মার্কস চিন্তার সহি তাফসির : একটি প্রাতিস্বিক গ্রন্থ প্রসঙ্গে

সৈয়দ মবনু’র ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ বইটি পড়ে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। বইটি যে আমার চিন্তার স্বাভাবিক উপলব্ধিকে হঠাৎ করে আঘাত করবে তা অবশ্য জানা ছিল না। আঘাতের গতি এতই প্রখর ছিল যে মার্কসীয় চিন্তাসম্বন্ধীয় নানা বিষয়াদি আমাকে নতুন করে ভাবতে হয়েছে। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ বইটির বিষয়কে যদি সামনে রাখি, তবে বলতে হয় এর বিষয়সম্বনীয় ধারণাকে খুব অল্প সংখ্যক পাঠকই তার ন্যূনতম চিন্তার উপলব্ধিময়ী চেতনায় ধারণ করতে পেরেছে। আর এ বিষয়টি-ই হয়ত এ বইয়ের প্রধান গুরুত্ব বহন করছে। বাঙালি বিশিষ্ট চিন্তক আহমদ ছফা বলেছিলেন- ‘কোন কোন মানুষ্য সমাজে এমন সময়ও আসে  যখন তথাকথিত মননশীলদের ক্লান্ত মস্তকে গুরুপাক সারবান কোন বস্তু হজম হতে চায় না। চুটকি এবং ধরতাই বুলিতেই তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দুই-ই নিবৃত্ত হয়’(বাঙালি মুসলমানের মন)। একজন ছফার কথার সূত্রে বলতে গেলে মননশীল উপলব্ধিহীনতার প্রভাব শুধু স্বীকার করাই নয়, বরং হীনমন্যতায় মননশীলদের মধ্যে যে অজ্ঞতার বীজ বপন করে তার অবস্থান আজ বেশ একটা পাকাপোক্ত। তবে ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ গ্রন্থটি সমকালীন মননশীলদের জ্ঞানলুপ্ত স্নায়ুতন্ত্রের ওপর যে প্রভাব সৃষ্টি করেছে তা স্বীকার করার অপেক্ষা রাখে না। একারণেই সৈয়দ মবনু’র লেখা শিল্প সংস্কৃতি ও তাত্ত্বিক উৎস-সন্ধানী রচনাগুলো লোলচর্ম প্রগতিবাদী থেকে গোড়াবাদী পাঠকের কলুষ স্পর্শ না করে গভীর উপলব্ধিময়ী শুভ্রতার আপন গতিময়তাকে রক্ষা করতে পেরেছে অনেকাংশে। বিশ্লেষিত করেছে মার্ক্সের ব্যক্তিমনসের অন্তর্গত আবেগ-প্রবাহে সৃষ্ট ইতিহাসের মৌলিক ধারাবাহিকতা। যার মধ্যদিয়ে সূক্ষ্মভাবে রূপায়িত হয়েছে ব্যক্তিসত্তার মৌলিক চিন্তার অবস্থান।

 

ব্যক্তি তার সৃষ্টিশীল অবস্থান থেকে শতাব্দীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও মৌলিক নৈতিকতা আর চিন্তার স্থিতিশীলতা আজও অনেকটা  স্থূলের কোটায়। বিশেষ করে এ স্থূলতায় মার্কসবাদীরা আদর্শ, চিন্তা, চেতনা, সাধনা, ভাব-কল্পনার বন্ধ্যাত্ত্বতা কাটিয়ে উঠে তাদের নিজ আসনকে আজও শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে লেখক খুবই সতর্কভাবে তার লেখনিশক্তির অভূতপূর্ব ক্ষমতা দ্বারা সে স্থূলতার জায়গাকে স্পর্শ করেছেন । ব্যক্ত করেছেন অভিমত তার নিজস্ব চিন্তা শক্তি ও নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে। লেখক  ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ গ্রন্থের শুরুতেই কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের জার্মান ভাষায় রচিত জার্মান ভাবাদর্শের অনূদিত গ্রন্থের বিশ্লেষণ করেছেন খুবই সূক্ষ্মভাবে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন কথিত মননশীলদের নষ্টলব্ধ মননে।

গ্রন্থের শুরুতে সৈয়দ মবনু লিখেছেন-

 

