ইবনে তাইমিয়া প্রসঙ্গে আলাপ

বর্তমান পৃথিবীতে যেসব প্রশ্ন আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে এবং নতুন রাজনীতি নির্মাণে প্রধান প্রশ্ন আকারে সামনে এসেছে এর মধ্যে ‘শরিয়াহ’ অন্যতম। শরিয়া নিয়ে দুনিয়া জুড়ে নতুন আলাপ আবার শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ৯/১১ পরবর্তী দুনিয়ায় উত্তর আধুনিক চিন্তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুনিয়ায় ইসলাম প্রশ্ন যেভাবে হাজির হচ্ছে তা পঠন-পাঠনের তাগিদ হিসেবে। এক্ষেত্রে গত এপ্রিল মাস থেকে চিন্তা পাঠচক্রে আমরা ধারাবাহিকভাবে জাসের আওদার ‘মাকাসেদে শরিয়াহ’, ইবনে তাইমিয়ার ‘সিয়াসা শারিয়া’, হাশিম কামালির ‘শারিয়া ল’, বাবের জোহানসেনের ‘A Perfect Law in an Imperfect Society’, তালাল আসাদের ‘রিলিজিয়ন, ন্যাশন স্টেইট এন্ড সেক্যুলারিজম’ ও ‘মুহাম্মাদ আসাদ বিটুইন রিলিজিয়ন এন্ড পলিটিক্স’, ওয়ায়েল হাল্লাকের ‘ইম্পসিবল স্টেইট’ ও ‘can shariyah be restored?’, মোহাম্মেদ ফাদেলের ‘a tragedy politics or an apolitical tragedy’, ওভামির আঞ্জুমের ‘Politics, law and community in Islam: Ibn taimiyah moment’ সহ শরিয়া নিয়ে হাজির ক্ল্যাসিক্যাল টেক্সটগুলা আলোচনা করেছি। এসব আলোচনার ধারাবাহিক সারসংক্ষেপ তুলে ধরে ‘নতুন রাজনৈতিকতা বিনির্মাণে শরিয়া প্রশ্ন’ নিয়ে একটা নৃতাত্ত্বিক আলোচনা তুলে ধরব। 

 

পলিটিক্যাল ইসলাম বলে পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন যে ধারণাটা চালু আছে তার একেবারে গোড়া ধরা হয় ইবনে তাইমিয়া থেকে। বিশেষ করে বর্তমান দুনিয়ায় আল-কায়েদা, আইএস, মিলিট্যান্ট ইসলাম ও পলিটিক্যাল ইসলাম নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা এসব ধারণার উৎপত্তির একেবারে গোড়াতে গিয়ে যে মানুষটার খোঁজ পান, তিনি ইবনে তাইমিয়া। ফলে নানান দিক থেকে ইবনে তাইমিয়া আর তার চিন্তাকে নতুন করে পাঠ করাটা জরুরি।

আমরা ইবনে তাইমিয়ার ‘আস-সিয়াসা আস-শরিয়া’ নিয়ে আলোচনা করছিলাম; যাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে ‘পলিটিকাল শরিয়াহ’ নামে। এরপর ইবনে তাইমিয়ার উপরে ওবামির আনজুমের করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থিসিসটা নিয়ে আলোচনা করব। সেটাতে যাওয়ার আগে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ইবনে তাইমিয়া নিয়ে আরো যারা আলোচনা করেছেন তাদেরকেও বুঝা দরকার। এজন্য Baber Johansen এর লেখা "A Perfect Law in an Imperfect Society: IbnTaymiyya’s Concept of Governance in the Name of the Sacred Law" এর একটা সারসংক্ষেপ তুলে ধরব। উল্লেখ্য, বাবের জোহানসেন হার্ভার্ড ডিভাইনিটি স্কুলের ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ বিভাগের নামকরা অধ্যাপক, জাতিতে জার্মান। ক্ল্যাসিকাল ও আধুনিক মুসলিম দুনিয়ায় ইসলাম ও আইন নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। বিশেষ করে হানাফী মাজহাবে সম্পত্তি ও আইনের ধারণা নিয়ে তার লেখা “Islamic Law on Land Tax and Rent (1988)” খুবই আলোচিত। এছাড়া ফিকহ শাস্ত্রে তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে “Contingency in a Sacred Law: Legal and Ethical Norms in the Muslim Fiqh (1999)”

