বৈধতার সীমারেখা, এখনকার সঙ্কট ও রাজনৈতিক কর্তব্য

দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট, রাষ্ট্র ও আইনের সম্পর্ক এসব বিষয় নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি’ ১৫ চিন্তা পাঠচক্রে আলোচনা করেন মুসতাইন জহির।

মুসতাইন জহির- পাঠচক্রে আমরা অন্যদের কথা শুনতে চাই এবং যে কেউ এসে আমাদের কথা শুনতে পারেন। আমাদের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনা হতে পারে, যেটাকে আমরা বলি সংলাপ। এটাই রাজনীতির একটা মৌলিক ধারনা। এটার উপর নির্ভর করে অন্তত আধুনিক রাজনীতির চিন্তাটা গড়ে উঠেছে।

আমি বা আপনি পরিবারের মধ্যে থাকি। ফ্যমিলি হল যেখানে মানুষের বৈষয়িক সম্পর্ক, যে সমস্ত জৈবিক প্রয়োজন সেগুলো পরস্পর মিলে পরিপূরণ ও শেয়ার করা। জৈবিক চাহিদা সেখানে একটা গুরুত্বপুর্ণ অংশ। সেটা আমাদের খাওয়াপরা, ভালবাসা-প্রেম, স্ত্রী-সন্তান সবকিছু। এর বাইরে যখন যাই, যেটাকে আমরা বলি সমাজ; তখন অন্যের সাথে সম্পর্ক এবং বিনিময়ের জায়গা বা পরিসরটা নিশ্চয় পারিবারিক পরিসর না। তার সাথে সম্পর্ক রচনা করার যে প্রয়োজন যাকে কেন্দ্র করে সমাজ বা আধুনিক অর্থে রাষ্ট্র গঠিত হয়, তা তৈরি করার জন্য ভিন্নতর একটা  প্রয়োজন লাগে। সেই প্রয়োজন থেকেই আসে একই সাথে প্রিন্সিপাল। যেমন পরিবারেরও কিছু মুল্যবোধ লাগে তাকে রক্ষা করার জন্য। ঐটাও গড়ে তোলার জন্য একটা পারপাস লাগে এবং সেই পারপাস পূরণ করার জন্য কিছু মুলনীতি লাগে। সমাজ বা সামষ্টিকতার পারপাস হল অন্যের সাথে মিলিত হওয়া। এই অন্যের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য এমন একটা জায়গা দরকার যেখানে আমরা পরিবার-অতিরিক্ত এমন কিছু আবশ্যিক বিষয় আছে যার বিনিময় করতে পারি। সেই এমন কিছুটা কি? বিনিময়টা কি এবং সেটা কেন বিনিময় করতে হবে? পরিবারের মধ্যে তো সব চাহিদার পরিপূরণ ঘটে না। পরিবারের মধ্যে আমরা কিন্তু একজন ব্যক্তি হিসেবে সম্পর্ক করি না, কিন্তু সমাজে আমি আপনি একজন ব্যক্তি। এখানে পারসন অর্থে ব্যক্তি, পারসোনালিটি ধারণ করবার দিক থেকে আলাদা ব্যক্তি। ইন্ডিভিজুয়ালিটি’র অর্থে ব্যক্তি বুঝানো হচ্ছেনা। তো, সেখানে এমন একটা ভিত্তি লাগে যাতে প্রত্যেকে আলাদা করে একটা সুনির্দিষ্ট পরিচয়ে অন্যের সাথে তার বিনিময়ের সম্পর্কটা নির্ধারন করতে পারে। যার ভিত্তিতে সে এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে পারে যে কাঠামোর মধ্যে দিয়ে তার বিনিময়ের রূপটা সচল থাকতে পারে। এটা তৈরি করার ভিত্তি বলে যেটাকে ধরা হয় সেটা হল গ্রিক 'পলিস'। যেখানে একটা বিশেষ সামষ্টিকতার চর্চা তারা করেছে। সেখানে একটা ভিত্তি ছিল এই যে সেখানে প্রত্যেকে এসে যেন একে অপরের সাথে আলাপ, কথোপকথন জারি রাখতে পারে। কথা শোনা এবং বলার মধ্যে দিয়ে নিজেদের মত করে সকলে মিলে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যে ব্যবস্থা তারা নিজেরা পরিচালিত করবে। নিজেদেরকে সামষ্টিক সম্মতির ভিতর দিয়ে পরিচালনার যে ব্যবস্থা এটা নিশ্চয় পারিবারিক ব্যবস্থা না। তাইলে পারিবারিক ব্যবস্থার বাইরে যে ব্যবস্থাটা এটাই হল রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এর বিপরীতে, পরিবার ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বা ওইকস (OIKOS) একারনে অটক্রেটিক যা পরিবার প্রধানের অধীনস্থ। অতএব, যেখানে কেউ কারও অধীনস্থ নয়, সেই  মুক্ত-পরিসর নির্মাণই রাজনীতি। সেই পরিসরটা তৈরির জন্য, এখানে আলাপ-আলোচনা, একত্রিত হওয়া।

