মার্কসের ইতিহাস চিন্তার উপর পাঠচক্রের আলোচনা-১

আত্মপরিচয়ের বয়ান খুঁজতে গিয়ে আমরা ইতিহাস পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমাদের মনে হল, ইতিহাস পাঠের সাথে সাথে ইতিহাসের দর্শন নিয়েও কিছুটা সজাগ থাকা উচিত। সেই লক্ষ্যে মমতাজুর রহমান তরফদার-এর সংকলিত ‘ইতিহাসের দর্শন’ বইটি আমরা হাতে রাখি; যেখানে শুরু করা হয়েছে ইবনে খালদুন দিয়ে, এবং শেষ হয় লেনিনের মাধ্যমে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য একটি অংশ থেকে যায় কার্ল মার্কস-এর ভাগে। সেই অংশটি নিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি চিন্তা পাঠচক্রের আলোচনা করেন মুসতাইন জহির। এরপর ফরহাদ মজহার ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আলাপ করেন। আলোচনাটা দুই অংশ করে  তুলে দেয়া  হল।

মুসতাইন জহির- গত পর্বে খলদুনের আলোচনায় কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলছিলাম। সেখানে আমার নিজের কিছু প্রশ্ন ছিল। কোনো চূড়ান্ত সমালোচনা আকারে সেগুলো উপস্থাপন করেছি, ব্যাপারটা তা না। কিন্তু আমি বলছিলাম কিছু প্রশ্নের জায়গা আমাদের থাকা দরকার। আমরা আমাদের বাস্তবতায় খলদুনকে যখন পড়ছি, তখন ইতিহাস বিষয়ে খলদুন যে কয়েকটা সূত্র প্রস্তাব করছে, তা আমরা কিভাবে দেখব। খলদুন হয়ে পরবর্তীতে ইতিহাসের যে তত্ত্বায়ন ঘটেছে সেটা মমতাজুর রহমান তরফদারের সংকলনে আছে। তিনি মাঝখানে আরও কিছু আলোচনার পরে যেখানে এসে শেষ করেছেন তা মোটা দাগে মার্কসীয় চিন্তা। তাহলে, মার্কসীয় চিন্তায় ইতিহাস এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? বা আমরা কেন মার্কসীয় চিন্তার সাথে ইতিহাসকে বিচার বিশ্লেষণ এবং ইতিহাস সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত আলোচনার জায়গা দেখতে পাই? এ নিয়ে আলোচনা যে বইয়ে আছে তা মার্কস ও এঙ্গেলসের যৌথ লেখা; তারা সেখানে পলিটিকাল ইকোনমির মাধ্যমে ইতিহাস বিচারের একটা পদ্ধতি হাজির করেছেন। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি ইতিহাসের যে কোনো চিন্তায় একটা প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে। এমনকি একটা বিশেষ মতাদর্শিক রাজনীতিরও উত্থান ঘটেছে।

আমরা খলদুনের আলোচনায় দেখেছিলাম, কিভাবে মানুষ একত্রিত হয়ে সমাজ নির্মাণ করে। আর মার্কসের আলোচনায় দেখব, কিভাবে উৎপাদন, ভোগ, বিনিময়, বণ্টন এগুলো মানুষের মধ্যে ক্রমাগত চলতে থাকে। এবং একই সাথে কিভাবে বিভিন্ন প্রথা, আইন, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এগুলো তৈরি হয়। এগুলোকে দেখার ক্ষেত্রে মার্কসীয় পদ্ধতিতে দুটো জিনিসকে মুখ্য করে দেখা। একটা হল, মানুষ সংঘটিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের ভোগ, উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময় ইত্যাদির মধ্যে সম্পর্ক। এবং দ্বিতীয় হল, এ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট সম্পত্তির ধরন বজায় থাকে। সে সুনির্দিষ্ট সম্পত্তির ধরনের উপর নির্ভর করে কিছু সুনির্দিষ্ট শ্রেণির পরিগঠন হয়।