 

ইবনে তাইমিয়ার আবির্ভাব এমন একটি সময়ে যখন মঙ্গলদের আক্রমণের শিকার হয়ে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে। পরবর্তীতে মামলুকরা ক্ষমতায় আসে। ইসলামে ভিতরেই খিলাফত ধারণার মধ্যে ইসলামী শাসন-চিন্তা নিয়ে তখন অনেকগুলো বিতর্ক ছিল। কিন্তু তখনো সিম্বলিকালি এবং প্র্যাক্টিকালি খেলাফত ব্যবস্থাটা ছিল। সেটা ভেঙ্গে যাওয়ার পরে শুরু হয় সালতানাত। তারপরে মামলুক। পরবর্তীতে বর্তমান তুরস্কে আরেকটা যে ব্যবস্থা তৈরি  ঐটাও সালতানাত-ই ছিল। আমরা যদিও বলি ওসমানী খিলাফত, কিন্তু আসলে এটা খিলাফত ছিল না। এরপর যেসব আলেম ওলেমা নতুন করে রাজনৈতিক চিন্তাটাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের একটা অংশ শরিয়াহ নামক চিন্তাটাকে পদ্ধতিগতভাবে গড়ে তুলছেন। এবং আস্তে আস্তে এ কাজটি একটা প্রফেশন হয়ে উঠেছে।

আমরা ইমামদের নিয়ে আলোচনায় ইসলামি শরিয়াহর বিকাশের ক্ষেত্রে একটা কথা বলেছিলাম। সেটা হচ্ছে, শরিয়াহ একটি কাউন্টার সোশাল মুভমেন্ট আকারে গড়ে উঠেছে। সেটা খিলাফত ব্যবস্থার মধ্যে যতটা না স্পষ্ট ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে সালতানাত পিরিয়ডে। তখন জুরিস্ট হিসাবে আলাদা করে ওলেমাদের মধ্যে যে অংশটা ছিলেন তারা আসলে মুফতি ছিলেন। এদের সাথে সবসময় সরাসরি কাজীর সম্পর্ক ছিল না। মুফতি মানেই কাজী ছিলেন ব্যপারটা এরকম নয়। কাজী হচ্ছে সরকার যাদেরকে নিয়োগ দিতেন। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা কথা বলব।

যে কথাটা বললাম, এই যে নতুন করে কিছু ধারনার উৎপত্তি হল এবং  এর ফলে একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড শুরু হল। তাইমিয়ার পজিশনটা নিয়ে মোটা দাগে দুটো আলোচনা আছে। তাইমিয়া কেন খিলাফত ধারনার উপর ভিত্তি করে তাঁর ইসলামিক চিন্তা গড়ে তুললেন না? তিনি কি এটাকে রিজেক্ট করে দিয়েছেন? নাকি তিনি ঐতিহাসিকভাবে (হিস্টরিকালি) খিলাফত যেটা ছিল সেটাকে গ্রহণ করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে অন্য একটা বয়ান দিয়েছেন। এরকম নানা তর্ক আছে।

আজকে রাকীবের কাছ থেকে যেটা চাইব, একটা হল ঐ সময়কালের প্রেক্ষাপটটা আলোচনা করা। তাঁর জন্ম হারান শহরে। পরবর্তীতে সেখানে মঙ্গলদের আক্রমণ হওয়ায় তিনি মিশরে চলে যান। এবং পরে আবার সিরিয়ায় যান। ফলে তিনি মিশর এবং সিরিয়ার মধ্যে জীবনকালটা অতিবাহিত করেন। ঐ সময়টা মামলুকদের শাসনকাল ছিল। সেখানে মূল চারটা মাজহাব রাষ্ট্রিয়ভাবে স্বীকৃত ছিল। চার মাজহাব থেকে যেভাবে কাজী নিয়োগ করা হত, এর বাইরে এসে তাইমিয়ার চিন্তাটা কি ছিল? কেন তিনি এই আলোচনাটা শুরু করেছেন? কোন পর্যায়ে গিয়ে মামলুক শাসনের সাথে তার বিরোধ হয়ে তাকে জেলে যেতে হল? এবং সুফি ধারার সাথেও তার বিরোধের জায়গাটা কি?—এগুলো আমরা আলোচনা করব। একটা ট্রাডিশনাল আলোচনা আছে যে তিনি খুব সুফি বিরোধী ছিলেন, খিলাফত বিরোধী ছিলেন, দর্শন বিরোধী ছিলেন। এসব বিষয় নিয়েই জোহানসেনের আলোচনা।

