দান্তে ও আবু নাসের আল ফারাবি

এবার ঈদের ছুটিতে কাজ থেকে ছুটি নেবো। কি কি আবার পড়ব তার তালিকা তৈরি করছি। তরুণ কবিদের কাজে লাগতে পারে ভেবে জানাচ্ছি, দান্তে আলিঘিয়েরির ‘ডিভাইন কমেডি’। এটা একই সঙ্গে ধৈর্যের পরীক্ষাও হবে। দান্তের ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের বিরোধিতা ও বিদ্বেষ অজানা কিছু নয়। বারো এবং তেরো শতকের খ্রিস্টিয় ক্রুসেড ইউরোপের স্মৃতি ও মননে কিভাবে ইসলাম বিদ্বেষ বদ্ধমূল করেছিলো দান্তে তার ভালো নজির। একই সঙ্গে মধ্য যুগে পাশ্চাত্যে ইসলামের প্রভাবও মনে রাখা দরকার। বিশেষত দর্শন, ওষুধশাস্ত্র ও গণিতে।  ফলে খ্রিস্টীয় ইউরোপের প্রধান মনোবাসনা ছিল নরকে ইসলামের নবি ও ইসলামি জিহাদের মূর্ত প্রতীক হজরত আলীকে নরকে শাস্তি দেওয়া। দান্তে সেই কুকর্মটিই তাঁর লেখায় করেছেন তারপরও পড়ব। কারন দান্তে ভূত হয়ে এখনও ইউরোপের আছেন।

সত্যি বলতে কি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ মনোযোগ দিয়ে তরুন বয়সে পড়িনি। নানা কারনে আকৃষ্ট করে নি। দান্তে ধর্মের একটা কাব্যিক ব্যাখ্যা হাজির করতে চান, আর সেটা করতে গিয়ে ধর্মের বিষয়কে কবিতাকে বিষয় বানিয়ে ব্যবহার করেছেন – ষাট আর সত্তর দশকের দিকে এটাই ছিল ঢাকা শহরে শিক্ষিত কবিকুলের অনুমান। দান্তে ইসলামের নবিকে কী চোখে দেখতেন সেটা বিচার্য ছিল না। কবিতা ভাল কি মন্দ লিখতেন সেই বিচার বাদ দিলে কবিতা কি জিনিস যারা, তারপরও বলি, সেটা আলবৎ জানতেন। এই সেই সময় যা আর ফিরে আসবে না। এখনকার যুগের সঙ্গে সে কালের তুলনাও চলে না।

জাতিবাদী সেকুলারিজমের উত্থানের সময়কাল এটা – অর্থাৎ একদিকে কবিতার বিষয় আর ধর্মের পরমার্থ অন্বেষণ সমার্থক সেটা অস্বীকারের মূর্খতা আমাদের গ্রাস করছে আর অন্যদিকে সেই বেকুবগিরির অভাব পূরণের জন্য ঢাকার কালিমন্দিরের সামনে বাংলা মদ খেয়ে কবিরা গলা ছেড়ে গাইছে, ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো’। রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় গান ততোদিনে খাঁটি ধর্ম নিরপেক্ষ গান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রগতিশীল হওয়ার মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ঝোলা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বৃটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী দাদাদের কাছ থেকে কমিউনিজমের দীক্ষা নেওয়া। দান্তে ঐ ডামাডোলে বিশেষ পাত্তা পান নি। তখনকার কোলাহলে হারিয়ে গিয়েছিলেন। বেহেশত থেকে নির্বাসিত আমরাও তাঁর পারাডাইস হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আর আশ্চর্য তারপরও তখন সময়ের কী এক দিলখোশ কারণে কমলকুমার মজুমদারই আমাদের কাছে একমাত্র কবি। ততোদিনে তিনিই ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন, মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ‘ঈশ্বর দর্শন’ ;( মুসলমানেরা দয়া করে এই স্থলে ‘আল্লার দীদার’ পড়বেন তাহলে আধুনিকতা নামক চরম প্রতিক্রিয়াশীলতার যুগে কবিরা কিভাবে তাদের ইমান অটুট রাখে তা খানিক আন্দাজ করা যাবে)।

