শাবি’র বই মেলা : কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
একটি রাষ্ট্রের জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই সর্বোচ্চ স্তরে এসে জ্ঞান যেমন হয়ে ওঠে পরিপূর্ণরূপে সৃষ্টিশীল, তেমনি সেটি প্রভাব সৃষ্টি করে ব্যক্তির মনন-কাঠামোর সুশৃঙ্খল পদ্ধতির উপর। মননরীতির ভিত্তি হিশেবে; দেশিক বা বিশ্বজনীন, যাই হোক না কেন সেখানে জ্ঞানই মুখ্য। চিন্তার বন্ধ্যত্ব থেকে সেই জ্ঞান যেমন মুক্ত করে সৃষ্টিশীলতাকে, তেমনি মননকে সমৃদ্ধ করার মধ্যদিয়ে দ্বার উন্মোচন করে এক নতুন দিগন্তের। তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন তার জ্ঞান নামক মুখ্য অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে নানান কূপমণ্ডূকতায় তখনই তার ওপর আরোপিত হয় অজ্ঞতা, অনিশ্চয়তা, অপসংস্কৃতি-সহ মরণব্যধির নানান কালো ছায়া। যা একটি সৃজনশীল রাষ্ট্রের সৃজনী শক্তিকে আক্রান্ত করতে পারে খুব সহজেই। পুরো সমাজকে পতিত করতে পারে অন্ধকারাচ্ছন্নতায়। আর এই গতিময় অন্ধকারাচ্ছন্নতা সমাজকে ক্রমেই ঠেলে দেয় ক্ষয়িঞ্চুতার দিকে। সে ক্ষয়িঞ্চুতা এতোই মারাত্মক হয়ে উঠে, যার বিষাক্ত ছোবল ব্যক্তির মনন-চিত্তে আঘাত হানতে পারে যে কোন মূহুর্তেই। তবে স্থূলতার অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে পুরো সভ্যতা যখন এগিয়ে যায় ক্ষয়িঞ্চুতার দিকে, তখন অন্যদিকেও চলে এর সৃষ্টিশীল চিন্তার বিনির্মাণ। আর এই নির্মিত সৃষ্টিশীলতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে তার মুখ্য ভূমিকা। কিন্তু সৃষ্টিশীল চিন্তার বিনির্মাণ হিশেবে; সজ্জিত ক্লাস রুম, বড় বড় ভবন বা প্রশাসনিক নানা জটিলতাকে জ্ঞান চর্চার মৌলিক উপকরণ মনে করে অনেকে ভুল করে থাকেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান চর্চার সঙ্গে এই বিষয়গুলোর থাকা বা না থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং অন্য অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে এটি যৌক্তিকও নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্ঞানের মুখ্য উপকরণ হিশেবে কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিবে? আমাদের কাছ থেকে প্রথমেই যে উত্তরটি আসবে সেটি হবে মননশীল বই।
বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্ঞান চর্চার উপাদান হিশেবে যে’কয়টি উপকরণের উপর নির্ভর করে এরমধ্যে বোধকরি বই’ই অন্যতম। তবে উপকরণ বলতে যে বস্তুগত ধারণার জন্ম হয়; একটি মননশীল বই শুধু বস্তুর চিন্তাই নয়, বরং আত্মবোধ বা আত্মতৃপ্তি আর জ্ঞানের মৌলিক উপকরণ হিশেবে অধিকাংশ সময়ই বিবেচিত হয়। সেই সঙ্গে কাজ করে এর নান্দনিকতা যা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য চিন্তায় বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। আর এই উচ্চমার্গয় উপকরণের সাহায্যে শুধু ব্যক্তিবিশেষই নয়; একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে উঠতে পারে জ্ঞানের প্রকৃত স্তম্ভ।
বইয়ের সঙ্গে বোধকরি যে বস্তুটির সবচে বেশি মিল রয়েছে সেটি মননশীলতার। মননশীল প্রতিভা বিকাশে বই যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, আশা করি সেটি কারো অজানা নয়। বই যেমন উন্মোচন করে ব্যক্তির বিকাশের ইতিহাস, তেমনি প্রাকৃতিক সত্যের রহস্যও। সঙ্গে সঙ্গে বই শুধু আনন্দের ইন্দ্রিয় বিলাসই নয় বরং প্রাণ সঞ্চার করে ব্যক্তির বোধ, উপলব্ধি আর প্রজ্ঞাতে। তবে বই যেমন জ্ঞানের আলোকময় পথের সন্ধান দিতে পারে তেমনি পারে জ্ঞানকে বিভীষিকাময় ভয়ংকর পথে চালিত করতে। মননপ্রতিভা বিকাশের অবস্থান থেকে চিন্তা করলে এরকম বিভীষিকাময় ভাবনা যদি বাস্তবে সত্যি রূপ লাভ করে, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মননশীলতার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তা কল্পনা করলে গা শিহরে উঠে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই যেন সেই দিকেই যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে যাওয়া বই মেলাই যেন এর বাস্তব প্রমাণ। মননশীল চর্চার অবস্থান থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিন’ আয়োজিত শাবিপ্রবি’র বই মেলা আমাদের যেন সম্পূর্ণভাবেই হতাশ করল। বিশ্ববিদ্যালয় একটি মননশীলতার জায়গা। এখান থেকে যেমন মননশীলতার বীজ বপন হয়, তেমনি এই জায়গাটি থেকে প্রসার হয় ব্যক্তির বোধ-শক্তির প্রকাশ। বোধ-শক্তিই ব্যক্তির সত্ত্বাকে বিশ্বের জ্ঞানদীপ্ত পরিমণ্ডলে নিয়ে যায়। আর এই জীবনবোধ বা মনন-প্রতিভার চর্চা বা বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান যদি এরকম দায়িত্ব-জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড সংগঠিত হতে শুধু মানসিক মৌনতা প্রকাশে সহায়তাই নয় বরং এরকম আস্তাকুড়ের