আমাদের নিজেদের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেগুলো নিয়ে আমরা অন্যদের সাথে ডায়লগ করতে চাই; যাতে আমরা একটা সাধারণ অবস্থান তৈরি করতে পারি। ডায়ালগ ইজ ভেরি মাচ পলিটিকাল। যখনই আমরা অন্যের সাথে এমন একটা পরিসরে কথা বলি, যে পরিসরে অন্যের কথা শোনা এবং নিজের কথা বলার মধ্যে দিয়ে একটা ঐক্য সৃষ্টি হয়। এই ঐক্য সৃষ্টি হওয়াটাই হল একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেই অর্থে পাঠচক্রটা একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু এখনকার রাজনীতি অর্থে নিলে মনে হবে ব্যাপারটা মিলল না। রাজনৈতিক দলের ইতিহাস খুবই অল্প কয়দিনের। কিন্তু মানুষের একত্রিত হয়ে নিজেদের একটা ব্যবস্থা তৈরি করার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। আধুনিক অর্থে আমরা যেটাকে রাষ্ট্র বলি সেটা জন্মের পরেই রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে উঠার অনুষঙ্গ আকারে রাজনৈতিক দল বলে একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে বলছিলাম। আমরা মনে করি বাংলাদেশ নামক যে ব্যবস্থাটা আছে এটা মোটেই সাম্য, মর্যাদা এবং ইনসাফ ভিত্তিক যে সমাজ বা রাষ্ট্র হবার কথা ছিল তার সাথে সঙ্গতিপরায়ন নয়। এবং আমরা মনে করি এর বদল দরকার। পরিবর্তন অনেকভাবেই হতে পারে এবং একদিনে হয়ে যায় না। কিন্তু পরিবর্তনের প্রশ্নটা এবং পরিবর্তন কোথায় কোথায় দরকার সে ব্যাপারে আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এটা নিয়ে আমরা অন্যদের সাথে কথা বলব। একইসাথে আমরা তো শুধু বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্র না, আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি। রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানে একটা আন্ত-রাষ্ট্রিক ব্যাপার যেটাকে বলে আন্তর্জাতিক।  

এই যে জাতি এবং জাতীয়তাবাদ একইসাথে রাষ্ট্রের সাথে জড়িত হয়ে আছে, এ ব্যাপারে আমাদের একটা অবস্থান আছে। আমরা মনে করি জাতীয়তাবাদ আধুনিক ইতিহাসের মোটা দাগে এমন একটা সমস্যা তৈরি করেছে যার অতিক্রমণ প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদ এমন একটা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে যেটা হয় বর্ণবাদী হয়ে উঠে অথবা ফ্যাসিবাদী। ফলে আমরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরোধী। সেটা বাংলাদেশি নামে হোক আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে হোক। কিভাবে জাতীয়তাবাদের এই পর্যায়টা অতিক্রমণ করে যাওয়া যায় আমাদের আগ্রহের জায়গাটা সেখানে।

থার্ড হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের জনগোষ্ঠি আকারে টিকে থাকার কিছু প্রশ্ন আছে। বললাম আমরা এ রাষ্ট্রের পরিবর্তন চাই। আমরা জাতীয়তাবাদের বিরোধী তাইলে আমরা এই জনগোষ্ঠীর কি রকম রূপান্তর কামনা করি। সেই রূপান্তর তো আমরা চাইলেই আপসে হয়ে যাবে না এবং আমরা বাংলাদেশের জনগণ চাইলেও সব কিছু করে ফেলতে পারব না। অভ্যন্তরীণ বিরোধ-ভিন্নতাগুলো তো আছেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুটো প্রসঙ্গকে আমরা মনে করি আমাদের চিন্তার জন্য, আমাদের রাজনীতির জন্য এবং আমাদের জনগোষ্ঠী আকারে টিকে থাকার জন্য জরুরী।

