ইসলামের কোরবানি, 'মনের পশু' তত্ত্ব ও খ্রিস্ট ধর্ম
এক
‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
১. প্রায় সব ধর্মেই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী পরমের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘কোরবানি’র বিধান আছে। বলাবাহুল্য তাকে ‘কোরবানি’ বলা হয় না। বলা হয় ‘বলী’,‘ঈশ্বরের জন্য রক্তোৎসর্গ’ ইত্যাদি। আরবিতে ‘উদিয়া’ শব্দের অর্থ ‘রক্তোৎসর্গ’। সেই দিক থেকে ‘ঈদুল আজহা’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘রক্তোৎসর্গের উৎসব’। এই ভাষাগত ইঙ্গিত থেকে নৃতাত্ত্বিকরা দাবি করতে পারেন আরব দেশের প্রাচীন প্রথার সঙ্গে এই উৎসবের সম্পর্ক রয়েছে। তবে উর্দু ও ফারসি ভাষাতে আরেকটি আরবি শব্দ ‘কোরবান’ থেকে ‘কোরবানি’ কথাটার চল হয়েছে। অনেকে মুসলমান হিসাবে নিজের সম্প্রদায়গত পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে চান বলে ‘পরমের সন্তুষ্টি লাভ’ কথাটা আরবি ভাষায় না হওয়ায় প্রকাশভঙ্গির কারনে একাত্ম বোধ নাও করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ তো অবশ্যই ইসলামের দিক থেকে পরম সত্য, সেই দিক থেকে 'পরম' ধারণার সঙ্গে একাত্ম বোধ না করার সমস্যাও আছে। তবে ইসলামের ইতিহাসে যাঁরা সাম্প্রদায়িকতা ও চিন্তার সংকীর্ণতাকে প্রশয় দেন নি, তাঁরা আল্লার সন্তুষ্টি বিধান ছাড়াও কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লার নৈকট্য লাভের কথা বলেন। কারন ‘কোরবানি’ শব্দটি যে ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন – অর্থাৎ‘করব’ - তা কোন কাম্য বস্তু বা বিষয়ের প্রতি নৈকট্য বোঝায়। কোন কিছু নিবেদনের মধ্য দিয়ে নৈকট্য লাভের বাসনা। ধাতু নির্ণয় বা ভাষার ব্যুৎপত্তি বিচারের দিকে না গেলেও আমরা জানি, মোমিনের জীবনে আল্লার নৈকট্য লাভের চেয়ে বড় প্রত্যাশা আর কিছু হতে পারে না। আল্লার নৈকট্য একই সঙ্গে সকল প্রকার সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোরবানিও বটে। বলাবাহুল্য ভোগবাদী সমাজে ধর্মের গভীর ইশারা, তাৎপর্য কিম্বা প্রস্তাবনা ভোগীদের ভাববার আর অবসর থাকে না। প্রতীক, ইশারা, উপাখ্যান, কল্পনা, পরমের প্রতি আন্তরিক নৈকট্য লাভের বাসনার ঘোর অনুপস্থিতির ফলে এই ধরনের সমাজে ধর্মচর্চা আদতে ধর্মহীনতায় পরিণত হয়। কোরবানি এখন ভোগীদের মাংস খাবার উৎসব আর ফ্রিজ বিক্রির মাসে পরিণত হয়েছে। হতে পারে। এই ভোগবাদিতার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই।
২. ইসলাম বিরোধী প্রপাগাণ্ডার অংশ হিসাবে কোরবানিকে নিছকই পশু হত্যা হিসাবে চিহ্নিত করবার চেষ্টা নতুন নয়। তবে সেকুলারিজম, নাস্তিকতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেবার জন্য ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে নিন্দিত করে তোলার চেষ্টা সাম্প্রতিক। একে প্রকট করে তোলার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের হিংসা, হিংস্রতা এবং প্রাণীর প্রতি নির্দয়তা সহজেই প্রমাণ করা যায়। যেহেতু কোরবানি শব্দটি বিশেষ ভাবে মুসলমানদের ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত, তাই সেই ভাবেই তাকে বিচার করা হয়। কোরবানির বিরুদ্ধে বিশেষ প্রচারও তাই ইসলাম ও মুসলমানদেরদের বিরুদ্ধে। অথচ ধারণাগত ভাবে যাকে মানুষ ‘পরম’ জ্ঞান করে তাকে সন্তুষ্ট করবার বিভিন্ন চর্চা অন্যান্য ধর্মেও রয়েছে এটা আমরা মনে রাখি না বা বুঝতে পারি না। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিভিন্ন কারণে ও প্রয়োজনে তার উদ্ভাবন ঘটেছে। অনেক সময় পরমের মধ্যস্থতায় সামাজিক ঐক্য দৃঢ় করবার প্রয়োজন হয়েছে। পশু উৎসর্গ করার মধ্যে অতএব মুসলমানদের কোন একচেটিয়া নাই। তবে কোরবানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গল্প, উপাখ্যান, মিথ কিম্বা ইতিহাস বর্ণনার পার্থক্য রয়েছে, ফলে তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ব্যাখ্যায় অবশ্যই স্বাতন্ত্র্য আছে। সেই দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ধর্মতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আধুনিক সেকুলার চিন্তায় ও সমাজে কোরবানির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী কিভাবে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বরং খ্রিস্টিয় চিন্তার সঙ্গে যুক্ত সেই দিকটার প্রতি নজর ফেরানোই আমাদের উদ্দেশ্য। তবে মনে রাখা দরকার আধুনিক সেকুলার চিন্তা ও সমাজের উৎপত্তি খ্রিস্টিয় ইউরোপে। এটা আমাদের সবারই জানা যে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু এই সকল 'ধর্ম' আধুনিকতার -- বিশেষত ইসলাম বিদ্বেষী আধুনিক মন মানসের ভিত্তি নয়, ফলে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের জীবের প্রতি অহিংসা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।
রোমান সম্রাট মারকাস অওরেলিয়াস (১৬১ – ১৮০) যুদ্ধে জয়ী হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য জুপিটারের মন্দিরে পশু বলী দিচ্ছেন । জুপিটারের মন্দিরে সামনে বলীর পশুসহ এই ছবি রোমের ক্যাপেটিলিন মিউজিয়ামের রক্ষিত রয়েছে)
৩। ধর্মের ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে প্রথমেই বোঝা দরকার পরমের সন্তুষ্টির জন্য প্রাণী উৎসর্গ করার বিধানের বিরোধিতা করা একান্তই একটি খ্রিস্টিয় চিন্তা। তাই এর বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রাণী প্রেম, অহিংসবাদ, নৈতিকতার বাগাড়ম্বর প্রদর্শন খুবই বিরক্তিকর। খ্রিস্টধর্ম একটি মহান ধর্ম। ফলে খ্রিস্টিয় চিন্তার বশবর্তী হয়ে কেউ ধর্ম চর্চার অংশ হিসাবে প্রাণী উৎসর্গ করবার বিরোধিতা করতেই পারেন। কারন খ্রিস্ট ধর্মের চোখে এটা ‘পাগানিজম’ – বর্বরদের চর্চা। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি, জাতি বা জনগোষ্ঠি অসভ্য ও পশ্চাৎপদ। তারা ধর্ম কি জানে না। দাবি করা হয়, খ্রিস্ট ধর্মই একমাত্র সত্যিকারের ধর্ম। যীশু নিজেকে নিজে ক্রসে ‘কোরবানি’ দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় কোরবানি আর কিছুই হতে পারে না। এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ কোরবানি। কোরবানির চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তিনি। এরপর অন্য সকল কোরবানি নিরর্থক। কারণ সত্যিকারের ধর্ম হাজির হয়েছে। এখন কর্তব্য হচ্ছে ক্রুসেড পরিচালনা ও সকল জনগোষ্ঠিকে ধর্মান্তরিত করা। আল্লার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পশু কোরবানি বন্ধ করা। পাগান বা বর্বরদের বিপরীতে খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রমাণের জন্যই পশু কোরবানি খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করেছে। যারা কোরবানির বিরোধিতা করেন, তারা খ্রিস্টান না হতে পারেন, কিন্তু সাধারণত তারা যে যুক্তি দিয়ে থাকেন, সেটা একান্তই খ্রিস্ট ধর্মেরই যুক্তি।
