“তরুণদেরকে ক্রমাগত দৃশ্যমান হয়ে ওঠতে হবে” (বৃহস্পতিবারে চিন্তার পাঠচক্রের আলোচনা)

কোনো একজনের সমুখে ডান পা গুটিয়ে বসার ধরন দেখে ফরহাদ মজহার নানান ধর্মের সংশ্লিষ্ট স্পিরিট ও দর্শনকে প্রাসঙ্গিক করে তুলে বললে- ডান পা শিবের, বাম পা পার্বতীর। অর্থাৎ পুরুষের ডান পা আর বাম পা নারীর। মানে, নারী যদি পুরুষকে আগলে না রাখে তবে পুরুষ এই জগৎ সংসারকে নষ্ট ও ধ্বংস করে ফেলবে। নারী এখানে অসাধারণ। আসলে শিব ও পার্বতীর এই ঘটনার সিম্বলিক মানে খুবই ইন্টারেস্টিং। অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মে বিষয়টি এরকম না। সেখানে গৌতম বৌদ্ধ ডান পা সামনে দিয়ে বসেন। ব্যাপারটি নারী বিরোধী মনে হবে। যেকারণে বৌদ্ধ ধর্মে নারী ভিু হতে পারে না। কারণ বুদ্ধ মনে করেন- মানুষ পাপী হয়েই জন্ম গ্রহণ করে। যার থেকে মুক্তি লাভ হয় নির্বাণে। খ্রিস্ট ধর্ম মনে করে- মানুষের ধারাবাহিকতা আদি পাপ থেকে। যীশু নিজে সকল পাপ তাঁর ক্রুশবিদ্ধ শরীরে ধারণ করে সেই পাপ থেকে মনুষ্যকূলকে মুক্তি দিলেন। আর ইসলাম মানব জাতির উৎপত্তির এইসব কাহিনী বিশ্বাস করে এবং ইসলাম তার বিশ্বাসের সঙ্গে নূহ, ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা সহ পূর্বের এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে অঙ্গীভূত করে নেয়। কিন্তু মানব জাতির উৎপত্তির এইরকম কোনো পাপের বিষয় ইসলামে নাই। মানুষ মাত্রই পাপ করতে পারে। সেটা অন্য জিনিস। সেজন্য পাপ মোচনের সেরকম ব্যাপার তার নাই। সে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে ঘোষণা দেয়। মানুষই সৃষ্টির সেরা। সে তো পাপী হতে পারে না। অর্থাৎ আদি পাপের ব্যাপার তার মধ্যে নাই। ফলে যে নিজেই আশরাফুল মাখলুকাত- সৃষ্টির সেরা তার পাপ মোচনের প্রশ্নও নাই। এই জিনিসগুলো আরো বিস্তারিতভাবে বুঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আজ এতোটুকু। এইভাবে বৈঠকি ঢঙ্গে কথাবার্তা শুরু হলেও মূলত গত ২৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের একদল তরুণ ছাত্র সমসা¤প্রতিক কালে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় মুক্তি ও জাতীয় স্বার্থের জায়গায় তাদের করনীয় কী হবে- এ বিষয়ে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন। গত তেইশ জুলাই বৃহষ্পতিবারের চিন্তার পাঠচক্রের বিষয় মোটামুটি এমনই ছিলো। নিজেদের পরস্পরের বোঝাপড়ার ও অবস্থান পরিস্কার করার মধ্য দিয়ে তেল-গ্যাস, কৃষি, নদী, টিপাইমুখ, ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ে সহ জাতীয় ইস্যুতে এই মুহূর্তে কী ধরনের অবস্থান নিতে হবে, কী ধরনের প্রক্রিয়ায় গিয়ে আগালে ভালো হয় এবং এগুলো নিয়ে অন্যরা কী ভাবছে, বিষয়গুলো কমিউনিকেট করা, জানা, বোঝা এবং এর মধ্য দিয়ে সকলকে এক জায়গায় আসার অবস্থা তৈরী করা। মুসতাইন জহির মোটামুটি সংপ্তিভাবে আলোচনার বিষয়বস্তু এভাবে তুলে ধরলেন। এর সাথে যুক্ত হলেন খোমেনী ইহসান। তিনি এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইংগিত করে বললেন- আমাদের এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো জনগণের কাছে যাওয়া। এখন একটি সন্ধিণ চলছে, একটা তৈরী হওয়ার অবস্থা চলছে। ফলে এই মুহূর্তটাকে যথার্থভাবে ধরতে হবে। বিগত এক এগারোর শাসনে যা চলছে তা এখনো চলছে। অন্যদিকে গোটা শাসক শ্রেণীর আসলে একই চেহারা। সে