মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ্
ইসলামে আইনের ধরনাটা আসলে কি, তা জানা-বুঝা ব্যতীত ইসলামে রাষ্ট্রের ধারনাটা পরিষ্কার করা সম্ভব না। বিষয়টি বিবেচনা করেই গত ৫ মার্চ চিন্তা পাঠচক্রের নির্ধারিত বিষয় ছিল মাকাসিদ আশ-শরীয়া বা শরীয়তের উদ্দেশ্য। আলোচনা করেন রাসেল ও জোবায়ের আল মাহমুদ। শুরুতে রাসেল মাওলানা আবদুর রহিমের ‘ইসলামী শরীয়তের উৎস’ বইটা নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর জোবায়ের আল মাহমুদ ড. জাসের আউদার ‘মাকাসিদ আল শরীয়া এজ ইসলামিক ল’ বইটার উপর প্রাথমিক আলোচনা করেন।
রাসেল- শরীয়া শব্দের অর্থ এমন একটা পানি যেখানে পিপাসার্ত মানুষ একত্রিত হয় এবং সে পানি পান করে। পারিভাষিকভাবে শরীয়া বলতে বোঝায় ইবাদত এবং মোয়ামেলাত সম্বদ্ধে যে বিধিবিধানগুলা দেয়া আছে সেগুলোকে। মাওলানা আবদুর রহিম বলছেন যে, পাঁচটি বিষয়ে শরীয়া সবসময় লক্ষ রাখে। এগুলো হল দ্বীন, প্রাণ, বংশ, ধন-মান ও বিবেক-বুদ্ধির স্বাধীনতা। এগুলোকে অপরিহার্য করে দেয়ার পিছনে প্রধান কারণ হল, মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। সে যদি নিজের মত করে শরীয়া তৈরি করে তাহলে সেখানে অসংগতি থাকবে।
এবার শরীয়া-এর বিস্তারিত আলোচনায় আসি। আমরা আইন মানে যা বুঝি শরীয়া কিন্তু ঠিক তা নয়। শরীয়া আরো অনেক অনেক বিস্তৃত। মোটা দাগে শরীয়া তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। এক. আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়াবলী, দুই. নৈতিক চরিত্র সংক্রান্ত বিষয়াবলী, তিন. পার্থিব কাজ-কর্ম সংক্রান্ত বিষয়াবলী।
এবার আসা যাক ইসলামী ফিকাহ্ বিষয়ের আলোচনায়। ফিকাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হইল বোঝা, অনুধাবন করা, জানা এবং কোন একটা বিষয় সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে সেটা সম্পর্কে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করা। ইসলামী পরিভাষায়, শরীয়তের মৌলিক দলীলসমূহের ভিত্তিতে বাস্তব কাজ-কর্ম সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান-ই হল ফিকাহ্। ফিকাহ্কে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ইবাদাত ও মুয়ামিলাত। ইবাদাত হল যে কাজের প্রধানত উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহ তায়ালা। আর মুয়ামিলাত হল যে কাজের প্রধানত উদ্দেশ্য মানুষ নিজেই।
ফিকাহর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বা সমষ্টির প্রাধান্য দেয়া।
শরীয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল দুটি। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং মানব কল্যাণ। আপনি মানুষের কল্যাণ করলেন কিন্তু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভাল হল না সেটা যেমন শরীয়া হবে না; ঠিক তেমনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রেখে মানুষের কল্যাণ করলেন না, সেটাও শরীয়াহ্ হবে না।