“মজহার –পূর্ব বাম’রা প্রগতির কথা বললেও তারা বুঝতে পারেননি পৃথিবীর গতিশীলতা। তারা বুঝেননি কিংবা বুঝতে চেষ্টা করেননি মার্কসের সময়(৫মে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪মার্চ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) থেকে নিজেদের সময় কতটুকু এগিয়ে আছে। তারা কেউ হয়েছেন চীনপন্থি আর কেউ সোভিয়েতপন্থী সমাজতান্ত্রিক, কিন্তু এই দুয়ে কি ব্যবধান ? তা তারা কষ্ট করে বের করার চেষ্টা করেননি। যদি তারা তা করতেন তবে বুঝতেন লেনিন কেন শ্রমিক বিপ্লবকে গুরুত্ব দিয়েছেন, মাউসেতুং কৃষক বিপ্লবকে এবং এছাড়া তাদের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন ব্যবধান আছে কি না ? এই দুয়ের সাথে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তার ভিন্নতা-অভিন্নতা কী ?” (মার্কস চিন্তার সহি তাফসির; পৃষ্ঠা ১০)।

 

উনিশ শতকের মধ্য দিকে এসে মার্কস-এঙ্গেলস  সমকালীন ফয়েরবাখ, বাউয়ের, স্টিরনারের মতো জাঁদরেল সব দার্শনিক জার্মান সমাজতন্ত্রের নানান দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেন তাদের জার্মান ভাবাদর্শে। যার মাধ্যমে তারা  হেগেলীয় ভাববাদী দর্শন আর সমকালীন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত নানান পর্যালোচনা করে তা থেকে বের করেন  সমাজতন্ত্রের এক নতুন রূপ। একই সঙ্গে হেগেলের ভাবাদর্শ থেকে এক ধাপ উপরে উঠে মার্কস হাজির করলেন মানুষ ও প্রকৃতি-সম্পর্কিত নানা প্রস্তাবনা।  নতুনভাবে ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন অর্থশাস্ত্র, ইতিহাস ও উৎপাদন সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের নিজস্ব ভাবনাকে। ফলে এক দীর্ঘ সময় ধরে ব্যক্তি-সম্পর্কিত  স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি  সম্বন্ধে যে নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হলো তাতে মার্ক্সের চিন্তা তার গুরু হেগেল থেকে অনেকটা অগ্রসর হয়ে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে নেয়। ফরহাদ মজহার অবশ্য মনে করেন- “গুরু হিসেবে হেগেলকে মার্কস অস্বীকার করেননি, বরং তরুণ বয়সে ইয়ং হেগেলিয়ান হিসাবে তাঁর দোঁহী মনোভাব থাকলেও পরিণত বয়সে এসে হেগেলের অসামান্য  অবদান আন্তরিকভাবে স্বীকার করে নিতেই আমরা দেখেছি।” (ফরহাদ মজহার; কেন মার্কসকে এখনও দরকার)। তবে জার্মান ভাবাদর্শ গ্রন্থটির  মাধ্যমেই মার্কস আবার ইয়াং হেগেলিয়েনদের বিরুদ্ধে কথা বললেন। বিষয়টি এরকম যে,  ইয়াং হেগেলিয়ানরা মূলত হেগেলের ভাববাদী চিন্তার বিদ্রোহী শিষ্য ছিলেন। মার্কস ব্যক্তিগতভাবে প্রথম দিকে ইয়াং হেগেলিয়ানদের সঙ্গে ছিলেন। তবে কিছুদিন যেতেই তাদের মধ্যে অনেকটা  চিন্তার ফারাক তৈরি হলে তিনি বেরিয়ে আসেন তা থেকে । লিখেন তাদের সমালোচনা। আর এই সমালোচনামূলক গ্রন্থই জার্মান ভাবাদর্শ।

 

