মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ্
‘ইসলামী শারিয়াহ্’ শব্দটা শুনলে অনেকেই আঁতকে উঠেন। এর কারণ শারিয়াহ্ নিজে নয়, ব্যক্তির অজ্ঞতা। কোনো বিষয়ে অজ্ঞতা থাকলে ব্যক্তি সে বিষয়কে হয়তো ভয় পাবে, নতুবা এড়িয়ে যাবে; -এটাই মানুষের স্বভাব। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলামী শারিয়াহ্ সম্পর্কে কোনো কিছু না জানার ফলেই শারিয়াহ্-র বিরোধিতা করেন। সম্প্রতি দেখেছি, মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোতে ফতোয়া নিষিদ্ধ হবার রায় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী তুলেছেন। তার এ ভয় সৃষ্টি হয়েছে শারিয়াহ্ এবং ফতোয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই।
শরিয়াহ্ কি ও কেনো –এ সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে কেউ কেউ যেমন এর বিরোধিতা করেন, ঠিক তেমনি এর অপব্যবহারও করেন কেউ কেউ। বিষয়টি মাথায় রেখে ড. জাসের আউদা-র ‘মকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ বইটির আলোকে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে দিচ্ছি। এক্ষেত্রে শুরুতেই আমার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিচ্ছি। যারা আমার মত ‘মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ বিষয়ে একেবারেই কিছু জানেন না, এটি কেবল তাদেরই পাঠ্য। মিজানুর রহমান খানদের জবাব দেয়ার জন্যে পাঠকের ধৈর্য কামনা করছি।
শারিয়াহ্, ফিকহ্, ও কানুন এ তিনটি শব্দের পার্থক্য না করে অনেকেই এর অনুবাদ করেন ‘ইসলামী আইন’ বা Islamic Law। ফলে শুরুতেই একটি ভুল ধারণা মানুষের মাঝে জন্ম নেয়। শারিয়াহ্ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পানি প্রবাহের এমন স্থান, যেখান থেকে মানুষ একত্রিত হয়ে পানি পান করে। ইসলামে শারিয়াহ্ শব্দের একটি নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। ইমাম ইবনুল কায়্যিম এর মতে, ‘শারিয়াহ্ গড়ে ওঠে মানুষের প্রজ্ঞা ও কল্যাণের উপর ভিত্তি করে। শারিয়াহ্ তাই যার মধ্য আছে ন্যায়, দয়া, কল্যাণ ও প্রজ্ঞা। যদি কোনো কিছু ন্যায় না হয়ে অন্যায় হয়, দয়া না হয়ে কঠোরতা হয়, কল্যাণ না হয়ে অকল্যাণ হয় কিংবা প্রজ্ঞা না হয়ে বাচালতা হয়, তাহলে তা শারিয়াহ্ নয়’।
ফিকহ্ শব্দের অর্থ গভীর জ্ঞান বা বুঝ। ইসলামী শারিয়াহ্কে ভালোভাবে বোঝার যে পদ্ধতি তাকেই ফিকহ্ বলে। অন্যদিকে কানুন শব্দের অর্থ আইন। ইসলামী শরিয়াহ্কে ভালোভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে যে নিয়ম-কানুন আবিষ্কার করা হয়, তাকেই কানুন বা কেউ কেউ হুকুম বলেন।
শারিয়াহ্ আল্লাহ তায়ালা দ্বারা নির্ধারিত, অপরিবর্তনশীল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু ফিকহ্ মানুষের আবিষ্কার, স্থান-কালের বিভিন্নতায় এর পরিবর্তন হয়। ফলে কখনো কখনো কানুনেরও পরিবর্তন হয়। যেমন, কোনো এক সময় উপমহাদেশের কোনো কোনো ধার্মিক মানুষ সিগারেট খেতেন। কিন্তু যখন জানা গেল যে, সিগারেট মানুষের মৃত্যু ঘটায়, তখন তা মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
আলেমদের ওয়াজ-মাহফিলের ফলে শারিয়াহ্-র সংজ্ঞা ও উৎস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছু ধারনা থাকলেও শারিয়াহ্-র উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কোনো কিছু জানি না বললেই চলে। শারিয়াহ্-র উদ্দেশ্যকে আরবিতে ‘মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ বলা হয়।
৪৭৮ হিজরি সময়ে ‘মাকাসিদ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ইমাম আব্দুল মালেক আল-জুয়াইনি। তিনি মাকাসিদ শব্দটিকে ব্যবহার করেন ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ শব্দের অর্থে। পরবর্তীতে তাঁর ছাত্র ইমাম আবু হামিদ আল-গাজালী মাকাসিদ শব্দটিকে আরও বিস্তৃত করেন। তারপর ইমাম ফখরুদ্দিন আল-রাজী, ইমাম কারাফি, ইবনে আশুর, ইমাম ইবনে তাইমিয়া সহ অসংখ্য ইসলামী চিন্তাবিদ মাকাসিদ বিষয়ে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যান, এবং মাকাসিদ-এর ধারনাকে উন্নত থেকে উন্নতর পর্যায়ে নিয়ে যান।
মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে কয়েকটি ধারণা পরিষ্কার করে নিলে আমরা সহজে সামনে এগিয়ে যেতে পারব। প্রথমত, দেশের এই সংকট-কালীন সময়ে ‘মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ জানার ফায়েদা কি? এককথায়, আমরা বাঙালিরা সব সময় কোনাকোনি পথ খুঁজি; ফলে সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান পাই না এবং একই সমস্যা বার বার আমাদের সামনে আসে। ইসলামকে যারা রাজনৈতিকভাবে বুঝতে চান, তাদের জন্যে মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ জানা-বোঝা একান্তই প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, ইসলামের বিভিন্ন ইবাদাত-বন্দেগি, আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন কেনো মুসলিমদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ তা জানার জন্যেও মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ জানা প্রয়োজন। কিংবা কোন কাজটিকে মুসলিমদের বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত আর কোন কাজটি কম গুরুত্ব দেয়া উচিত, তা বোঝার জন্যেও মাকাসিদ প্রয়োজন।