প্রথমত, আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশ মুসলমান। ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান হওয়ার কারণে এখনকার পরিস্থিতিতে তাকে একটা বিশেষ কারণে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার যে ভিত্তি সে ভিত্তিটা রক্ষা করা এবং তার সাথে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মতাদর্শিক সম্পর্কের মধ্যে নিহিত।

অনেকগুলো লড়াই আছে; সেখানে আমাদের পরিষ্কার একটা অবস্থান আছে। যেটাকে সহজে বলি সাম্রাজ্যবাদ। সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেটা তার মিত্র, এরকম অনেকেই আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দূরের একটা দেশ ব্যাপারটা তা না। এটা একই সাথে একটা মতাদর্শ, একটা চিন্তা। এর আকাঙ্ক্ষা দ্বারা তাড়িত হওয়া মানুষ তো আমার দেশেও আছে। কেউ সরাসরি তার স্বার্থ রক্ষা করে বলে আছে কেউ সেই চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত বলে আছে। ফলে তার সাথে আমাদের চিন্তার জায়গায় একটা গিট খুলতে হবে। আর যারা স্বার্থের জন্য কাজ করে তাদের সাথে চিন্তার চাইতেও স্বার্থগত প্রসঙ্গটা অনেক বেশি সামনে আসবে। এই যে সাম্রাজ্যবাদ মানে যারা বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যে আধিপত্য করছে এবং আধিপত্য করার জন্য যেভাবে সে কিছু কিছু জনগোষ্ঠীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছে তাদের সাথে লড়াইয়ের একটা ব্যাপার আছে।

দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থাটা পরিচালিত হচ্ছে একটা সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। যেটাকে আমরা বলি পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমাদের একটা পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি আছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে চরিত্র আছে আমরা তার ঘোরতর বিরোধী। এবং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের চূড়ান্ত লড়াই এর যে প্রয়োজন সেই প্রয়োজনকে আমাদের মৌলিক অবস্থান মনে করি। আমরা মনে করি, যেরকম জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের সম্মিলনের একটা জমিন খোঁজা দরকার; একইসাথে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে গিয়ে অন্তত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার এখনকার যে চরিত্র এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন করতে পারে সেরকম একটা  অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সম্পর্ক অনুসন্ধান করা দরকার।

এগুলো হল মোটা দাগে চিন্তা পাঠচক্রের দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান। এ জায়গাগুলো নিয়ে আমরা অন্যদের সাথে ডায়ালগে রাজি আছি কিন্তু এই প্রসঙ্গগুলোতে আমাদের অবস্থানটা পরিষ্কার করে। ফলে যাদের রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী না, যাদের রাজনীতি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী না তাদের সাথে আমাদের একটা পরিষ্কার পার্থক্য রেখা আছে। তারা আমাদের বন্ধু নয়।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটা সুনির্দিষ্ট চরিত্র আছে। সে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারাই তার উৎপাদন এবং শোষণ-লুণ্ঠন বজায় রাখে। এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজনীতির আরেকটা মৌলিক দিক হল শোষণ সবসময় সবাই সবার উপর করে না। কিছু মানুষ অন্য কিছু মানুষের উপর জুলুম করছে। জুলুমের একটা শ্রেণীগত ব্যাপার আছে। একটা বিশেষ শ্রেণী অন্য একটা বিশেষ শ্রেণীর উপরে জুলুম করছে। কেন সে জুলুম করছে? কি কারণে সে সক্ষম হয়ে উঠে? এবং একই সাথে শোষণ করার পরেও কিভাবে সে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে, এটা আমাদের কাছে গুরুতর বোঝাপড়ার জায়গা। যে কারণে আমারা ক্যাপিটালিজম সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াটাকে কার্ল মার্কসের চিন্তার জায়গা থেকে বুঝতে চাই এবং এ ক্ষেত্রে মার্কসের চিন্তা বাদ দিয়ে বোঝা সম্ভব না বলে মনে করি। অনেকে হয়তো জানেন না, কি কি মৌলিক জায়গা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন চিন্তা পাঠচক্রটা চালিয়ে যাচ্ছি, আজকে একটু পরিষ্কার করলাম; ফলে অনেকের জন্য বুঝতে সুবিধা হবে।

