ব্লগার হত্যাঃ বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের ফলাফল জনসমক্ষে আসবে কী?
বাংলাদেশ এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। শুধু গত ছয় মাসেই খুন হয়েছেন চারজন ব্লগার। আর প্রতিদিন এখানে সেখানে কত মানুষের রক ঝরছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ব্লগার হত্যার ব্যাপারটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশি আলোচিত হতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ব্লগার হত্যার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবী জানিয়েছে।
অবশ্যই ব্লগার হত্যা একটা উদ্বেগজনক ইস্যু এবং ঘোরতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির। এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা, রিপোর্টিং হওয়া অত্যন্ত দরকারিও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব আলাপ-আলোচনা, রিপোর্ট কিভাবে হচ্ছে? কোন জিনিসকে সামনে আনছে বা কি লুকিয়ে রাখছে? আলোচনা কি ব্লগার হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার তাগিদে হচ্ছে নাকি অনেক ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে? কে এবং কেন খুন করেছে তা বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের ফলাফল জনসমক্ষে আসতেই হবে। কোন পরিকল্পিত পারসেপশন তৈরি অথবা তৈরি পারসেপশনের ঘাড়ে চড়িয়ে বয়ান খাড়া করা হবে আত্মঘাতি। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রবণতাই প্রাধান্য বিস্তার করে নাই এটা বলা যাচ্ছে না। ব্লগার হত্যাকান্ড বন্ধ করা তো দুরের কথা হত্যাকারীদের একটা যথাযথ বিচারের মুখোমুখি করাও দুরূহ হয়ে উঠছে।
আমরা যদি সত্যি সত্যি একটা বিচার চাই, তাহলে একটা নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করে অপরাধীদের চিহ্নিত করার দাবী করাই বাঞ্ছনীয়। নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যতীত আসল অপরাধী শনাক্ত হবে কি করে? কিন্তু মিডিয়া থেকে শুরু করে কাউকেই এ দাবী করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা দেখি অবধারিতভাবেই একটা বিশেষগোষ্ঠীর দিকে চোখ বিন্ধ করে সবার আঙ্গুল উঠে যায়। শুরু হয়ে যায় এর সাথে ইসলাম, জঙ্গী এসবের জড়িত থাকার নানা কেচ্ছা কাহিনী। বিচারের আগেই এক ধরণের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়। পাঠকের সামনে এমনভাবে হাজির করা হয় যেনবা নিশ্চিতভাবে এই ধর্মীয়গোষ্ঠীর-ই কাজ এটা।
যদিও ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকারীদের শিগগিরই ‘ধরে ফেলা’ সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। (হত্যাকারীদের ধরে ফেলব: মন্ত্রী, বিডিনিউজ, http://goo.gl/PlizR5)। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হত্যাকান্ডে সাতজনকে আটকের পর চার্জশিট দেওয়া ছাড়া অন্য ব্লগারের হত্যাকা-ের ঘটনায় এখনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। সন্দেহ আর তদন্তের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে এসব মামলার আসামিদের গ্রেফতার চেষ্টা। (ব্লগার হত্যা :ফাইলবন্দিই থাকছে তদন্ত, দৈনিক ভোরের পাতা http://bit.ly/1Q3ROHS)। মানে বাকিগুলোর চার্জশিট দেয়াতো দূরে থাক তদন্ত কাজও শেষ হয় নি। এমতবস্থায় পত্রিকাগুলোর একটা বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্রমাগত দায়ী করার পিছনে এর বিচার চাওয়া কাজ করছে না অন্য কিছু এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
এতো গেল তদন্ত কাজ শেষ হওয়ার আগেই কাউকে দোষারোপ করার প্রশ্ন। এরপরে আছে ফ্যাক্ট পাল্টিয়ে দেয়ার ব্যাপার। যথাযথভাবে তদন্ত করার ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট একটা গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার। তথ্যের বিকৃত উপস্থাপন তদন্ত কাজ একটা বিশেষ দিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। সম্প্রতি এমন এক তথ্য বিকৃতি নির্ভর প্রচারণা আমরা দেখি ব্লগার হিট লিস্ট নিয়ে। কয়েকটি পত্রিকা এই ব্লগার হিটলিস্ট হেফাজতে ইসলামের দেয়া বলে রিপোর্ট করে। ৭ই মার্চের এক রিপোর্টে দৈনিক যুগান্তর জানায় “আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) হিটলিস্টে রয়েছে সরকারের কাছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জমা দেয়া ৮৪ জন ব্লগার”(আনসারুল্লাহর হিটলিস্টে ৮৪ জন ব্লগার http://bit.ly/1IzosuB)। এর একমাস পর ১৫ই মে জনকন্ঠও একটা রিপোর্টে ব্লগারদের লিস্ট হেফাজতের দেয়া