মতায় থাকলে আর বিরোধী দলে থাকলে তাতে কিছুই তার যায় আসে না। অবস্থা অনুযায়ী সে শুধু ইস্যুগুলোকে তার মতো করে ব্যবহার করে। মতায় থাকলে যেমন টিপাইমুখের বিপে আর বিরোধী দলে থাকলে পে হয়ে যায়। এই হলো তাদের চেহারা। ফলে তরুণদের এখানে কর্তব্য কী ভাবতে হবে এবং কাজে নামতে হবে। মুসতাইন জহির ও খোমেনী ইহসানের কথা ধরে ফরহাদ মজহার প্রশ্ন তুলে তিনি তার আলোচনার সূত্রপাত ঘটালেন। তিনি বললেন- আসলে পরিচয়টা কিভাবে ঘটবে, কিভাবে ভাবলে বা কি করে আলোচনাকে ফলপ্রসূ করা যায়, আমাদের মনের আকুতিগুলো কিভাবে একত্র করা যায়- জিনিসগুলো মাথায় রেখে আগাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আরেকটা দিক হলো ধর্ম, ভাষা ও পুঁজির দিক থেকে বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে নানানা সংকটের মধ্যে একজন তরুণ হিশেবে আমার ভূমিকা কী- সেটা বুঝতে হবে আগে। এবং এটা করতে হবে অনেকটা ব্যবহারিক দিক থেকে, ম্যাচিউরিটির দিক থেকে। ভেতরের-বাইরের বিভিন্ন সম্পর্ক, আলামতগুলো সত্যিকারভাবে ধরতে জানতে হবে এবং একইভাবে সেগুলোর ফলাফল আঁচ করে পদপেটা কী নিতে হবে সেটা বুঝতে হবে। এই যে ধরুন, এখন আব্দুল কালামের আসাটা। আসলে আব্দুল কালাম তো একটা সিম্বল। যেটা এই মুহূর্তে খুবই প্রাসংগিক। অর্থাৎ জরাবৎ ষরহশ’র দিক থেকে তার প্রতীকী প্রকাশটা ধরতে হবে আপনাকে। উনি ব্যাক্তিগতভাবে খুবই ভালো মানুষ। তার সহজ ও সাধারণ জীবন যাপন অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক হতে পারে। এসব দিক থেকে তার এই সফরের প্রভাবমূল্য ভারত কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু তার ইনোসেন্ট জীবন দেখে আমাদের এখানে উদ্বেলিত হলে চলবে না। এটা আমাদের রাজনৈতিকভাবে কোনো কাজে লাগবে না। তিনি আর যাই হোন আমাদের জাত শত্র“। তার সাথে লড়াইটা জাতিগত নীতির জায়গা থেকে। ভাতে মারার, পানিতে মারার রাজনীতিটা ঠিক এখানেই। এটা আত্ম মর্যাদার লড়াই শুধু নয় জাতীয় মুক্তি ও জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে শেখ হাসিনাকে, আওয়ামীলীগকে কেবল গালাগালী করা যাবে তাতে কোনো কাজের কাজ কিছুই হবে না। তার চেয়ে তো বিএনপি আরো বেশী খারাপ। আসলে কাজটা আপনাকে বুঝে শুনেই করতে হবে। কারণ এটা আওয়ামীলীগ বনাম বিএনপির রাজনীতি না এমনকি ব্যাপারটা তো ভারত বনাম বাংলাদেশও না। আরো অনেক কিছু। সারাবিশ্বে এখন তারা পানিকে ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানী করার কাজ সম্পন্ন করে চলছে। নদীকে ব্যক্তি মালিকানাধীন করে ফেলতেছে। পানি অসম্ভব মূল্যবান। প্রাণ-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের দিক থেকে পানি যে কতো মূল্যবান সেটা আর কি বলবো। মিষ্টি পানির দাম- তেলের, দুধের, সোনার এবং মদের চেয়েও অনেক মূল্যবান। এতো মিষ্টি পানি এই বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নাই। তাহলে আমাদের তো গরিব থাকার কথা না। ফলে এই মহামূল্যবান জিনিসের দিকে চোখ পড়ে গেছে। এখন তাহলে আমাদের কী করতে হবে। কিভাবে সফল হবো- উপায় কী, কর্মকৌশলটা কী? এগারো জানুয়ারী এদেশের ইতিহাসে এক বিশাল ত। ঠিক পলাশীর মতো এর প্রভাব। এই ঘটনা প্রায় দুশো বছর পিছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথটা খুবই ুদ্র, সংকীর্ণ। গত নির্বাচন এই তকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। এগারো