মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ -২

ইসলামে রাষ্ট্রের ধারণাটা জানার জন্যে আমরা মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ নিয়ে গত দু’সপ্তাহ জুড়ে আলোচনা করেছি। এই সপ্তাহে ( ১২ মার্চ) এ নিয়ে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা শুরু করেন জোবায়ের আল মাহমুদ।

জোবায়ের- গত সপ্তাহে আমি সংক্ষেপে শরিয়াহ্ কী, ফিকহ্ কী, এবং কানুন কী, এসব বিষয়ে কথা বলেছি। শরিয়াহ্, ফিকহ্ ও কানুনের মাঝে কী কী পার্থক্য আছে, তাও বলেছি। এ সপ্তাহে আমরা বিস্তৃতভাবে মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ বিষয়ে আলোচনা করব। একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। আমি আর রাক্বীব ভাই আসার সময় রাস্তায় অনেক যানজট ছিল। আসাদ গেটে এসে অনেকক্ষণ আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। কেনো? কারণ, ট্রাফিক পুলিশ লাল বাতি দেখে আমাদের গাড়িটি থামিয়ে দিয়েছে। এই যে লাল বাতি দেখে গাড়িগুলোকে থামিয়ে দেয়া হয়, এটাকে বলে আইন বা আরবি ভাষায় বলে কানুন। কেনো এই আইনটি করা হল? মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের জন্যে। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে এই আইনটির উদ্দেশ্য কী? তখন আমরা বলব, মানুষের নিরাপত্তা করা। ঠিক তেমনি ইসলামে অনেক আইন বা কানুন রয়েছে। যখন কেউ প্রশ্ন করে, কেনো এই আইনটা করা হল? তখন ইসলামের পক্ষ থেকে এর একটা উত্তর আসে। এটাকেই মোটা দাগে আমরা বলতে পারি, মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্।

মাকাসিদ শব্দটির প্রথম ব্যবহার নিয়ে গত সপ্তাহে বলেছি। এ শব্দটি প্রথম ১১৮৫ সালের দিকে ব্যবহার করেন ইমাম আবদুল মালিক আল-জুয়াইনি। পরবর্তীতে তাঁর ছাত্র ইমাম আবু হামিদ আল-গাজালি এ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার করেন। তিনিই প্রথম মাকাসিদকে তিন ভাগে ভাগ করেন। এক. দরুরিয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়; দুই. হাজিয়াত বা প্রয়োজনীয়; তিন. তাহসানিয়াত বা বিলাসবহুল। দরুরিয়াত বিষয়গুলোকে আবার পাঁচ ভাগ করেছেন ইমাম গাজালি। দ্বীন, জীবন, সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা ও পরিবার রক্ষা। কেউ কেউ এসে পরে আরেকটি যুক্ত করেছেন; সম্মান রক্ষা। শরিয়ার যে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথমে আমলে নিতে হবে দরুরিয়াত বিষয়গুলোকে। এর পর পর্যায়ক্রমে হাজিয়াত ও তাহসানিয়াত। 

বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এভাবেই শরিয়াহর উদ্দেশ্য বিচার করা হত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পর ইমাম শাতেবী এসে মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহ্ নিয়ে নতুন তত্ত্ব প্রধান করেন। তিনি শরিয়াহর উদ্দেশ্যগুলোকে একটি ভিন্ন উপায়ে ভাগ করেন। এবং মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহর আগের ও পরের তত্ত্বে বেশ কিছু পার্থক্য তুলে ধরেন। ইমাম শাতেবী মাকাসিদকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। সাধারণ মাকাসিদ, বিশেষ মাকাসিদ এবং আংশিক মাকাসিদ। সাধারণ মাকাসিদে যুক্ত হবে দরুরিয়াত, হাজিয়াত এবং ন্যায় বিচার –এর মত বিষয়গুলো। বিশেষ মাকাসিদে যুক্ত হবে অর্থনৈতিক লেন-দেন, সন্তান লালন পালন, বা ক্রিমিনাল ল –এর মত বিষয়গুলো। এবং আংশিক মাকাসিদে যুক্ত হবে ঈদ বা আনন্দের উৎসব জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো।

জাসের আউদা নতুন ও পুরাতন মাকাসিদের বেশ কিছু পার্থক্য তুলে ধরেন। যেমন, ইমাম গাজালির সময় মাকাসিদকে বিবেচনা করা হত আইন বা কানুনের একটি দার্শনিক সৌন্দর্য আকারে। কিন্তু ইমাম শাতেবীর সময় থেকে মাকাসিদকে মূল্যায়ন করা হয় আইনের ভিত্তি হিসাবে। দুই. পুরাতন মাকাসিদ মানুষের সামগ্রিক জীবনকে গুরুত্ব দিলেও বিশেষ বিশেষ বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্বারোপ করেন নি। তিন. পুরাতন মাকাসিদ সমাজের চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিত। চার. পুরাতন মাকাসিদে বর্তমানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয় নি; যেমন, ন্যায় বিচার, স্বাধীনতা ইত্যাদি। পাঁচ. পুরাতন মাকাসিদ ইসলামের মূল উৎসের চেয়েও ইসলামের ঐতিহ্যকে অনেক বেশি আমলে নিয়েছে।