৪। এই দিক থেকে খ্রিস্ট ধর্ম সৎ। ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রাণী প্রেম, নৈতিকতার বাগাড়ম্বর এখানে নাই। এই বিরোধিতা খ্রিস্ট ধর্মের দিক থেকে একই সঙ্গে ‘কোরবানি’র ন্যায্যতা প্রমাণও বটে। যদি আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন বা নৈকট্য অর্জনই আমাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে কোরবানির দেবার চেয়ে বড় উৎসর্গ আর কি হতে পারে? কিন্তু ‘মনের পশু’ কোরবানির তত্ত্ব যারা দিয়ে থাকেন, তাঁরা নিজেদের সেকুলার প্রমাণ করবার জন্য এই সৎ অবস্থান গ্রহণ করেন না। তাঁরা যীশুর মতো মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে রাজি না। তাই তাঁরা ‘মনের পশু’ বধ করবার কথা বলে সস্তায় হাততালি পেতে চান।
৫। খ্রিস্ট ধর্মের যুক্তি হচ্ছে চূড়ান্ত কোরবানির উদাহরণ প্রদর্শিত হয়েছে। আর কোন কোরবানির দরকার নাই। যাঁরা মহান যীশুর উদাহরণ দেখে উজ্জীবিত তাদের উচিত প্রভুর প্রেমের জগতে আশ্রয় লাভ করা। কিন্তু এই সততা একই সঙ্গে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণারও ভিত্তি। এর দ্বারা কারা সভ্য আর কারা অসভ্য, অপরিষ্কার ও হননযোগ্য তাও নির্ধারিত হয়। সাদারাই একমাত্র সভ্য এবং তারা খ্রিস্টান। বর্ণবাদী হোয়াইট সুপ্রিমেসির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় খ্রিস্টধর্ম। যারা পশু কোরবানিকে বর্বর মনে করেন এবং ভাবেন যে এটা ধর্ম নিরপেক্ষ নৈতিক অবস্থান -- আসলে ব্যাপারটা অতো সিম্পল নয়। আপনি আসলে আপনার অজান্তে হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও বর্ণবাদের জয়গানই গাইছেন। কিন্তু নিজের চেহারা লুকিয়ে। আপনি যদি খ্রিস্টান না হয়ে থাকেন, আপনি নিজেই বলুন আপনাকে কী বলা যায়!
৬। ইসলাম হজরত ঈসা আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই কোরবানিকে মান্য করে। তিনি আল্লার রাসুল এবং তাঁকে রসুল হিসাবে মানা ইসলামে মোমিন হিসাবে বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয়ত, আল্লার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নিজেকে নিজে আল্লার পথে কোরবানি দেওয়া ইসলামের চূড়ান্ত একটি আদর্শ যার সঙ্গে ‘জিহাদ’-এর ধারণা যুক্ত। অর্থাৎ আল্লার সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে কোরবানি দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। হজরত ঈসার (আ) মধ্যে এই বিশুদ্ধ জিহাদি ও প্রেম মূর্তির সম্মীলন ঘটেছে বলে তিনি ‘রুহুল্লা’। তাঁর মধ্য দিয়ে নাফসানিয়াতের বিরুদ্ধে রুহানিয়াতের বিজয় ঘটেছে, এবং আল্লার সন্তুষ্টি বিধানের পথে মানুষ রুহানিয়তের পরম যে রূপ প্রদর্শন করতে পারে তার নজির। আল্লা তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। আখেরি নবির আগে আল্লার নৈকট্য লাভের চূড়ান্ত রূপ হজরত ঈসার (আ) মধ্যেই দেখা যায়। মানুষের পক্ষে এই হাল বা স্বভাব অর্জন সম্ভব, কারন দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষকে আল্লার খলিফা হিসাবেই – রুহানিয়াতের শক্তি সম্পন্ন করেই -- পাঠিয়েছেন। ফলে শুধু মৃত্যুর পর বেহেশতের লোভে, কিম্বা ব্যাক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয় বরং জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তি এবং আল্লার সৃষ্টি প্রতিটি প্রাণের হেফাজত ও সুরক্ষার জন্য ইসলাম জিহাদের কথা বলে। হজরত মোহাম্মদ (সা) শুধু মুসলমানদের মুক্তির জন্য আসেন নি। তিনি সকল মানুষের জন্যই এসেছেন। শুধু মানুষও নয় – পশু পাখি কীট পতঙ্গসহ আল্লার সকল সৃষ্টির রহমত হিসাবেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে হজরত ঈসাকে (আ) নিয়ে কোন ঝগড়া নাই।