এখন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আসি। সবাই জানেন বর্তমান সরকার পুলিশ, র‍্যাবসহ প্রশাসনিক সর্বশক্তি দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, নির্বিচারে বলপ্রয়োগ করছে। এটা করছে কারণ, জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে। আজকে যদি র‍্যাব-পুলিশ দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি না করে তাহলে আসলেই মানুষ রাস্তায় নেমে যেতে পারে, নামবে। নামবে কিনা এ ভয়টা সরকার কেন পাচ্ছে? রাস্তায় নেমে গেলে তো ঐ জিনিসটা উদোম করে ফেলবে যে আসলে মানুষ তাকে চায় না। মানুষ তাকে চায় না এই জিনিসটা দেখলে সমস্যা কি তার? ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কেউ অন্তত বিপুল অংশ তাকে চায় না এটা দেখতে দেওয়া সম্ভব না। যখন এটা প্রকাশ্য হয়ে যাবে যে বিপুল মানুষ তাকে চায় না, যাকে বলা হয় লেজিটেমিসি, সেটা চলে যায়। তখন আর কোন বৈধতা থাকে না। বৈধতা কিন্তু রাজনৈতিক, আমরা অনেকে মনে করি এটা বুঝি আইনি। আইনি একটা বৈধতার জায়গা আছে কিন্তু ঐ বৈধতাটা টলে যায় রাজনৈতিকভাবে। সরকার প্রমাণ করছে তার আইনি ভিত্তি। কিন্তু সে একইসাথে সমানভাবে ভীত তার রাজনৈতিক বৈধতা যে নাই এটা প্রমাণ হতে দেয়া যাবে না। রাজনীতি এবং আইনের এই সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনীতি যে কোন আইনের সক্ষমতা, আইনি বৈধতা এবং ন্যায্যতাকে পালটিয়ে ফেলতে পারে। এটাকে অতিক্রম করে যেতে পারে এবং নতুনভাবে আইনের বাইরে থেকেই নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এবং তার উপর দাঁড়িয়ে নিজেকে বৈধ বলে হাজির করতে পারে। কিন্তু একটি আইনি কর্তৃত্ব রাজনৈতিক অনুমোদনহীন ভাবে কখনোই টিকতে পারে না। একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যে কোন বিদ্যমান আইনি ক্ষমতাকে পালটিয়ে ফেলতে পারে, তাকে সরিয়ে ফেলতে পারে বা উৎখাত করতে পারে। এ কারণে রাজনৈতিক বৈধতার প্রসঙ্গটা এত গুরুত্বপূর্ণ।

যখন কোন একটি ক্ষমতা নিজেকে আইনি ক্ষমতার বলে বা বিভিন্ন উপায় ব্যাবহার করে তার বিরুদ্ধে বিপুল জনগোষ্ঠীর না প্রত্যাখ্যানের অসন্তোষটাকে দমন করতে চায়, তখন এটা পরিষ্কার হয়ে পড়ে যে, আসলে রাজনৈতিক বৈধতা তার নাই। এবং সে চেষ্টা করছে সেটা যেন প্রকাশ হয়ে না পড়ে। এ বাস্তবতার কারণে জনগণকে আইনের অতিরিক্ত একটা বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ঘোষণা করতে হয়। আইনি কাঠামোর মধ্যে যেমন নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যদি তার আকাঙ্ক্ষার এ প্রতিফলনটা না ঘটে অথবা সে যদি এটা থেকে বঞ্চিত হয় বা সে অধিকার যদি হরণ করা হয় তাহলে তো এই আইনি ব্যবস্থাটাই তখন অকার্যকর হয়ে যায়। তখন সে এ আইনি অধিকারটা উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাতে পারে। কিন্তু সে চেষ্টা চালানো ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হয় যতক্ষণ পর্যন্ত আইনি এ অধিকারটা ফিরে পাওয়ার একটা বাস্তবতা থাকে।

বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় এখন কি এমন একটা নির্বাচন হওয়া সম্ভব, যার মধ্যে দিয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় নির্বিঘ্নে তার পছন্দ এবং মতামত প্রতিফলিত করতে পারবে? এবং সরকার পরিবর্তন ঘটবে? না, আইনীভাবে নেই। সরকারের যুক্তি যদি মেনে নিই তাহলে বাংলাদেশের মানুষজনের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা কি আগামী পাঁচ বছর পরে ভোট দেওয়া? নাকি আসলে তারা ভোট দিয়ে একটা স্থিতিশীল প্রতিনিধিত্বশীল সরকার চায়? তাইলে সেটা তো এ সরকার অস্বীকার করছেন। যদি একটা স্বাভাবিক নির্বাচনও হত, তারপরেও যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপুল অংশ এটা চাইত যে আমরা আরেকটা নির্বাচন চাই, তাহলে কি কোন সরকারের সেটাকে অস্বীকার করার অধিকার নৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে থাকত? অবশ্যই থাকত না। জনগণ তার পলিটিকাল ম্যান্ডেট আবার নতুন করে প্রয়োগ করতে চায়। আপনি আইনের দোহাই দিয়ে তো তাকে এটা থেকে বিরত রাখতে পারবেন না। যদি আপনি আইনের দোহাই দিয়ে করতে চান তখন আইন এবং রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সাথে একটা সরাসরি সংঘাত তৈরি হবে। সে সংঘাত যদি আইনি মীমাংসার রাস্তা খুঁজে না পায় তখন আইনি বহাল ব্যবস্থাকে সে নিশ্চয় অতিক্রম করে যাবে। অতিক্রম করে যেতে যখন সে চাইবে তখন তো তার নিজেকে আর আইনি অধিকারের বরাতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তখন সে অধিকার প্রয়োগের সম্ভবত্যতা ছিল না বলেই নিজেকে নতুন করে আবার বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আকারে জাহির করতে হয়েছে বলে সে ঘোষণা দেবে।

এরকমের ঘোষণাগুলো যখন আসে তখন আমরা দেখি আধুনিকভাবে নতুন সরকার গঠিত হয়। এটা ছাড়া আরেকটা জায়গা দেখি সেটাকে আমরা বলি বিপ্লব। বিপ্লব রাষ্ট্র বানায় না কিন্তু সরকার ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে। বিপ্লব আসলে রাষ্ট্র বানানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। বিপ্লব মানে একটা নতুন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যা ঐ জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপরায়ন হয়ে উঠবে। অর্থাৎ জনগণ নিজে কেমন সরকার চায়, কিভাবে তার অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, তার রূপটা কেমন হবে, এসব যদি স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় পুর্ণ করা সম্ভব না হয় তাহলে সে আইনের অতিরিক্ত তার রাজনৈতিক ক্ষমতার যে প্রাকৃতিক অধিকার আছে সেটা প্রয়োগ করে। কিছু কিছু অধিকার কোন আইন পাল্টাতে পারে না। যা আইন দিতে পারে সেটা সে হরণ করতে পারে কিন্তু যেটা সে দিতেই পারে না সেটা সে হরণও করতে পারে না। আইন শুধু তার স্বীকৃতি দিতে পারে বা দিবে তা সুরক্ষিত করার জন্য। যদি আইন জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করতে না পারে তখন সে আইনের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে পরিষ্কার আছে, এই যে অধিকারের কথা বললাম এই অধিকার যদি সে প্রয়োগ করতে না পারে এবং ব্যবস্থাটা যদি তার বিরুদ্ধে অত্যাচার এবং নিপীড়নমুলক হয়ে উঠে তার বিরুদ্ধে তার সশস্ত্র প্রতিরোধ করার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অধিকার আছে। অর্থাৎ তারা এ ন্যাচারাল রাইটটাকে কন্সটিটিউশানাল রাইট আকারে গ্রহণ করেছে। যেখানে জনগণ নিজে এই অধিকারটা নিরঙ্কুশভাবে নিজের কাছে রক্ষিত রাখে। যদি প্রয়োজন হয় সে অধিকারটা প্রয়োগ করতে পারবে সেটা যেন স্বীকৃত থাকে এটাকে বলা হয় কন্সটিটিউটিভ পাওয়ার। 

