“বাইরের দর্শন মাথায় নিয়ে এখানকার নতুন রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তুলতে পারবেন না”- (চিন্তার পাঠচক্রে ফরহাদ মজহার)
দর্শন আপনাকে পড়তে হবে মূল টেক্সট থেকে। আপনি নিটশে, স্পিনোজা পড়বেন, তো সেটা পড়তে হবে মূল টেক্সটেই। তবে এগুলো তো পশ্চিমের। পশ্চিমা দর্শনের জিনিস। কিন্তু এখানে এর প্রাসঙ্গিকতা কী। আপনি তো পড়বেন কুরআন, মুহাম্মদ, বেদ, শ্রীকৃষ্ণ, লালন। আপনি ওগুলো পড়েন কেনো। আপনার কাছে তবে প্রশ্নটা কী। ওখানে পশ্চিমা জায়গায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হবার প্রশ্ন আছে। মানে নিশ্চয় জ্ঞানের সমস্যা। আপনি যে জানেন, এটা আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে। পশ্চিমা জ্ঞানের এটি একটি মৌলিক জায়গা। তাহলে কি আমাদের এখানে জ্ঞান নাই? আমাদের এখানে এটা জ্ঞানের নিশ্চয়তা থেকে শুরু হয় নাই। সেটা অন্য জায়গা থেকে। আর এটাই আপনাকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। কিন্তু সবশেষে আসলে প্রশ্নটা কী। আপনাকে আরো পড়তে হবে- এই যে রামমোহনকে নিয়ে ভট্রাচার্যের বিচার। এগুলো পড়বেন। কিন্তু তারপরেও এখানে আপনার তর্কটা কী। আপনার কনসেপ্ট, আপনার অবস্থান তো এখনো স্পষ্ট না। আপনি নানা কথা বলেন, নানান দিকে যান তাতে তো আপনাকে বুঝা যায় না। আপনাকে পড়া দরকার আবুল মনসুর আহমদ। আপনি তো তাকে পড়বেন। মনসুর এখানকার প্রশ্নগুলো যেভাবে গোড়া থেকে আপনকার মতো করে তুলেছেন সেখানে তার মতো এখানে আর এতো বড় ব্রিলিয়ান্ট আসে নাই। অর্থাৎ আপনাকে এখানকার পলিটিক্সটা বুঝতে হবে। এখানকার প্রশ্নগুলো এই মুহূর্তে কী সেটা আপনাকে শনাক্ত করা দরকার। এখানের মানুষ, এখানকার ধর্ম, ভাষা, জীবন, সময়, গতি ও চাহিদাগুলো আপনাকে ধরতে হবে। ধরা জানতে হবে। আপনার প্রথম টার্গেট হবে, আপনার অডিয়েন্স কারা? পশ্চিম না এখানকার সমাজ। নিশ্চয়ই এখানকার সমাজ। এখানকার ভাষা মানুষ ও ধর্ম। তবে পশ্চিমা দর্শন অবশ্যই আমাদের জানার ও বুঝার প্রয়োজন আছে। যেমন পশ্চিমা জ্ঞানকে জানতে হলে আমাদের দেকার্তে বুঝা খুবই দরকার। কিন্তু এখানকার সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা কী। আপনি যে পশ্চিমা দর্শন, চিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান পড়েন সেগুলো আসলে একাডেমিক। কিন্তু আপানার তো এখানে কিছু দেবার কিছু অবদান রাখার সময়। গত তেরো আগস্ট বৃহস্পতিবার চিন্তার পাঠচক্রে কবি ফরহাদ মজহার আলোচনা শুরু করার মুহূর্তে উপস্থিত সকলের সাথে পড়া লেখা ও চিন্তা-ভাবনা সহ নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর বিনিময় করার সময় মাহমুদ হাসানের দর্শন পড়ার বিষয়কে ঘিরে কথাগুলো বলেন। তিনি বলেন, দর্শনকে সহজ করে বুঝাটা জরুরী। সমকালীন প্রোপটে দার্শনিক জায়গা থেকে কোন প্রশ্নটা কীভাবে তোলা দরকার সেটা বুঝার পদ্ধতি জানাটা আরো জরুরী। অর্থাৎ আপনাকে দ্রুত আগানোর পথটা আয়ত্ত করে ফেলতে হবে। সেটা কীভাবে করবেন। দর্শনে যে প্রশ্নগুলো কাঁচাভাবে আছে কিংবা আদিতে প্রশ্নগুলো যে নিরিখে তোলা হয়েছে সেটাকে গ্রেফতার