dante

তবে কাব্য আর দর্শন এখন যুগপৎ দান্তের প্রতি আগ্রহ আবার তীব্র করছে। কেউ কেউ আজকাল দাবি করছেন পাশ্চাত্য লিবারেলিজমের নামে যে টলারেন্স বা ‘সহনশীলতা’র চর্চার কথা বলা হয় তার গোড়া আরব-ইসলামিক চিন্তার শেকড় থেকে এসেছে, পাশ্চাত্যে যার বীজ রোপন করেছিলেন দান্তে। ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের পরেও কেন আজকাল এই দাবি করা হচ্ছে বোঝা দরকার। তাঁকে এখন আর শুধু ধর্মতত্ত্বের জায়গা থেকে পড়লে চলছে না। আবু আল নাসের আল ফারাবি ধর্ম ও দর্শনের যে সম্পর্ক জারি রাখতে চেয়েছেন দান্তে সেই সম্পর্ক চর্চার ব্যবহারিক প্রয়োগে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। হতে পারে।

গ্লোবালাইজেশানের এই কালে আজকাল অনেকে আবু আল নাসের আল ফারাবির একটি দাবির কথা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ধর্মচর্চা নিয়ে পার্থক্য থাকলেও চমৎকার সব জনগোষ্ঠি আর চমৎকার সব শহর মানুষই বানাতে সক্ষম’। কেন? দেশ, কাল ও পাত্র ভেদে মানুষ তার জন্য উপযোগী আকিদা ও আচার আবিষ্কার করবেই। কিন্তু পরমার্থিক অর্থে ধর্ম যদি মানুষের স্বভাব হয় তাহলে পরমার্থ অন্বেষণের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্যের ক্ষেত্র সবসময়ই হাজির থাকে। সেই ঐক্যের  জমিন এখন অকর্ষিত কিন্তু হাজির – সাড়ে ষোল আনা উপস্থিত। একমাত্র কবিরা তার হদিস নিতে সক্ষম। সেই স্বভাব আন্দাজ করবার জন্য দান্তের ডিভাইন কমেডি এখন ধর্ম ও কল্পনার দুই প্রকার দৃষ্টির আলো ফেলে পড়বার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দান্তের পথ ধরে আবু নাসের আল ফারাবির কাছে ফিরে আসা -- মন্দ না। চলুন কাজাকিস্তান ঘুরে আসি।

পশ্চিমা সভ্যতার গোড়ায় ইসলাম ও আরব সভ্যতার বীজ আছে কিনা সেটা পণ্ডিতেরা গবেষণা করে দেখুক। অন্যদিকে দেবালয়ে যদি কেউ নিজেকে প্রদীপ বানাবার আকাঙ্ক্ষা করেন, সেখানে কাব্য, ধর্ম, ঐতিহ্য ও কল্পনা কিভাবে আলোর আভা হয়ে ওঠে সেটা কয়জনই বা দেখতে সক্ষম? তারাই পারেন যারা একই সঙ্গে মসজিদের মোমবাতি বা আতরদানির আভার মধ্যে বিশ্বাসীর প্রাণ কিভাবে অকাতর সৌরভে সকাতরে জ্বলে যায় -- সেই দহনের জ্বালা দেখবার শক্তিও ইতোমধ্যে অর্জন করেছে্ন। তাদের সংখ্যা খুবই কম।

কবিতা আসলেই যাদের সাধনা, তাদের বলি। আসুন বড় পরিসরে ভাবতে শিখি। কবিতাকে তার যোগ্য সম্মান না দিলে কবিতা লেখা যায় না।

অপরদিকে চাই তুমুল ধৈর্য। দেখা যাক দান্তের প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়ে নাকি কমে। ইউরোপের আরেকটি চেহারা তো চিনব। সেটাই নগদ লাভ।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।