বার্থই হাসিল করছেন। রাসুল (সঃ)-এর পর ইসলামে আবু বকর খলিফা হওয়ার পিছনে অনেকগুলো যুক্তি দিলেন। রাসুল (সঃ) বলেছিলেন যে,কুরাইশদের থেকেই খলিফা হবে। কুরাইশ গোত্রের কথা রাসূল (সঃ) একারণে বলেছেন যে,কুরাইশ না হলে মুসলিম সমাজে তখন অনেক সমস্যা দেখা দিত। আর কুরাইশরা ছিল রাসুলের আসাবিয়া।আবুবকর, ওমর, ওসমান ও আলীর জীবনী আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন যে, তাঁদের সময় পর্যন্ত তারা ধর্মের মাধ্যমে আসাবিয়াকে ব্যবহার করতে পেরেছেন; এর পরে আর কেউ পারে নাই। এরপর তিনি রাষ্ট্রের অনৈক্যের কারণ নিয়ে আলোচনা করছেন। রাষ্ট্রের অনৈক্যের দুইটা কারণ উল্লেখ করছেন। একটা হচ্ছে সামষ্টিক অনুভূতি যখন পানসে হয়ে যায় আরেকটা হচ্ছে সৈন্যদের যখন উপযুক্ত খরচ না দিতে পারে। আর নতুন রাজশক্তি পাওয়ার পিছনে তিনি দুইটা পদ্ধতি দেখিয়েছেন।যখন সামষ্টিক অনুভূতি পানসে হয়ে যায় তখন হয় বাইরের শক্তি আক্রমণ করে অথবা নিজেদের মধ্যে আরেকটা শক্ত গ্রুপ ফিলিং তৈরি হয় যারা কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়।

খলদুন বলেন, যে কোনো সভ্যতায় দুই ধরণের চালিকাশক্তি থাকতে পারে। একটা হচ্ছে প্রত্যাদেশ বা ওহী, আরেকটা হচ্ছে যুক্তিশীল রাজনীতি। কিন্তু যুক্তিশীল রাজনীতিতে একটা ভুল হয় যে, তারা জনগণের স্বার্থ দেখে না। পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে শাসকদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। খলদুন বলছেন এই ব্যাপারগুলো মাথায় নিয়ে যখন ইতিহাসের চর্চা করব তখন সে ইতিহাসটা অনেক বেশী ইতিহাস হয়ে উঠবে।

মুসতাইন জহির- আমরা ইতিহাসের দর্শন আলোচনার জন্যে মমতাজুর রহমান তরফদারের সংকলনটাকে বেছে নিয়েছি। ইতিহাস আলোচনার পদ্ধতিগত জায়গাটা আস্তে আস্তে কিভাবে তৈরি হয়েছে এবং সেটা খালদুন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে মার্কস পর্যন্ত এসে কোথায় দাড়িয়েছে। আমি এর আগে একটা আলোচনা করেছিলাম, একটা জিনিস আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আধুনিক ইতিহাস আলোচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল টেলিওলজি। এখানে সময়ের একটা রৈখিক বা সামনের দিকে অগ্রগতি এবং পিছন-সামনের ধারাবাহিকতা রক্ষার অনিবার্যতা রয়েছে। সবসময় পিছনের দিকে তাকিয়ে বর্তমানকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসের আধুনিক তত্বায়নের মধ্যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সাথে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্বের কি যোগাযোগ তা পরে আলোচনা করব। এর মধ্যে দুটো জিনিস আছে; একটা হল অগ্রগতি, আমরা যেটাকে বলি মুক্তির ধারনা বা সটেরিওলজিকাল (soteriological)কনসেপ্ট। পরবর্তীতে মানুষের মুক্তির ধারনাটা আসলে সেকুলারাইজ জেনারেল কনসেপ্ট আকারে আসছে। এ ধারনাগুলোর আগে এর কি কি ধরনের উপাদান মিশ্রিত হয়েছে, খলদুনের আলোচনায় আমি ওটা দেখতে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলাম। আমার অবজারভেশনটা হল, এর আগে এতটা সুনির্দিষ্ট করে আলোচনা হয় নাই যে মানুষের সংঘবদ্ধতার কারণ কি। সামষ্টিকতা, সংঘবদ্ধতার একটা মানে আছে, আরেকটা হল গোত্রীয় সংঘবদ্ধতা। আরবি ভাষাভাষী বিশেষত