 

বাবের জোহানসেন প্রথম শুরু করেছেন ইবনে তাইমিয়া কখন এবং কিভাবে ইবনে তাইমিয়া হয়ে উঠল। তিনি প্রথমে দেখিয়েছেন, তাইমিয়া যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন সেটা ছিল মামলুক বংশ। এ সালতানাতটা ১২৫০ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত স্থিতি ছিল। মামলুক বংশের আগে আব্বাসিয় এবং উমাইয়া খিলাফত ছিল। মামলুকরা ককেশাশের কোনো এক জায়গার দাস ছিল। মিশরের মিলিটারিরা তাদেরকে নিয়ে আসছিল, নিয়ে আসার পরে কোন এককালে তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আব্বাসিয় শাসন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেই দাসরাই মিশর-সিরিয়া-লিবিয়ার বিশাল অঞ্চলে শাসন ক্ষমতা দখল করে। দখলের পর তারা প্রধান যে সমস্যায় পড়ল সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতা। তারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতা চাইল। কারণ, তাদের পূর্বসুরি উমাইয়া আর আব্বাসিয়রা আরবের সংস্কৃতি আর ধর্মীয় আবহে নিজেদের শাসনের যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতা লাভ করেছিল, মামলুকদের সেরকম কোন বৈধতা ছিল না।

ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য তারা কয়েকটা কাজ করল। প্রথমত, তারা ক্রুসেডে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের এক ধরনের ধর্মীয় বৈধতা তৈরি করল। এরপর তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মিশরকে একটা প্রধান কেন্দ্র করে ফেলল, যার ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মামলুকদের যত শিক্ষিত লোক ছিল তারা সবাই মিশরে চলে আসল। এরপর তারা প্রধান চারটা সুন্নী স্কুলের প্রত্যেকটা থেকে একজন করে কাজী নিয়োগ করল, যারা প্রধান বিচারপতির কাজ করত। মামলুকরা সেখানকার মাদ্রাসাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অনুদান দিল।

শেষতক তারা দুইভাবে সেখানে নিজেদের বৈধতা তৈরি করল। একটা হচ্ছে মিলিটারির মাধ্যমে সিরিয়া এবং মিশরকে ক্রুসেডের হাত থেকে রক্ষা। অন্যটি হল ধর্মীয় বৈধতা পাবার জন্য সুন্নী স্কুলের প্রধান চারজনকে কাজী নিয়োগ করা।

এরকম পরিবেশের মধ্যেই ইবনে তাইমিয়ার বেড়ে ওঠা। সেসময় মামলুক শাসকদের অনেকেই নিজেরা যখন বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে যেত, রিলিজিয়াস অথোরিটিও শাসকদের সাথে সাথে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যেত। আবার পরবর্তীতে দেখা যেত, অনেক শাসক ধর্মীয় স্কুলগুলোকে কখনো সহায়তা দিচ্ছে,আবার কখনো দমন করছে।

