মেইনেক, ইতিহাস ও সংকটের সম্পর্ক বিষয়ক পাঠচক্রের আলোচনা

চিন্তা পাঠচক্রের ধারাবাহিক ইতিহাস দর্শনের আলোচনায় গত ১২ ফেব্রুয়ারির বিষয় ছিল মেইনেকের ইতিহাস চিন্তা। জোবায়ের আল মাহমুদ পাঠচক্র শুরু করেন।

জোবায়ের আল মাহমুদ-  ইতিহাস আলোচনায় ইবনে খলদুন সবসময় কারণ-ফলাফল ভিত্তিতে আলোচনা সামনে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আজ আমরা যাকে নিয়ে আলোচনা করছি, তিনি হচ্ছেন মেইনেক। তিনি একটু ভিন্নভাবে ইতিহাসকে দেখলেন। তিনি বলছেন, যে কোন একটা ইতিহাসকে যখন কারণ দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন তার মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। তিনি তিনটা ভাগে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দেখিয়েছেন। প্রথম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কারণ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে, ইতিহাসকে একটা ইউনিভার্সাল ইতিহাস আকারে দেখার চেষ্টা থাকে। আমরা যদি একটু খুলে বলি, শেখ মুজিবের শাসনামলে তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে যে অবস্থা ছিল এখনকার অবস্থা প্রায় একই। কিন্তু এখন যদি কেউ বলে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার পরিণতি একই, তাহলে সে মারাত্মক ভুল করবে। কারণ ইতিহাস সবসময় একই কারণে একই পরিণতের দিকে গড়ায় না। মেইনেক বলছেন, পৃথিবীতে এমন কখনোই ঘটে নাই। পৃথিবীতে প্রতিটা ইতিহাস তার স্থান, কাল, সময় অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে রূপ নিয়েছে। সুতরাং, কজ এবং ইফেক্ট দিয়ে যদি আমরা কখনো ইতিহাস বিচার করতে যাই, এ ধরনের অনেক সমস্যা সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয় হল, ইতিহাসকে যখন কজ এবং ইফেক্ট –এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাণী করি, এতে ইতিহাসকে অগ্রিম একটা হাইপো থিসিস আকারে কল্পনা করা হয়ে থাকে। এই এই ঘটনা অতীতে ঘটছে, তার এই এই ফল হয়েছে। সুতরাং নতুন কোনো ইতিহাস সংরক্ষণের সময় অনেক কিছুই তার চোখ এড়িয়ে যায়। মেইনেক তৃতীয় যে সমস্যা দেখালেন তা হচ্ছে- কজ এবং ইফেক্ট দিয়ে যখন আমরা ব্যাখ্যা করব তখন মানুষের মূল্যবোধ, আবেগ, চেতনা ইত্যাদির মত অসংখ্য উপাদান মিসিং হয়ে যায়। 

মেইনেক যে খলদুনের বিপরীতে এগুলো বলছেন তা না, তিনি শুধু বলছেন যারা কজ এবং ইফেক্ট দিয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে যায়, তাদের সীমাবদ্ধতার কথা। আমাদের মনে রাখা দরকার, খলদুন শুধু কজ এবং ইফেক্ট দিয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন নি। খলদুন ইতিহাস গড়ে উঠার পিছনে যে অনেকগুলো কারণ আছে সেগুলো দেখিয়েছেন।

মেইনেক বলছেন, যখন একজন মানুষ ইতিহাস নামক কিছু আমাদের সামনে হাজির করতে চায়, তখন সে প্রথমে ইতিহাসের বিভিন্ন মাল-মসলা সংগ্রহ করতে যায়, সেটা করতে গিয়ে একটা মূল্যবোধ তার মধ্যে কাজ করে। সেটা নৈতিক কি অনৈতিক, তা বলছি না। সে যেভাবে গড়ে উঠেছে একটা সোসাইটির মধ্যে দিয়ে, সে সোসাইটির অনেকগুলো ভ্যালু তার মধ্যে কাজ করে। এতে করে সে যখন ইতিহাসের মাল-মসলা সংগ্রহ করতে যায় তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তার চোখে পড়ে না। শুধু তার মূল্যবোধকে আঘাত করে অথবা তার মূল্যবোধের পক্ষে যায় এ ধরনের উপাদান গুলোই তার নজরে আসে। পরবর্তীতে সে এগুলোকে নিয়ে এসে ইতিহাসকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য বসে তখন সে যে উপাদানগুলো নিয়ে আসছে এগুলোকে আর ছাড়তে পারে না। মেইনেক বলছেন ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে যিনি ইতিহাস রচনা করছেন তাকে এবং তার পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো আমলে নিয়ে বিচার করলে তখন মোটামুটি একটা সুবিবেচনা হবে নচেৎ শুধুমাত্র কজ এবং ইফেক্ট দিয়ে, রাজ-রাজড়াদের ঘটনা দিয়ে ইতিহাস রচনা করি তাহলে সে ইতিহাস আমাদেরকে অনেক ধোঁকা দিবে।