কুরাইশ এবং ঐ অঞ্চলে সেখানে গোত্রীয় সংঘবদ্ধতাকে আসাবিয়াত বলা হোত। যে প্রশ্ন থেকে তিনি তার পদ্ধতি তৈরি করছেন সেটা হল মানুষ একত্রিত হয় কেন? আধুনিক ভাষায় আমরা বলি সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা; একটা সোসাইটি কিভাবে ফর্ম করে। আমরা এর আগে যে আলোচনাগুলো পড়ছিলাম এনথ্রোপোলজি এবং সোশোলজির মধ্যে বারবার আসা যাওয়া করছিলাম। এর মধ্যে বিভাজন, সম্পর্ক, ক্ষমতা এই  জায়গাগুলোর কথাটা খলদুনের মধ্যে অন্যভাবে এসেছে। মোটা দাগে খলদুন যে প্রস্তাব দিচ্ছেন তা হল, যে কোন সমাজ নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদেরকে অনুমান করে নিতে হবে তারা কিভাবে একত্রিত হয়। একত্রিত হওয়ার কারণ কি। কোন উপাদান দ্বারা তারা একত্রিত হয়। খলদুন ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছেন এই একত্রিত হওয়ার উপাদানটা কি এবং কখন একতা বিনষ্ট হয়। একতা বিনষ্ট হওয়াটাকে সে রাইজ এন্ড ফলের তত্ত্ব আকারে এনেছে। কখন কাদের কিভাবে উত্থান হয়েছে আর পতন হয়েছে। এ ব্যাখ্যাগুলোর সমস্যা হল এটা অনুমান করে নেয় যে কোন ক্ষমতার যে কোন শক্তির পতনের কারণ হল এক ধরনের আলস্য, অবক্ষয় এইসব। এটা কিন্তু খুবই দুর্বল এবং প্রশ্নবোধক একটা প্রস্তাবনা। ডেফিনেটলি পোশাক-জৌলুস এগুলোর ব্যবহার ঘটে, সেটা সব সময়ই ঘটে। এটা যখন কারো উত্থানকাল থাকে তখনো ঘটে, পতনের সময়ও ঘটে।(এই দিকটা আমরা বুঝব আন্য আরেকটা বিষয়কে সামনে আনলে: ক্ষমতার উৎস, অভিষেক এবং বৈধতার যে ধারণা সমূহ দ্বারা রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা নিজেকে উপস্থাপন করত, যিনি শাসন কার্যের নিয়ন্তা তার মহিমা প্রচার এবং মহামহিমের সাথে তার সম্পর্ক আরোপনের যে প্রয়োজন দেখা দিত সেই জায়গা থেকে। ক্ষমতার সাথে গ্লরি যুক্ত করা, একে গ্লরিয়াস করে তোলা। সেই আলোচনা আপাতত এখন নয়।) আমি বলতে চাই, এই যে সংঘবদ্ধতা একটা জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের সংহত করার পিছনে একটা যুক্তি একটা কারণ বা একটা উপাদানকে খুঁজতে চাচ্ছেন এটা কিন্তু আধুনিক ইতিহাস তত্বেরও একটা মৌলিক উপাদান।

এখানে আপনার আলোচনায় আপনি এই তফাতটা করেন নি। খলদুন যা বলছেন তা হল এই গোষ্ঠীবদ্ধতা স্বৈরতান্ত্রিক বা খারাপ হয়ে যেতে পারে যদি ধর্ম অর্থে ব্রডলি প্রিন্সিপাল বা এথিকস দ্বারা এটি গাইডেড না হয়। গোষ্ঠীবদ্ধতা তো ছিলই আরবে। ইসলাম আসার পরে নতুন ধরনের গোষ্ঠীবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। নতুন সেই গোষ্ঠীবদ্ধতার ব্যাখ্যা কি? এই নতুন গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রয়োজন কেন হয়েছে। কি উপাদান যুক্ত করে এই সমাজ তৈরি করা হয়েছে। তা আগের চেয়ে আলাদা কোথায় কোথায়। আমি একটা খ্রিস্টিয়ান নোশন এই আলোচনার মধ্যে দেখি।