করা শিখতে হবে। তাহলে আপনি সহজেই আগাতে পারবেন। প্রশ্নটা ছিলো যে, পশ্চিমা জগতে নিশ্চয়ই জ্ঞানের সমস্যা। অর্থাৎ সেখানে প্রশ্নটা তোলা হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে। কিন্তু এখানে নিশ্চয়ই জ্ঞানের সমস্যা নাই। আছে দু:খ বোধ। যেটা জ্ঞানতাত্ত্বিক নয় বরং বাস্তব জায়গা থেকে এর শুরু। তো এইভাবে চর্চাটা এখানে বহু প্রাচীন সময়কাল থেকে হয়ে এসেছে। এখানকার পুরনো অংশগুলো খোঁজলে এটা আপনি বুঝতে পারবেন। সাক্তরা এখানকার মোটামুটি পুরনো। তানিম বললেন, আর্য দেবতাদের প্রতি এখানকার তাদের অনীহা আছে। আর হাসান শিবকে জিসাসের সাথে তুলনা করলেন। জবাবে ফরহাদ মজহার বললেন- এগুলো বুঝতে হলে আপনাদেরকে কনসেপশন অব সেক্স বা রিপ্রোডাকশনও বুঝা দরকার হবে। আর শিবকে জিসাসের সাথে তুলনা করার কোনো মানে হয় না। এছাড়া শিবের ঘটনাটা এখানে প্রাক হিস্ট্রির মতো একটা ঘটনা। একটা আলাদা ব্যাপার। ফলে খুঁজলে দেখবেন এখানে দেব দেবতাদের ঐতিহ্যের মধ্যে শিব নাই। কারণ শিব দেবতারও দেবতা। এমনকি শিব বেদের বাইরের। শুধু তাই নয় শিব বেদেরও আগের ঘটনা। কারণ তার কোনো অবতার নাই। ফলে শিবের বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এইসব নানা কারণে। প্রশ্ন হলো আমাদেরকে এখানকার প্রশ্নগুলো বুঝতে হলে এখানকার প্রচলিত গল্পগুলো উপলব্ধি করতে হবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গল্প, কাহিনী আছে সেগুলোর মধ্যে আপনার প্রশ্নটা খুঁজে নিতে পারেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনাকে ঠিকভাবে ধরাটাও জানতে হবে। আপনাকে সন্ধান করে বেড়াতে হবে- এই যে আব্দুর রহমান বয়াতি, কেমন করে তিনি ধর্মকে দেখেন। এখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুহাম্মদ, নবী, ধর্ম, আল্লাহ এবং দ্বীন কীভাবে মুখে মুখে আছে, জীবন যাপনের মধ্যে আছে, ভাষার মধ্যে আছে এটা আপনাকে তাদের সাথে মিশে মিশে নিতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে। তবে আপনি এটা মধ্যবিত্তের মধ্যে পাবেন না। দেখবেন, কীভাবে এখানে আল্লাহ প্রভু থেকে হাবীবে রূপান্তর হয়ে গেলো- এগুলো আসলে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত এগুলো এতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও আসলে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কীকরে এখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে আরবীয় প্রভাবের বাইরে এখানকার নিজের বয়ান গড়ে উঠলো সেই দিকটা তো অসাধারণ এক ঘটনা। এই যে আপনি যখন প্রভু বললেন, তার মানে আপনি প্রি-ইসলামের মধ্যে মানে খ্রিস্টিয়ানিটির মধ্যে চলে গেলেন। এই ইংগিতগুলো এখানে আপনি পাবেন। আল্লাহর কনসেপ্ট কোন ধর্মে কিভাবে কতোরকম হয়েছে এই জায়গায় এটি দেখবার বিষয়। কোন ধর্মে কিভাবে সৃষ্টিকর্তার ধারণা রয়েছে সেটা দেখতে হবে। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মধ্য দিয়ে যে ইসলাম সেখানে সৃষ্টিকর্তার ধারণা মৌলিক নয়। ইসলাম এটাকে কখনো প্রধানভাবে এনকারেজ করে না। আখেরে ফানা, কিয়ামত এটা ক্রিস্টিয়ানিটি। প্রাক ইসলামি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে এটা আছে। ফলে ইসলাম এটাকে একদিকে ঐতিহ্যগত কারণে ঔন করে অন্যদিকে এটাকে আবার নিজের স্বতন্ত্র কন্ট্রিবিউশন আকারে গ্রহণ করে না। ইবরাহীমের বয়ানের মধ্যে নিরাকার ও হাবীবের ধারণা অতি গুরুত্বর্পূ বিষয়। এখানে ব্যাপারটি বন্ধুত্বের । যেখানে আল্লাহ এবং হাবীব পরস্পর স্বতন্ত্র। আলাদা আলাদা। নিজের অবস্থায় স্বাধীন। কেউ কারো মধ্যে লীন হবার ব্যাপার নাই। অর্থাৎ শেরেকের কোনো বিষয় নাই। আপনি (হাসানকে উদ্দেশ্য করে) স্পিনোজার কথা বলেন কেনো, আমি তো এখনো কুরআন পড়েই শেষ করেনি। আমি তো এখানে রাজনীতি করবো। আমাকে তো এখানকার জিনিসগুলো আগে জানতে হবে। আমাকে তাজকেরাতুল আউলিয়া বা এখানকার আউলিয়াদের জীবনী পড়তে হবে। এখানের লোকমুখে ফরিদ উদ্দীন আত্তার আছে। বায়েজীদ আছে। আমাকে তো এগুলো জানতে হবে। আপনি নিছক দর্শন করেতেছেন। তার চে বেশি মানুষকে ভালোবাসুন। দর্শনটাকে ওখান থেকে পাঠ করুন। ওখান থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। মানে মানুষকে জানুন। মানুষের কাছে যান। তাদের কথা শুনুন। তাদের গল্পগুলোতে মনোযোগ দিন। তাহলে তাদের গল্প ও ভাষা থেকে আপনার বয়ানটা কী হবে বুঝতে পারবেন। কিন্তু বাইরের দর্শন মাথায় রেখে এখানকার বয়ান, এখানকার রাজনীতি ও ভাষা তৈরী করবেন এটা হবে না। এরপর ফরহাদ মজহারের সাধারণ মানুষের গল্প শোনার কথা প্রসঙ্গে হাসান বললেন- ব্রহ্মপুত্র নদী বদলে যাওয়ার কাহিনী সম্পর্কে ওখানকার সাধারণ মানুষ মনে করেন, ঘটনাটি স্থানীয় এক আল্লাহর ওলীর ফজলে-কেরামতে হয়েছে। জবাবে তিনি বললেন, বিষয়টি এভাবে আমি বুঝাতে চাইনি। আপনি এটাকে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের পীর মুরশিদদের একটা সোশ্যলজি আছে। এদিকটায় সচেতন থেকে আমার কথাটা আপনার শুনতে হবে। কারণ সোশ্যলজি আর ধর্মতত্ত্ব তো এক না। অর্থাৎ আপনি যখন একটা গল্প শুনবেন, সে গল্পের তাৎপর্যটা কী সেটা বুঝা তো অন্য জিনিস। আপনি আলী-ফাতেমা-হাসান-হোসাইনের গল্প শুনবেন? এই শুনুন, আমি বলছি- একবার হযরত মুহাম্মদের (স.) কাছে এক গরীব লোক এসে তার মেয়ের বিয়ে দিতে না পারার অসামর্থের কথা বলে সহযোগিতা চাইলেন। মুহাম্মদ (স.) তাকে আশ্বাস দিলেন। কিন্তু নবী কোথায় থেকে তাকে সাহায্য করবেন। নবীর তো তেমন টাকা-কড়ি, সহায়-সম্পদ নাই। সামনেই উপস্থিত ছিলে আলী। আলী তখন সেখানকার এক সম্পদশালী লোকের কাছে গিয়ে কিছু টাকা-কড়ি ধার চাইলেন। ঐ লোক দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় আলী তখন তাঁর ছেলে হাসানকে দিয়ে ধার চাইলেন। আলী বললেন, সূর্য ডোবার আগে যদি তোমার টাকা না দিতে পারি তবে সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসান তোমার হয়ে যাবে। একথার ভিত্তিতে হাসানকে ঐ লোকের কাছে দিয়ে আলী মেয়ে বিয়ে না দিতে পারা লোকের কাছে ছুটে গেলেন। এবং তাকে সাহায্য করলেন। এদিকে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। হাসান ঐ লোকের দাশ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আলী কোনো