চিন্তা-চেতনা ধারণ করে, তবে এ লজ্জা কার? আমরা আবারো বলছি, একটি স্বতন্ত্র বই মেলার আয়োজন সম্পর্কে কথা বলা আর সামগ্রিকভাবে বই মেলার বিরুদ্ধাচরণ করা এক নয়। আমরা সেই স্বতন্ত্র বই মেলার সমালোচনা করছি যার চিন্তা সম্পর্কিত মানসিকতা প্রতিনিয়তই আমাদের জ্ঞানের জগতকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে অনেকদিন ধরে অনেকেই নানা কথা তুলছেন। প্রশ্ন তোলাটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা একটি জাতি মননশীল হয়ে উঠে তার ভাবনাচিন্তায়, আর এই ভাবনা চিন্তা বিকাশের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মনন-প্রতিভা বিকাশের জায়গা নয় বরং এর চর্চারও অবাধ বিচরণ-স্তর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞান বা মননের চর্চাহীনতা যে আমাদের প্রতিদিনই আক্রান্ত করছে তার মরণব্যধি বিষাক্ত ছোবল থেকে তা কি শাবির এবারের বই মেলা থেকে প্রকাশ পায় নি? এধরনের বই মেলা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েরই তা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিশেবে আমার কাছেও লজ্জার বিষয়। জ্ঞানের বটবৃক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন-‘একটি দেশের মানুষ কোন ধরনের তা বুঝা যায় বইয়ের দোকান আর বাজারে গেলে।’
মননরীতির বৈশিষ্ট্য যেমন শুদ্ধ জ্ঞান চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তেমনি বই কেনার সঙ্গেও সম্পর্কিত। তবে আমি আমার পর্যবেক্ষণ শক্তির মাধ্যমে বলতে পারি, এবারে হয়ে যাওয়া শাবির বই মেলায় প্রায় সব স্টলেই যে ধরনের মানহীন বই রাখা ছিল তা কেবল আমাদের জ্ঞানের চর্চা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অল্প পরিমাণ জ্ঞান আর মুক্তচিন্তার চর্চা হয় তাও যে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে তা স্পষ্ট।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম বাংলার মানহীন বইয়ের যে আগমন আমাদের মননশীল লেখকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল, শাবির বই মেলার মানহীন বাজারি বই কি আমাদের পাঠকের চিন্তার স্তরকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে না? চিন্তা-ভাবনা আর মননশীলতায় কি স্থূলতা সৃষ্টি করছে না? এ ধরনের বই মেলা যদি কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান আয়োজন করতো তাও মেনে নেয়া যেত। কেননা বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে পুঁজির মুনাফা, সেক্ষেত্রে যদি নৈতিকতা পদদলিত হয় তাতে কিছু আসে যায় না। তাই বলে কি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা সম্ভব। যেখানে ৫২, ৬৯, ৭১ এর মতো চেতনাসমৃদ্ধ গণআন্দোলনগুলো সংগঠিত হয়ে এই রাষ্ট্রের মুক্তির পথ এঁকে দিয়েছিল। তবে স্বাধীনতা-উত্তর ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের নতুন স্বপ্ন যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যদিয়ে বয়ন হয়েছিল, সেই মননশীল পরিমণ্ডলে মানহীন বই মেলা আয়োজন করা হচ্ছে কোন বিশেষ স্বার্থে?
যে বইগুলোর শৈল্পিক উৎকর্ষতা নেই, যেগুলো আমাদের পাঠকের বোধ, মনন ও উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে না, সেই বইগুলো নিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করে বই মেলা, তখন তাতে কি সমাজ ব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে না ? কিংবা সৃষ্টিশীলতার অবস্থা থেকে চিন্তা করলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্তাপিত হতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মৌলিক বা সৃজনশীল জ্ঞান চর্চায় কতটুকু সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? কোনো অসাধারণ জ্ঞান’কে কি গর্ভে ধারণ করে বিকশিত করেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? এসব প্রশ্নের দিকে আমরা যাচ্ছি না। শুধু এতটুকু বলা প্রয়োজন, চিন্তার মৌলিকতায় অপ্রতুলতা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয় নি। হয়তো দীর্ঘ দিনের অজ্ঞতার সংঘটিত কর্মই এর ফল। তবে এর পেছনে রাষ্ট্রের প্রতি জ্ঞান, মনন, আদর্শের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথার্থভাবে পালন করে আসছে? সমাজ ব্যবস্থায় হঠাৎ করেই কোন রীতি চালু হয়ে যায় না। এবং সম্ভবও নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা আর মননশীলতার সংস্কৃতিতে স্থূলতার যে অ-পরিণাম রীতি চালু হয়েছে তাও একদিনের ফল নয়। কালের আবর্তে এটিও প্রবাহিত হয়েছে অনেক আগ থেকে। তাহলে এখন কি আমরা তার সেই ফল ভোগ করছি? হয়তো করছি! যতদিন শিল্প, উৎকর্ষ, মান আর মননহীন বাজারি বই মেলা আয়োজন করা হবে অন্তত ততদিন।
২১ অক্টোবর ২০১৪
৪২৯সি, শাহপরাণ হল
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।