সেটা থাকা মানে দোষের, সেই অর্থে বলছিনা। আধুনিক  নৃতত্বের মধ্যে প্রধান অনুমান— এই যে, গোত্রের ধারনা; একজন তার পরবর্তী প্রজন্ম অথবা তাদের এক্সটেনডেট ফ্যামিলি পেট্রিয়ার্কের ধারনা; এটা অনুমান করে নেয় যে এর মধ্যে একটা রক্তের সম্পর্ক আছে। রক্তের সম্পর্ক দ্বারা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার বা তাকে দেখার এই অনুমানটার সাথে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্বের প্রথম অনুমানটা হল ব্লাড। খেয়াল করবেন কমিউনিটি ফরমেশনের মধ্যে শেষ ভোজন বা লাস্ট সাফার যেটাকে বলা হয়, যেখানে ঈসা বলছেন যে এই যে ব্রেড আর ওয়াইন এটা হল আমার ফ্লেশ এবং ব্লাড। ক্রসিফিকেশনের পরে এর একটি প্রতিকী ও  ফিলোসফিকাল মিনিং তৈরি হয়েছে। ফলে আধুনিক চিন্তার মধ্যে ফ্লেশ এন্ড ব্লাড- এটা ল’তে, হিস্ট্রিতে, সোশোলজিতে,এন্থ্রোপোলজিতে এত ব্যাপক পরিমাণে কাজ করে। এই কাজ করার একটা জায়গা হল খ্রিস্টীয় চিন্তার মধ্যে, সংঘবদ্ধতার সূত্রের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের একটা অনুমান আছে। এই জিনিসগুলো খলদুনের আলোচনায় অনুমানের মধ্যে রয়ে গেছে। কিন্তু এটা হয়ত প্রধান উপাদান হিসাবে এখানে নেই।খলদুনের আলোচনার মধ্যে এক ধরনের প্রাকৃতিক বিবর্তনমূলক অনুমানও আছে। পদ্ধতিগতভাবে কমিউনিটি চিন্তার মধ্যে তার একটা ইভলিউশনারি অনুমান আছে। সে অনুমানের মধ্যে আবার গোষ্ঠীবদ্ধতার মুল ভিত্তি রক্তের সম্পর্কটাকে তিনি অনুমান করে নিয়েছেন। ইসলামের উত্থানের পরে আরবীয় সমাজের যে মৌলিক পরিবর্তনটা ঘটেছে এবং ইসলামে উম্মার যে ধারনাটা, সেটা তিনি কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন? এই কয়েকটা প্রশ্ন করে আমি আপাতত থামি।

রাসেল-কোরানের ঐ আয়াতটা- আমি তোমাদেরকে একটা পুরুষ এবং নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে ভাগ করছি, যেন তারা পরস্পর পরিচিত হতে পারে। এখন এ গোত্রগুলো কিন্তু আল্লাহ ভাগ করে দিয়েছেন আলাদা আলাদা হওয়ার জন্য না। বরং পরিচিত হবার জন্যে।

মুসতাইন জহির- কোরানের এই আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে যে সমগ্র মানুষকে আল্লাতালা সৃষ্টি করেছেন দুটো নর-নারী থেকে। তাহলে এখানে কি এটা প্রস্তাব করা হচ্ছে যেহেতু মানব সম্প্রদায় একটা পরিবারের অংশ; তার মানে এটা কনসেপ্ট অব দ্য ফ্যামিলি। তার মানে ইটস এ কোশ্চেন অব ফ্যামিলি এন্ড এগেইন ইটস এ কোশ্চেন অফ ব্লাড। তার মানে আমরা অন্যের সাথে একত্র হওয়ার মুল সম্পর্কটা হল আমার রক্তের সম্পর্ক। কোরানের আয়াত দেয়ার পিছনে আমাদের মাথার মধ্যে একটা অনুমানটা কাজ করছে যে আমরা আদম-হাওয়ার বংশধর। ফলে আমরা একটা পরিবার এবং আমাদের এই রক্তীয় সম্পর্কটাই হল মুল ভিত্তি।এমন কি? বাকি যে বৈচিত্র্য সেটা হল আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। জগত ভ্রমিয়া দেখ একই মায়ের পুত, সবার মধ্যে একই রক্ত এসব আলোচনা শুনতে ভাল লাগতে পারে কিন্তু এগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন করার জায়গা তৈরি করা দরকার। এবং রক্তের সম্পর্ক প্রস্তাব করে আমরা যে ইতিহাসে খুব বেশি আগায়ে গেছি তা না। শুনতে ভাল লাগে আমরা সবাই একই রক্তের। রক্তের সম্পর্কটা নিয়ে আমি হয়ত আরেকদিন আলোচনা করব। যেমন রক্তের বিশুদ্ধতার প্রশ্ন। রেসিজমের একটা মুল ভিত্তি হল রক্ত। খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে ক্রুসেডের আগে পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্রিস্টানিটির একটা ফান্ডামেন্টাল প্রবলেম ডিল করেন। হত্যা মাত্রই একটা পাপ। আপনি যখন পাপ করেন তখন ধর্মচ্যুত হন। ফলে ধর্মের মধ্যে এই কনসেপ্টটা