গুম হয়ে যাওয়া মানুষ ও তাদের পরিবার: আন্তর্জাতিক সংহতি সপ্তাহ
আপনি কি জানেন যে গতকাল ২৫ মে থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে মনুষ গুলো গুম হয়ে গিয়েছে তারা যে দেশেরই হোক তাদের স্মরণে সপ্তাহ পালন শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২৯ তারিখে। মানুষ গুম করে ফেলার মতো নৃশংস ও মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াব্যাপী সপ্তাহ (International Week of the Disappeared) পালন প্রতিবাদের একটি ধরণ। সত্য যে যাদের প্রিয় মানুষগুলোর হদিস আর পাওয়া যাচ্ছে না, তার মৃত নাকি জীবিত সেটা তাদের আত্মীয়স্বজনও জানেন না – তাদের কষ্ট ও বেদনার মাত্রা বোঝার সাধ্য হয়তো আমাদের নাই। কিন্তু তারা যেন আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে না যায় তার জন্যই গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য এই সপ্তাহে তাদের বেদনার ভাগি হয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার জন্য সাতটি দিন। তাঁদের প্রতি সংহতি জানাবার মানবিক বোধটুকু যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।
খেয়াল করেছেন কি, কোন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এই সপ্তাহের গুরুত্ব নিয়ে কোন বিবৃতি আমরা দেখি নি। এমনকি সেইসব দলগুলোর কাছ থেকেও নয় যাদের নেতা কর্মীরা গুম হয়ে গিয়েছে। আমরা এমনই একটি দেশে আছি! অপরের বেদনা, ক্ষোভ, কষ্ট ও চাপা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্ঘতির মধ্য দিয়ে মানুষ আবার নিজদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির ওপর আস্থা ফিরে পায়।
আসুন আমরা সপ্তাহটি পালন করি। কিভাবে করা যায় তার পরামর্শ সকলের কাছ থেকে চাইছি। গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সপ্তাহ পালনের তাগিদ কিভাবে তৈরি হোল সেই ইতিহাসটুকু আগে জানার চেষ্টা করা যাক।
সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ আসে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে খুনি ডিক্টেটরদের ইতিহাস আমরা জানি। ষাট দশকের শেষ থেকে পুরা সত্তর দশক পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের একনায়কতান্ত্রিক সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের নির্বিচারে খুন, অকথ্য নির্যাতন এবং গুম করে ফেলার ইতিহাস শুনে ভাবতাম কিভাবে এটা সম্ভব? স্বাধীনতার পরপরই বুঝেছি হ্যাঁ, সম্ভব। হত্যা শুধু নাগরিকদের করা হয় নি, মুক্তিযোদ্ধাদেরও করা হয়েছে। আর, আমরা রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় কী পরিমান পশ্চাতপদ তা বুঝি যখন একাত্তরের রণাঙ্গণে অসীম সাহসের সঙ্গে জনগণের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা থাকার পরেও জনগণকে নিয়ে রাজনৈতিক রূপান্তরের কঠিন পথে না গিয়ে অনেকে শাসক পরিবর্তন করতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের ঐক্যের স্মৃতি না হয়ে বিভেদের গহ্বরে পরিণত হয়েছে, সেটা হয়ে উঠেছে যার যা খুশি আবর্জনা ফেলবার ডাস্টবিন। এখন বলতে ভয় পাই, আমরা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম, মোম্বাতির আলোর মতো সেই স্বপ্ন অন্যদের কাছ থেকে আড়াল করে এখনও লড়ে যাচ্ছি অনেকে। যেন নিভে না যাই। এখন সম্মুখে হাজির গুম হয়ে যাওয়ার ভয়াবহতা। পেট ফুটা করে ইঁট বেঁধে নদিতে লাশ ফেলে দেবার নৃশংসতা। ভাল। আমরা বহুদূর অগ্রসর হয়েছি।