মাকাসিদকে যখন থেকে ইসলামী আইন প্রণয়নের ভিত্তি আকারে সবাই দেখতে লাগলেন, তখন প্রশ্ন জাগলো, তাহলে কি মাকাসিদের আলোকে সালাত-সিয়াম সবই পরিবর্তন করা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইবাদতের ক্ষেত্রে মাকাসিদ-আশ-শারিয়াহর প্রয়োগ হবে না। শুধুমাত্র মুয়ামিলাতের ক্ষেত্রেই মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্কে আমলে নিতে হবে। এবার তাহলে বুঝতে হবে ইবাদাত কি আর মুয়ামিলাত কি? ইবাদাত হল যা প্রধানত আল্লাহ তায়ালার জন্যেই পালন করা হয়। কোনো অমুসলিম তার জীবন যাপনের ক্ষেত্রে যা  করতে হয় না, কিন্তু মুসলিমদের জন্যে যা করা একান্তই কর্তব্য, তা হচ্ছে ইবাদাত। অন্যদিকে মুয়ামিলাত হল তাই, যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে করতে হয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি কিংবা জিনার শাস্তি এগুলো হল মুয়ামিলাত; আর এসব ক্ষেত্রে মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহর প্রয়োগ করতে হবে।

এবার আরেকটি প্রশ্ন আসল, রাসূল (স) –এর বিভিন্ন কাজের যে যে পদ্ধতি রয়েছে, তা কি মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে? তখন ইমাম কারাফি এসে রাসূল (স)-এর সকল কার্যাবলীকে চার ভাগে ভাগ করলেন। দায়ী হিসাবে রাসূলের (স)-এর কাজ; বিচারক হিসাবে; রাজনৈতিক হিসাবে এবং ব্যক্তি মানুষ হিসাবে। তিনি বলেন, রাসূল (স) ব্যক্তি মানুষ হিসাবে যা করেছেন, সে কাজের পদ্ধতি মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহর আলোকে পরিবর্তন করা যাবে। 

ইমাম শাতেবীর পর ইসলামের মূল উৎস সমূহের আলোকে কি কি বিষয় মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে বর্তমান আলেমদের বিস্তর গবেষণা আছে। ইমাম ইবনে আশুরের মতে মাকাসিদ হিসাবে ‘উম্মাহ’কে যুক্ত করতে হবে। রশিদ রিদার মতে ‘ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন’ বা নারীর অধিকার যুক্ত হতে পারে। ইউছুফ আল কারদাওয়ীর মতে ‘মানবিক মর্যাদা’ যুক্ত হতে পারে। বিভিন্ন আলাম বর্তমানে বিভিন্ন মাকাসিদ যুক্ত করার পক্ষে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরছেন।

মুসতাইন জহির- আপনি একটু বিস্তারিত বলেন, যারা নতুন নতুন জিনিস মাকাসিদ হিসাবে যুক্ত করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছেন, তাঁদের আসলে যুক্তিটা কি?

জোবায়ের- তাঁদের যুক্তি হল কোর’আনের সূরা বাকারার পঁচাশি নম্বর আয়াত। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সহজ কর, কঠিন কর না”। ইমাম গাজালি তাঁর মাকাসিদগুলো নিয়েছেন মূলত সুরা আন‘য়াম এর ১৫১ থেকে ১৫৪ নং আয়াত, এবং সূরা ইসরার ২৩ থেকে ২৬ নং আয়াত থেকে। কিন্তু জাসের আউদা দেখাচ্ছেন যে, পরবর্তীতে যারা মাকাসিদ নিয়ে বলছেন, তাঁরা দাবী করেছেন যে, এই আয়াতগুলোর মধ্যে মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ সম্পূর্ণভাবে আসে নাই। এবং ইমাম গাজালি যেভাবে ভাগ করছেন, সেভাবে বর্তমান সময়ের অনেকগুলো সমস্যার সমাধান করা যায় না অথবা কোরানের মুল স্পিরিটটা ঠিক থাকে না। এ কারণে পরবর্তীতে বিভিন্নজন তাদের ইজতেহাদ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রস্তাব প্রদান করছেন। এবং তারা বলেন ইজতেহাদের দরজা যেভাবে বন্ধ হয় নাই, ঠিক তদ্রূপ শরিয়াহর মাকাসিদ কি হবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নাই। মাকাসিদ নিজেই বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হতে পারে; যার ভিত্তিতে অন্যান্য কানুনগুলোও পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, আমি ফ্রিডম, জাস্টিস, রেশনালিটির কথা বললাম। এরকম আরও অনেক কিছু হতে পারে; যার উৎস হবে অবশ্যই কুর‘আন।

মুসতাইন জহির- আচ্ছা। এ জিনিসগুলো কি? এগুলো যুক্ত করতে হচ্ছে কেনো? যেমন ইউসুফ আল কারযাভী বলছেন ডিগনিটি, এটাকে মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্’র অন্যতম প্রধান উপাদান করতে হবে কেনো? কিংবা এর আগে কেনো করা হয় নাই? এবং এটা না করলে কি সমস্যা? আধুনিক যামানায় এসে পশ্চিমা চিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শনে এগুলোকে অধিকার আকারে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এখানে যখন উনারা এগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলছেন, তখন কি আকারে অন্তর্ভুক্ত করতে বলছেন?