ইসলামী শরীয়তের ইতিহাস কোর’আন নাযিল হবার ইতিহাসের মতই। পরবর্তীতে শরীয়তের ইতিহাস বলতে আমরা যা জানি, তা আসলে ফিকাহ্ শাস্ত্রের ইতিহাস। রাসূল (স) এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ফিকাহ্ শাস্ত্রে ক্রমবিকাশ ঘটেছে। সাহাবীদের যুগ থেকেই ফিকাহ্ বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তাঁরা মূলত তিনটি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। ১) কুর’আন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে ২) অন্য বিধানাবলির সাথে তুলনা করে ৩) নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে।
সাহাবাদের যুগে দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। কোন কোন সাহাবা হাদিসের আক্ষরিক অর্থটা নিতেন। আবার কিছু কিছু সাহাবা শুধু বাহ্যিক অর্থটাই নিত না তাৎপর্য বুঝে সে হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতেন। যারা আক্ষরিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন তাদেরকে বলা হত আহলুল হাদিস। আর যারা হাদিসের তাৎপর্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন তাদেরকে বলা হত আহলুল রায়। এ ধরনের দুইটা দল আল্লাহর রসুলের সময়ও দেখা যেত। খন্দকের যুদ্ধের পর রাসুল (স) কিছু সাহাবীকে বললেন যে, ‘বনু কুরাইজায় পৌঁছার পূর্বে কেউ আসরের সালাত পড়বে না’। পথে আসরের সময় হয়ে যাওয়ায়, একদল সাহাবী বললেন, বনু করাইজা পৌছা ব্যতীত আমরা আসরের সালাত পড়ব না; তাতে সালাতের সময় যদি চলেও যায় তবুও। অন্য দল বললেন, না; আমরা বরং এখানেই আসরের সালাত পড়ে নিব। পরবর্তীতে রাসূলের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করার পরেও তিনি কোনো একটি দলকেও ভৎসনা করেন নি।
রসুলের যুগ শেষ হল, সাহাবাদের যুগ শেষ হল, তারপরে আসল তাবেঈনদের যুগ। এ যুগের শুরুতে ফিকাহবিদদের জন্ম হচ্ছে, আস্তে আস্তে নতুন মাজহাব আর ফিকাহ যুগ শুরু হচ্ছে। মাজহাব আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক মাজহাব; একজন ব্যক্তি চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে কিতাব লিখেছে। আরেকটা হল দলগত একটা মাজহাব যেমন আমরা চার মাজহাবের কথা বলি। এ চার মাজহাবে শুধু ব্যক্তিগত না। ঐ কেন্দ্রিক যারা চিন্তা ভাবনা করত তাদেরও চিন্তা ভাবনা মতামত সব আছে। এ চার মাজহাবের কমন বৈশিষ্ট্য হল তারা প্রথমে যদি কোন সমস্যায় পড়তেন এর সমাধানের জন্য কোরানে যেতেন, কোরানে না পেলে হাদিসে যেতেন, তারপরে যেতেন ইজমায়, তারপরে কিয়াসের পক্ষে ছিল, কেউ বিপক্ষে ছিল। আর সাহাবিদের ক্ষেত্রে তারা কোন কিছুর জন্য কোরানে যেতেন,তারপরে হাদিসে যেতেন, তারপরে ইজতাহাদে যেতেন ইজতাহাদে বসে যখন কোন হাদিস পেতেন সেই হাদিসটা গ্রহণ করতেন। ইমাম মালেক হাদিসকে ব্যাপক গুরুত্ব দিতেন বলে তাঁকে আহলুল হাদিস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর ইমাম আবু-হানিফা ইজমা এবং কিয়াসকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তারপরে আসল ইমাম শাফী, তিনি হাদিসকেও গ্রহণ করতেন আহলুল রায়কেও গ্রহণ করতেন। তারপরে আসল হাম্বলী মাজহাব, উনিও একই সিলসিলায় চিন্তা