আসছে আপনি যুদ্ধ করবেন, যুদ্ধ মানেই হত্যা করা। খ্রিস্টানিটির মধ্যে ব্লাডের কনসেপ্টটা অনেক গভীর। কারণ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে রক্ত দিতে হয়েছে। জেসাসের হত্যাটাকে দেখা হয় মাস মার্ডার হিসেবে। খ্রিস্টিয়ান থিওলজির মধ্যে বলা হয় যে আমরা সবাই তাকে হত্যা করেছি। এটার মধ্য দিয়ে যিশু নিজেকে উৎসর্গ করেছেন সবাইকে মুক্ত করার জন্য। এখন তাহলে হত্যা মাত্রই তো রক্তপাত ঘটানো। কোনভাবে যদি মানুষের রক্তপাত ঘটান এটা একটা পাপ। এই যে রক্তপাত ঘটানো-এটা পাপ। এটা খ্রিস্টান থিওলজির একটা সিরিয়াস প্রবলেম। ক্রুসেডে, এটা কোন সাধারণ যুদ্ধ না একটা ধর্ম যুদ্ধের প্রশ্ন আসছে। তখন কনসেপ্ট অব ব্লাডের মধ্যে একটা ভাগ টানা হল। খ্রিস্টিয়ান ব্লাড। ফলে আপনি যদি একজন খ্রিস্টানের রক্তপাত করেন সেটা পাপ কিন্তু আপনি যদি একজন খ্রিস্টানকে রক্ষার জন্য রক্তপাত করেন এটা সওয়াব। ফলে খ্রিস্টিয়ান ব্লাড ও নন খ্রিস্টিয়ান ব্লাডের ভাগটা তিনি করলেন; করে ক্রুসেডের থিওলজিকাল বেসিসটা দিলেন। একজন খ্রিস্টানের কর্তব্য হল যাতে অন্য খ্রিস্টানের রক্তপাত না ঘটে তা নিশ্চিত করা। আপনি অন্যের সাথে এখনো রক্তের দ্বারাই সম্পর্কিত। যেমন, আমার রক্ত আর তোমার রক্ত, খ্রিস্টানের রক্ত আর অ-খ্রিস্টানের রক্ত, ইউরোপিয়ানের ব্লাড-নন ইউরোপিয়ান ব্লাড। এটাই এখন আপনি ব্লাড আকারে শুনেন না; রেস আকারে, নেশন আকারে শুনেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের এ জমানায়, বাংলাদেশে আপনাদের কাছে এটা বেশ সেক্যুলারও লাগতে পারে। তো, আসাবিয়ার আলোচনার মধ্যে আমি একই ধরনের ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। গোত্রীয় সম্পর্কটার এক ধরনের এক্সটেনশন ঘটছে। এখান থেকে বের হওয়ার কোন ইশারা বা জায়গা আমি খলদুনের আলোচনায় পাচ্ছি না।

তাহলে সারমর্ম যদি করি আমাদের আলোচনার সেটা হল, আমরা ইতিহাসের আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসের তত্ব আলোচনা করছি। ইতিহাস তত্বের আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ইবনে খলদুন। তিনি প্রশ্ন করলেন যে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায় তারা নিজেদেরকে একতাবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ করে নিজেদের ক্ষমতার যে উত্থান ঘটায় আমরা কিভাবে তা বুঝব। ফলে একদম প্রাথমিক উপাদান থেকে শুরু করে আরো আরো উপাদানগুলো আছে সেখানে খাদ্য, পরিবেশ তার প্রকৃতি আরো নানা কিছু নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসমস্ত কিছু দিয়ে একটা সম্প্রদায়কে একটা কালপর্বকে একটা জনগোষ্ঠীকে একটা সভ্যতাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এসমস্ত কিছু বোঝার মধ্যে কেন্দ্রীয় বিবেচ্য বিষয় হল তার মধ্যে সংহতিটা। এ সংহতির প্রধানতম সূত্রটা কি। কিসের উপর ভিত্তি করে এ সংহতিটা নির্ণয় করা যাবে। তার ভিত্তি বা পাটাতন কি হবে। মডার্ন সোশিওলজিতে খলদুনের এই দিকটাকে গ্রহণ করার একটা ব্যাপার আছে, যেটা এপারেন্টলি দেখতে পাচ্ছি। এটার মধ্য থেকে ইসলামের উম্মাহর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। উম্মাহকে এর মধ্যে ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।