কুল-কিনারা করতে পারতেছেন না। এ ঘটনায় আলীর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার কোনো ছাপ দেখা গেলো না। আলী শুধু উদ্বিগ্ন ফাতেমাকে কী জবাব দেবেন। জিবরিল তখন আল্লাহকে বললেন, সূর্য তো ডুবে যাচ্ছে আপনি এখন কী করবেন। হাসান তো দাশ হয়ে যাবে। বিয়ে দেবার কর্তব্যটা তো আপনারই ছিলো। আর আপনার সেই দায়িত্ব পালন করে এখন বুঝি আলী-ফাতেমা তার ছেলেকে হারাবেন? এটা কেমন কথা। এটা তো হতে পারে না। এদিকে ইতোমধ্যে সূর্য একদম ডুবে যাচ্ছে এমন অবস্থায় আলী বাড়িতে গেলে ফাতেমা তাঁকে হাসানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ঘটনা খুলে বললো আলী। কিন্তু তাতে ফাতেমা এতোটুকুও উদ্বিগ্ন হননি। শুধু মাথাটা একটু বাঁকা করলেন আর সাথে সাথে দু ফোঁটা অশ্র“ গড়িয়ে পড়লো। আলী দেখলেন দু ফোঁটা অশ্র“ মাটিতে পড়ে মুক্তায় পরিণত হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মুক্তাদানা নিয়ে দৌড়ে গেলেন। আর আল্লাহ জিবরিলকে বললেন, নবী কী করেছে? আপনার কর্তব্য পালন করেছে। আলী কী করেছে? আপনার দায়িত্ব পালন করেছে, মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করেছে, ফাতিমা কী করেছে? আপনার কর্তব্য পালন করেছে, মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করেছে। হাসান কী করেছে? আপনার কর্তব্য কর্তব্য পালন করেছে, মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করেছে। তাহলে সূর্য বেটা এটা বুঝে না যে, কী করতে হবে। আল্লাহর কথা শুনে তখন সূর্য ডুবে যেতে দেরী করলো এবং আলী তার হাসানকে মুক্তা দিয়ে নিয়ে আসলেন। তো আপনারা এ ঘটনা থেকে কী বুঝলেন। এ ঘটনায় আসলে প্রশ্নটা কী। প্রশ্নটা হলো সূর্যের ওঠা বড় না মানুুষ বড়। জিবরিলের মধ্যস্থতায় আল্লাহ মানুষকেই বড় করে দেখলেন। এখানেই বড় তাৎপর্যের জায়গাটা। এটাই আমাদের বুঝা দরকার। আরো বুঝতে হবে, এই গল্প কিন্তু আরবের না। আরব এই গল্প নেবে না। আরবে এইরকম প্রশ্ন নাই। এই গল্প আমাদের। আমাদের এখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে এইভাবে এক ভিন্ন ভাষা বেড়ে উঠেছে। আবার দেখবেন এই গল্পের মধ্য দিয়ে আল্লাহ এবং প্রফেট রিইস্টাবলিসড হচ্ছে। এটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে আরবের মতো না। ইসলামের মূল স্পিরিটের দিকে নজর দিলে এটা সহজে বুঝতে পারবেন। এবার একটা নারীর গল্প বলি- আলীর ছিলো অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস। যেকারণে একবার আলী কোনো এক ঘটনায় ফাতেমার সামনে বলে ফেললেন যে, তিনি না হলে ইসলামই কায়েম হতো না। এ কথা শুনে ফাতেমা মনে মনে ভাবলেন ওনার মধ্যে তো অহংকার এসে গেছে। কী করা যায় ভেবে তখন তিনি এক কৌশল আঁটলেন। এরপর তিনি আলীকে বললেন, তোমার যে এতো শক্তি এর প্রমান কী? তবে ঐ যে মসজিদ দেখা যায়, তুমি ওখানে যাও। এরপর সেখানে গিয়ে কিছু চড়–ই দেখতে পাবে, যদি তুমি একটা চড়–ই ধরতে পারো তাহলে প্রমাণিত হবে তুমি একজন বীর। দুঃসাহসী। আলী বললেন তুমি কী বলছো! একটা সামান্য চড়–ই আমি ধরতে পারবো না!! এটা তো কোনো ব্যাপারই না। মুহূর্তের