এখন বাংলাদেশে কম-বেশি আমরা সবাই মনে করছি, এটা বুঝি বিএনপির বিষয়, বুঝি এটা আওয়ামী লীগ- বিএনপির সংলাপের বিষয়। না; বাংলাদেশের জনগণের এটা একটা ইস্যু। আদৌ কিভাবে সে তার নিজের সরকার ব্যবস্থা নিজে নির্ধারণ করবে এবং নির্ধারণ করার নিশ্চয়তা চাইবে, তাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। এ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজনটা সাধারণ মানুষের মধ্যে অনুভূত হওয়ার ভাষাটা আমি যেভাবে বলছি হয়ত তা থেকে ভিন্নও হতে পারে। সে ভাষাটা কি অথবা সে ভাষাটা যদি আমরা আধুনিক রাজনীতির ভাষার সাথে মিলিয়ে দেখি কোথায় তার সম্পর্ক আছে কোথায় তার সম্পর্ক নাই, সেটা বুঝা দরকার।

খালেদা জিয়া অ্যারেস্ট হলে কি হবে। নির্বাচনের দাবি বিএনপির দাবি হিসেবে হয়ত মারা পড়বে অথবা পড়বে না। হয়ত বাংলাদেশে অবরোধ চলছে এ কথা এক সময় মানুষ ভুলে যাবে, অবরোধ আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে অকার্যকর হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কোথাও কোন গাড়িতে বোমা পড়বে, আগুন জ্বলবে। তখন মনে হবে আচ্ছা অবরোধের কারণে এটা ঘটেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সাধারনভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার-আপনার নিজের কোন সমস্যাটা এর ফলে তৈরি হচ্ছে সেটা আলাদা করে বিশ দলের অবরোধ আর হরতাল এবং তাকে গ্রহণ করা না করার নৈতিকতা, অনৈতিকতা, দুর্বলতা, পেট্রোল বোমা, মানুষ পোড়ানো এগুলা ব্যাতিরেকে চিহ্নিত করতে পারছি কিনা সেটা ভাবা দরকার। মানুষের সংখ্যাগরিষ্ট মতামতকে জড়ো করতে পারছি কিনা এটা হল এখনকার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অন্তত আওয়ামীলীগ-বিএনপির বাইরে এসেই আমরা বের করতে চাই।

আমাদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তা কাজ করে যে কেউ বুঝি এসে আমাদেরকে উদ্ধার করবে। কেউ উদ্ধার করার যে যামানাটা ছিল তা নবী মুহাম্মদের পর শেষ হয়ে গেছে। মানে যখন নবী রাসূলই একমাত্র ঐ বিদ্যমান ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন। আমাদের মধ্যে এরকম একটা চিন্তা তো এখন আর কাজ করার দরকার নাই বা উচিত না। কারণ নবী তো এই চিন্তার মধ্যে ইতিহাস যেন আর গড়াগড়ি না খায় তার জন্য বলেছেন ‘আমিই শেষ’। তারপরে বাকি কাজ বান্দার এবং মুমিন মুসলমানের। এই যে পপুলার কালচার তার মধ্যে কি পরিমাণে এগুলো কাজ করে, প্রতিনিয়ত আমার দেখি যে বলবান, শক্তিমান একজন এসে দুর্বলকে উদ্ধার করছে। হ্যারি পটার, স্পাইডার-ম্যান এগুলো তো আসলে এই সিম্বল। এই সিম্বল গুলো কাজ করে কারণ খ্রিস্টীয় ধর্মের মধ্য এই চিন্তাটা গভীরভাবে আছে। মুসলমানদের এই ভুত কেন তৈরি হল। ইসলামে তো মাসাইয়া চিন্তা নাই। খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে তো মৌলিকভাবে চিন্তাটা আছে। ত্রাণকর্তা আবার আসবেন। তার পুনরাগমন ঘটবে। আমাদের কার পুনরাগমন ঘটবে? ইসলামের চিন্তার সাথে ইতিহাস চিন্তার এটাই মৌলিক তফাৎ। এখানে ইতিহাসের কর্তা হওয়ার জন্য আর কারো ফিরে আসার প্রয়োজন নাই।

অনেকে হয়ত বলবেন ইজতিহাদের একটা ধারনা আছে। ইজতিহাদের চিন্তাটা আসলে কি? যিনি নবায়ন করবেন বলে আমরা বলি। যিনি নবায়নের কাজ করেন তাকে আমরা মুজাদ্দিদ বলি। কিন্তু একজন আসবেন তিনিই মুজাদ্দিদ ব্যাপারটা তো তা না। যিনি করেন তিনিই মুজাদ্দিদ।