গবেষণা করতেন। প্রথমে কোরানে যেতেন, তারপর সমাধান না পেলে হাদিসে যেতেন, তারপর ইজমায় যেতেন, তবে তার একটা বৈশিষ্ট্য হল সাহাবিদের ‘আসার’ মানে যে বিষয়ে সবাই একমত হয় নি হয়তোবা অধিকাংশই একমত সে আসার গুলাকে উনি বেশি গ্রহণ করতেন। তারপরে আসল জাহেরী মাজহাব। ইমাম জাহেরী এসে বললেন কিয়াস চলবে না। কিয়াস হল একটা ঘটনা বর্তমানে ঘটেছে সেটা আগে ঘটে নি কিন্তু কোরান হাদিসে ভিত্তিতে একদম অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া এটা জায়েজ হবে কি হবে না। যেমন মদ হারাম করছে কোরান শরীফে কিন্তু ইয়াবা হারামের ব্যাপারে কোরান হাদিসে কিছু নাই। এখন ইয়াবা কি হারাম হবে না হালাল হবে। তিনি বলছেন কিয়াস করতে গেলে তিনটা শর্ত পূরণ করতে হবে। একটা হল অকাট্য দলিল থাকতে হবে, আরেকটা হল কারণ থাকতে হবে, আরেকটা হল নতুন ঘটনা হতে হবে। তো নেশা হচ্ছে তাই যা মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়, রসুল আরেকটা কথা বলছেন যা বেশি খেলে নেশা হয় তা অল্প খেলেও হারাম। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মদের কারণ এবং ইয়াবার কারণ একই এ জন্যে এটা হারাম। জাহেরী মাজহাবে তিনি বলছেন যে, এ কিয়াস চলবে না। পরবর্তীতে ইমাম জাহেরী মারা যাওয়ার পরে তার অনুসারীরা কিয়াসের দিকে চলে আসছে।
তারপরে হানাফি মাজহাব। ইমাম আবু হানীফার মাজহাবের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তিনি যখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইতেন, তখন তাঁর ছাত্র থেকে শুরু করে সবাইকে বলতেন যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তটা কি হবে? সবাই মিলে বসতেন তারপরে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐ সিদ্ধান্তের আলোকে মাসালা নির্ধারণ করতেন। তাঁর মাজহাবের আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তিনি সামান্য দুর্বলতা থাকলেও ঐ হাদিস গ্রহণ করতেন না।
ফিকাহর ব্যাপারে মতপার্থক্যগুলো হলেও তাদের বিনয় ছিল অসম্ভব রকমের। আমি চার ইমামের কিছু কোটেশন দেব। ইমাম আবু হানিফা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতেন যে- ‘আমি জানি আমারটা একটা মত মাত্র। আমার শক্তি সামর্থ্যের বিচারে এই মতই হচ্ছে সর্বোত্তম। কেউ যদি এর চাইতে অধিক যথার্থ মত পেশ করতেন তবে সেটাই হবে যথার্থ, আমারটা হবে অগ্রহণযোগ্য।
ইমাম মালেক বলেন- “আমি একজন মানুষ ছাড়া কিছু নই। আমার ভুলও হতে পারে, আবার যথার্থও হতে পারে। কাজেই তোমরা সকলে অবশ্যই আমার মতের যথার্থতা বিচার বিবেচনা করে দেখবে। যে মত কোরান-সুন্নাহ মোতাবেক হবে কেবল তাই গ্রহণ করবে। আর যা এ দুটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাকে তোমরা বর্জন ও পরিহার করবে”।
ইমাম শাফী বলতেন- “তোমরা আমার মত গ্রহণের জন্য নিজেদের বাধ্য মনে করবে না। আমার মাজহাবের বিপরীত কোন হাদিস যদি সহীহ হয়। তাহলে তোমরা তাই গ্রহণ কর এবং মেনে চল। এবং জেনে রেখ সেটাই আমার মাজহাব”।