দাবী করে বলা হয় “তারপর থেকেই খুন হচ্ছেন মুক্তমনা লেখক ও ব্লগাররা”( মুক্তমনা ৮৪ ব্লগারের তালিকা দেয় হেফাজতে ইসলাম http://bit.ly/1KzdBXw)। পরে পত্রিকাগুলোর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন হেফাজতের আমীর আহমদ শফী। বিবৃতিতে তিনি ব্লগার লিস্ট হেফাজতের দেয়া নয় বলে দাবী করেন(ব্লগারের তালিকা হেফাজত দেয়নি http://bit.ly/1JH7f7G)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা হস্তান্তর করা হয় ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। ঐদিনের করা রিপোর্টে বিডিনিউজ জানাচ্ছে “বৈঠকে দৈনিক আল ইহসানের সম্পাদক আল্লামা মুহাম্মদ মাহবুব আলম নয়টি ব্লগ সাইটের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আনেন। ব্লগগুলো হচ্ছে, সামওয়্যার ইন ব্লগ, আমার ব্লগ, মুক্তমনা, নাগরিক ব্লগ, ধর্মকারী, নবযুগ, সচলায়তন, চুতরাপাতা ও মতিকণ্ঠ।
আল্লামা মুহাম্মদ মাহবুব আলম বিভিন্ন ব্লগ সাইটের ৮৪ জন ‘নাস্তিক ও অপপ্রচারকারী’ ব্লগারের তালিকা কমিটির কাছে হস্তান্তর করেন” (নাস্তিক’ ব্লগারদের তওবার দাবিতে সায় কমিটির http://bit.ly/1KnAAGC)। বিডিনিউজ সরকার সমর্থক পত্রিকা হিসেবেই পরিচিত। ঐ বৈঠকে হেফাজতের কোন নেতার উপস্থিত থাকার কথা বিডিনিউজ সেই নিউজে উল্লেখ করে নি। তাহলে এখন এই তালিকা হেফাজতের দেয়া বলে প্রচারের পিছনে উদ্দেশ্য কি? ব্লগার হত্যার বিচার তরান্বিত করা? তথ্য পাল্টিয়ে তদন্তকে ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করে ন্যায়বিচার তরান্বিত করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এটাও ঠিক যে তালিকা হেফাজত না দিলেও আলেমরাই দিয়েছেন। তাঁদেরও দায় আছে অবশ্যই। সেক্ষেত্রে ব্লগার হত্যার ব্যাপারে আলেম ওলেমাদের বক্তব্য সুপষ্টভাবে পাঠকদের কাছে তুলে ধরাই হচ্ছে পত্রিকার কাজ। কিন্তু তাঁদের কোন বক্তব্য পত্রিকাগুলো ছাপে তো না উলটা তাঁদেরকে এর জন্য দোষী করে প্রচার চালিয়ে পাঠকের কাছে তাঁদেরকে অপরাধী করে তুলে।
তৃতীয়ত আছে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুমিকা। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আগের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তবে সেটা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করায় না। যেখানে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে চাইলেই ঘরের ভিতর আটকে রাখতে পারে, প্রতিবাদকারীকে রাস্তা থেকে পিটিয়ে তুলে দিতে পারে সেখানে এতজন ব্লগারকে খুন করে অপরাধী পালিয়ে যেতে পারে কিভাবে? নাগরিকের জান-মাল রক্ষা করা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। সে দায়িত্ব তারা কতটুকু পালন করছে? এক্ষেত্রে সরকারেররই বা ভুমিকা কি? বলা হয়ে থাকে কিছু করা যেমন পলিসি তেমনি কিছু না করাও পলিসি। ব্লগার খুন হতে দেয়াই কি সরকারের পলিসি? এসব নানা প্রশ্নের সুরাহা ছাড়া ব্লগার হত্যাকান্ডের যথাযথ বিচার এবং হত্যাকান্ড বন্ধ করা সম্ভব না।
রাষ্ট্রে নাগরিকদের এমন কিছু অধিকার থাকে যা রাষ্ট্র যেমন হরণ করতে পারে না তেমনি অন্য নাগরিকও সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এ অধিকারগুলোর ব্যাপারে সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা কমন ঐক্যের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। রাষ্ট্র নাগরিকদের তরফে সেসব অধিকার দেখভাল করে। কেউ সে অধিকার লঙ্ঘন করলে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে তার সুরাহা করে। কিন্তু সেটা না করে যদি নাগরিকদের এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া হল সমাজকে আরো বিভক্তির দিকে ঠেলা দেয়া। একটা গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কারো কাম্য হতে পারে না।
এ পরিস্থিতে যদি ব্লগার হত্যার সুষ্ঠু বিচার এবং এ হত্যা বন্ধ হোক আমরা চাই। সবার আগে প্রয়োজন নাগরিকদের মধ্যে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে ঐক্যমত গড়ে তোলা। সে ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করা যেখানে ব্লগার হত্যাসহ সকল হত্যার ন্যায়বিচার করা যাবে।
কাউকে অহেতুক দোষারোপ নয় এ মুহুর্তে জরুরী হচ্ছে সবার কথা শোনা। সবাইকে কথা বলতে দেয়া এবং সে কথা শোনার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক নীতি। এ গণতান্ত্রিক নীতি ও মুল্যবোধ শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে যে রক্তের দাগ লেগে গেছে সেটা মুছা সম্ভব। নইলে বাংলাদেশকে আরো কত রক্ত পাড়ি দিতে হবে কে জানে!