ইবনে তাইমিয়ার জন্ম ১২৬৩ সনের দিকে হারানে। এই সময় মঙ্গলরা হারানে চরম আক্রমণ করলে তাঁর পিতাসহ তিনি দামেস্কে চলে আসেন। দামেস্কে এসে তিনি হাদীসের উপর এত জ্ঞান অর্জন করেন যে, সেসময় ইবনে তাইমিয়া যেটাকে সহীহ হাদীস বলতেন ঐটাই সহীহ হাদিস হিসেবে সবাই মানত; আর যেটাকে সহীহ বলতেন না সেটাকে সবাই বর্জন করত। এক পর্যায়ে তাইমিয়া হাম্বলী স্কুলের প্রধান অথোরেটি হয়ে গেলেন। সে সময় একজন খ্রিষ্টান ব্যক্তি মুহম্মদ(স) কে অবমাননা করলো। এ ঘটনায় ইবনে তাইমিয়া ফতোয়া দিলেন যে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। কিন্তু সিরিয়ার যে গভর্নর ছিলেন তিনি এটা মেনে নিতে পারেন নাই। গভর্নর ইবনে তাইমিয়াকে তার মত পরিবর্তন করতে বলেন। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া কিছুতেই তার মত থেকে সরেন নাই। শেষে ঐ অবমাননাকারী খ্রিষ্টান ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং গভর্নরের পরামর্শে তওবা করার কথাও বললেন। ইবনে তাইমিয়া এরপরো বলছেন যে তাকে মৃত্যুদন্ডই দিতে হবে। এবার তিনি নতুন করে ফতোয়া দিলেন, খ্রিস্টান হোক মুসলিম হোক মহানবীকে যে অবমাননা করবে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এটা সে-সময় বিশাল বিতর্ক তৈরি করল।

সেকালের জগতখ্যাত গাজাল খান যখন দামেস্কে আবার আক্রমণ শুরু করল, তখন ইবনে তাইমিয়া নিজে গাজাল খানের সামনে গিয়ে বললেন, তোমার এই এই কাজগুলো করা উচিত। গাজাল খান যে সব মুসলাম সম্প্রদায় দখল করল, এর মধ্যে মারদানি সম্প্রদায় নিয়ে তিনি একটা ফতোয়া দিলেন। তিনি দেখলেন ঐ সম্প্রদায়  মুসলমানরা দখল করলেও সেখানে ইসলাম মোতাবেক শাসন চলছে না। তিনি বললেন, দারুল ইসলাম হলো যেখানে মুসলিমরা শরিয়াহ দ্বারা শাসন করছে। আর ‘দারুল কুফর’ হলো যেখানে অন্য ধর্মের লোক শাসক করছে। এবং ‘দারুল হরব’ হলো যেখানে মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে লড়াই চলছে। মারাদানী সম্প্রদায়ে যেহেতু সবাই মুসলিম এবং তারা ইসলামী শাসন অনুযাযী চলছে না, সেখানে ইবনে তাইমিয়া এটাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন। তখন তিনি এর নাম দিলেন ‘দারুন আহাদ’। এসব ঘটনার কারণে তাইমিয়া তখন আলোচনায় চলে আসলেন।

সেসময়ে অন্যান্য যেসব স্কুল ছিল বিশেষ করে মালেকি ও শাফি; এদের সঙ্গে আল্লাহর ধারনা নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার তর্ক হচ্ছিল। এজন্য তাঁরা তাইমিয়ার উপর একটু ক্ষেপে যায়। আমরা জানি যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চার পাঁচবার কারাবরণ করেছেন। এর মধ্যে একজন মাত্র শাসক ছিলেন যার সাথে তাইমিয়ার সম্পর্ক ভাল ছিল। তার নাম- কাওয়ান। কারণ কাওয়ান যাকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাইমিয়া তার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন ক্রসেড নিয়ে। তিনি ১৩০৯ সালে যখন জেল থেকে বের হলেন, তখন কাওয়ান আবার ক্ষমতা নিল। তাইমিয়ার যে বিখ্যাত গ্রন্থ পলিটিকাল শরিয়াহ, এটি ঐ সময়ের লেখা।

মামলুকদের আগে সিরিয়া ও মিশরে প্রধান কাজী ছিলেন শাফি মাজহাবের ওলামারা। যখন মামলুকরা এসে চার স্কুল থেকে চারজন কাজী নির্ধারণ করলেন শাফি মাজহাবের একচ্ছত্র ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হল। শাফিদের একটা অংশ ছিল আশআরী; আল্লাহর ও সত্তার ধারণা নিয়ে তখন তাদের মধ্যে একটা থিওলজিক্যাল তর্ক হচ্ছিল। যে কোন সত্তা তাঁর যে সাবস্টেন্স, সেটা কি সত্তার নিজের অংশ নাকি অন্য কোন কিছুর কারণে নির্ধারিত হয়। নির্ধারক সত্তাটা কি সত্তার মধ্যে থেকেই তৈরি হয়, নাকি বাইরে থেকে তৈরি হয়।