মধ্যে দেখো কীভাবে আমি ধরে দিচ্ছি। আলী সারাদিন ব্যায় করে দিলেন কিন্তু তারপরেও ধরতে পারলেন না এই সামান্য একটি চড়–ই। লজ্জায় আলীর মাথা নত হয়ে গেলো। মুহূর্তেই এই দুঃসাহসী বীরের তাবৎ অহংকার ধুলিসাৎ হলো। আলীর নিজের ভুল বুঝতে পেরে যখন পাখির কাছে মা চাইতে গেলেন তখন আল্লাহ জিবরিলের মাধ্যমে পাখিটির পায়ের রক্ত মুছে দেন। কারণ যিনি এই পাখি তিনি তো জগৎ জননী মা ফাতেমা। আলী তাঁকে ধরার সময়ে একটুখানি পায়ে আঘাত লেগে যে রক্ত বের হয় তার জন্য তো জননীকে ছোট করা যায় না। বুঝতে পারছেন ফাতেমা তখন আর আলীর সহধর্মীনি থাকতেছেন না। ফাতেমা তখন জগত জননী........ এই গল্পের মধ্য দিয়ে পুরুষতন্ত্র খতম। এমনকি লিঙ্গভেদও সমাধান হয়ে গেছে। তো এই হলো বঙ্গীয় জায়গায় ইসলামের বয়ান। এখন আপনার কাজ হলো এই ভাষাগুলো বুঝা। এর তাৎপর্যের বিষয়টি উপলব্ধি করা। এরপর আপনার প্রশ্নটা কী সেখান থেকে বিষয়টি সম্পর্কিত করতে পারেন কিনা চেষ্টা করে দেখুন। তবে শেষ কথা হলো আপনার কাছে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে এবং এখানকার গল্পগুলো শুনতে হবে। বুঝতে হবে। অতএব এই সব নানা কারণে আমি কবিদের সঙ্গ ত্যাগ করেছি। এটা আমাকে করতেই হলো। কারণ এই ধরনের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে থেকে আপনি তো এই গল্প, গল্পের তাৎপর্য, এই ভাষা কিছুই খুঁজে পাবেন না। খুঁজে পেলেও বুঝতে পারবেন না। এর কারণ হলো এই শ্রেণীর মধ্যে ইতোমধ্যে যে ভাষাটি কর্তৃত্বশীল আছে সে ভাষাকে ধারণ করে আগানো যায় না। যে কারণে আমাকে এটা ছাড়তে হলো। এই ত্যাগ করার জায়গায় সাইমন জাকারিয়াসহ আরো অনেককে আপনি পাবেন। তাদের মধ্যে বড় কোনো কাজ করার উদ্দেশ্য নাই। আসলে আপনি তো দর্শনের কথা বলছেন, কিন্তু দর্শন এভাবে হয় না। আপনাকে কাজে নেমে যেতে হবে। যেখানে কোদালী করতে হয়। এটা ছাড়া তবে আপনার দর্শন হবে না। এই কোদালীর কাজটা নানাজনে নানাভাবে করেছে। যেমন বিদ্যাসাগর করেছেন। তার কাজটা হিন্দু সংস্কারের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটা এমনি বুঝবেন না। কারণ বঙ্গের কাউকে যদি বাদ দেয়া হয় সেেেত্র যে তিটা হবে সেখানে তারচেও অসম্ভব তি হয়ে যাবে। কিন্তু লালনকে এখানে এইভাবে আনতে পারবেন না। কারণ লালনের ব্যাপারটা শুধু বঙ্গের না। পশ্চিমের বিপরীতে জ্ঞান ও ভাব খাড়া করার প্রশ্নে লালনের ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক। যেকারণে আমি বাংলার ভাবান্দোলন বলিনি। আমি বলিছি ভাবান্দোলন। সেেেত্র বাংলার ভাব নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। এখানে গুরুর ধারণা চলে আসে। এটা করতে হলে গুরুর দরকার হয়। কিন্তু লালন যে আকারে গুরু সে আর আগের গুরুর মতো না। সাধারণভাবে গুরুর যে ধারণা এই গুরুচিন্তা এক না। এই গুরু আধুনিক লিডারশীপ বা ডিজিটাল টেন্ডেন্সি না। এখানে গুরু মানে হলো, প্রত্যেক এপোকে একজন একজন গুরু আছে। প্রত্যেক যুগে একজন জীবন্ত গুরু থাকে, যিনি বিদ্যমান টেক্সটের বিপরীতে যুগের বয়ান দেন। এটা না হলে সমাজই থাকে না। কিন্তু গুরু এমন না যে, তিনি