ইমাম হাম্বল বলতেন- “তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারগুলো নিজেরাই বিচার বিবেচনা করে দেখ। কেননা যে লোক নির্ভুল ও নিষ্পাপ নয় তার বাধ্যতামূলক ভাবে অনুসরণ করা অত্যন্ত অপছন্দনীয়”।
ইসলামী শরীয়তের মৌল উৎস তো আমরা জানি কোর’আন, কোর’আন সম্পর্কে মাওলানা আবদুর রহীম কিছু আলোচনা করছেন। কোরান সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এবং এর প্রত্যেকটা শব্দ যেভাবে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রসুল যখনই যে ওহী পেতেন, সে ওহী সাহাবীদের দ্বারা লিখে রাখতেন।। সাহাবিরা লিখতেন এবং মুখস্থ করতেন। রসুলের ইন্তেকালের পরে আবু বকর এগুলো সব নিয়ে একটা কপি করলেন। তারপরে ওসমান (রাঃ) এসে ঐ কপিটা রেখে বাকি কপিগুলা পুড়িয়ে ফেললেন।
তারপরে শরীয়ার দ্বিতীয় উৎস হল হাদিস। বলা হয় যে হাদিস রসুলের যুগে সাহাবিরা মুখস্থ করে রাখতেন কিন্তু লিখতেন না যদি কোরান হাদিস মিলে যায়। আবার বলা হয় যে, লেখাটা সবার জন্য নিষিদ্ধ ছিল না। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হাদিস লিখে রাখতেন। তারপর এক যুদ্ধে অনেক সাহাবা শহীদ হওয়ার কারণে ওমরের আমলে সাহাবিরা হাদিস সংকলন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এরপরে আব্বাসিয় আমলে এসে হাদিস পুরোপুরি সংকলিত হয়।
শরীয়তের তৃতীয় উৎস হইল ইজমা। সাহাবিরা কোন বিষয়ে যখন সবাই একমত হতেন, সেটা হল ইজমা। আর কিয়াস হল চতুর্থ উৎস। এর বাইরে আনুষঙ্গিক আরও কিছু উৎস আছে যেমন ইজতিসান। আরেকটা হল জারিয়া। জারিয়া হল কোন জিনিস পর্যন্ত পৌঁছার একটা ওসিলা। আরেকটা হল ইজতিসাব। আরেকটা হল ইজতিহাদ। কোরান হাদিসে স্পষ্ট দলিল থাকার পরে ঐ বিষয়ে ইজতিহাদের কোন দরকারই নাই। মদ খাওয়া হারাম। এটা নিয়ে আর কোন ইজতিহাদের দরকার নাই। ওষুধ হিসাবে বাদে সামান্য পরিমাণ মদও হারাম।
মুসতাইন জহির- এই যে আপনি দুটো কথা বললেন, একটার সাথে আরেকটা মিলল না। একটা হচ্ছে যদি কোন বিষয় পরিষ্কারভাবে হারাম হয় যেটা নিয়ে আলোচনারই কোন জায়গা নেই তাহলে সেটা ওষুধ হয় কিভাবে? যদি কোন জিনিস হারাম হয় সেটা তো অন্য কোন কারণে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার মানে আপনি দুইটাকে কন্ডিশনাল করলেন। এটা ইন্টেনশানালি বলছি না ক্যাটাগরিকাল সমস্যার কথা বলছি। আচ্ছা আপনি বলেন।
রাসেল- আচ্ছা। আকিদা বিষয়ে ইজতিহাদের কোন প্রয়োজন নাই। আল্লাহ এক, আল্লাহতে বিশ্বাস, রসুলে বিশ্বাস, আখেরাতে বিশ্বাস এগুলোতে আর ইজতিহাদের প্রয়োজন নাই। নতুন নতুন যে সমস্যা আমাদের সামনে আসতেছে এগুলোর ইজতিহাদ করা যেতে পারে। আরেকটা হল পরিস্থিতির আলোকে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু আইনগত পরিবর্তন আসে। একবার এক সাহাবা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মদ খেয়েছেন। সবাই শাস্তি দিতে চাইলে একজন বলল এখন দেয়া যাবে না। যুদ্ধকালীন সময়ে মদ খাওয়ার শাস্তি এখন দেয়া যাবে না। ওমর (রাঃ) একটা পত্র পাঠিয়েছেন যে, যুদ্ধকালীন সময়ে কাউকে কোন অপরাধের জন্য শাস্তি দেবে না। তার মানে এই না যে তার শাস্তি পরবর্তীতে হবে না। আরেকটা উদাহরণ হল, একবার ওমর (রা:) সময় অভাব অনটনের কারণে তিনি চুরির জন্য হাত কাটা নিষিদ্ধ করে দিচ্ছিলেন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আইনের এধরনের পরিবর্তন হতে পারে।