গৌতম দাস কৃত  ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ গ্রন্থের বাঙলা অনুবাদে ফরহাদ মজহার  দীর্ঘ পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়  কথিত মার্কসবাদীরা মার্কসের নামে যে প্রচলিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন তা থেকে কিছুটা দূরে এসে নতুন পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছেন  মার্কসের চিন্তাকে। নতুনভাবে তুলে ধরেছেন মার্কস-সম্বন্ধীয় নানান পর্যালোচনা। অন্যদিকে গৌতম দাসও ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ গ্রন্থটির বাঙলা অনুবাদ করতে গিয়ে মার্কসের সঙ্গে মার্কসবাদের মৌলিক ব্যবধান তুলে ধরলেন পাঠকের সামনে। অবাক করলেন সে-সব পাঠকদের, যারা এতো দিন থেকে জেনে এসেছিলেন মার্কসের চিন্তা আর মার্কসবাদ একই!  ফরহাদ মজহারের মতে—“এঙ্গেলস কর্তৃক আবিষ্কৃত মার্কসবাদের সরল ব্যাখ্যায় আমরা মার্কসবাদকে দেখি খানিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর খানিক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হিশেবে”।(প্রাগুক্ত,পৃ-৩৭)। মূলত মার্কসের পরই মার্কসবাদকে তৈরি করেছেন তার বন্ধু এঙ্গেলস। তাই গৌতম দাসও যখন জার্মান ভাবাদর্শ গ্রন্থটির বাঙলা অনুবাদ করেন তাতে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন মার্কসের সঙ্গে মার্কসবাদীদের ব্যবধানগুলোকে।  যেমন, ১) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এক নয়। ‘জর্মান ভাবাদর্শ’-এ দ্বান্দ্বিক বলতে কিছু নেই। কোন প্রকার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধারণা মার্কসের নেই। ২) ‘বস্তু ও চেতনা’ বা ‘জীবন ও চেতনা’ এই রকমের বিভাজনের অনুমান করে ইতিহাস বা প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার প্রস্তাব মার্কসের নয়। মার্কসের নজর ছিলো প্রকৃতি ও মানুষ–এই দুই ধারণার অন্বেষণ করেছেন, এটাই এ যাবতকালের সিদ্ধ সিদ্ধান্ত। কিন্তু ইতিহাস, ইতিহাসের শর্ত ইত্যাদি ধারণার মধ্য দিয়ে মার্কস ইতিহাসকে যেভাবে বুঝিয়েছেন প্রচলিত মার্কসবাদীরা সেভাবে বুঝেননি। বরং  ইতিহাস যেনো মানুষের বাইরে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ব্যাপার, এক নৈর্ব্যক্তিক, ঐশ্বরিক ও রহস্যময় শক্তি, এভাবে বুঝায়। ৩) ব্যক্তিগত সম্পত্তির  বিরোধীতা মার্কসবাদী রাজনীতির  যাত্রাবিন্দু। কিন্তু এই ধারণা মার্কসের নয়। আসলে মার্কসবাদ বুঝতে পারেনি সম্পত্তির প্রচলিত মালিকানা ধারণার সাথে অর্থশাস্ত্রীয় ধারণার পার্থক্যটা কোথায়। ৪) পাশ্চাত্য দর্শনের বস্তু ও চেতনার সম্পর্ক-বিচারের প্রশ্নটি প্রধানত উঠেছে জ্ঞানের নিশ্চয়তার প্রশ্ন হিসাবে। যেখানে জগত বোঝাবুঝির কাজটা Reason দিয়ে করার কাজ মনে করা হয়, এবং যুক্তির এই বৃত্তির সাথে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয়বৃত্তির সম্পর্ক কী, মার্কসবাদ  তা নিয়ে এখনও ভাবতে শেখেনি। ৫) বস্তুচেতনা  বা চেতনা ও জীবনের সম্পর্ক বিচারে মার্কস পৌঁছেছেন  তাঁর মার্কসীয় চিন্তার অতি পরিচিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারনায়; উৎপাদন সম্পর্কে। আইনি মালিকানা অর্থে ‘সম্পত্তি’  আর উৎপাদন সম্পর্ক অর্থে সম্পত্তি এই দুয়ের ব্যবধানের দিকটা এখনও পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু, জ্ঞানতত্ত্ব বা দর্শনের সংকট বিচার করতে গিয়ে ‘সম্পত্তি’ সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রীয় ধারণা মার্কস কীভাবে নিষ্পন্ন করলেন, অর্থাৎ ভাববাদী দর্শন আর মার্কসের অর্থশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী? এতে কি মূল সমস্যা-বস্তু ও চেতনা বা জীবন ও চেতনার সম্পর্ক নির্ণয়ের কাজ সমাধা হয়েছে? মার্কস দর্শন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অর্থশাস্ত্রে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা হলে মার্কসের অর্থশাস্ত্র কি দর্শন এবং তা কোন অর্থে? ৬) মানুষের মুক্তি। কার্ল মার্কস যদি মার্কসবাদীদের মতো শুধু উৎপাদন শক্তি বিকাশের মধ্যে মানুষের মুক্তি দেখে থাকেন তাহলে মানুষকে শুধু উৎপাদনকর্তা বা উৎপাদন উপায় হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতেন না। (মার্কস চিন্তার সহি তাফসির;পৃ ২৯)