জোবায়ের- আমি আগেই বলেছি। ইমাম গাজালি মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহ্ কে দেখতেন ইসলামী শরিয়াহর সৌন্দর্য হিসাবে। কিন্তু ইমাম শাতেবী বিষয়গুলোকে দেখতেন শরিয়াহ্-এর মূল ভিত্তি হিসাবে। এখানেই আসলে তাঁদের মৌলিক পার্থক্য। এ কারণে কিছু মাকাসিদ আগে যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এখন যুক্ত করা প্রয়োজন। 

মুসতাইন জহির- না আমি আলোচনাটা ঐ জায়গা থেকে তুলি নাই। ইমাম গাজালি বলছেন এই পাঁচটা জিনিস হল মাকাসিদ। এই পাঁচটা জিনিসকে রক্ষা করতে হবে। এই পাঁচটা জিনিস সুরক্ষা করা হলে কি হয়? আর না করা হলে কি হয়? এটা নিয়ে ইসলামী চিন্তার মধ্যে পরবর্তীতে আরো আরো অনেক জায়গা দেখতে পাচ্ছি। যেমন ধরা যাক অধিকার; আমরা বলি না, মৌলিক অধিকার? মানুষকে যদি বাঁচতে হয় এগুলো তার অধিকার হিসেবে দেখে এগুলো রক্ষা করার মধ্য দিয়েই মানুষ হিসেবে তার অস্তিত্বের তার সমৃদ্ধির এবং তার প্রয়োজনের জায়গাগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব। এর কোনোটার যদি হানি ঘটে, তাহলে সেখানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এটা এরকম একটা ধারনার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন ধরুন, জীবন রক্ষা করতে হবে, তারপরে তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এরকম আরও অনেক জিনিস আছে। ইমাম গাজালি যখন বললেন যে, মাকাসিদকে আমাদের সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। এই সামগ্রিকতার জায়গাটা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রটা কি হবে? এগুলা কেন দরকার? যেমন এরপরে এসে যারা বলছেন ‘স্বাধীনতা’ যুক্ত করা দরকার। এই স্বাধীনতা কেনো যুক্ত করা দরকার? এটা যুক্ত না করলে কি সমস্যা হয়? কার সমস্যা হয়? কেনো সমস্যা হয়?

জোবায়ের- জাসের আউদা মাকাসিদের আলোচনাটা এভাবে তুলে আনেন নাই। তাঁর আলোচনার ধরন হচ্ছে, পুরাতন ও নতুন মাকাসিদের কাঠামো কি হবে, তা নিয়ে। তিনি এ আলোচনায় প্রবেশ করেন নি যে, কেনো এখন নতুন নতুন মাকাসিদ যুক্ত করতে হবে। 

মুসতাইন জহির- আমি বলছি এই তর্কটা কার কাছ থেকে আমরা পেতে পারি? এ আলোচনাটা আছে কিনা? সহজ করে যদি মাকাসিদের ফিলোসফিটা কি হবে? এটা আমরা কার কাছ থেকে পাব?

জোবায়ের- খুব সম্ভবত হাশিম কামালীর বইয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, আলোচনার মূল বিষয় হল, মুসলিমরা তাঁদের চিন্তার পরিবর্তনের কারণেই মাকাসিদ-আশ্-শারিয়াহর পরিবর্তন করতে চান। এই পরিবর্তনটা ইসলামের ভিতর থেকেই ঘটে। কেউ এখানে জোর করে ঘটায় না।

মুসতাইন জহির- গাজালির উস্তাদ জুয়াইনি-এর সময়ে মাকাসিদের আলোচনাটা কি পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হল? উনি কোনো প্রথম এইভাবে ভাগ করলেন? এবং নতুন একটা আলোচনার সূত্রপাত  করলেন যে, শরীয়ার একটা উদ্দেশ্য থাকা দরকার বা এটাকে একটা উদ্দেশ্যের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করা দরকার। আমি যতটুকু বুঝি, এর আগে পর্যন্ত প্রবলেম ছিল যে, ঠিক কি পদ্ধতিতে কোন একটা বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং সে সিদ্ধান্তটা কি ধরনের মূলনীতি ব্যবহার করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলোকে দালিলিক হিসাবে গ্রহণ করবেন এবং গ্রহণ করার জন্য ক্রাইটেরিয়া কি হবে এবং সেটা কারা প্র্যাকটিস করবে। তার মানে সেটা ছিল উপায়। কিভাবে আমরা একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। গাজালি এসে এটাকে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন। এই যে সিদ্ধান্তগুলো আমরা নিচ্ছি এর উদ্দেশ্যটা কি? সেখানে আপনি বললেন ‘পাবলিক গুড’। এই ক্রাইটেরিয়া আকারে পাবলিক গুডের আলোচনাটা কি পরিপ্রেক্ষিতে কেন উনারা শুরু করলেন। আগে ছিল মাধ্যমের আলোচনা; এখন এটা উদ্দেশ্যের আলোচনায় চলে গেল। এ আলোচনাটা তখন কেন আসল? জাস্ট একটা ইন্টেলেকচুয়াল জাম্প নাকি হিস্টরিকাল একটা জায়গা আছে? একটা ইন্টেলেকচুয়াল জাম্প তো না, তার কিছু বাস্তবিক কারণ বোঝা ও অনুসন্ধান করা দরকার।