তো এই তর্কে ইবনে তাইমিয়া বললেন যে, কোরানে আল্লাহ নিজেকে যেভাবে হাজির করেছেন, সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে, অর্থাৎ Anthropomorphic যে বয়ান আছে আল্লাহ ঠিক তেমনই। এটা বলার পরে তাঁর সঙ্গে শাফি স্কুলের কাজীদের তর্ক হওয়া শুরু হল। তখন তাঁরা কাজীর কাছে তাঁর নামে আপিল করল। আপিলে প্রথমবার তিনি বেঁচে গেলেও পরের বার দুই বছরের মত তাঁর জেল হয়। এরপরে বার বার তিনি যখনই তাঁর বয়ান দিতে লাগলেন, সুন্নী আলেম-ওলেমা ও সুফিরা তাঁর উপর চটে গেলেন। আবার কাজী ডাকলেন; ডেকে বললেন আপনি বলেন যে, আপনি যে বয়ান দিচ্ছেন এটা আপনার নিজের না, এটা হাম্বলী মাজহাবের একটা চিন্তা। এতে আপনি শাস্তি থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব খারিজ করে দেন এবং তাকে আবার কারারুদ্ধ করা হয়।

এরপর আসি দ্যা মিনিং অফ সেকরেড ল; যেটাকে আমরা আসমানী আইন বলি। ইবনে তাইমিয়া একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, গভর্ন্যান্স একর্ডিং টু দ্যা সেকরেড ল। তিনি যখন এটা লিখছেন তার আগে একজন শাফি বিচারক ছিলেন যিনি তাইমিয়াকে অভিযুক্ত করেছেন উমাইয়া নামক একটা মতবাদের জন্য। তখন তাইমিয়া ফতোয়া দিলেন যে বিচারকের কাজ হচ্ছে কারো মধ্যে যদি মতবিরোধ থাকে এটার নিষ্পত্তি করা। কোন ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা একজন বিচারকের কাজ না।

এই বইটাতে তিনি আসমানী আইনকে তিনটা ভাগে ভাগ করেছেন। ১. রিভিল্ড ল (revealed law): যেগুলো সুস্পষ্ট এবং কোন খুত নেই। ২. ইন্টারপ্রিটেড ল (interpreted law): সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন নতুন সমস্যা আমাদের সামনে দেখা যায়, কোরানে যেগুলো নিয়ে সরাসরি কোন নির্দেশনা নাই, তখন বিচারক নিজের চিন্তা ভাবনা অনুযায়ী একটা রায় দেন কোরান-হাদীসের উপর ভিত্তি করে, এটাই হল ইন্টারপ্রিটেড ল। এটা মানাও ফরজ না আবার ছেড়ে দেয়াও যাবে না। ৩. পার্ভাটেড ল (perverted law): বিচারক শরিয়াহতে যা আছে তার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এটা হল বিচ্যুত আইন। তাইমিয়ার ছাত্র ইবনে কাইয়ুম আল জাওজিয়াও পরবর্তীতে ‘সেকরেড ল’ বলতে এই তিনটা জিনিসকেই ব্যাখ্যা করেছেন।