 

একজন আহমদ ছফা কিংবা ফরহাদ মজহার মার্কস চিন্তার প্রতিফলন সমাজ-বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ শক্তির মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন  পরবর্তী সময়ে অন্য কেউ এসে তা পুর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন কিংবা ধারণ করতে পারেননি বলে আমাদের ধারণা। না মার্কস চিন্তার ধারক বলে খ্যাত কথিত মার্কসবাদীরা! না গোঁড়া প্রগতিবাদীরা!  যার ফলস্রোতিতে  মার্কসবাদীরা মার্কসের চিন্তাকে নিছক যান্ত্রিক-বস্তুবাদ বলে প্রচার করলেন। অস্বীকার করা হলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ভাব,কল্পনা, আবেগ, অনুভূতিকে। চাপিয়ে দেয়া হলো সমাজ পরিবর্তনের নামে যান্ত্রিক-বস্তুবাদের অপরিহার্য পরিণাম। তবে বাস্তবিক দৃষ্টিতে বিচার করলে ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ গ্রন্থটিতে  যতোটা না মার্কসের মৌলিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে মার্কসবাদীদের মৌলিক দর্শনের ব্যাখ্যা। বিষয়গত দিক থেকে জার্মান ভাবাদর্শ বা ইয়ং হেগেলিয়ান, মার্কসবাদের মজহারীয় তফসির বা সহি মার্কসনামা, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারণা, জীবন বা চেতনা কিংবা লালন আর হেগেলের সমন্বয়ে মজহারের মার্কস; প্রভূতি বিষয়গুলোকে খুব একটা পৃথক করা না গেলেও তাতে লেখক তার চিন্তার সমন্বয়ের মাধ্যমে মার্কস ও মার্কসবাদের প্রধান ও মৌলিক বিষয় বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, খুবই সূক্ষ্মভাবে।  প্রায়োগিক দিক থেকে মার্কসের চিন্তার সঙ্গে মার্কসবাদীদের সমাজ-ব্যবস্থায় ব্যর্থতার  বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছেন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। কোন লেখক বা চিন্তকের সৃজনশীল চিন্তার  মৌলিক যোগসূত্র না বুঝলে একজন পাঠকের কাছে যেমন দর্শন, সভ্যতা, ইতিহাস প্রভূতি বিষয়গুলো অস্পষ্ট থেকে যায়, তেমনি থেকে যায় তার অন্তর্নিহিত বিমূর্ত চিন্তার রূপটি। তাই মার্কসকে বুঝার জন্য লেখক মার্কসের চিন্তার যোগসূত্রকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন,--

১)দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে হেগেল  ২)বস্তুবাদে ডারউইন, ফুয়েরবাখ  ৩) সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদে রুশো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে ওয়েন, কান্ট  ৪)অর্থনীতিতে এডার্ম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো ৫) লেখার স্থিরতার ক্ষেত্রে এঙ্গেলস। (মার্কস চিন্তার সহি তাফসির; পৃঃ ২৭)

 

মার্কসবাদীরা মার্কসের চিন্তাকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছেন, প্রায়োগিক দিকে নিয়ে যেতে পারেননি। যে কয়েকটি মৌলিক ধারা সমন্বয়ের অভাবে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে মার্কসবাদ মুখ থুবড়ে পড়লো তার কারণগুলোকে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন সমকালীন সমাজ বাস্তবতার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রায়োগিক দিক থেকে মার্কসবাদীদের ব্যর্থতার বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করা যায় এভাবে-

প্রথমত; জ্ঞানের স্ফুরণের সঙ্গে যখন মানবিকতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় তখনই ব্যক্তি মননশীলতায় মৌলিক দয়ার স্বরূপ প্রকাশ পায়। মার্কসবাদীরা অধিকতর বস্তুবাদী হয়ে ওঠায় বস্তুর বাইরের দিক থেকে জ্ঞানকে শুধু পর্যবেক্ষণ করেছেন; বস্তুর অন্তর্নিহিত ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেননি।