৭। তবে বিরোধ তো অন্য ক্ষেত্রে আছেই। খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে ইসলামের বিরোধের প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্ম হজরত ঈসাকে আল্লার পুত্র বানিয়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যে রুহানিয়াতের বিকাশের সম্ভাবনা কার্যত অস্বীকার করে। এতে দাবি করা হয় আল্লার পুত্র না হলে ইহলৌকিক মানুষের পক্ষে এই প্রকার রুহানিয়াতের শক্তি অর্জন অসম্ভব। অন্যদিকে আল্লার কোন ছেলে মেয়ে নাই সেই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একত্ববাদের আদি রসুল হজরত ইব্রাহিম বা আব্রাহামেরও খ্রিস্টধর্ম বিরোধিতা করে। যীশুকে আল্লার পুত্র বলার মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রধান আপত্তি হোল এটা শেরেকি। ইসলামের অভিযোগ খ্রিস্ট ধর্ম হজরত ইব্রাহিমের একত্ববাদের শিক্ষা থেকে সরে গিয়েছে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্ম সভ্য/বর্বর, সাদা/কালোসহ মানুষের মধ্যে মানুষের বিভাজন তৈরি করে। আমরা ইসলামের আপত্তি নিয়ে তর্ক করতে পারি, কিন্তু দুটো ধর্ম যীশুকে মেনেও তাঁর তাৎপর্য বিচার করতে গিয়ে কোথায় পরস্পর পৃথক হয়ে যায় সেই দিকে নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
হিন্দু ধর্মে বলী। ধর্মচর্চার দিক থেকে প্রতিটি অনুষ্ঠানেররই নিজস্ব অর্থ রয়েছে। প্রতিটি ধর্মের অন্তর্গত ধারণা ও ঐতিহ্য থেকে দেখলে একে স্রেফ নির্দয় পশু হত্যাই মনে হবে।
৮। এবার আসা যাক আখেরি নবি কেন হজরত ঈসার (আ) নজির থাকা সত্ত্বেও কোরবানির প্রচলন করলেন। এর কারন হচ্ছেন হজরত ইব্রাহিম। আল্লার সন্তুষ্টি বিধান যদি রুহানিয়াতের পথ হয়ে থাকে তাহলে হজরত ইব্রাহিম আল্লার আদেশ পালন করতে গিয়ে তাঁর সব চেয়ে প্রিয় জিনিসকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন। কোরবানির এই নজির যেন আমরা ভুলে না যাই। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘আল্লা এক ও অদ্বিতীয়’ – ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহ্ -- এই সত্য তিনিই সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামপন্থিরা রসুলের উম্মত, কিন্তু একই সঙ্গে তারা – ‘মিল্লাতে ইব্রাহিম’-এর অন্তর্ভূক্ত। শেরেকির বিরুদ্ধে লড়তে হলে হজরত ইব্রাহিমের শিক্ষা কোন ভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। হজরত মুসা ও হজরত ঈসার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যারা হজরত ইব্রাহিমের একত্ববাদ থেকে সরে গিয়েছে -- অথচ বড় গলায় হজরত ইব্রাহিমকে তাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে যারা আবার স্বীকার করে -- তাদের সুপথে আনবার জন্যই হজরত ইবাহিম খলিলুল্লাহকে স্মরণ ইসলামে বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক। আল্লার আদেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম নিজের পুত্র সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব।
৯। হজরত ইব্রাহিম যখন হজরত ইসমাইলের গলায় ছুরি চালাতে যাচ্ছিলেন, গলা কাটছিল না। তিনি পাথরে ছুরি শান দিলেন। দিয়ে পাথরে ছুরির ধার পরীক্ষা করলেন, পাথর দুই ভাগ হয়ে গেলো। এরপর তিনি আবার সন্তানের গলায় ছুরি চালাতে গেলেন – কিন্তু কোন কাজ হোল না। কিন্তু তাতেও গলা কাটলো না। ইসলামের গল্প হচ্ছে এই যে হজরত ইব্রাহিম বললেন, হে ধারালো ছুরি, তুমি পাথর দ্বিখণ্ডিত করতে পারো, কিন্তু আল্লার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাজে বাধা হয়ে উঠছ কেনো? আল্লাহ ছুরিকে কথা বলার ক্ষমতা দিলেন। ছুরি