উর্দু-ফার্সি-আরবি ও কওমি মাদ্রাসার লেখাপড়ার হকিকত
আকসার কওমি মাদ্রাসার নামের সাথে ‘জামেয়া’ শব্দটি দেখা যায়। ‘জামেয়া’ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়। কোথাও কোথাও ‘আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’-ও লাগানো থাকে নামের সাথে। যারা কওমি মাদ্রাসার লেখাপড়া সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারা মাদ্রাসার নামের ভেতরকার ‘জামেয়া’ বা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’শব্দটি লাগানো দেখে হয়ত ভেবে বসতে পারেন মাদ্রাসায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক ক্লাস আছে, মাদ্রাসা পড়ুয়ারা ভালো আরবি জানেন। তিক্ত হলেও সত্য এই যে, ব্যাপারটা পুরোপুরি উল্টো। মাদ্রাসা নামের মধ্যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি বসানো থাকলেও মাদ্রাসার সিলেবাসে যে আরবি পড়ানো হয়, তা খুবই নিম্ন মানের।
আরবি একটা আন্তর্জাতিক ভাষা। বিপুল পরিমাণ মানুষ আরবিতে কথা বলে। তাদের সংখ্যা বাংলাভাষীদের চেয়ে কম না।আন্তর্জাতিক মানের অনেক পত্রপত্রিকা বের হয় আরবিতে। মিশরের আল আহরাম পত্রিকা তো শত বছরের পুরোনো। আরবি ভাষায় অনেক বড় বড় লেখক আছেন। মিশরের নাগিব মাহফুজ একমাত্র লেখক যিনি আরবি ভাষায় লিখে নোবেল পুরস্কার পান। আরবি ভাষা এতদূর এগিয়ে গেলেও কওমি মাদ্রাআসায় যে আরবী পড়ানো হয়, তা আধুনিক বা এখনকার যুগের আরবি নয়। হাতে পড়ুয়া কয়েকজন কওমি-পড়ূয়া পাওয়া যাবে যারা আরবি দৈনিক পত্রিকা ও এ সময়ের গল্প-উপন্যাস পড়তে সক্ষম। কিন্তু তাদের এ সক্ষমতার পিছনে কওমি মাদ্রাসার অবদান নাই বলেই আমি মনে করি। তারা নিজেদের চেষ্টাতেই আরবি শিখেছেন।
আনুমানিক চার বছর আগেও কওমি মাদ্রাসার কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, তুমি কি নাগিব মাহফুজকে চেনো? আমি নিশ্চিত সে ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে বলত, না আমি তাকে চিনি না। পাঠক, চিন্তা করে দেখুন কত বড় সাংঘাতিক কথা! যারা প্রতিষ্ঠানের গায়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় লিখে রাখে, তারাই নোবেলবিজয়ী আরব লেখক নাগিব মাহফুজকে চেনে না। অথচ নাগিব মাহফুজ নোবেল পেয়েছেন সেই ১৯৮৮ সালে। খোদ মিশরেই মাহফুজের চেয়ে বড় বড় লেখক-সাহিত্যিক আছেন। সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসার কিছু কিছু ছাত্রের আধুনিক আরবির ব্যাপারে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ নাগিব মাহফুজকে চেনে। কয়েক বছর আগে নাগিব মাহফুজ মারা গেলে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার সাময়িকীতে তাঁকে নিয়ে খুব লেখালেখি হয়েছে। তারপর থেকেই নাগিব মাহফুজ বাংলাদেশে খুব পরিচিতি পেয়েছেন। এমনকি নগণ্য হলেও মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছেও।
আসল কথা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। আবার জায়গায় ফিরে যাই। মাদ্রাসাগুলোতে বছরের পর বছর ধরে উর্দু-ফার্সি অত্যন্ত গুরুত্ব ও প্রাধান্য সহকারে পড়ানো হয়। কিন্তু আরবির মতই এ দুটো ভাষারও বেহাল দশা। বর্তমান সময়ের উর্দু-ফার্সির সঙ্গে মাদ্রাসার কোন যোগাযোগ নেই।