মুসতাইন জহির- আমরা ইতিহাস নিয়ে অনেক আলোচনা করছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে এটাও তো একসময় ইতিহাস হিসেবে কেউ না কেউ বুঝতে চেষ্টা করবে। আমরা এখন ইতিহাসের যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেটাকে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ বলা যায়। সন্ধিক্ষণ মানে যেটা কোন কিছুর শুরু বা শেষ নয়; কিন্তু তার মধ্যে এমন একটা জায়গা যেখানে একটা সংকট বা একটা অনিশ্চয়তা থাকে। এই সন্ধিক্ষণের মধ্যে আপনারা আছেন বলে কি মনে হয়? ইতিহাসের দিক থেকে সংকট বা সন্ধিক্ষণ কথাটার একটি গুরুত্ব আছে। এই জিনিসটাকে বোঝা-পড়ার চেষ্টাই আমরা এখন করছি।

আমরা বলছিলাম আমাদের অনেকগুলা প্রশ্ন আছে। অন্তত বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা অনেকগুলা প্রশ্নের মুখোমুখি। আমাদেরকে অনেকগুলা সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তার একটা হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট। সাংস্কৃতিক-আর্থ-সামাজিক বিভাজন আজ আমাদের একটা মহা সংকটের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এখান থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে? তার জন্যে আমাদের একটা বোঝা-পড়া করা দরকার, একটা হিস্টরিকাল রিভিউ দরকার।

ইতিহাস বলতে আমরা ধরে নেই সাধারণত আমাদের পূর্ববর্তী যে সময়টা। বর্তমানে যে সংকট বিদ্যমান আছে, তার সমাধান আমরা অতীতে খুঁজি। ইতিহাসে সংকটের কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধান করি। এভাবে কারণ অনুসন্ধানের একটা ধারনা ইতিহাস চিন্তার মধ্যে আছে। তা ইবনে খলদুনের মধ্যেও কম বেশি আছে আমরা বলতে পারি। খলদুন কোথা থেকে শুরু করেছে তা আমরা কম বেশি আলোচনা করেছি।

ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আমরা সময়ের একটা ধারনার কথা বলেছি। সময়ের মধ্যে একটা বিভাজন আছে। আগে, পরে, বর্তমান এই তিনটা ভাগ। সময়ের দুইটা চলনের কথা আমরা বলছি, একটা রৈখিক আরেকটা চক্রাকার।

রৈখিক ধারনা ক্রমাগত অগ্রসরমান, কোন কিছু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার মানে প্রগতি হচ্ছে। পরিবর্তন প্রকৃতির মধ্যেও ঘটে, তারপরেও প্রকৃতি একই রকম থাকে। কিন্তু হিস্ট্রি একই রকম থাকে না। ইতিহাসের পরিবর্তনের মধ্যে একটা প্রগ্রেসিভ ধারনা আছে। প্রগ্রেসিভের মধ্যে ডেভেলপমেন্টের ধারনা আছে। ইন্ডিয়াতে যেটাকে বলে বিকাশ। এই বিকাশকে একই সাথে অগ্রগতি বলা হয়।

প্রকৃতির মধ্যে ক্রাইসিসের কোন ধারনা নাই। হিস্ট্রির মধ্যে ক্রাইসিসের ধারনা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও ক্রান্তিকাল শব্দটা আছে। সংবিধানের আর্টিকেল ১৫০-এ ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি  নামে একটা বিধান আছে। যখন সংবিধানকে স্থগিত করে শাসনকার্যভার অন্য কেউ গ্রহণ করে বা করেছিল, তারা তখন বলে এটা ক্রান্তিকালীন সময়। ক্রান্তি,  সংক্রান্তি, এই শব্দগুলোর মধ্যে দিয়ে আমার শুধু আমাদের ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের অপেক্ষা করি না; আমরা একই সাথে আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেও বুঝি। এবং  এটা সম্পর্কে আমরা এন্টিসিপেট করি।