আমরা ‘জর্মন ইডিওলজি’ নামে বইটার কথা বলছি যেখানে এঙ্গেলস এবং মার্কস ইতিহাসের যে একটা বস্তুগত ভিত্তি যে আছে তার দিক থেকে ইতিহাসকে বোঝা, দেখা এবং ব্যাখ্যা করার কথা বলছেন। এই ব্যাখ্যার একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন ছিল, তেমনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত করে অপরাপর শাস্ত্রগুলোকেও নিজস্ব একটা বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাও ছিল। প্রকৃতির যেমন একটা অন্তর্গত সূত্র আছে, নিয়ম মেনে চলে তেমনি ইতিহাসের নিয়মটা অনুধাবন করা বা সে নিয়মটাকে আবিষ্কার করা দরকার এই রকম চিন্তা কাজ করে। তখন ইতিহাসের আমরা একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা পাব। এই যে বিজ্ঞানসম্মত, ইতিহাস, বস্তুতান্ত্রিক এই জিনিসগুলো অনেক ছড়ানো ছিটানো কথা আমি বলছি এগুলো হয়ত সময় পেলে আলোচনা করব। হানা আরেন্ট-এর একটা লেখা থেকে আমি এই পদ্ধতিটা কিভাবে ডেভেলপ করল তা আলোচনা করার চেষ্টা করব।

আমরা মার্কসের চিন্তায় ফিরে যাই। ঐ সময়ে জর্মন দর্শনে ইতিহাস একটা দার্শনিক সমস্যা আকারে ছিল। ইতিহাস-চিন্তা জর্মন দর্শনে এত বিপুল এবং ব্যাপকভাবে উপস্থিত হওয়ার কারণ দার্শনিক হেগেল। হেগেলের চিন্তার সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক অনেক নিবিড়। হেগেলের কাছে এসে দর্শন চিন্তা একটা ঐতিহাসিকতার মধ্যে প্রবেশ করে। অর্থাৎ স্পিরিট/চিন্তাকে তিনি শুধু চিন্তা আকারে দেখলেন না, চিন্তার ঐতিহাসিকতা আকারে হাজির করলেন। চিন্তা কিভাবে বিভিন্ন কালপর্বে মানুষের ইতিহাসের ভিতর দিয়ে নিজেকে বাস্তব করে তোলে। জর্মন চিন্তার জগতে তখন প্রশ্নটা ছিল, চিন্তা ইতিহাসের মধ্যে কি করে নিজেকে বাস্তবায়ন করে। চিন্তা নিজেকে যখন চিন্তা আকারে বিকশিত করে, তখন সে চিন্তার একটা পূর্ণরূপ দেখতে পায়। চিন্তার একটা চলন আছে এবং চলনের মধ্যে এর একটা প্রক্রিয়া আছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা বিকশিত হয়েছে। বিকশিত হয়ে এটার পূর্ণ মাত্রায় উপনীত হয়েছে।

জর্মনীতে তখন যে তর্কটা হচ্ছিল সেটা হল, জর্মন জাতি চিন্তায় বা দর্শনে যে উপলব্ধিতে পৌঁছিয়েছে সে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে কিভাবে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা বা একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায়। তখন ইতিহাসের আলোচনায় মার্কস এবং এঙ্গেলস দেখালেন, হেগেল যেভাবে ইতিহাসকে দেখেছে তার বিপরীতে বস্তুগত ভিত্তির উপর দাড়িয়ে ইতিহাস একটা প্রক্রিয়া আকারে নিজে কিভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। মার্কসীয় চিন্তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হল, ইতিহাসকে বুঝতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের বস্তুগত ভিত্তির দিকে তাকাতে হবে। ইতিহাসের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি হয় মানুষ যখন নিজের প্রাকৃতিক সত্তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে পারছে। কিভাবে পারছে? পারছে কারণ প্রকৃতি আর সকল সত্তা প্রাকৃতিক উপায়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাধ্য। তার অস্তিত্ব রক্ষার শর্ত প্রাকৃতিক ভাবেই নির্ধারিত। কিন্তু মানুষ এমন এক সত্তা যে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। এটা মানুষ যেভাবে করে অন্য সব প্রজাতিও করে। কিন্তু মানুষ নিজে এমন একটা সত্তা যে নিজে শুধুমাত্র প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না। সে প্রকৃতিকে বদলায়। প্রকৃতির মধ্যে যেভাবে জিনিসটা আছে, যে শর্তটা আছে, তাকে সে নিজের মত করে নিজেকে রক্ষা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে। আসলে কথাটা হল কৃষিকাজ করতে পারছে। তার নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে যা খাবে তা নিজে নিশ্চিত করতে পারছে। এ ঘটনা মার্কস-এঙ্গেলসের দিক থেকে হল ইতিহাস তৈরি হওয়ার প্রথম শর্ত। প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এখানে একটা যুগান্তকারী বদল ঘটেছে। মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের আলাদা এই জায়গাটাই হল ইতিহাসের সূচনা বিন্দু, এবং ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যার প্রথম প্রস্তাবনা।