বলল, আপনি একবার আমাকে হজরত ইসমাইলকে কোরবানির আদেশ দিচ্ছেন, আর আল্লাহ সোবহানুতাআলা আমাকে হাজার বার নিষেধ করছেন। আমি তাঁর অধীন। এসময় আল্লার নির্দেশে জিব্রাইল হজরত ইসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানির জন্য হাজির। পুরা ঘটনার মধ্যে তিনি আল্লার মহিমা আল্লা কিভাবে প্রকাশ করেন তার নজির দেখে বলে উঠলেন আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। হজরত ইব্রাহিম এই ঘোষণা শুনে পিছে ফেরে দেখলেন জিব্রাইল দাঁড়ানো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’। ছুরির নীচে স্বেচ্ছায় নিজের গলা পেতে রাখা হজরত ইসমাইল যোগ করলেন ‘ আল্লাহু আকবর, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ – আল্লাহ মহান, সকল প্রশংসা শুধু আল্লার জন্যই। এই গল্পের নানা বয়ান থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিটি মুসলমানের জন্য এই মূহূর্তটি চরম আবেগের বিষয়।
১০। অন্য যে কোন ধর্মের ইতিহাসের মতো ইসলামের ইতিহাসও সরল পথে এগোয় নি। তার অনেক মোড়, বাঁক, স্ববিরোধিতা, দ্বন্দ্ব আছে, আছে নানান মত ও মাজহাব। দুনিয়ার সকল মানুষকে একদিন এক্ত্রিত করতে হবে – রক্ত, গোত্র, আভিজাত্য, গোষ্ঠি, ভূখণ্ড, নৃতাত্ত্বিক কিম্বা ভাষা বা সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অতিক্রম করে মানুষ একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে -- ইসলাম এই স্বপ্ন দেখেছিল বলে তার আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছিল দ্রুত। হজরত ইব্রাহিম সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা। যে কারণে জেরুজালেমের দিক থেকে রুকু ইব্রাহিম খলিলুল্লার স্মৃতি মক্কার দিকে ফিরে যায় -- রুকু বদলের এই ইতিহাসের তাৎপর্য বুঝতে হবে। আখেরি নবী ভেবেছিলেন ইব্রাহিমের মধ্য দিয়ে তিনি সেই সময়ের সকল একত্ববাদী ধর্মকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। হজরত ইব্রাহিম সেই দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর সম্মানেই তাই কোরবানির ঈদ পালন ওয়াজিব করা হয়েছে।
১১। কিছু কথা বলে রাখলাম আপাতত এটা বোঝাবার জন্য যে কোন বিষয়কে আংশিক বা একদেশদর্শী ভাবে বিচার করা মোটেও ঠিক নয়। অর্থাৎ কোরবানি দেবার দরকার কি? ‘মনের পশু’কে কোরবানি দিলেই তো হয় – যাঁরা এইসব পপুলিস্ট কথাবার্তা বলেন তাঁরা আসলে নীতিগত ও কৌশলগত উভয় দিক থেকেই মারাত্মক ভুল করেন। প্রথমত বোঝা যায় ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁদের কোন ধারণাই নাই। দ্বিতীয়ত তাঁরা আসলে যে খ্রিস্টিয় তত্ত্বই ধোপদুরস্ত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান ধরে প্রচার করছেন – তাঁরা নিজেরাই তা জানেন কিনা সন্দেহ। যার অর্থ একালে দাঁড়ায় তাদের মনের পশুর তত্ত্ব না মানলে অন্যেরা ধর্ম চর্চার দিক থেকে বর্বব ও অসভ্য। ইসলামের সমালোচনা বা পর্যালোচনা করুন, কিন্তু না বুঝে বা না জেনে নয়। প্রপাগান্ডার শিকার হবেন না।
সরি, 'মনের পশু' তত্ত্ব মেনে নেবো না।