আমি বললাম প্রকৃতির মধ্যে সংকট নাই, সংকট ইতিহাসের মধ্যে। ইতিহাস ক্রমাগত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সময়ের এই ধারাবাহিকতার মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনের চিহ্ন-বিন্দু গুলো তাহলে কি? এটা হল সংকটের সময়। এটা দিয়েই বোঝা যায় আগের এবং পরের মধ্যে কি পরিবর্তন ঘটেছে।হিস্ট্রির সাথে সময়ের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে। ইতিহাসের মধ্যে সময় কিন্তু একটা অনন্ত  ও শাশ্বত ধারাবাহিকতা নয়। ইতিহাস নতুন সময়ের জন্ম দেয়। ঐতিহাসিক সময় টেম্পোরাল; এর সূচনা, স্থায়িত্ব ও সমাপ্তি আছে, তা নির্ধারণ করা যায়। টাইমের ট্রানসেনডেনটাল ধারনা, যা স্থান ও পাত্রকে ছাপিয়ে  বহাল থাকে এটা তা থেকে আলাদা। ট্রানসেনডেনটাল সময়ের ধারনা শাশ্বত এবং বহমান। কিন্তু আমরা যে ঐতিহাসিক সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ইতিহাসের মধ্য থেকেই একেকটা নতুন সময়ের সৃষ্টি হতে পারে এই ধারণাটি কালিক এবং স্থানিক সার্বজনীনতার প্রশ্নটিই পাল্টে দেয়। বলা যায় দার্শনিক শক্ত ভিত্তিটি নির্মিত হয় হেগেল এর হাত ধরে। সবকালে সব যুগে কোন কিছু প্রযোজ্য হওয়া থেকে আলাদা করে  ইতিহাসের একটা সময়ে সব মানুষের জন্য অর্থাৎ সাকলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার ধারণাকেই ইউনিভারসাল বা সার্বজনীনতা বলে হেগেল সংজ্ঞায়িত করে। যারা বুদ্ধিমান তারা বুঝবেন, মানুষের সার্বজনীনতার এই ধারণার পিছনে, খ্রিস্ট ধর্মের অবদানটা কি। তার সঙ্গে ইসলামের যোগাযোগ কতটা কিভাবে ঘটেছে সেইদিকে আমরা এখন যাবনা।    

তো, সময়ের এই ধারণার মধ্যে একটা প্রগ্রেসিভ এলিমেন্ট এবং একইসাথে মুক্তির ধারনা আছে। সেলভেশনের ধারনাটা এসেছে দুটো ধারনা থেকে। একটা তো খ্রিস্টানিটির সেলভেশন। সময় ধারনার মধ্যে আরেকটা ধারনা আছে, তা হল বিশ্বজগত সমাপ্তির ধারনা। এটা মূলত আব্রাহামিক ধর্মগুলোর ধারনা; যেমন লাস্ট জাজমেন্ট, আখেরাত। আখেরাত বা বিচার দিনকে মনে করা হয় সময়ের শেষ বিন্দু। তারপর আরেকটা সময় শুরু হবে।

যদি প্রশ্ন করা হয় গ্রীক দর্শন চিন্তার একেবারে প্রাথমিক অনুমানটা কি? তাহলে বলা যায়, যা উপস্থিত এবং সামনে স্থিত হয়ে আছে, সেই প্রকৃতি হল এমন জিনিস যে নিজেই নিজের কারণ। নিজেই নিজের কারণ হলে তাকে বলা হয় সেলফ কজিং বিং। প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তার এই জায়গাগুলো কম বেশি সমস্ত চিন্তার মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। এগুলো গভীরভাবে দার্শনিক। একারণে দেখবেন যে  থিওলজি মাত্রই জগত সৃষ্টির কারণ, যিনি ঈশ্বর তাকে আবার নিজেই নিজের কারণ হিসাবে ধার্য করছে।