এখানে ইতিহাসকে দেখা হচ্ছে মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক হিসাবে এবং এ সম্পর্কের ক্রমাগত বিকাশ হিসাবে। যখন সে কৃষিকাজ করতে গেছে তখন যে ধরনের সংঘবদ্ধতা; যখন সে শিকার করতে গেছে নিশ্চয় একই ধরনের সংঘবদ্ধতা নয়। কৃষি করতে গিয়ে এই যে সংঘবদ্ধতা সেখানে কৃষি কাজের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আরেক ধরনের দায়িত্ব বণ্টন হয়েছে। কেউ ঘরে থেকেছে, কেউ বাইরে গিয়েছে, কেউ লাঙ্গল ফলিয়েছে। এভাবে আস্তে আস্তে উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের শ্রমবিভাজন ঘটেছে। সে শ্রমবিভাজনগুলোর সাথে কি ধরনের সম্পত্তির ধারনা আস্তে আস্তে বিকশিত হচ্ছে। কিভাবে পরিবার গোত্রের মধ্যে সবাই একত্রিত হয়। এই যে বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে নতুন উপায়গুলো আবিষ্কৃত হয়েছে তার ফলে নতুন ধরনের শ্রমের বিকাশ ঘটেছে। নতুন শ্রম আসার কারণে নতুন শ্রম বিভাজন ঘটেছে এবং একইসাথে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সমাজের বণ্টন সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে, এবং গড়ে উঠেছে বিনিময়ের সম্পর্কটা। একে কেন্দ্র করে সমাজের যেসব  নিয়ম, প্রথা, কাঠামো, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, মোটা দাগে তা-ই মার্কসের ইতিহাস চিন্তার জায়গা। এখানে কেন্দ্রীয় বিষয় হল, কিভাবে মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের সম্পর্কটা সচল থাকে; এবং তার মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী তৈরি হয়। এভাবে আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর সাথে সম্পর্ক এবং সংঘাতের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বের ঘটনাগুলো বিচার করি। আধুনিক যামানায় এসে আমাদের সম্পর্কটা  অর্থনৈতিক সম্পর্ক আকারে বললে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একটা বিশেষ ধরনের সম্পত্তি সম্পর্ক কাজ করে।

হানা আরেন্ড-এর মতে, এ ধরণের চিন্তা আসলে গ্রিক চিন্তার মধ্যেই প্রথিত ছিল। গ্রিক চিন্তা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকমের ছিল। ইতিহাস চিন্তার জনক বলা হয় হেরেডোটাস। গ্রিক জগতে ইতিহাস চিন্তায় প্রকৃতি এবং ইতিহাস আলাদা করে নাই বরং প্রকৃতিকে বোঝার যে পদ্ধতি একই রকম পদ্ধতি ইতিহাসের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হত। গ্রিক চিন্তার মধ্যে কেউ জগত সৃষ্টি করছে এরকম কোন ধারনা ছিল না। এটা নিজেই নিজের কারণ আকারে সামনে আছে এবং এটা এমন একটা সত্তা যা চিরস্থায়ী। মানুষ হল ব্যক্তি হিসেবে ক্ষণস্থায়ী। গ্রিক চিন্তায় সত্তার ধারনা প্রকৃতির ধারনা দ্বারা প্রভাবিত। এরিস্টটলের মতে, স্পেসিস হল প্রকৃতির মধ্যে চক্রাকারে পুনঃপুন ফিরে আসে এমন কিছু। কিন্তু প্রকৃতি সত্তা আকারে বজায় থাকে। প্রকৃতির মধ্যে আর সমস্ত সত্তার যে রকম একটা রূপ আছে মানুষেরও সে রকম রূপ। কিন্তু মানুষের আবার একটা রৈখিক সময়েরও অভিজ্ঞতা আছে। এই