এখন গভর্নমেন্টের সাথে এই ‘সেকরেড ল’র সম্পর্ক কি? তিনি বললেন গভর্নমেন্টের একটাই কাজ সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ। তিনি আরো বললেন, ধর্মীয় যত কাজ এর মধ্যে সবচেয়ে মহৎ কাজ হচ্ছে একটা গভর্নমেন্ট চালানো। তিনি বললেন, গভর্নমেন্ট ছাড়া রিলিজিয়নের কোন ভ্যালু নাই। এরপরে কাজী কে? কাজী হচ্ছে যিনি মানুষের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করবেন। ১২০০ সনের দিকে মালিকি মাজহাবের একজন বিখ্যাত বিচারক ছিলেন আল কারাফী। তিনি কাজীর হবার কিছু শর্ত দিয়েছেন। তিনি বললেন, কাজী যে কেউ হতে পারেন। এমনকি সুলতানও কাজী হতে পারেন, উজীর মন্ত্রীরাও কাজী হতে পারেন, আর্মি অফিসার-ট্যাক্স অফিসার সবাই কাজী হতে পারেন। আরেকজন হাম্বলী স্কলার, ইবনে আকিল, তিনি বললেন, গভর্নমেন্ট রাসুলের (স) সময় এরকম ফর্ম আকারে ছিল না। গর্ভমেন্ট মানে হচ্ছে ডিভাইন যেভাবে বলেছে সেভাবেই করতে হবে এটা ঠিক না। সরকার চালানোর সময় নতুন নতুন বিষয় হাজির হবে তখন নিজেদের মত করে রায় প্রদান করা যাবে। তাইমিয়া মনে করলেন, সরকার পরিচালনার আগে আমাদের সবসময় ‘সেকরেড ল’ মাথায় রাখতে হবে। তাঁর মতে ‘সেকরেড ল’ একটা পারফেক্ট এবং ইন্ডিপেনডেন্ট সিস্টেম। তিনি বললেন, সেকরেড ল’র সবকিছু একদম কোরানে স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে, এরপরে রাসুলের (স) সুন্নাহকে তাইমিয়া আরেকটু ব্রডার সেন্স দিলেন। রাসুল যা বলেছেন, করেছেন এমনকি রাসুলের সামনে করা হয়েছে, তিনি নিষেধ করেন নাই –এগুলো সব সুন্নাহর অধীন।  আমরা যে ইজমায়ে উম্মত বলি, তিনি এটা বলতে রাসুল পরবর্তী তিনটা প্রজন্মের মানুষকে বুঝিয়েছেন। তিনি ইজমায়ের উম্মত বলতে প্রথম তিন যুগ পরবর্তীদেরকে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন।

এরপর তিনি সালতানাতের প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছেন। তিনি বলছেন, সালতানাতের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন (পিপলস গুড)।  ইসলামের বিজয়ের জন্য মানুষের পার্থিব জগতের উন্নয়ন করতে হবে। এরপর তিনি গুরুত্বপুর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, ধর্ম ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যখন ধর্ম ক্ষমতা থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন ধর্ম এবং ক্ষমতা দুইটাই ‘করাপ্ট’ হয়ে যায়। ইসলামের সবচেয়ে মহৎ কাজ হচ্ছে পাবলিক পাওয়ারটাকে এক্সসারসাইজ করা।

এরপর ইবনে তাইমিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতরণ করেন। তিনি মত দেন যে, ইসলামে কোনো একটা ‘প্রেসক্রাইবড ফর্ম অফ পলিটিক্স’ বা ‘ফর্ম অফ গভর্ন্যান্স’ নাই। কিন্তু কিছু প্রিন্সিপাল আছে শাসনের ধরণ যাই হোক, তা ফলো করতে হবে। প্রশ্নটা হল প্রিন্সিপালের;  ফর্ম অফ গভর্ন্যান্স বা পলিটিক্সের না। যখন খিলাফত ভেঙ্গে পড়েছে, সালতানাত এসেছে, মামলুকরা শাসন করছে, ফলে খিলাফত বা সালতানাত নির্ভর আলোচনা তিনি করছেন না। তিনি বলছেন যে, রাজনৈতিক দল বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ফর্মুলা আসলে ইসলাম নয়। বরং যে কোনো সরকার ইসলামের মূলনীতি মেনে চললেই তা ইসলামিক হয়ে যাবে।