গাজালি যখন ঠিক করেছেন পাঁচটা মাকাসিদ। তিনি এ পাঁচটাকে ফান্ডামেন্টাল হিসেবে দেখিয়েছেন। এগুলোকে তিনি বলছেন পাবলিক গুডের জন্য এসেনশিয়াল। পাবলিক গুডটা হল ক্রাইটেরিয়া। পরবর্তীতে যারা আলোচনা করেছেন তারা তো আসলে পাবলিক গুডের জন্য আরো কতগুলো জিনিসকে এসেনশিয়াল মনে করেছেন। এখন গাজালির ক্রাইটেরিয়া চেঞ্জ করা যাবে না এটা ইসলামিক মেথডলজির মধ্যেই কোন আর্গুমেন্ট না। আমি বলছি যে ক্রাইটেরিয়া ইটসেলফ আমাদের আলোচনার জায়গা হওয়া উচিত। যেমন পাবলিক গুড কথাটা আমরা ইসলামের চিন্তার মধ্যে কিভাবে বুঝব? আমরা পশ্চিমা চিন্তার মধ্যে, রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে তো বুঝি। গ্রিক  কনসেপ্টটা যখন ছিল যে-'গুড লাইফ'। পলিসটাই হল সেখানে গুড লাইফটা নিশ্চিত করা; এবং গুড লাইফ কখনই নিশ্চিত করা যায় না যদি না সেটা পাবলিক গুড না হয়। কে কার কাছ থেকে এগুলো নিয়েছে, এত সরলীকরণের জায়গায় যাবেন না। গ্রিক চিন্তাটার এরকম একটা জায়গা ছিল। এখানে যখন ভাবনাটা এসেছে এটা কি নতুন কোনো ভাবনা? এ ভাবনারই আরেক ধরনের আনসার? এটার সাথে মিল-অমিল সব কিছু হতে পারে। ক্রাইটেরিয়াগুলা আমরা ক্যেটাগরিকালি কিভাবে বুঝব? পাবলিক গুডটা আমরা কিভাবে ঠিক করব?

আসুন বিষয়টা আমরা আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করি। আমরা মাকাসিদ বা ফিকাহর আলোচনা যখন করতে যাই, তখন আমরা কোরান শরীফের যে আয়াতগুলোর মধ্যে কোনো আদেশ বা নির্দেশ আছে সেই আয়াতগুলোকে চিহ্নিত করি। এই যে দেখুন, কনসেপচুয়ালি এসামশনটা হল কোন কিছুর ক্ষেত্রে আদেশমুলক যা বলা হয়েছে সেটা আইনের ব্যাপার। ফলে আমরা কোর‘আনের ঐ অংশগুলা দেখছি। এটা আমরা কম বেশি ইসলামের মধ্যে গেলেও পাব, অন্য জায়গায় গেলেও পাব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা বোঝা দরকার। সেটা হল অথরেটির সম্পর্কের জায়গা। এখন অথরেটির সাথে দুটো জিনিসের সম্পর্ক আমাদের বুঝতে হবে একটা হচ্ছে অথরেটির সাথে ডেলিগেশনের সম্পর্ক; যেমন কোর‘আনে বলা হয়েছে, তুমি এটা করবা না বা এটা কর, এই নির্দেশটা এজ সাচ ইন জেনারেল সবার জন্য। এখন এটা কি ওপেন টু ওবে এন্ড ডিসওবে? এটা নিশ্চিত করবে কে? তখন কিন্তু আপনি ফিজিকালি হিস্টরিকাল একটা বাস্তব অবস্থায় চলে আসেন। এখন পাওয়ারটা কি ডেলিগেটেড? কাউকে দেওয়া হয়েছে এটা নিশ্চিত করার জন্য?  তখন প্রশ্নটা চলে আসবে, কনক্রিট পাওয়ার কি ডেলিগেটেড পাওয়ার। তাহলে স্টেট কি এটা এনসিওর করার অথরেটি হবে? বা এরকম কোনো ফিজিক্যাল হিস্টরিকাল এজেন্সি? এটা কিভাবে সে ক্লেইম করবে? আদেশ নির্দেশের যায়গায় কোন তর্ক নাই, কিন্তু এটা যে এনফোর্স করবে এজ এ অথরেটি, তা তো ঐশী কোন ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত না। এটা তো সবার জন্যই দেওয়া হয়েছে, এখন পালন করা না করার জায়গাটা আপনি আইন দিয়ে বাস্তবে নিশ্চিত করতে চাইবেন; প্রয়োগ করতে চাইবেন; সেই ক্ষমতা তৈরি হবে কোত্থেকে? কিসের ভিত্তিতে? আমি যতদূর দেখেছি, শরীয়ার যারা আলোচনা করেছেন, তারা ক্লিয়ারলি এই জায়গাটায় খুব একটা কাজ করেন নাই। তারা অথরেটিটাকে এখানে ডিভাইড করেন নাই। যে কোন আদেশের মধ্যে একটা  অথরেটিটিভ স্টেটমেন্ট থাকে। কিন্তু যদি বলা হয় এটা কর; এটাও-তো একটা আদেশ। কিন্তু আদেশ মাত্রই তো আইন নয় বা অথরেটেটিভ নয়। যখন অথরেটিটিভ হয় এর সাথে আর বাকি দুইটা উপাদান যুক্ত হয়, এ দুইটা উপাদানতো আপনার যে কোন একটা আদেশ নির্দেশমুলক বাক্যের মধ্যে থাকে না।