মুসতাইন জহির- এই যে মেথডলজিটা আপনি এতক্ষণ আলোচনা করলেন তাতে প্রধানত যে প্রস্তাবনাটা দেয়া হয়েছে সেটা হল, যেখানে কোরান পরিষ্কার সেখানে হাদিসে যাওয়ার সুযোগ বা প্রয়োজন নাই। যদি স্পেসিফিকালি কোরান থেকে কিছু বোঝা বা জানা যাচ্ছে না তাহলেই কেবল সেখানে হাদিসের ব্যাপার আসছে। আজকে আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করব না। এসব ব্যাপারে আমরা পরে আসব।
আমরা এতক্ষণ শরীয়া সম্পর্কে একেবারে না জানলেই নয়, এবং সাধারণ ভাবে প্রচলিত যে ধারনা সেটার সাথে পরিচিত হয়েছি। এগুলো আরও অনেক ডিটেইল আলোচনা করা যাবে; আমরা সেখানে যাব। পদ্ধতিগতভাবে এখন আমরা হয়ত বই কেন্দ্রিক করব পরে আমরা ধারনা কেন্দ্রিক করব। যেমন ‘কোরান হল আমাদের সোর্স’, তাহলে সোর্স কথাটা ধারনাগতভাবে কি এবং অকাট্য কথাটার মানে কি। কোরানে আছে বললেও এটার মানেটা কি দাঁড়ায়। আছে কথাটা কে কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ডেফিনেশনগুলো শুনলে মনে হয় বুঝি জিনিসটা সেটেল, এগুলো সেটেল না ডেফিনেটলি এগুলো সম্পর্কে এক্সটেন্সিভ ডিসকাশন আছে এগুলা সম্পর্কে অথরেটেটিভ স্কুল অফ ইন্টারপ্রেটেশন আছে, সে আলোচনাগুলোয় আমরা যাব। আমি এখন জোবায়েরকে এ আলোচনাটার পরের ধাপের আলোচনা করতে বলব।
জোবায়ের- আমি যে কথাগুলো বলব এগুলো বলব জাসের আউদার রেফারেন্সে। এগুলোর দায় আমি নিচ্ছি না। জাসের আউদা বলেন, সবাই শরীয়া, ফিকাহ এবং কানুন এই তিনটাকেই অনুবাদ করে ইসলামী আইন আকারে। কিন্তু আইন-এর স্পেসিফিক ইসলামে ব্যবহৃত শব্দ হল কানুন। এটা শরীয়া না, আবার ফিকাহও না। তাহলে শরীয়া কি? ফিকাহ কি? এবং কানুন কি? সেটা আলাদা করে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করছেন। সংক্ষেপে যদি বলি শরীয়া হচ্ছে একটা পথ বা পদ্ধতি। যা বিভিন্ন নবীদের জন্য স্পেসিফিকভাবে পাঠানো হত তা হচ্ছে শরীয়া। আর শরীয়াকে বোঝার যে পদ্ধতি তাকে বলা হয় ফিকাহ। কানুন হচ্ছে যা আমরা আইন বলে জানি। এখন শরীয়া বোঝার যে পদ্ধতি এটা হচ্ছে ফিকাহ। আর এ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যে রুলিংসগুলো বের হয় সেটা হচ্ছে কানুন। আমরা এ তিনটার শাব্দিক অর্থ জানলাম।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এর মতে, ‘শারিয়াহ্ গড়ে ওঠে মানুষের প্রজ্ঞা ও কল্যাণের উপর ভিত্তি করে। শারিয়াহ্ তাই যার মধ্য আছে ন্যায়, দয়া, কল্যাণ ও প্রজ্ঞা। যদি কোনো কিছু ন্যায় না হয়ে অন্যায় হয়, দয়া না হয়ে কঠোরতা হয়, কল্যাণ না হয়ে অকল্যাণ হয় কিংবা প্রজ্ঞা না হয়ে বাচালতা হয়, তাহলে তা শারিয়াহ্ নয়’।
ফিকহ্ শব্দের অর্থ গভীর জ্ঞান বা বুঝ। ইসলামী শারিয়াহ্কে ভালোভাবে বোঝার যে পদ্ধতি তাকেই ফিকহ্ বলে। অন্যদিকে কানুন শব্দের অর্থ আইন। ইসলামী শরিয়াহ্কে ভালোভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে যে নিয়ম-কানুন আবিষ্কার করা হয়, তাকেই কানুন বা কেউ কেউ হুকুম বলেন।