কওমি মাদ্রাসায় প্রধানত আরবি-ফারসি-উর্দু এই তিন ভাষায় পাঠদান করা হয়। এ ভাষাগুলোরই হালত যদি এমন অবহেলিত নাজুক হয়, তাহলে মাতৃভাষা বাংলার কি চিত্র পাঠক কল্পনা করুন। একসময় কওমি আলেমগণ বলতেন, “উর্দু মে নুর হ্যাঁয়, বাংলা মালাওন কি ঝুবান”। বাংলা ছিল তাঁদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই অচ্ছুত।ফলে তাঁরা বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েও বাংলায় নেহায়েতই জাহেল। ইদানীং বাংলা ভাষার ব্যাপারে আলেমদের শত্রুভাবাপন্ন অভ্যাস আমূল পাল্টে গেছে বলা যায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়াতে চায় না। মাদ্রাসার নিচের শ্রেণীগুলোতে বাংলা পাঠ্যবই পড়ানো শুরু হয়েছে। পড়ানোর মান কেমন, তা যদিও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবু পড়ানো শুরু হয়েছে এটাই আশার কথা। মাতৃভাষায় জাহেল কোন জনগোষ্ঠী দ্বারা বিপ্লব বা আন্দোলন সফল হওয়া তো দূরের কথা, তাদের অস্তিত্ব বিপদাপন্ন হয়ে দাঁড়ায় টিকে থাকতে গেলে। আর এখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে ঘোরতর শেকড়মুখী হয়ে এবং নিজেদের গোড়া আঁকড়ে থেকে লড়াই লড়াইয়ের জন্য সামনে না তাকালে কর্পুরের মত উবে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। এ কথা আলেম সমাজ হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন কিনা জানি না। কোন কোন মাদ্রাসায় দেখছি নজরুল, আল মাহমুদ, আহমদ ছফার পাশাপাশি হুমায়ুন আজাদ ও সৈয়দ শামসুল হকের মত খাসা নাস্তিকদের বইও পাঠাগারে স্থান পেয়েছে। উঠতে বসতে যেখানে প্রতিদিন বাংলাতেই কথা বলতে হয় সেখানে আলেমরা উল্টা বিদেশী ভাষার দিকে যুগ যুগ ধরে ছুটছেন তো ছুটছেন। এ যেন ঘোড়ার আগে গাড়ির মত অবস্থা।
আরেকটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই যে, কওমি মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না। হোক সেটা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার ইতিহাস কিম্বা মুসলিম উম্মাহর বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে ইসলামের ইতিহাস। কোন ধরনের ইতিহাসের পাঠ্যবই সেখানে নাই। উল্টো মাদ্রাসাগুলোতে দেখা যায়, তাঁরা ‘আকাবির’ বা পুর্ববর্তীদের সংগ্রাম, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে ভয় পান। বিগত দুনিয়ার মানুষদেরও যে ভুল থাকতে পারে এ কথা তারা বেমালুম চেপে যান। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে পেছনের ভুল, ভ্রান্তি ও ব্যর্থতা শুধরে নিয়ে তারপর সামনে এগুতে হবে। অন্যথায় পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। মাদ্রাসাওয়ালাদের মাথায় কিছু কিছু বিষয়ে গোঁয়ার ধ্যান-ধারণা পাকাপোক্তভাবে গেঁড়ে বসে আছে। প্রযুক্তির এই যুগেও মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এই নিয়ম হয়ত ঠিক আছে কিন্তু মোবাইলের কারণে ছাত্রদের শারীরিকভাবে আঘাত করা কিম্বা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া একদমই অনুচিত বলে আমি মনে করি। কারণ এতে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যকার স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। মাদ্রাসার ভিতর ছাত্রদেরকে পেপার পড়তে দেয়া হয় না। পত্রিকা পড়লে নাকি ছাত্রদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাবে। আমি বলি সামান্য পত্রিকা পড়লেই যাদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় তারা কিভাবে উম্মতকে পথ দেখাবে? গোটা বিশ্বজগতে নবীর এমন দুর্বল প্রতিনিধি দেখে খুবই খারাপ লাগে আমার। নবীদের মতো তাদের মেজাজও জবরদস্ত না হয়ে, হয়েছে উল্টো। দেরিতে হলেও কেন যে ঘুম ভাঙছে না মাদ্রাসাগুলোর সেটা ভাববার বিষয়।