ইফতিখার জামিল - সাহাবিদের সময়ে অথবা তার পরবর্তীতে মাকাসিদে শরীয়াহর চর্চা হয়েছে মাসালা চর্চার মাধ্যমে। মাসলা শব্দের অর্থ হল প্রশ্ন করা। বড় ব্যক্তি বা যারা আলেম তাদের কাছে মাসালা নিয়ে যাওয়া হত; তখন তারা প্রশ্নের উত্তর দিতেন।  এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা কখনো  হত আকিদাগত বা চিন্তাগত বিষয়ে; কখনো কর্মগত বিষয়ে অথবা ফিকাহ বিষয়ে। এভাবে যখন একটা বিশাল চর্চা হতে লাগল, এক সময় চারটা মাজহাব হল। কিন্তু পরবর্তীতে গাজালি অথবা গাজালির তিনশ বছর আগে ইবনে দাব্বুসি অথবা তারও আগে দুইশ আড়াইশর দিকে আক্কারফি দেখলেন যে, এই সিদ্ধান্তগুলি যে নেওয়া হচ্ছে এবং মাসালার উত্তর দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে একটা কারণ পাওয়া যাচ্ছে। একটা কারণের ভিত্তিতে মাসালার উত্তর দেওয়া হচ্ছে। ধরা যাক, দশটা বিশটা উত্তর দেওয়া হল, তখন এর মধ্যে একটা ‘সাধারণ’ দাঁড়িয়ে যায় বা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ঐ জায়গাটা থেকেই মূলত শুরু হয়েছে মাকাসিদের ধারনাটা। একটা মাসালা ধরে বাকি পাঁচটা ঘটনা বিচার করা হয়েছে। যখন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে প্রশ্নের উত্তর দেয়া হচ্ছিল, এর কারণগুলো এক সাথে হচ্ছিল, পরবর্তীতে তিনশ ত্রিশ বা চল্লিশের দিকে সর্বপ্রথম ইমাম দাব্বুসি একটা সংকলন করেন। এটা ছিল শাখাগত বা কর্মগত বিষয়। এটা দুইটা কারণে হয়েছে। প্রথমত, যাতে ইজতেহাদ করাটা সহজ হয়। আপনি যখন একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন তখন অনেক হাদীস না  বের করে নির্দিষ্ট যখন কারণ পেয়ে যাবেন এর ভিত্তিতে অনেকগুলো বিষয় বিচার করতে পারবেন।

এগুলো আস্তে আস্তে হচ্ছিল। সাথে সাথে আরেকটা চর্চা হচ্ছিল, কোরান হাদিসের মাধ্যমে একটা জিনিস প্রমাণের পাশাপাশি বুদ্ধির মাধ্যমে প্রমাণ করা। ইমাম গাজালি অথবা তার আগে ইলমুল কালাম বলে একটা শাস্ত্র দাঁড়ায়। শাস্ত্রটা মূলত দার্শনিক ক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধী যে সমস্ত চিন্তাগুলো ছিল তার সাথে একটা মোকাবিলা করত। পরবর্তীতে এ চিন্তাটা ফিকাহর মধ্যে বা আইনের মধ্যে আসে। ইমাম গাজালি মাকাসিদ যখন সাধারণ অথবা নিয়ম পালন শুরু হয় এগুলিই ব্যাপক আকারে মাকাসিদের ধারনায় আসছে। মাকাসিদের ধারনাটা আসার মুল বিষয় হল যে কোন একটা মাসালার যখন উত্তর দেওয়া, হয় সমস্ত কোরান অথবা হাদিস খুঁজে যে তর্ক গড়ে উঠেছে, সেই তর্কের মধ্যে একটা ঐক্য পাওয়া। সেই ঐক্যটাই যদি সামগ্রিক ক্ষেত্রে হয়, তাহলে মাকাসিদ আর ফিকাহর ক্ষেত্রে হলে সেটা কায়দা। যে কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়, যেমন, বিবাহ অথবা ইবাদত-নামাজ; এটাকে বলে জাবাহ। এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

আধুনিক কালে এসে মাকাসিদ ধারণা আবার বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, আমাদের আগে যে রাষ্ট্র ছিল, সেখানে ফতোয়ার একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আপনারা জানেন সম্রাট আলমগির এরকম একটা সংকলন করছিলেন, যেটাকে আমরা ‘ফতোয়ায়ে আলমগির’ নামে জানি। ওসমানী খেলাফতের সময় বিষয়টা আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তারা ফতোয়ার একটা সংকলন করে। এগুলো তখনকার সময়ে স্রেফ আইন ছিল; যাতে নির্দিষ্ট একটা মূলনীতি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে যখন আধুনিক রাষ্ট্র হয়, তখন ইসলাম যেভাবে বিচার করত বা আগের যে ধারায় আইনটা চলত, আগের যে মাসালাগুলো ছিল বিশেষ একটা জায়গার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সে মাসালগুলো পরবর্তীতে দেখা গেল প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। কারণ আগের প্রেক্ষাপট আর বর্তমানের প্রেক্ষাপট এক না। তখন তারা খোঁজা শুরু করলেন যে মূলনীতিগুলো কি ছিল। যেমন, আবু হানিফা বা মুহাম্মদ শাফী বিশটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিশটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলছেন যে, এগুলোর মূলনীতি এটা। আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে বা আইনের মধ্যে যখন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল, তখন এই মূলনীতিগুলো বের করার প্রয়োজন হল। তখনি এভাবে মাকাসিদ ব্যাপারটা গড়ে উঠে।