আইন দেবেন, ডমিন্যান্ট করবেন তিনিই। তবে তিনিই সব জানেন, সব বুঝেন ব্যাপারটা আসলে এরকম না। আসলে এইকালে লালনপন্থী হওয়া অসম্ভব। কারণ এখন লালন নিয়ে নানা রকম জটিলতা আছে, যেমন- ফেরকাবাজি, গঞ্জিকা সেবন, রাজনৈতিকতা ও তত্ত্ব সাধনা সহ নানা ভ্রান্তি আছে। তবে আমি মনে করি, কৃষি তৎপরতার মধ্য দিয়ে লালন চর্চাকে দৃশ্যমান করে তোলা মোটামুটি সহজ। এতে কাজের কাজ হবে। কারণ আমার এসব বিষয়ে লালনের প্রতি আগ্রহ নিয়ে কাছাকাছি এসেছে অরূপ রাহী, যায়েদ, শাহনাজ বেলী, আনুশেহ, ফরীদা পারভীন। তাদেরকে সান্নিধ্য দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই পেলাম না। মূলত ঢাকার মধ্যবিত্তের ছেলেদের দিয়ে একাজ হবে না। আনিসুল হামিদ টুটুল প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। তিনি প্রশ্ন রাখলেন ফরহাদ মজহারের কাছেÑ আপনি বঙ্কিম নিয়ে কেনো লিখলেন না। জবাবে তিনি বললেনÑ কারণ গোষ্ট গান নিয়ে লিখেছি বলে লিখলাম না। অর্থাৎ সেেেত্র বঙ্কিম হিস্ট্রিক্যাল। তার অবদানটা এখানে ঐতিহাসিক জায়গায়। মানে, তার কাছে আসল বিষয়টা ছিলো, হিন্দু ধর্মের একটা হিস্ট্রিক্যাল ফিগার লাগবে। এটা সে মনে প্রাণে উপলব্ধি করেছে হিন্দু ধর্মের েেত্র। এেেত্র সে কাজ করেছে মৌলিকভাবে। এটা আমার আসল জায়গা না। কিন্তু এই জিনিসগুলো বুঝা, উপলব্ধি করা জরুরী। এগুলো নিয়ে লিখবার আমার চিন্তা আছে। আহমদ ছফা এ বিষয়ে কাজ করেছে। তবে লালনের জায়গাটা অন্যত্র। সেটা খুবই ব্যাপক। এর তাৎপর্য সাম্প্রতিক অবস্থার জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলতে পারার উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ লালনের দার্শনিক বয়ান একটা মেটাফোরিক্যাল অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে সেখানে......টুটুল- আহমদ ছফা ত...। ফরহাদ মজহার- ইংরেজী শেখেনি বলে... তার কনসার্নটা এসেছে ঐখান থেকে যেখানে রাষ্ট্র ছাড়া একটা কমিউনিটি টেকে না। কিন্তু এই ধারণটাই এখানে নাই। ফলে টিপাইমুখ সহ আরো জটিল ঘটনা ও পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে পড়বে এই জনগোষ্ঠী। অন্য কারণ হলো, বাংলাদেশ একটা এ্যান্থ্রোপলজিক্যাল ট্রাইবাল। যেমন, হিন্দু ট্রাইবাল, মুসলিম ট্রাইবাল ইত্যাদি। তো এখানে এখনো এই ট্রাইবাল অবস্থা যে রাজনৈতিকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা খুবই খারাপ। আরো কারণ হলো, এখানে এখনো ঐ দেশ মিত্র ঐ দেশ বন্ধু এই প্রবণতা, এই বিশ্বাস রয়ে গেছে। ফলে এইভাবে রাষ্ট্র ত হয় না। এইভাবে রাষ্ট্র হয় না। রাষ্ট্র টিকবে না। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র টিকে থাকার কন্ডিশান থাকে না। হারিয়ে যায়। মিডিয়ার কারণে এই অবস্থা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। এবং আরো নানা জটিলতা তৈরী হবে যদি না.......... এমনকি প্রাইভেট স্ট্যাট হয়ে যেতে পারে... যদি আপনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারেন। কিন্তু আপনার তো এখানে কোনো রাজনৈতিক শ্রেণী বা কর্তা শক্তিই নাই।
নিজের সম্পর্কে লেখক
student