দ্বিতীয়ত; একটি বৃহত্তরো জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চৈতন্যের বিকাশ ঘটিয়ে তার মানোন্নয়ন এবং বোধ উপলব্ধিতে নতুন সমাজের ভ্রূণ গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি না করে বরং অনুভূতিকে আহত করার প্রবণতা বৃহত্তরো জনগণকে মার্কসবাদের প্রতি বিমুখ করে তুলেছে।

তৃতীয়ত; আধুনিক সময়কালে পুঁজিবাদী অর্থনীতির জয়যাত্রা মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। তাঁরা জনগণের শ্রম-নির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের পথ একচেটিয়াভাবে পরিহার করে পুঁজিবাদের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

চতুর্থত; বৈষয়িক মুক্তি হলেই ব্যক্তি মননের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে না, প্রয়োজন মানসিক মুক্তির বিকাশ। মার্কসবাদীরা এ’দুয়ের সমন্বয় করতে পারেননি। মানসিক মুক্তি প্রসঙ্গকে এড়িয়ে তারা  জনমানুষের হৃদগর্ভে মার্কস চিন্তার ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

পঞ্চমত; বিশ্বপরিসরে ক্ষমতা লাভের দ্বন্দ্বটি মার্কসবাদীরা যতোটা বড় করে দেখেছেন, মার্কসের সমাজসম্বন্ধীয় চিন্তা ভাবনা সে তুলনায় অনেকটাই গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

ষষ্ঠত; মার্কস ‘জর্মান ভাবাদর্শ’ গ্রন্থে সম্পত্তি-সম্পর্কের যে রূপ দাঁড় করিয়েছিলেন তা অনেক মার্কসবাদী বুঝতে পারেননি। মার্কস যখন বলেন-‘উৎপাদন শক্তি ও বিনিময়-সম্পর্কের রূপের মধ্যকার দ্বন্দ্ব’ তখন মার্কসবাদীরা বুঝেন, উৎপাদন শক্তি ও বিনিময়-সম্পর্কের দ্বন্দ্ব।

সপ্তমত; জাতিসত্তার বিকাশের ভেতর যে আন্তর্জাতিক প্রগতি ও সমপ্রবাহমানতা  রয়েছে তা অনেক মার্কসবাদী বুঝে ওঠতে পারেননি। যার ফলস্রোত হিশেবে তারা জাতিসত্তার প্রশ্নটি একরকম এড়িয়ে চললেন।

 

মার্কসীয় অর্থনীতির বিচিত্র বিকাশের উদ্ভূত নানান চিন্তাভাবনা মার্কসীয় সমাজকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে, সঙ্কীর্ণ বলয় থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সাধারণের কাছে পৌঁছতে পারেনি। পারেনি ইনসাফ বা সাম্যবাদ বিকাশের প্রক্রিয়াটিকে সমাজ ও ব্যক্তি মননের ভেতর থেকে জ্বালিয়ে তুলতে। আর এই জায়গাটিতে এসে মার্কসবাদ বোধ করি সবচে বেশি ব্যর্থ হয়েছে। তবে এঙ্গেলস আবিষ্কৃত মার্কসবাদের ভুল-শুদ্ধ চিন্তার উপস্থাপনের মাধ্যমে সাময়িক সময় হলেও মার্কসবাদ যে পৃথিবীর রাজনীতিকে কাঁপিয়েছে, চিন্তার গতিশীল বিকাশ ব্যাক্তি-মননে যে এক নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় কারোরই নেই। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি চিন্তার বৈপ্লবিক অন্বেষণ ও অনুসন্ধানের স্থিতিশীলতাকে হারিয়ে কালক্রমে মার্কসের চিন্তা হয়ে উঠেছে যে নিছক নিষ্প্রাণ মতবাদ, আর কোথাও অন্ধগোড়ামীর চরম পদানিক বস্তুর গতানুগতিক চিন্তার ধারাবাহিকতা তা অস্বীকার করা অন্তত আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ গ্রন্থটি আমাদেরকে সেই চিন্তার দিকে যেতে সাহায্য করে, যা খুলে দিয়েছে আমাদের মন ও মননশীলতার এক নতুন দুয়ার।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।