চক্রাকারে মানুষ প্রকৃতির মধ্যে প্রতিনিয়ত উপস্থিত থাকে। এইটাই হেরেডোটাস বা গ্রিক চিন্তার মধ্যে ছিল যে মানুষের নিজের যে ডিডস, ওয়ার্ডস এন্ড ইভেন্টস মধ্য দিয়ে থাকতে পারে, যদি এটার যে মহিমা এটার যে গুরুত্ব তা আনায়ন করা যায়। ফলে কবি এবং ঐতিহাসিকদের কাজ ছিল কম বেশি এক রকমের। এটাকে গ্লোরিফাই করা। মানুষ যে তার এক্টের মধ্য দিয়ে জগতে অন্য কিছুর নির্মাণ, স্থাপন, প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তার কোন একটা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এরকম একটা চিরস্থায়িত্ব আনয়ন করতে পারে। এ চিরস্থায়িত্ব যেহেতু প্রকৃতিগত বস্তুর মত না, কোন একটা  কর্মকাণ্ডের মধ্যে সে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে সেটা তো প্রকৃতির মধ্যে আছে, থাকবে।

স্মৃতির যে জায়গাটা আমরা দেখি মনুমেন্টাল করা। মনুমেন্টাল করা ধারনাটার সাথে এটা আছে। একই সাথে এটার যে মেমোরাইজেশন যেটাকে রিমেমবেব্রেন্স বলত। যেটা মানুষের স্মরণের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকত। প্রকৃতি তো তার নিজের কারণ আকারেই উপস্থিত হয়। কিন্তু মানুষ নিজে যদি স্মরণ করে স্মরণটা এই পুনরাবৃত্তির জায়গাটাকে নিশ্চিত করে। এবং এটা তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছিয়ে দেবে। ফলে এই স্মরণের মধ্য দিয়ে তার নিজেকে টিকিয়ে রাখা হাজির রাখার চেষ্টা আসতে পারে। যে কথাটা আমরা বলছি, তাইলে এখানে প্রকৃতির সাথে ইতিহাসের সম্পর্কের জায়গাটা কি এবং পদ্ধতিগত জায়গাটা এক বলছি কেন? কারণ এখানে মানদণ্ড হল প্রকৃতি যা চিরস্থায়ী ফলে যা কিছু স্থায়ী তাই হল গ্রেট তাই হল বিশাল। ঐটা হয়ে উঠাই হল কোন সত্তার অমরত্বের, না হারিয়ে যাওয়ার জায়গায় উন্নীত হতে পারার সম্ভাবনা। এটা একটা দিক দুই নম্বর হল প্রকৃতির মধ্যে এটা যেরকম ফিরে ফিরে আসে পদ্ধতিগত ভাবেও ইতিহাস চর্চার জায়গাটা হবে এটাকে বারংবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা তার এই স্মৃতি চর্চার মধ্যে। আমরা দেখব যে, যেটা আমি খলদুনের আলোচনায় বলছিলাম-- এই যে জৌলুশ এই যে প্রশংসা এই যে মাহাত্ম্য কীর্তন, এগুলো নিয়ে খলদুন যেভাবে আলোচনা করেছেন এটা একটা সময়ে গিয়ে একটা রাজপরিবারে উত্থান-পতনের ক্রমিক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ব্যাপারটা ঠিক তা না। এখানে এই জিনিসগুলোর সাথে ইতিহাস ধারণার একটা সম্পর্ক আছে। অন্তত গ্রিক চিন্তার মধ্যে আছে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জায়গা আছে, একটা হল এই যে গ্রেটনেসটা যেটা মাহাত্ম্য থেকে অমরত্ব অর্জন করে সেটাই টিকে থাকে। ফলে স্থায়ী হওয়া মানে প্রকৃতির মত করে স্থায়ী হওয়া। এই ধারনার একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যখন খ্রিস্টীয় চিন্তাটা গ্রিক চিন্তার সাথে মিশ্রিত হয়। খ্রিস্টীয় চিন্তার মধ্যে এসে প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে সেটা হল, প্রকৃতি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মানুষ থেকে যাবে। এখানে পুরো জিনিসটা কিন্তু রিভার্স হয়ে গেল। ফলে প্রকৃতির এই যে ক্ষণস্থায়ীত্বটা তখন হয়ে গেল প্রধান জায়গা। যেহেতু প্রকৃতিই থাকবে না, ফলে প্রকৃতির মধ্যে আপনি কোন কিছুকে স্থায়ী করে তোলা সেটা তো কোন অর্থ বহন করে না, তাৎপর্যও বহন করে না। এখানে ব্যক্তির যে একটা নতুন ধরনের মানে আসছে এটাও কিন্তু প্রকৃতির সাথে মানুষের নতুন ধরনের সম্পর্ককে