এরিস্টটলিয়ান মেটাফিজিক্স ব্যবহার করে এই ঐতিহ্য গড়ে উঠে। ধর্মতত্ত্ব বিশেষত খ্রিস্ট, জুদাইজম এবং ইসলামী  ধর্মতত্ত্বের মধ্যে এরিস্টটলিয়ান মেথডটা অনেকে ব্যবহার করেছেন এবং এর দ্বারাই তাদের প্রধান চর্চা গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে ইন্টারনাল ডিভিশন ছিল, ডিফারেন্স ছিল, ডিবেট ছিল।

গ্রিক চিন্তা তো খ্রিস্ট ধর্ম আসার পরে একই রকম থেকে যায় নাই। খৃস্ট ধর্মের মধ্য দিয়ে গ্রিক চিন্তা বদলে গেল। কিন্তু কি কি পরিবর্তন হয়েছে? খৃস্ট ধর্ম কেনো এই গ্রিক চিন্তার পাটাতনকে গ্রহণ করতে হল? ইসলাম আসছে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। গ্রিক ফিলোসফি তারও এক হাজার বছর আগের। এক হাজার বছর আগের পুরো ঐতিহ্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ইসলাম। এদিকে খৃস্ট ধর্ম ছয়শ বছর প্রায় অতিক্রম করে ফেলছে। এই চিন্তার সামনে দাঁড়িয়ে ইসলাম যখন নতুন আরেকটা চিন্তা করতে গেছে, তাকে তখন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছু পদ্ধতি এবং প্রকরণ অনুসরণ করতে হয়েছে।

চিন্তার একটা ব্যাকরণ আছে, তার মধ্যে ভিন্নতা আছে, ভিন্ন প্রস্তাবনা আছে, প্রকরণের দিক থেকে ভিন্নতা আছে। কারণ প্রশ্ন এবং অনুমানের কারণে চিন্তা পালটে যায়। আমরা দেখব যে ইসলামও একইভাবে গ্রিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ভাল কি মন্দ, সেই বিচার থেকে বলছিনা। ইসলামের সূচনা পর্বে যতটা গ্রিক চিন্তার কাছে যাওয়া, এটাকে বুঝতে চাওয়া, অনুবাদ করা; আমরা সেইরকম প্রচুর খ্রিস্টিয়ান থিওলজিকাল জিনিস অনুবাদ হচ্ছে দেখি কি? তার সামনে তো খ্রিস্টান থিওলজিকাল চিন্তাও ছিল; এটা তো প্রধান আকর্ষণের জায়গা ছিল না। প্রধান আগ্রহের জায়গা ছিল গ্রিক চিন্তার অনুবাদ করা। কেন এরিস্টটল, প্লেটো আমাদের অনুবাদ করতে হল? মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু কলোনির যুগ নয়, চাপিয়ে দেয়া বা পরাজিত সমাজের বিদ্যা চর্চা নয়।

কোনো নবী কি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে কোনো কিছু প্রমাণ করেছে? বা জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছে? জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির অনুসরণ তো গ্রিক চিন্তার আদি এবং সহি বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যটা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কেন করেছে? কারণ নবীর পরে তো আর কোন ডিভাইন অথরিটি নাই। তাই যখন ডিভাইন অথরিটি নাই, তখন ফিকাহ, তাফসীর এগুলোর জন্য একটা মেথডলজি ডেভেলপ করতে হয়েছে। এটাই গ্রিক চিন্তার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠার জায়গা।

আমার এ কথাটা বলার উদ্দেশ্য হল এই বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা করা। আবার একই সাথে পদ্ধতিগতভাবে এটা কিভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা বলা। ইসলামের চিন্তার মধ্যে সময়ের ধারনা এরকম প্রগ্রেসিভ কিংবা এরকম সেলভেশনের চিন্তাটা নাই। এ কথাটা কেন বলছি? এর একটা তাৎপর্য আছে। এটা যে গুরুতরভাবে আলাদা জিনিস তা বুঝলে পরে আধুনিকতার মর্ম আমরা বুঝতে পারব। আধুনিকতা মাত্রই গ্রিকো-রোমান-খ্রিস্টীয় ডেভলপমেন্ট। এর সাথে যদি ইসলামের চিন্তাটা আমরা বুঝতে চেষ্টা করি এবং কোনো ভিন্নতা দেখতে পাই, সেই ভিন্নতাটার কি সম্ভাবনা আছে যেটা নতুন ধরনের একটা চিন্তা, একটা সভ্যতা, একটা সমাজ নির্মাণের প্রস্তাবনা হতে পারে। গ্রিক জগতকে অতিক্রম করে যাওয়া যাচ্ছে না কেন? আধুনিকতাকে অতিক্রম করতে চান? পশ্চিমা সভ্যতাকে পরাজিত করতে চান-ইন্টেলেকচুয়ালি? যদি চান তাহলে আপনাকে আসলে গ্রিক দর্শনেরই মোকাবিলা করতে হবে। খ্রিস্টীয় এবং গ্রিক চিন্তার সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আমরা যে সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি, এটা তো এই চিন্তারই অবদান। এটা আধুনিকতা নামে হাজির হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলা সমস্যা ও সংকট দেখতে পাচ্ছি। যেখান থেকে আমরা ক্রাইসিসের কথাটা আলোচনা করেছি। এই ক্রাইসিস্টাকে যদি আমরা ইসলামী চিন্তার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে চাই, সমাধানের কোনো নতুন প্রস্তাবনা পাব কি? এটাই আজকের আলোচ্য বিষয়।

