বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার অতীত ঐতিহ্য, বর্তমান চালচিত্র ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা (পর্ব-০১)
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি বাজারমুখিতা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আনুসাঙ্গিক অন্য শিক্ষা প্রকল্প যেমন বিশেষ কানাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে তেমনি ধর্মনির্ভর শিক্ষার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠার প্রবণতা রয়েছে অনেকের। বিশেষ করে এদেশের তথাকথিত আগ্রাসী এবং উগ্রপন্থি সেকুলার মৌলবাদীরা এই ভীতি তৈরির জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ করে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের এই সেক্যুলার নামধারী হিংস্র গোষ্ঠী মাদ্রাসা তথা ধর্মীয় ও নৈতিকতা নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। এটা ঠিক যে, তারাই প্রথম না, তাদের আগে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাও ইসলামী শিক্ষার বিরোধিতা করেছিল; ধ্বংস করার পাঁয়তারা করেছিল নানা ভাবে। বিশেষ করে ইংরেজ নীতিনির্ধারকরা জানত তাদের ক্ষমতায় ধ্বস নামাতে গেলে যে শিক্ষার প্রয়োজন, জাতিসত্তা ও আত্মসত্তার যে বিশ্বাসগত ভিত্তি প্রয়োজন তা একমাত্র নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কম্যুনিস্ট সাম্রাজ্যবাদের ভাঁড়েরাও ঠিক একই নীতি অবলম্বন করে। আর তারাই বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ছলে বলে কৌশলে পুঁজি বিরোধিতার নামে সাম্রাজ্যবাদকে আরো পাকাপোক্ত করতে চায়। আর বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে নৈতিকতার শিক্ষায় বিরোধিতা করা এ দীর্ঘ এজেন্ডার অংশ মাত্র।
আমরা জানি, মোগল আমলে প্রত্যেক মাদ্রাসার জন্যে প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ করা ছিল। এতে করে মাদ্রাসাগুলো স্বাধীনভাবে তাদের পড়াশুনা করতে পারে। তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেরাই বহন করতে পারত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু পরবর্তীকালে মাদ্রাসার জন্যে বরাদ্দকৃত সেই জমিগুলো ব্রিটিশরা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ফলে তখন হাজার হাজার মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার উপর যে নিষ্পেষণ চলছে আজ অবধি বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে। দেশের স্বনামখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় তথাকথিত সেকুলার শিক্ষার এ+ সন্ত্রাসে ভেসে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যখন মাদ্রাসার নৈতিকতা নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত মেধাবীদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না, তখন কাজে লাগানো হচ্ছে অনৈতিক আই। সরাসরি মেধার কাছে না পেরে আগ্রাসী সেকুলার গোষ্ঠী এখানে আশ্রয় নিচ্ছে ভ্রষ্টাচার ও কুটকৌশলের।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাঙলার পাঠশালা’ নামে একটি সংগঠন সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে। সেখানে বক্তৃতা করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যতটা না পরিচিত তার থেকে বেশি লাইমলাইটে এসেছেন একজন বাম নেতা হিসেবে। তিনি বলেন, ‘এ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের প্রথম তিনটি কাজ করতে হবে।
এক. সংবিধান থেকে ইসলামকে সরিয়ে দিতে হবে;
দুই. ধর্মভিত্তিক সকল দল নিষিদ্ধ করতে হবে; এবং
তিন. মাদ্রাসার সংখ্যা হ্রাস করতে হবে’।
এখানে আমরা শুধু তৃতীয় পয়েন্ট তথা মাদ্রাসার সংখ্যা হ্রাস নিয়েই সামান্য একটু আলোচনা করব।
মাদ্রাসার সংখ্যা হ্রাস করার প্রসঙ্গে আকাশ বলেন, স্বাধীনতার সময়ে এ দেশের মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার; কিন্তু বর্তমানে ৬৪ হাজার। প্রতি তিন জনে একজন মাদ্রাসার ছাত্র। সুতরাং মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ‘বাঙলার পাঠশালায়’ কিছুদিন আগে নজরুল ইসলাম নামের এক গবেষক একই বিষয়ে তার গবেষণা উপস্থাপন করেন।