প্রস্তাব করে হচ্ছে। একই সাথে তখন প্রশ্ন আসল প্রকৃতিকে বোঝার যে এরিস্টটলিয়ান প্রস্তাবনাটা ছিল এটাও নির্ভর করেছিল এই চিন্তার উপর দাঁড়িয়ে যে প্রকৃতি এমন একটা সত্তা এটা স্থির থাকে তার প্রজাতিগত সত্তার মধ্যে। ফলে এটা প্রতিনিয়ত পুনরাবৃত্ত হয়। যে নিয়মের মধ্য দিয়ে পুনরাবৃত্ত করে এটাকে যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করেন তার ভিতরে অন্তর্গত যে নিয়মটা সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণমুলকভাবে অধ্যয়ন করার মধ্য দিয়ে যে নৈর্বত্তিকতার জ্ঞান অর্জনের প্রস্তাব এরিস্টটলিয়ান মেথড থেকে তৈরি হয়েছে। মিডল এজে ইতিহাস চিন্তার পদ্ধতির মধ্যেও একই ধরনের ধারনা ছিল। ইতিহাস পর্যবেক্ষণের এই জায়গাটা যখন খ্রিস্টীয় চিন্তার জগতে ওরা যেটাকে বলে সেলভেশনের ধারনা নতুন একটা মাত্রা যুক্ত করেছে। ইতিহাসের এরকম কোন পারপাস ছিল না। জগতের নিজের কোন পারপাস নাই। মানুষ যা করে এটাই একমাত্র পারপাসফুল। খ্রিস্টীয় চিন্তার মধ্য থেকে এই যে ইতিহাস চিন্তার মধ্যে উদ্দেশ্যের জায়গা আসছে সেটা হল মুক্তির যে জায়গাটা। সেলভেশনের মধ্যেও কিন্তু একটা চক্র আছে। এটার সূচনা আছে এটার চলনের মধ্য দিয়ে একটা জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। ফলে ইতিহাসকে বিচার করার তখন জায়গা হল এই যে তার সূচনা এবং তার পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে এটা যে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এর যে চলন এটার জায়গা থেকে এটাকে দেখা। এবং সেটা করার জন্য এই যে প্রকৃতিকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় ইতিহাসকেও পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই সূত্রটা প্রাকৃতিক সূত্রের মত এখান থেকে নির্ণয় করা সম্ভব। এর মধ্যে যেহেতু একটা উদ্দেশ্য আছে, একটা সুনির্দিষ্ট যাত্রা আছে। আমরা পরবর্তীতে দেখব এটা কমবেশি খলদুনের মধ্যেও আছে। 

এখন একটা প্রশ্ন সামনে আসছে, তা হল অবজেক্টিভিটির কোশ্চেন। আপনি যখন পর্যবেক্ষণ করেন প্রকৃতির মধ্যে যে নিয়মটা পুনরাবৃত্তি ঘটে সেখান থেকে যে পর্যবেক্ষক তার পর্যবেক্ষক সত্তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে অর্থেই সেটা নৈর্বত্তিক। মানে আপনি নিজের কোন মতামত যুক্ত করছেন না। মতামত যুক্ত না করার এই প্রশ্নটা এর আগের গ্রিক চিন্তায় ঐ অর্থে ছিল না। তাদের কাছে চিন্তা ছিল যা কিছু মানুষের যা কিছু মহিমান্বিত কবি এবং ঐতিহাসিকের কাজ হল তাকে যথাযথভাবে উপস্থিত করা তার গ্লোরিটা নিশ্চিত করা। এর পরে যে ব্যাপারটা আসছে সেটা হল সিলেকশন। আপনি তো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। খলদুন যে আলোচনাটা করছেন বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিকরা এটাকে অতিরঞ্জন করেন; শাসকের চাপে পড়ে করেন এই বিষয়গুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই যে সিলেকশন এটা তো একটা হিউম্যান ইন্টারভেনশন। ফলে এটা আসলে একটা সাবজেকটিভ ইন্টারভেনশন। সাবজেকটিভ ইন্টারভেনশন হলেও পরে যে পদ্ধতি অনুসরণ করছে সে পদ্ধতি কিন্তু প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করার এরিস্টটলিয়ান মেথডটাকে অনুসরণ করেই সে এটাকে প্রস্তাব করে। তৃতীয় ধাপে এসে যে তর্কটা আসল যখন স্পেসের ধারনাটা চলে আসছে এবং গ্যালীলীয়র পরে প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। সেটা হল এর আগে পর্যন্ত গ্রিক চিন্তার মধ্য দুটো