তরুনদের খুব কম অংশই ইতিহাস জানে কিম্বা বোঝে। ইতিহাসের কর্তা হবার বাসনা তো দূরের কথা। ইতিহাস তাদের খড়কূটার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একপক্ষ আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি। তারা বিচার চায় না, ফাঁসি চায়। বিচারে ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় হলে আদালতের রায় মানে না। মানুষের ফাঁসি হওয়ার পর হাসি হাসি মুখে মিষ্টি খায়, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি বলে শ্লোগান দেয় এবং বিচিত্র যে ফাঁসির জন্য মোমবাতি জ্বালায়। আমার কোন ক্ষোভ নাই, এই তো আমাদের তরুণ প্রজন্ম(!)। তবে মোমবাতির জন্য মন খারাপ হয়।
আরেকপক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসকেই ইসলামের চূড়ান্ত সম্ভাবনা ভেবে সেই ইসলাম কায়েম করতে চায় যা জর্জ বুশ আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন -- হয় তুমি আমার সঙ্গে অথবা তুমি আমার দুষমন। তাদের দাবি দুনিয়ায় তারা যেভাবে ইসলাম বোঝে শুধু সেই মজহাবের মুসলমানই থাকবে, আর কেউ থাকবে না। কে কার কাছ থেকে এই তত্ত্ব নিয়েছে বলা মুশকিল।
জর্জ বুশের মরা লাশ মাথায় নিয়া নাচি
মরলে হমু শহিদ আর জিতলে হমু গাজি
সরল পথটা মাঝখানে। মানবেতিহাসকে এগিয়ে যেতে হলে মানুষকেই পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জীবাশ্ম ভিত্তিক পরিবেশ বিধ্বংসী শিল্পায়নের কালপর্ব পেরিয়ে যাবার ঈমান আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষকেই আবার দৃঢ়চিত্তে দাঁড়াতে হবে। ঈমান দৃঢ করে আরেকবার বিশ্বাস করতে হবে মানুষের পক্ষেই এই সৃষ্টির সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
ঈমান কথাটা সজ্ঞানেই আমি ব্যবহার করছি, কারন নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকদের কাছেও ইহলোকে আল্লার খলিফা হিসাবে মানুষ নির্বাচিত -- এই প্রস্তাবনা ধর্মীয় হতে পারে, কিন্তু খুবই শক্তিশালী প্রস্তাব। কোন জ্বিন, ফেরেশতা , দৈত্য , দানব, টেকনলজি বা বিজ্ঞানের ওপর এই দায় ও কর্তব্য প্রদান করা হয় নি। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষের চেষ্টা নাই, তা নয়। অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু মানুষ একসময় নিজের দিব্য প্রতিভা এবং নৈতিক শক্তির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে সমর্পন করেছে বাইরের শক্তির কাছে: পুঁজি কিম্বা টেকনলজি তার ধর্মে রূপান্তরিত হবার পর থেকে তার ধারণা সে 'ধর্ম' থেকে মুক্ত হয়েছে। এই ধোঁয়াশাও মানুষ কাটিয়ে উঠবে। কমিউনিজমের যে ধরন আমরা ইতিহাসে দেখেছি সেই বিশেষ ধরণের পতনের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে সেটা দেশকালে নির্দিষ্ট পাশ্চাত্য চিন্তা ও সভ্যতার সম্প্রসারণের অধিক কিছু ছিল না, যার পতন ছিল অনিবার্য। তারও পূজনীয় ছিল প্রকৃতি ধ্বংস করে শিল্প সভ্যতা গড়া। শহর বানিয়ে গ্রাম ধ্বংস। জগত শুধু ভোগের বিষয় বা বস্তু মাত্র, মনুষ্য নামক সম্ভাবনার বসত কিম্বা বাসস্থান নয় -- এই অনুমান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