শারিয়াহ্ আল্লাহ তায়ালা দ্বারা নির্ধারিত, অপরিবর্তনশীল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু ফিকহ্ মানুষের আবিষ্কার, স্থান-কালের বিভিন্নতায় এর পরিবর্তন হয়। ফলে কখনো কখনো কানুনেরও পরিবর্তন হয়। যেমন, কোনো এক সময় উপমহাদেশের কোনো কোনো ধার্মিক মানুষও সিগারেট খেতেন। কিন্তু যখন জানা গেল যে, সিগারেট মানুষের মৃত্যু ঘটায়, তখন না মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
আলেমদের ওয়াজ-মাহফিলের ফলে শারিয়াহ্-র সংজ্ঞা ও উৎস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছু ধারনা থাকলেও শারিয়াহ্-র উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কোনো কিছু জানি না বললেই চলে। শারিয়াহ্-র উদ্দেশ্যকে আরবিতে ‘মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ বলা হয়।
৪৭৮ হিজরি সময়ে ‘মাকাসিদ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ইমাম আব্দুল মালেক আল-জুয়াইনি। তিনি মাকাসিদ শব্দটিকে ব্যবহার করেন ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ শব্দের অর্থে। পরবর্তীতে তাঁর ছাত্র ইমাম আবু হামিদ আল-গাজালী মাকাসিদ শব্দটিকে আরও বিস্তৃত করেন। তারপর ইমাম ফখরুদ্দিন আল-রাজী, ইমাম কারাফি, ইবনে আশুর, ইমাম ইবনে তাইমিয়া সহ অসংখ্য ইসলামী চিন্তাবিদ মাকাসিদ বিষয়ে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যান, এবং মাকাসিদ-এর ধারনাকে উন্নত থেকে উন্নতর পর্যায়ে নিয়ে যান।
আজকে আমরা বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। শুধু মাকাসিদ এ শরীয়া আলোচানাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা একটু বলব প্রথমত, দেশের এই সংকট-কালীন সময়ে ‘মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্’ জানার ফায়েদা কি? এককথায়, আমরা বাঙালিরা সব সময় কোনাকোনি পথ খুঁজি; ফলে সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান পাই না এবং একই সমস্যা বার বার আমাদের সামনে আসে। ইসলামকে যারা রাজনৈতিকভাবে বুঝতে চান, তাদের জন্যে মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ জানা-বোঝা একান্তই প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, ইসলামের বিভিন্ন ইবাদাত-বন্দেগি, আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন কেনো মুসলিমদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ তা জানার জন্যেও মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ জানা প্রয়োজন। কিংবা কোন কাজটিকে মুসলিমদের বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত আর কোন কাজটি কম গুরুত্ব দেয়া উচিত, তা বোঝার জন্যেও মাকাসিদ প্রয়োজন।