আমার আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল আপনাদেরকে একটা ধারনা পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আমাদের দৈনন্দিন যে সমস্যা তা আধুনিক ধারনার সাথে সম্পৃক্ত। সংক্রান্তি বা সংকট বলতে ভারতীয় চিন্তা বা দর্শনে যা কিছুই বুঝি না কেন, আমরা আধুনিক চিন্তা দ্বারাই আসলে বুঝতে চাই। আবার আধুনিক চিন্তা বলতে এমন কোন চিন্তা নাই যা খ্রিস্টীয় এবং গ্রিক চিন্তার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয় নাই। এই যে এক একটা থিওলজিকাল ডেভেলপমেন্টের মোমেন্ট ছিল, ঐখান থেকেই আমরা আজ সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডের কথা বলছি। এই চিন্তার জায়গাটায় আসার জন্য আমি এত কথা বলছি।

অতীত বলতে কোনো একটা স্থির নির্দিষ্ট কিছু নাই। অতীত নামে যা কিছুকে চিহ্নিত করেন সেটা তো চিহ্নিত করেন বর্তমানে; এবং এই বর্তমান বলতে একটা সংকটকালীন বর্তমানে। যে সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার আগের সময়টাকে অতীত আকারে আমরা পাঠ করি। ফলে এটা তার পাঠ করার জন্য যে ক্রাইটেরিয়া তা নির্ধারণ করে দেয় । এবং অতীত তো আসলে সবসময় নতুন হয়ে যায়। আমরা তো জানি না এরপরে অতীতটা কেমন হবে। শুধু তাই না, এটা একই সাথে ঐতিহাসিক। এই যে ধারনার পরিবর্তন ঘটেছে এটাই হল ইতিহাসের আধুনিক চিন্তা।

আমরা আজ অনাগত সময়ের কথা বললাম, অপেক্ষার কথা বললাম, প্রফেটিক যে জগত ছিল সেখানে কি হত? সেখানে সাধারণ সময়ের চেয়ে আলাদা সময় হচ্ছে যখন নবী আসছেন বা আসবেন। তাহলে সময়ের পরিবর্তনের চূড়ান্ত লক্ষণ বিন্দুটা হল নবীর মুহূর্তটা। এখানে হিস্ট্রি চিন্তাটা কি? একটা প্রফেটিক প্যারাডাইম আছে এখানে। নবুয়তের পরিমণ্ডলের মধ্যে মানুষ সময়কে বুঝছে, এর পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে যাচাই করছে। কিন্তু এখন কি আপনি নবীর জন্য অপেক্ষা করেন? আপনি পরিবর্তন হওয়ায় সম্ভাবনা, পরিবর্তনের বাস্তবতা ইতিহাসের মধ্যে তার কার্যকরণের মধ্যে অনুসন্ধান করেন। ইতিহাসকে প্রেডিক্ট করেন। তাই না?

আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে দুইটা জিনিস করা সম্ভব। এতক্ষণ কথা বলার উদ্দেশ্য হল দুইটা। এত বোঝা-পড়া, এত চিন্তা পরিশ্রম কসরত এগুলার এক অর্থে কোন দরকার নাই। বরং সময়ের অপচয়। কারণ আমরা কম বেশি জানি এখনকার বাংলাদেশে চোখে দেখা সমস্যাগুলো কি। এবং এটার পরিবর্তন দরকার। এভাবে চলতে পারে না, এটা বদলাতে হবে। কিন্তু আমাদের পাইয়ে বসছে একটা ভূতে। আমরা অপেক্ষা করছি কেউ এসে আমাদের উদ্ধার করবে, সেই পথ চেয়ে। আমরা কোন এক উদ্ধারকর্তার, ত্রাণ কর্তার অপেক্ষায় আছি; যেরকম আগেরকালে মানুষের অভ্যাস ছিল। তখন ইতিহাস চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গিটায় এটা ছিল যে, তখনই কিছু হবে যখন নবী আসবে। এসে আমাদেরকে উদ্ধার করে যাবেন। আমারা আসলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখানেও যারা আছি, তারা ভাবতেছি কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করবে। বিএনপি পারলো না, তাহলে অন্য কেউ আসবে। এভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে পারেন, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা নিজেদেরকে ইতিহাসের কর্তা মনে করি, আমরাই ঠিক করব আমরা কারা কি চাই।

আপনারা যারা ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় আছেন, তারা পরবর্তীতে যারা আসবেন তাদের অধীনস্থই থাকবেন। ইতিহাস তাই ছিল। যদি আপনি সেটা না চান, আপনি যদি মনে করেন জগতের মধ্যে এই পরিবর্তনটা ঘটেছে এবং আপনি সেটা উপলব্ধি করেন অথবা মনে করেন আপনি একজন কর্তাসত্তা, এখনকার সময়টা কি আপনি চান, আপনার শাসন ব্যবস্থা, আপনার রাষ্ট্র, সমাজ কেমন করে গড়তে চান এই প্রস্তাবনা আপনাকেই করতে হবে এবং আপনাকেই নামতে হবে। দশজনের সাথে মিলে সামষ্টিক শক্তি দ্বারা সেটা আদায় করতে হবে। এটা যদি না করেন তাইলে আপনারা এরকম নবুয়তি অপেক্ষায় দিন গুজরান করতে পারেন। এটাতে আদৌ কোন ফায়দা আসবে না। কারণ শ’য়ে শ’য়ে বছর কাটিয়ে যারা নবীর অপেক্ষায় ছিল তারপরে কখনো আসছে কখনো আসে নাই। যদিও ঘটনা তা না। মানুষ ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ করেছে। মানুষের বিদ্রোহ-বিক্ষোভের মধ্যেই আসলে নবীদেরও আগমন ঘটেছে। কথাটা একটু ঘুরায়ে বললাম। কোন সমস্যা নাই, কোন কিছু নাই, হঠাৎ করে নবী আসছে এরকম কোন নবীর ঘটনা পাবেন না। সবকিছু ঠিক আছে আল্লাহ একজন নবী পাঠিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ কেবল সংকটকালীন সময়েই শুধু নবী পাঠান!

তাহলে সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ালেই তো আমরা চিন্তা করি যে এটা সমাধান করা দরকার। সমাধানের জন্য কেউ আসবে চিন্তাটাও সমাধান চিন্তারই অংশ। আমাদের ‘সুশীল সমাজ’ নামক একটা যে সম্প্রদায় আছেন তারা কিন্তু বসে নাই, তারা তাদের মত সক্রিয়। তারা সংলাপের কথা বলছে, চাপ প্রয়োগ করছে, জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরির কথা বলছে, বলছে একটা সামাজিক চুক্তি দরকার। এ জাতিকে রক্ষা করার উপায় হতে পারে নিজেদের মধ্যে সেন্সটা ফিরাই নিয়ে আসা। তার উদ্দেশ্য হবে পরস্পরের সাথে বসবাস করার, সৌহার্দ এবং সহাবস্থানের জায়গা তৈরি করার যেটা হতে পারে ন্যাশনাল ইউনিটি। একটা ন্যাশনাল ইউনিটির জন্য একটা ন্যাশনাল কনসেনসাস দরকার, সেই কনসেনসাসটাই বলছে যে সামাজিক চুক্তি। এ কাজটা করতে হলে আমার আপনার সবারইতো সেখানে অংশগ্রহণ করতে হবে। সুশীল সমাজের নেতৃত্বে করবেন কিনা সেটা আমি বলছি না, বিএনপির নেতৃত্বে করবেন কিনা বলছি না, আওয়ামী লীগের পক্ষে গিয়ে করবেন কিনা বলছি না। কিন্তু কিভাবে করবেন সেই চিন্তাটা এখন করা দরকার।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।