১২। তবে যাঁরা সত্যি সত্যিই যেভাবে এখন ‘উৎসব’ করে কোরবানি দেওয়া হয় তার বিরোধিতা করেন, তাঁদের অনেক যুক্তি আছে। আমি তা সমর্থন করি। তাঁরা 'মনের পশু'র ধারণার মধ্য দিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলতে চান, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায্য। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতন থেকে তুলবার ধরণ এবং ধর্মের ইতিহাস ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ না করায় এতে ভুল বোঝার সম্ভাবনাই বেশী। এটা তো সত্যি যে আমাদের কিছু বৃত্তি, চরিত্র ও আচরণ রয়েছে যা বিপজ্জনক। পশুর প্রতি নির্দয় হওয়া, অতিরিক্ত ধর্মোৎসাহ পশু হত্যা বাড়িয়ে দেওয়া, ইত্যাদি। প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি দরদ ইসলামের নীতি, কিন্তু সেই দরদের অভাব আমাদের কাতর করছে না। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ। এসব নিয়ে সুযোগ পেলে অন্যত্র আলোচনা করব। তবে পশুকে জীব হিসাবে ইসলাম মানুষের চেয়ে হীন মনে করে না। মনের পশুকে হত্যা যদি সিদ্ধ বলে গণ্য হয় তাহলে বাস্তবে পশু কোরবানি দেওয়া অগ্রহণযোগ্য কেন তার কোন যুক্তি নাই। এই জন্যই ইসলাম কথাটাকে 'পশু' প্রতীক দিয়ে বলতে নারাজ। এই ক্ষেত্রে সঠিক শব্দ হচ্ছে 'নাফসানিয়াত' -- মানুষের নিজের নফস থেকে মুক্ত হতে না পারা। মুক্ত হবার পথ হচ্ছে 'জিহাদ'। অর্থাৎ নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। কিন্তু 'জিহাদ' শুনলে অনেকের গা হাত পা কাঁপতে থাকে -- সমস্যা এইখানে।
১৩। শুধু বলে রাখি, কোরবানির ঈদ মোটেও উৎসব নয়, এটা পরীক্ষার দিন। মানুষের রুহানিয়াত অর্জনের সম্ভাবনা স্বীকার করে নিজেকে আল্লার পথে যে কোন সময় কোরবানি দেবার শপথ নেবার দিন, মোমিন সেভাবেই এই দিনটি পালন করেন। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের অবশ্যই কিছু বিষয় পালন জরুরী বলে ছেলেবেলা থেকে আলেম ওলামা মুফতিদের কাছ থেকে জেনেছি। সেটা হোল, (১) কোরবানির গোশত একবেলার বেশি যেন ঘরে না আসে সেইদিকে খেয়াল রাখা; (২) বাকি গোশত গরিবদের মধ্যে অবশ্যই বিলিয়ে দিতে হবে। কোরবানির গোশতের তারাই হকদার। এই দিনে গরিবকে তার হক থেকে বঞ্চিত করার চেয়ে বড় কোন গুনাহ আর হতে পারে না। তিন ভাগ করে এক ভাগ আত্মীয় স্বজনদের দেওয়ার বিধান আছে। এই বিধান কোন ছহি হাদিসের ওপর ভিত্তি করে প্রামান্য নিয়ম হিসাবে না, ঐতিহ্য হিসাবে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া গরিবের কথা বলার মধ্যে আত্মীয়স্বজনও অন্তর্ভুক্ত, যারা গরিব। ফলে গরিবের হকের ওপর জোর দেওয়া একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১৪। কোরবানির গোশত জমিয়ে রেখে খাওয়ার মধ্যে যে ভোগবাদিতা ও ভোগী আচরণ গড়ে উঠেছে তা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দুঃখিত। যারা মাংস খেতে চান তো খান। তবে দয়া করে মিল্লাতে ইব্রাহিমের অপমান করে ঈদের দোহাই দিয়ে এই ভোগবাদিতার পক্ষে যুক্তি দেবেন না। ভোগবাদিতার সঙ্গে কোরবানির কোন সম্পর্ক নাই। এর সঙ্গে সম্পর্ক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও ব্যাক্তিতন্ত্রের। ইসলামকে অবশ্যই এই পুঁজিতন্ত্র ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে দাঁড়াতে হবে। না দাঁড়ালে ভোগবাদীদের চরিত্রই ইসলামের চরিত্র বলে সবাই মারাত্মক ভুল করবে। আলেম ওলামা মওলানা মুফতিদের এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। এখন ঈদের যে রূপ তা ভোগবাদিতারই প্রতিযোগিতা। দয়া করে এর সঙ্গে কেউ ইসলামকে জড়াবেন না। সবার কাছে আবেদন, ভোগবাদিতার বিরোধিতা করুন। মাংস খাওয়া আর গরু জবাইয়ের উৎসবের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক আছে বলে অন্তত আমার সীমিত পড়াশুনায় মনে হয় নি। যারা জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ ও মুফতি – মতামত দেবার অধিকারী -- তাঁরাই ভাল জানবেন।
২৫ সেপ্টেম্বর। ২০১৫।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।