জানুয়ারীর ঘটনার প্রভাবকে আরো বাড়িয়ে দিলো এই নির্বাচন। সমাজ এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। ক্রমাগত বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সমাজ। টিপাইমুখ ইস্যু যে জাতীয় ইস্যু সেখানে পুরো বাংলাদেশ এক। এখানে জনগণের সংবেদনা ও আকুতির জায়গাটা এক হয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি তথ্য-উপাত্তের বিষয় বানিয়ে ব্যাপারটাকে আরো সংকটময় করে তুলছে। এটা তো তথ্য-উপাত্তের বিষয় না। জনমনে এটা খুবই পরিষ্কার। ফারাক্কার কথা তো গণমানুষ ভুলে যায় নাই। তবু তথ্য উপাত্ত। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কী হবে। সরকারের তরফে দ্বি-পয়ি সালিশ হবে। এরপর চুক্তি হবে। তাতে কী হবে। বিএনপিও এটাকে সমর্থন করবে। তাহলে কী হলো। আর এই সমর্থনের সংগে যুক্ত থাকবে- এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ। পেছনেও থাকবে তারা। ফারাক্কা তো একই পথে গিয়েছিলো। জনগণের তো সেই অভিজ্ঞতা আছে। ফলে বিমূর্তভাবে তরুণদের কোনো কিছু করলে হবে না। নীতিগতভাবে আসতে হবে- আমরা এরকম, এটা করতে চাই, এইভাবে করতে চাই ইত্যাদি দিকগুলো পরিষ্কার করে আসতে হবে। এই মুহূর্তের তাৎণিক কর্তব্য কী- এটা সনাক্ত করতে হবে। সে দিক থেকে সামাজিক আন্দোলন আকারে গণসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে সমাজের ভেতরে হাজির হতে হবে। দেশকে, সকলকে বড় কাজের দিকে নিয়ে যাবার জন্য ধীরে ধীরে সকলের মধ্যে প্রবেশ করা চাই। একই সঙ্গে আসলে আমাদের কাজটা কী, কর্তব্যটা কী- এটাকে বারবার বুঝতে থাকা। সেজন্য বেশী সিদ্ধান্ত আপানাদেরকেই নিতে হবে। আর ক্রমাগত সমাজে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে হবে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা অনেকেই মেনে নিবে না। কারণ এখানে তো ইতোমধ্যে ভারত দ্বন্দ্বটা আদত হয়ে গেছে। চাইলেই দালালী বলে বা গালাগালী করে এর সমাধান করা যাবে না। এখন অনেক সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে মানুষকে একত্র করার। একটা অবস্থা বিরাজ করতেছে এই সময়ে এই সমাজে। একটা নির্ধারিত সময় পার হলে এই সুযোগ আর হয়তো পাওয়া যাবে না। ফলে সময়ের জ্ঞান ও অবস্থার সংবেদনা আমাদের মধ্যে থাকাটা অসম্ভব জরুরী। কারণ এখানে, গণমানুষের মধ্যে তো সাহস আছে, আকুতি আছে, তার বেদনা আছে সেটাকে তো আপনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আপনাকে এক জায়গায় একত্র করে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। সেই সাধনা, প্রেম, সাহস আর যন্ত্রণা তো আপনার থাকাটা অপরিহার্য। যেটা মূলত সেমিনার, বৈঠক আর গোল টেবিল করে হয় না। তার জন্য মাঠে নামতে হয়। জনগণের হৃদয়ের ভেতরে ঢুকতে হয়। এরপরই সকলকে একটা জায়গায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া তৈরী হয়। এইভাবেই ছাত্র, যুবক, পেশাজীবি, শিক ও নানান শ্রেণী পেশার মানুষের উপস্থিতিতে চিন্তার পাঠচক্র সন্ধ্যার পরপরই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। মুক্ত আলোচনার এই পাঠচক্র শ্যামলীর শিশু মেলার বরাবর বিপরীত গলিতে উবিনীগ কার্যালয়ে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। ২৩. ০৭. ’০৯


নিজের সম্পর্কে লেখক

student



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।