তরুণদের খুব কম অংশই বোঝে যে কেন বাংলাদেশের ইতিহাসকে একটি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লাশ টপকিয়ে সামনে যাবার পথ তৈরি করতে হয়েছে। এটা জাতীয় ট্রাজেডি সন্দেহ নাই, কারণ যার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটত তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে তাকে ভূত হিসাবে আমরা ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছি এখন। চাইলেই আপনি এখন তাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারবেন না। ইতিহাস মশকরাতে বড়ই বাহাদুর! তবে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হচ্ছে এই যে একনায়ক শাসককে অপসারণ কঠিন নয়, কিন্তূ তুলনায় ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র মোকাবিলা অনেক কঠিন। এর হাত থেকে মুক্তি সহজ নয়। ইতিমধ্যে বহু মানুষ নিখোঁজ হবে, গুম হবে, তাদের লাশ পাওয়া যাবে না, মিছিলে গুলি করে মানুষ হত্যা করতে পুলিশের হাত কাঁপবে না, ইত্যাদি। বর্তমান পরিস্থিতি ৭২ -৭৫ কালপর্বের চেয়েও ভয়ানক।
অতএব আমাদের ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সেখানে নিখোঁজ হওয়া, গুম হয়ে যাওয়া, কিম্বা সরকারের কারাগারে গ্রেফতার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে থাকা মানুষগুলোর পরিবার ও পরিজন রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর নির্ভর করে বসে থাকে নি। তারা রাজনীতি, দল ও মতাদর্শ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তার নাম American Federation of Associations for Relatives of Disappeared-Detainees বা সংক্ষেপে FEDEFAM । তারাই প্রতিবছর মে মাসের শেষ সপ্তাহ ‘গুম ও নিখোঁজদের জন্য সপ্তাহ’ হিসাবে পালন করবার ডাক দিয়েছিল এবং তা বিশ্বব্যাপী সমর্থন পেয়েছে।
এই সপ্তাহে কিছু প্রাথমিক বিষয়ে সকলের মনোযোগ নিবদ্ধ করবার অনুরোধ করছি।
প্রথম কাজ হচ্ছে গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance বা সংক্ষেপে ICPED) সার্বজনীন আন্তর্জাতিক বিধান হিসাবে কায়েম ও বলবৎ করা। ICPED জাতিসংঘে সম্প্রতি গৃহীত হয়েছে, ২০ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে এবং তা কার্যকর হতে শুরু করেছে ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ সালে। বাংলাদেশ নির্যাতন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশানে স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ ICPED –তে স্বাক্ষর করে নি। তার মানে প্রচুর কাজ বাকি।
দ্বিতীয় কাজ: গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বা বিধিবিধানের আলোকে বাংলাদেশে গুম করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে আইন প্রণয়ন ও তা বলবৎ করে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া;
তৃতীয়, গুম সংক্রান্ত জাতিসংঘের কমিটিকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য দাবি তোলা। যেমন রাষ্ট্রগুলোকে মেনে নিতে হবে জাতিসংঘের এই কমিটিই ICPED বলবৎ হচ্ছে কি হচ্ছেনা তা দেখভাল করবার দায়িত্ব প্রাপ্ত এবং সেই অনুযায়ী ক্ষমতা সম্পন্ন। এই কাজে তাদের দক্ষতার স্বীকৃতিও জরুরি। তাদের হাতে এখন ৮৮টি দেশের ৪৩,২৫০টি গুমের ঘটনা তদন্তাধীন আছে।
চতুর্থ কাজ হচ্ছে যারা গুম হয়ে গিয়েছে বা যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তাদের তথ্য দৃশ্যমান করে রাখা। কারন তাদের পরিবার পরিজনের কাছে ভুলে যাওয়ার চেয়ে বেদনাজনক কিছু আর হতে পারে না।
এই পর্যায়ে বেশী কিছুর প্রত্যাশা হয়তো আমরা করতে পারবো না । কিন্তু নিদেনপক্ষে সচেতনতাটুকু যেন আসে।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।