আমরা মাকাসিদ নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম, মাকাসিদের আলোচনার সাথে এ দুটো বিষয় প্রাসঙ্গিক। আমরা যখন শরিয়া নিয়ে আলোচনা করব, শরিয়ার তো একটা দর্শন আছে, তার একটা পদ্ধতি আছে। যেগুলোকে তার উসুল হিসেবে গণ্য করা হয়। শরিয়া ব্যাপারটা আমরা যে কারণে বুঝতে চাচ্ছি সেটা হল, ইসলামী চিন্তার মধ্যে রাজনীতি, এবং রাষ্ট্র ও আইনের ধারনার জায়গাটা কি এবং এর উদ্দেশ্যটা কি। সংবিধান নামক ধারনার সাথে আমরা সারা দুনিয়ার মানুষ কবে থেকে পরিচিত হয়েছি। ফলে কবে থেকে কোরানকে সংবিধান বলে বা আইন আকারে দেখছি। ফলে এগুলোকে ঐতিহাসিকভাবে অনুসন্ধানমূলক একটা কাজ করতে হবে। আর ইসলামের ভিতরে চিন্তাটা কিভাবে ধারাবাহিকভাবে তার ঐতিহ্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। তার কাছে আসলে কি প্রবলেম ছিল? তার কাছে কি রাষ্ট্র প্রবলেম ছিল? নিশ্চয় তার কাছে রাষ্ট্র প্রবলেম ছিল না। রাষ্ট্র তো প্রবলেম হয়েছে যখন আমরা কলোনি ব্যবস্থার মধ্যে গিয়েছি। তাহলে ইসলামে শরিয়ার চিন্তা কি রাষ্ট্র নামক ধারনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে? তাহলে কি কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, কি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছে এবং কিভাবে সে এই জিনিসটাকে তৈরি করেছে। যেমন আধুনিক রাজনীতির মধ্যে যখন রাষ্ট্র নামক ধারনা গড়ে উঠেছে তাকে একটা পদ্ধতিগত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য পার্লামেন্ট করেছে, বিচার বিভাগ করেছে, নির্বাহী বিভাগ করেছে। তাহলে ইসলামের ঐতিহ্যের মধ্যে কিভাবে জিনিসটা গড়ে উঠেছে?

অনেকেই মনে করে যে রাষ্ট্র বুঝি আইনের বিষয়। এ কারণে সবাই মাথা ঘামিয়ে ফেলছে এটা সার্বভৌমত্বের সমস্যা মনে করে। যদি রাজনীতি বলতে এর অনিবার্য রূপ মনে করা হয় রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ধারনার সাথে সার্বভৌমত্ব ধারনাকে একাকার এবং অনিবার্য করে ফেলা হয়, তখনই আমরা একটি ফাঁদে গিয়ে আটকাই। আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মওদুদী আধুনিক রাষ্ট্র বুঝতে মারাত্মক ভুল করছেন। তিনি যথেষ্ট প্রতিভাবান ছিলেন, এতটুকু বুঝতে পারছেন যে রাষ্ট্রই হল এখন প্রবলেম। কিন্তু রাষ্ট্র বুঝতে গিয়া তিনি জটিলতা তৈরি করেছেন। তিনি মনে করেছেন রাষ্ট্র হল একটা আইনি ব্যাপার, এবং যেহেতু পশ্চিমা চিন্তার মধ্যে গড়ে উঠেছে যে আইন হল একটা সার্বভৌম কর্তৃত্বের উৎস থেকে জাত ব্যাপার, ফলে সার্বভৌম কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি শুরু করে দিলেন তাঁর আলোচনা। কোরান শরীফ থেকে খুঁজে বের করলেন উলুহিয়াত, উলুহিয়াত থেকে আইন; আইন হতে হবে সার্বভৌম, এটা হতে হবে আল্লাহর। অনেকে তো এটাকেই মনে করেন, ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার মৌলিক অনুমান। পশ্চিমা আইনের দর্শনের মধ্যে যে অনুমান সে অনুমানটাকেই আনক্রিটিকালি গ্রহণ করে নিয়েছেন, করে নিয়ে তার সাথে ইসলামের বিরোধটাকে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু অনুমানটাকে ঐ অনুমানের মত গ্রহণ করার মধ্যেই একটা প্রবলেম আছে । 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।