জিনিস একটা হল জগত যেহেতু আছে উপস্থিত হয় এবং জগতের উপস্থিতিটাকে বোঝার জন্য ইন্দ্রীয়র মধ্য দিয়ে এটার সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং তার সম্পর্কে আমরা জ্ঞান অর্জন করি। তখন এটা এলোমেলো হয়ে যায়। কারণ আমরা আমাদের এই ইন্দ্রিয় দিয়ে জগতটাকে কখনই বুঝতে পারব না। এটা এরিস্টটলিয়ান মেথডটাকে এলোমেলো করে ফেলে। মানুষ ইন্দ্রিয় দিয়ে তার সামনে জগতকে বোঝার যে পদ্ধতি সেটা দিয়ে সে যদি তার বাইরের জগত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারে এবং এর মধ্যে দেকার্ত প্রস্তাব করেই ফেললেন যে ইন্দ্রিয় উপলব্ধির দ্বারা জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। শুধু তাই নয় আদৌ প্রকৃতি সম্পর্কে শুধু ইন্দ্রিয় না যৌক্তিকভাবেও কোন সুনির্দিষ্ট এবং নিশ্চিত জ্ঞানে পৌঁছানো সম্ভব কিনা সেটাও প্রশ্নবোধক হল এবং অসম্ভব জায়গায় চলে গেল। যেখান থেকে বলা হয় কান্ট এটা থেকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা করলেন। এর আগে পর্যন্ত ধরে নেয়া হয়েছে জগত কি এটা আমরা জানতে পারি যেহেতু এটা আমাদের সামনে আছে। এখন তো এটা মহাজগতের ধারনায় এসে গেছে। ফলে আমি তো কোনভাবে এটা ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারব না। এটা ইন্দ্রিয়ের অতীত একটা বাস্তবতায় মানুষকে নিক্ষেপ করে। আপনি পৃথিবীকে যে অর্থে বুঝতে পারেন বিশ্বজগতকে আসলেই সেই অর্থে ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারবেন না। আপনি ইন্দ্রিয় দিয়ে এটা দেখতেই পান না কখনো। তখন যেটা আসল একমাত্র মানুষ নিজে যা সৃষ্টি করে তাই মানুষ একমাত্র জানতে পারে। কারণ যা সৃষ্টি করে এবং যে প্রক্রিয়ায় করে সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে এটা সম্পর্কে জানতে পারে। ফলে অনুসন্ধানের জায়গাটা কী সে প্রশ্ন থেকে কিভাবে এখানে সরে গেল। এটা যার নামে প্রস্তাব করা হল তার নাম হল ভিকো। তার প্রস্তাব হল যে প্রকৃতিকে আসলে জানা সম্ভব না বরং মানুষ নিজে যা সৃষ্টি করে এটাই মানুষ জানতে পারে আর সেটা হল হিস্ট্রি। পরিবর্তনের জায়গাটা হল এখন ইতিহাস মানে মানুষের এমন ঘটনা এমন কোন দুঃখ, যাতনা এগুলাকে স্মৃতি আকারে মানুষের মধ্যে জিইয়ে রাখার যে চর্চা এটা নয়। বরং মানুষ যা সৃষ্টি করে এবং সৃষ্টি করে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। এই প্রসেসের ধারনাটাও আসছে আবার প্রকৃতি থেকে, কারণ প্রকৃতি নিজেকে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি করে এবং এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয়। যদিও সে প্রক্রিয়াটা কি সেটা আমরা জানি না জানতে পারব না। কিন্তু আমরা মানুষ যা সৃষ্টি করে তা জানতে পারি। মানুষের নিজের সৃষ্টি করার জায়গাটা হল ইতিহাস। যেহেতু মানুষ নিজে তার কর্তা ফলে মানুষ এটা জানতে পারে। এই সময় থেকে ইতিহাসকে প্রক্রিয়া আকারে, মানুষের সৃষ্ট যা কিছু তাকে ইতিহাস বলে জানার দৃষ্টিভঙ্গিটা তৈরি হল। ফলে পদ্ধতিগত জায়গা থেকে এখনো ইতিহাস এবং প্রকৃতি বলে এই যে দ্বিধা এটা কিন্তু বজায় থাকল। একই সাথে প্রকৃতিকে প্রাকৃতিকতার যেই জায়গা সেটাকে প্রক্রিয়া আকারে দেখার জায়গাটা ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে চাচ্ছি। ফলে ইতিহাসকে প্রক্রিয়া আকারে উপলব্ধি করাটা ন্যাচারের সাথে প্রতিতুলনা করে বোঝার চেষ্টা বলে হানা আরেন্ট মনে করেন।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।