মুসতাইন জহির- ঠিক আছে। আমি একটু সারমর্ম করি। রাসেল একটা চমৎকার কাজ করছে, আবদুর রহিম সাহেবের বইটা পরিচয় করে দেওয়াটা দরকার ছিল। বাংলাদেশে যারা ইসলামী চিন্তা ভাবনা বাংলা ভাষায় চর্চা করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি একজন গুরুত্বপুর্ণ লোক। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে বাংলা ভাষায় এগুলো চর্চার গুরুত্বটা কি। তারা যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন সে সময়ে তাদের কাছে যা যা জিনিসপত্র সহজলভ্য ছিল সে সব জায়গা থেকে তারা আলোচনা করেছেন। এটারও অনেক ত্রুটি আমরা ধরতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সহজ বাংলায় আলোচনা করার ক্ষেত্রে আমি যে কয়জনকে চিনি তার মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহিম অন্যতম।
আমরা সিস্টেমেটিক আলোচনায় ঢুকছি। জোবায়ের শরীয়া এবং মাকাসিদকে লক্ষ করবেন আলাদা বলেছেন। কিন্তু আবদুর রহিমও যখন আলোচনা করছেন উনি কিন্তু আসলে শুরুতে মাকাসিদের কথাই বলেছেন। শরীয়ার উদ্দেশ্য হল এই পাঁচটা। তারপর শরীয়াটার উৎস কি উনি ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে পদ্ধতিগতভাবে মাকাসিদের আলোচনাটা আগে চলে। যদিও আমরা বলি মাকাসিদের আলোচনা শরীয়া আলোচনা না করলে বুঝা যাবে না।
এখন সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলি। ব্রডলি আমরা যেটা বলি ইসলাম, ইসলাম নিশ্চয় আর দশটা শাস্ত্রের মত না। এটা একটা ধর্ম। ধর্ম বললেও পুরাটা ধারণ করে না, যে কারণে আমরা বলি দ্বীন। মাকাসিদের প্রথম শর্তই হল দ্বীন। সেটার সাথে উনি যেটা বলেছেন ইবাদত এবং মোয়ামিলাত। ইবাদত হল আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক আর মোয়ামিলাত হল অপরাপর মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক। ইবাদতের জায়গা মোয়ামিলাতের জায়গা এগুলা কিন্তু আমরা খুব একটা ব্যাখ্যা করি নাই। আধুনিক যামানায় এসে আমরা দেখব যে বিশ্বাসের ক্ষেত্রটা যেটাকে আমরা বলি প্রাইভেট আর যেটা হল সমাজ যেখানে অপর দশজন মানুষের সাথে বাস সেটা পাবলিক বা পলিটিকাল। তাহলে ইবাদত এবং মোয়ামিলাতের জায়গা থেকে এটাকে কি একই জিনিস বলব নাকি আলাদা মনে করব। আলাদা মনে করলে কি অর্থে আলাদা? যেমন তিনি বলেছেন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে শরীয়ার একটা প্রভাব আছে, সর্বক্ষেত্রে যদি বলি তাহলে ইবাদত এবং মোয়ামিলাত বলে ভাগ করছি কেন? যখন থেকে আমরা পশ্চিমের রাজনৈতিক অধীনস্থতার শিকার হলাম তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে আসলাম, তখন থেকে ইসলামী চিন্তার মধ্যে নতুন যে চ্যালেঞ্জটার মুখোমুখি হলাম সেখান থেকে আজকের যামানা পর্যন্ত পুরো ইসলামী চিন্তার মধ্যে ফান্ডামেন্টাল তর্ক হল আল্লাহর আইন বনাম মানুষের আইন। শরীয়া আলোচনার মধ্যে কম বেশি এ আলোচনার অনুরণন দেখতে পাবেন। ‘আইন’, ‘আইনের উৎস’ সেখানে ‘মানুষ’ এবং ‘আল্লাহ’ এগুলা আমরা আলোচনা করব। তাহলে মানুষের আইন এবং আল্লাহর আইনের বিভাজন রেখাটা কিভাবে নির্ধারিত হয়। ইসলামী চিন্তাবিদরা কিভাবে পশ্চিমা চিন্তাকে দেখেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন। এখান থেকেই এসেছে, ‘আল্লাহর আইন চাই’। আমরা জিনিসটাকে কেন আইনের বিষয় আকারে দেখি? আগামী সপ্তাহে এ আলোচনাটা আমরা করব।