এর আগে, আরেকজন খ্যাতনামা অর্থনীতি আবুল বারাকাত এ বিষয়েই বই লিখেন। আশির দশকে আহমদ ছফা তার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সেক্যুলার গোষ্ঠী তাদের লেখা বা বক্তৃতায় মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। তারা যেসব তথ্য প্রদান করছে, তা কতটা সত্য বা মিথ্যা; সে বিতর্কে এখন যাচ্ছি না। কিন্তু এটা ঠিক যে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে তারা অনেক সফল হয়েছে। ‘কওমী’ ও ‘আলিয়া’ নামে দেশে দুই ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা রয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসাকে তারা ইতোমধ্যে ধ্বংস করে দিতে পেরেছে; বাকি আছে দাফন করার। দীর্ঘ দিন থেকে নানা চক্রান্ত চলছে আলিয়া মাদ্রাসার বিরুদ্ধে; চলছে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতি বছর প্রথম স্থান সহ ভালো ভালো রেজাল্ট করছে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা; সংখ্যায়ও তারা অন্যদের চেয়ে বেশি। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা নানা ভ্রান্ত অজুহাতে তাদের ভর্তি হতে দিচ্ছেন না। শিক্ষকরা নিজেদের দুর্বলতার ভার মাদ্রাসার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীদের বলছেন, তোমারা বাংলায় ও ইংরেজি প্রত্যেক বিষয়ে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে; যদিও ইতোমধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে, বাংলা-ইংরেজি সহ সকল বিষয়ে তারা কলেজ শিক্ষার্থীদের চেয়েও সেরা।
এদিকে, সরকার মাদ্রাসা বোর্ডের জন্যে একটি অমানবিক সিলেবাস প্রণয়ন করল। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একজন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে কলেজে থাকলে দিতে হয় ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষা; অথচ মাদ্রাসায় পড়লে দিতে হয় ১৭০০ নম্বরের পরীক্ষা। চার’শ নম্বরের এক বিশাল বোঝা তাদের বহন করতে হয়। অপরাধ তাদের, তারা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, তাদের অনুদান আসে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত শোয়া দুইশ’ বছর নানাভাবে সরকারের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয় এই আলিয়া মাদ্রাসা। যেখানে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম পরিবর্তন করার দরকার ছিল, তা না করে তারা মাদ্রাসার উপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিল।
যদি মেনে নেয়া হয়, মাদ্রাসার স্বার্থেই তাদের জন্যে এ অমানবিক সিলেবাস করা হয়েছে; তাহলে প্রশ্ন হল, মাদ্রাসার কত ভাগ শিক্ষার্থীর জন্যে তা করা হল? নিশ্চয় ২% এর বেশি না। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা এতই স্বল্প যে, ২% এর বেশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো সম্ভব না। তাহলে কেন ২% এর জন্যে মাদ্রাসার সকল শিক্ষার্থীর উপর এ অমানবিক সিলেবাস চাপিয়ে দেয়া হল? বর্তমান এ অযৌক্তিক সিলেবাস নিয়েও যদি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হয়, তখন কি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সাদরে গ্রহণ করার কোনো সম্ভাবনা আছে?
যেখানে ২০১২ সালে মাদ্রাসা থেকে দাখিল(SSC) পরীক্ষা দিয়েছে ২,৭৫,৯৩০ জন; সেখানে ২০১৪ সালে এসে আলিম(HSC) পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,০৭,৫৫৭ জন। তাহলে, বাকি ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৭৩ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী গেলো কোথায়? নিশ্চয়ই তারা কলেজে চলে গেছে। প্রশ্ন হল, কেন গেছে? কারণ, তারা মাদ্রাসার এত বড় সিলেবাসকে ভয় পায়। তাই মাদ্রাসা ছেড়ে কলেজে চলে গেছে। এভাবে যখন আলিম(HSC) শেষ করে ফাজিল শ্রেণীতে(ডিগ্রী) উঠে, তখন আরো অর্ধেকের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী চলে যায়। কামিল(মাস্টার্স) পর্যন্ত এসে মাদ্রাসায় আর কোনো মৌলিক শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। তবে আরো ভয়ংকর ব্যাপার হল, পাঁচ বছর আগেও মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের যেখানে অভাব হত না; সেখানে এখন ছাত্র/ছাত্রী ভর্তির নানা বিজ্ঞপ্তি দিয়েও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন আশঙ্কাজনক হারে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হ্রাস পাবার পিছনে প্রধান তিনটি কারণ থাকতে পারে-
এক. মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সেক্যুলার শিক্ষার চাপ দিয়ে তাদের সিলেবাস এতই বড় করে দেয়া হয়েছে যে, তারা এখন আর মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করতে চাচ্ছে না।
দুই. পশ্চিমাদের ‘ওয়ার এন্ড টেরর’ প্রকল্প মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, ফলে কেউ আর এখন মাদ্রাসায় পড়তে চায় না।
তিন. সেক্যুলারদের চাপে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রায় সব ধরণের ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার জন্যে আর এসব মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন না। সুতরাং বলা চলে, আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা হ্রাস করার প্রকল্পে সেক্যুলার গোষ্ঠী শতভাগ সফল হয়েছে।