নতুন করে সাইয়িদ কুতুবের পরে একটা ইসলামিজম পন্থা দাঁড়ায়। তখন একটা প্রশ্ন হচ্ছিল যে, এটা কি পশ্চিমাদের থেকে আসছে কিনা? মাকাসিদটা কি পশ্চিমা দ্বারা প্রভাবিত কিনা? মাকাসিদের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হচ্ছে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’। তখন একটা প্রশ্ন উঠেছিল আসলো যে, ইসলামকে কি এভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? তিনি দুইটা যুক্তি দিয়েছেন। প্রথম যুক্তি হচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্র নামে যেগুলো কায়েম ছিল, তাঁর মধ্যে মুসলমান ও অমুসলমানদের কর্মগত ক্ষেত্রে সমান অধিকার ছিল। একজন মুসলমান অপরাধ করলে যে শাস্তি, অমুসলিমদেরও ঐ শাস্তি। অমুসলিমদের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব যদি কোন বিষয় থাকে এগুলো তাদের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে। তিনি বললেন যে একটা মুসলমান রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলমান আছে অমুসলিমও আছে, যে কোন বিধান যখন আমরা বলি, এটা অমুসলিমের যুক্তিতে নাও আসতে পারে; সুতরাং মূলনীতিগুলো আমাদের বলতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, যখন মূলনীতিগুলো দাঁড়াবে তখন নতুন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। তবে যারা এ অভিযোগ তুলেছেন যে, পাশ্চাত্য দ্বারা এটা প্রভাবিত কিনা? তাঁদের প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ; তবে এটা আসলে ইসলামী ঐতিহ্যেই ছিল।

মুসতাইন জহির - যারা এর বিরোধিতা করেন বা করেছেন, তারা কোন জায়গাটা রক্ষা করতে চান বলে করেন।

জামিল - তাদের কথা হচ্ছে, ইসলাম যে অর্থে সামগ্রিকতাকে বলে যে এটা সামগ্রিকতা ইসলামের বাইরের একটা চিন্তা সে অর্থে এটাকে সামগ্রিকতা মনে নাও করতে পারে।

ফরহাদ মজহার - এটা কি এরকম যে ইসলাম একটা পূর্ণ ব্যবস্থার ধারনা; এবং যেহেতু সে উৎকণ্ঠা বোধ করে, যদি বাইরে থেকে কিছু আসে, তাহলে সেটা প্রশ্নবোধক হয়ে যাবে। আমরা যদি মনে করি ইসলাম একটা পুর্ণব্যবস্থা; বাইরে থেকে তার কোন কিছু প্রয়োজন নাই, তাহলে উৎকণ্ঠা হবে নিঃসন্দেহে।

জামিল - ইজতেহাদের একটা ভিত্তি থাকবে। কোরান শরীফের নির্দিষ্ট আয়াত অথবা হাদিস পেশ করে সে বলবে, অথবা তার নিজস্ব চিন্তা থেকে বলবে। নিজস্ব চিন্তা থেকে সে যদি বলে তাহলে সে জায়গায় মুসলমান-অমুসলমান ভেদ নাই। সে বাইরের চিন্তা থেকেও আনতে পারে।

ফরহাদ মজহার- মানে ইসলামের নিজের ট্র্যাডিশনের ভিতর থেকে ইজতেহাদ হচ্ছে এক রকম; আর ইজতেহাদের মধ্যে এমন কেউ থাকতে পারে যে বাইরের চিন্তাকে নিয়ে আসতেছে, কিন্তু হাজির করছে ইসলামিক চিন্তা আকারে তাহলে উৎকণ্ঠা হতেও পারে।

মুসতাইন জহির- ‘পশ্চিমা চিন্তা’ এ ধারনাটাই তো তৈরি হয়েছে যখন পশ্চিম কলোনিয়াল পিরিয়ডে নিজেকে একটা বিশেষ সভ্যতার চিন্তা আকারে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাইমিয়া যখন প্রশ্ন তুললেন যে ইসলাম অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল কিনা তর্কটা এরকম ছিল বলে আমার মনে হয় না। তখন তো মূলত আলোচনাটা ছিল কালাম শাস্ত্র এবং ফালাসাফার মধ্যে। আমরা এখন যত সহজে পশ্চিমা চিন্তা বলি এটার সূচনা খুব স্পেসিফিক একটা সময় থেকে; এবং এটার সাথে সংস্কৃতি, সভ্যতা এই ধারনাগুলো মিলেমিশে আছে। চিন্তা আকারে আসলে এটাকে আমরা পড়ছি না। আমরা যখন কোন  বিশেষ ভূগোলের, বিশেষ সংস্কৃতির চিন্তা আকারে আলাদা করি তখন আমরা চিন্তা আকারে আলাদা করছি না। এটাকে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, সভ্যতার একটা প্যাকেজের মধ্যে ধরছি।

আমি একটা সতর্কতামুলক নোট দেই, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা কথাটা যখন বলি এটা কিন্তু কোন হালকা কথা না। আমরা যখন সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কৃতির সম্পর্কটা আলোচনা করব, তখন আমাদেরকে এ ক্যাটাগরাইজেশনে যেতে হবে। বিশেষত পশ্চিম যখন তার চিন্তার জায়গাটাকে একটা মতাদর্শিক জায়গায় নিয়ে গেছে, ঐ অর্থে যখন চিন্তাটা কাজ করে একটা মতাদর্শিক জগতে। যেমন পশ্চিমা জগতের সাথে আমার নিজের সভ্যতা-জগতের সম্পর্কটা অনিবার্য হয়ে উঠে, আমি যখন ঐটার দ্বারা ওরিয়েন্টেড হয়ে যাই। এই যে ঘটনাটা, এটাকে পড়তে হবে, বিচার করতে হবে, তা ঠিক আছে। কিন্তু একইসাথে সতর্ক থাকতে হবে।