আর একটা কথা তুলে এই লেখার পর্দা নামাবো। বাংলাদেশে পদ্ধতিগতভাবে দুই ধরনের মাদ্রাসা আছে। উভয় ধরনের মাদ্রাসাই দেওবন্দপন্থী। প্রথম প্রকার মাদ্রাসা স্বাভাবিক কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আগাগোড়াই দেওবন্দের কারিকুলামে বা পাঠ্যব্যবস্থায় চলে। দেওবন্দের মতই এখানে একটি ছেলেকে দাওরা হাদিস(এম এ সমপর্যায়) শেষ করতে ৯/১০ বছর লেগে যায়। এই ধরনের মাদ্রাসায় উর্দু-ফারসির মত কঠোরভাবে আরবি শেখানো হয় না। তাই দেখা যায় ৯/১০ বছর পড়াশুনা করে মাওলানা হয়েও একটা ছেলে আরবিতে খুবই কাঁচা। ধর্মীয় আরবি কিতাবিদের বাইরে অন্য কোন আরবি বই পড়তে এরা অপরাগই বলা যায়। এমনকি পবিত্র কোরআনের তর্জমা শেখানোতেও প্রচুর গাফিলতি দেখা যায় এই মাদ্রাসাগুলোতে।
দ্বিতীয় যে প্রকারের কওমি মাদ্রাসা বিদ্যমান তাতে দাওরা হাদিস শেষ করতে সময় লাগে মাত্র সাতা বছর। এই পদ্ধতির উদ্ভাবক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ এর নাম দিয়েছেন ‘মাদানি নেসাব’। আজ থেকে প্রায় ২০/২২ বছর আগে কামরাঙ্গীরচরে ‘মাদ্রাসাতুল মাদিনা’ নামক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর মাদানি নেসাবের যাত্রা শুরু হয়। প্রচলিত কওমি মাদ্রাসার তুলনায় এখানে কম সময় লাগে বলে অনেকেই এটাকে ‘শর্টকোর্স’ মাদ্রাসা বলে থাকে। মাদানি নেসাব মাদ্রাসাগুলোয় প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি শেখানো হয়। উল্লেখ্য, মাদানি নেসাব ছাড়া অন্যান্য মাদ্রাসায় প্রথম কয়েক বছর উর্দু-ফার্সি পড়ানোর পর আরবি পড়ানো শুরু হয়। কঠোর অনুশাসনের মধ্যে উর্দু ও ফার্সির কঠিন নিয়ম বা ব্যাকরণের গ্যাঁড়াকলে প্রথম কয়েক বছর মস্তিষ্ক বন্দি থাকার পর যখন আরবি পড়ানো শুরু করা হয় তখন আর একটি ছেলের আরবি শেখার মন মানসিকতা থাকে না। মাথার মধ্যে উর্দু-ফার্সি জিলাপির প্যাচের মত অবস্থান করছে, সেখানে আরবি ঢুকবে কি করে! আমি মনে করি মাদ্রাসার ছাত্রদের মানসম্মত আরবি না জানার এটাও একটা অন্যতম কারণ।
মাদ্রাসাতুল মদিনাসহ অন্য ‘মাদানি নিসাব’ মাদ্রাসাগুলোতে প্রচলিত নিয়মে আরবি শেখানো হয় না। বরং এখানকার আকসার কিতাবই(পাঠ্যবই) মাওলানা মিছবাহ’র লিখিত। তাঁর উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি বাংলাদেশে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে। এখানকার ছাত্ররা অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো এবং বিশুদ্ধ আরবি জানে। এমনকি আধুনিক আরবি সাহিত্যের খোঁজ-খবরও রাখে অনেকেই।
এছাড়াও পাঠ্যব্যবস্থার বাইরে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ১/২ বছরের আরবি ভাষা ও সাহিত্য কোর্স আছে ‘আদব বিভাগ’ নামে। দাওরা হাদিস সম্পন্ন করার পরই কেবল এসব আদব বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। মোহাম্মদপুরে আল মারকাজুল ইসলামিতেও এক বছরের আধুনিক আরবি শেখার ব্যবস্থা আছে। আল মারকাজুল ইসলাম বাদে আর যেসব জায়গায় আরবি পড়ানো হয় সেগুলোতে সাধারণত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের নামে নাহব(আরবি ব্যাকরণ ও বাক্যগঠন প্রক্রিয়া)এবং ছারফ( শব্দের রুপান্তরের নিয়ম) পড়িয়েই ছাত্রদের ছেড়ে দেয়া হয়। গল্প-কবিতা-উপন্যাস বা পত্র পত্রিকা এসব কিছুই পড়তে শেখানো হয় না। সেই তুলনায় আল মারকাজুল ইসলামিতে অনেক ভালো আরবি শেখানো হচ্ছে। ভালো হোক মন্দ হোক একেবারে মডার্ন আরবি বলতে যা বোঝায় সেটাই এখানে শিখছে ছাত্ররা।
২০১০
নিজের সম্পর্কে লেখক
respect the way of thinking of others, rebuild values and utilize inner strengths