জামিল - আরেকটা জিনিস ক্ষমতার যে প্রশ্ন করছেন, ইসলাম ক্ষমতাটাকে মানুষের কাছে দিতে চায় নি। ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। ক্ষমতাটা যখন আল্লাহর বলা হয় তখন একটা সমস্যা তৈরি হয়। আমি পার্থিব জগতে ক্ষমতার মীমাংসাটা কিভাবে করব। যেহেতু ইসলামের ধারনা হচ্ছে দুনিয়ায় শেষ না আখেরাত বলে একটা জিনিস আছে। এখন যে ক্ষমতাবান এবং যার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হচ্ছে এ দুইটা বিষয় দাঁড়িয়ে গেছে। ক্ষমতা, শাসক এ বিষয়গুলো যদি আমরা হাদিসে দেখি, তাহলে দেখব দুইটার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের নির্দেশ আছে। নির্দেশটা এরকম-শাসনকর্তাকে মানতে বলা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে এক সময় শাসনকর্তাই সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী হয় উঠতে পারে। ইসলাম শাসক এবং শাসিতের দায়িত্বটা ভিন্নভাবে দিয়ে দিয়েছে।

মুসতাইন জহির- শাসক এবং শাসিতের এই ভাগটা ইসলামের মধ্যে কিভাবে করা হয়।

জামিল - ইসলামে খেলাফতের যে ধারনা আর দ্বিতীয় ধারনা হচ্ছে কারো নেতৃত্ব দেয়ার ধারনা। খেলাফতের ধারনাটা যে ইসলামে খুব বেশি যে স্পষ্টভাবে দিয়েছে তা না। খেলাফতই একমাত্র  সিস্টেম এটা কিন্তু ইসলামে নাই। আর সেকেন্ড হচ্ছে নেতৃত্বের ধারনা, হাদিসে আছে যখন তোমরা তিনজনের সাথে থাক একজনকে নেতা বানাও।

মুসতাইন জহির- খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। শাসক এবং শাসিতের ধারনা আর নেতা বা নেতৃত্ব নির্বাচনের ধারনা কিন্তু সম্পুর্ণতই আলাদা। রুল আর রুলার আরেকটা হল আপনি আপনার মধ্য থেকে একজনকে নেতা হিসেবে নির্বাচিত করবেন। যাকে আপনি নেতা নির্বাচন করছেন তার সাথে আপনার শাসক এবং শাসিতের সম্পর্ক না।

আমরা যেহেতু শাসক-শাসিত সম্পর্কটা দিয়েই ইসলামের জিনিসগুলাকে ব্যাখ্যা করা শুরু করছি বা করি। ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে শব্দগুলো দ্বারা কি জিনিসকে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে এবং কিভাবে তারা এ চর্চা গড়ে তুলেছে, তাকে যদি আমরা আপাত অর্থে বুঝার চেষ্টা করি, যেমন ধরা যাক একটা সমষ্টি নিজেরা কিভাবে পরিচালিত হবে, তার জন্য একজন নেতা নির্বাচিত করতে হলে সে কি করবে, নেতার কি কি জিনিসগুলো লক্ষ রাখতে হবে এবং তিনি কি করতে পারবেন এবং করতে পারবেন না, যদি করেন বাকিরা যারা তাকে নির্বাচিত করেছে তারা কি প্রতিবিধান করবে? তারা নিজেরা কেমন ধরনের ব্যবস্থা এটাকে রাজনৈতিক যদি বলি, প্রশাসনিক যদি বলি তাহলে একটা সিস্টেম অফ গভর্নেন্স তারা কি তৈরি করেছে এবং তার ক্রাইটেরিয়াগুলো এবং এজামসনগুলো কি? এটা কোথায়, কতটুকু, কিভাবে আলাদা।

আমরা যখন বলছি খলিফা, আমরা অলরেডি ধরে নিয়েছি উনি শাসক হবেন। সুলতান যখন ছিলেন, খলিফা যখন ছিলেন তারা শাসক ছিলেন অবশ্যই। কিন্তু শাসক হয়ে উঠার ইতিহাসটাকে আমরা সাধারণভাবে বৈধ বা গ্রাহ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। এটা একটা পর্যায়ে গিয়ে এরকম হয়েছে, হয়ত কনসেপসুয়ালি এরকম না হয়ে অন্যরকমও হতে পারত। বা এরকম যেটা হয়েছে সেটা দেখা যাচ্ছে যে ক্রাইটেরিয়ার সাথে মিলে না।

ক্ষমতার কথাটা আবার রিপিট করি, আমরা যখন ফিকাহর আলোচনায় দেখলাম ফিকাহ হল যে বোঝার প্রচেষ্টা এবং পদ্ধতি। কি বোঝার পদ্ধতি? সেটা হল কোরআন। আমরা বাংলায় যখন বলি প্রত্যাদেশ তখন অলরেডি এটাকে আদেশই বলছি। তাহলে তার মধ্য থেকে আমরা আদেশ ও নির্দেশমুলক আয়াতগুলোকে আলাদা করছি। এই যে কোন না কোন অর্ডার বহন করার স্টেটমেন্ট আকারে যখন বের করছি এবং তাকে অথরেটিটিভ স্টেটমেন্ট আকারে বের করছি । এই অথরেটি যখন আমরা যোগ করছি এটা তো একটা জেনারেল স্টেটমেন্ট। এটা তো কারো জন্য আলাদা করে দেওয়া হয় নি। ফলে এটা সবাই গ্রহণ করবে, সবাই পালন করবে। কিন্তু আমরা যখন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার জায়গায় এসে এটাকে ফেলি তখন তো আপনি বলেন এটাকে বাস্তবায়ন করতে হবে, এটা তখন মোয়ামিলাতের জায়গায় গেল। এটা বাস্তবায়নের যে অথরেটি তা আপনি এই স্টেটমেন্ট থেকে ডিরাইভ করতে পারছেন না। এখন সেটা তো দুনিয়াবি ক্ষমতা। সে দুনিয়াবি ক্ষমতা হতে পারে কমিউনিটি কাউকে ঠিক করেছে, কাউকে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু এ দায়িত্বটা কি সোশাল এবং কালচারাল ডেলিগেশন, নাকি এটা আপনার ঐশী মেন্ডেট? এ আলোচনাটা আমি ইসলামী আইন ও ফিকাহর যারা আলোচনা সেখানে স্পষ্ট দেখতে পাই না। তারা মনে করেন ঐ মেন্ডেটটা শরীয়া কিংবা ফিকাহর মেন্ডেট।

জামিল - আসলে ইসলামের মধ্যে বুঝা বুঝির যে জায়গাটা তার মধ্যে পাঠ ধারনাটা একটু অন্যরকম। সিলসিলা বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ইসলামে ক্ষমতার ধারনাটা কি হবে। এটাকে আধুনিককালে আরবী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধরে ধরে পড়ানো হচ্ছে। ইসলামে এ বিষয়গুলো আধুনিক রাষ্ট্র আসার আগ পর্যন্ত ছিল না। ইমামত আর খেলাফতের যে কথাটা আপনি বলছিলেন, এটা ইলমে কালামের মধ্যে সেই সাথে এদিকে গ্রিক ট্র্যাডিশনের একটা মিল ছিল। শিয়া-সুন্নি বিরোধ এবং গ্রিক এই তিনটা এক সাথে যুক্ত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় তারা আলোচনাটা এভাবে কেন করেন নাই যদি আসলে সংকটটা থাকত। অথচ আবু হানিফা বা এ ধরনের বড় বড় ব্যক্তিরা ক্ষমতার কাছে নানা ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। আবু ইউসুফ আবার ক্ষমতার কাছে যাচ্ছেন। শাফী আবার ইমাম মুহাম্মদের ছাত্র। আমার কাছে মনে হয় তাদের কাছে বিষয়টা ছিল একটা ব্যক্তিগত বুঝাবুঝির মত, আলাদা করে তর্ক আকারে ছিল না। যদিও তখন থেকে প্রবলেমগুলো ছিল। আর সেকেন্ড হচ্ছে যে যারা ক্ষমতাবান ছিলেন তাদের সাথে ওলামাদের এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল।

মুসতাইন জহির- এই জায়গায় আমি আসতে চাচ্ছিলাম। পশ্চিমা ইতিহাসের মধ্যে পশ্চিমা আইনের উদ্ভব এবং বিকাশের সাথে দেখলে এটা একদম মৌলিকভাবে আলাদা। ইমামরা যখন ফিকাহ নিয়ে কথা বলছেন, ফিকাহর মূলনীতি নিয়ে কথা বলছেন, তারা অলরেডি যারা সুলতান আছেন তাদের অবারিত ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রত্যেকে লড়াই করছেন। রুলগুলো কারা দিচ্ছেন? এটা কিন্তু সুলতান দিচ্ছেন না। সুলতানের যে পারিষদ আধুনিক ভাষায় যা পার্লামেন্ট, ইসলামী দর্শনের মধ্যে পার্লামেন্ট বলে কোন ধারনা নাই। এখানে হয়েছে কি সুলতান যে ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন তার ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা ঠিক করছেন এ বিষয়গুলোতে প্রিন্সিপালটা এই, প্রসিউডারটা এই, এবং ফলো করে রুলিংগুলা এই হবে। ফলে সুলতান যা ইচ্ছা তা করতে পারবে না। ইসলামে ফিকাহর বিকাশটাই হচ্ছে একটা সোশাল কাউন্টার মুভমেন্ট এগেন্সট দ্য পাওয়ার। এখানে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল এই। শরীয়া বলে আমরা যে আলোচনাটা করছি জাসের আউদা যে ভাগটা করেছেন সেটা হল ফিকাহ। ফিকাহ থেকে শুরু করে উনারা যখন রুলগুলো দিচ্ছেন এই বিষয়ে এটা হবে নিয়ম এবং এভাবে সিদ্ধান্তটা টানতে হবে। এটা কিন্তু এস সাচ আইনের চরিত্রের না। এবং এটা কারা করেছে, এটা ক্যাপাবল কারা? যারা জ্ঞানী যারা আলেম তারা করবে।

আমার অনুমান গাজালিরা যখন করেছেন তারা আকল বা উইসডম বা নলেজকে কেন একটা ফান্ডেমেন্টাল ক্রাইটেরিয়া বলেছেন। কারণ পুরো জিনিসটাই করছেন কিন্তু ওলামারা। এবং এটা প্র্যাকটিস করার ফান্ডামেন্টাল নেসেসিটি হল আপনি আসলেই যদি আপনার আকল ব্যবহারের জায়গাটাকে সুরক্ষা করতে পারেন। এই আকল ব্যবহারের সুরক্ষাটা কিসের বিরুদ্ধে চাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এটা বাধা প্রাপ্ত হয়েছে তা না, এটা হল পাওয়ার। গাজালির সময়ে তারা যে পাঁচটার কথা বলেছেন, সেটাকে তারা দেখেছেন এই পাঁচটা হলে সমাজের, যে কোন সোসাইটির মধ্যে ন্যুনতম যে জিনিসগুলো না হলে একটা কমিউনিটি ঐরকম একটা সময়ে এরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তার অধিকারের বা ইসলামের যে মুল আকিদা-বিশ্বাস এগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হোত না বা সম্ভব হবে না বলে মনে করেছেন। এটা আমি অনুমান থেকে বললাম। আপনারা যারা এগুলো আরো বেশি জানেন তারা বলতে পারবেন।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।