 তিনি সুলতানের চারটা দায়িত্বের কথা বলেছেন। এক. যারা ইসলামের মূলনীতিগুলো পালন করবে না তাদেরকে সুলতান শাস্তি দিবেন, প্রয়োজনে মৃত্যুদন্ডও দিবেন। শাসককে ইসলামের ধারক ও বাহক হতে হবে। দুই. শাসকের কাজ হচ্ছে যুদ্ধ পরিচালনা। তিনি যুদ্ধকে মোটা দাগে তিনটা  ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটা হচ্ছে কুফরী ধারণার সাথে লড়াই করা, দ্বিতীয় হচ্ছে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে, আর তৃতীয় হচ্ছে যারা ডাকাত ছিনতাইকারী এদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, সুলতানের উপর যখন  অমুসলিম শাসক আক্রমণ করবে, তখন জনগণ সুলতানকে সাহায্য করবে। কিন্তু যখন এক মুসলিম শাসক আরেক মুসলিম শাসককে আক্রমণ করেব তখন জনগণ কার পক্ষে থাকবে– এটা তিনি বলেন নাই।

এরপর তিনি বলছেন শাসক ব্যবসায়ীদের উপর চারটা ক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। যখন মুজদার মাল মজুদ করে রাখবে। তারপর মনোপলি একটা অর্থনীতি যাতে না হয় শাসক সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন। আরেকটা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে এমন কোন লেনদেন হয় যেটা সার্বিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর শাসক ঐখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।

তিনি তিনটা গ্রুপের কথা বলেছেন যারা ধর্মের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। ১/ যারা শরিয়াহর বিধিবিধান জানে কিন্তু এগুলো পূরণ করে না। ২/ জনগণের প্রতি সদয় এবং আন্তরিক কিন্তু শরিয়াহর বিষয়গুলো জানে না। ৩/ সবকিছু জানে কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সেটা পূরণ করতে না পারার ভয়ে পাবলিক পাওয়ারটা নিতে চাচ্ছে না।

বাবের জোহানসেন এখানে প্রশ্ন তুলেছেন। তাইমিয়ার গভর্ন্যান্স নিয়ে যে বয়ান এটাকে আমরা কিভাবে জাস্টিফাই করব? তাইমিয়া যে গভর্ন্যান্স সিস্টেমের কথা বলেছেন আমাদের এই সময়ে এসে আমরা এটাকে কিভাবে দেখব? তাঁর ‘সেকরেড ল’ নিয়ে কিভাবে ভাবব?

 

 

শেষ কথাঃ

তাইমিয়াকে নিয়ে লম্বা সময় পর্যন্ত একটা কমন ধারণা ছিল। একটা সাধারণ ব্যাখ্যা ছিল। এ ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। তাইমিয়া সম্পর্কে বিশেষ কিছু ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন একটা হচ্ছে এনথ্রোপোমরফিক ইন্টারপ্রিটেশন, যেটা একটা বিশেষ ঘটনায় একজন তাঁকে  আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে শুক্রবারের একটা জামাতে জিজ্ঞেস করেছিল । তিনি বলেছেন আমি যেমন  এরকম দাঁড়িয়ে আছি আল্লাহ আরশে এরকম আছেন। এটা একটা রেফারেন্স। কিন্তু আসলে আল্লাহ সম্পর্কে তাইমিয়ার এটাই একমাত্র ধারণা না। এটা বলে তিনি আল্লাহকে এনথ্রোপোমরফিক জায়গায় নিয়ে আসছেন ব্যাপারটা তাও না। ইসলামের প্রস্তাবনার মধ্যে তাওহীদের ধারণাটা কি? কোনটা শিরক আরও কোনটা শিরক না—তা তাইমিয়ার না বুঝার কারণ ছিল না। এ বিষয়গুলো তিনি জানতেন এবং অন্য জায়গায় এ বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। তবুও এটা বললেন কেন তা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে।

আমরা যে আলোচনাটা করছি, সেখানে আমাদের একটা হিস্টরিকাল রিভিউ দরকার। তর্কগুলো কোন সময়কার তাও জানা দরকার। ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তা, আইনের চিন্তা মোটাদাগে এ দুটোকে মিলিয়েই শরিয়াহ বলা হয়। শরিয়াহ নিছকই আইন না আবার নিছকই রাজনৈতিক চিন্তা না। ইসলামী আইনের ভাবনা বা দর্শন তাইমিয়ার সময়কালে এসে নতুন করে কি ধরণের আলোচনা অথবা নতুন বাঁক নিয়েছে, তা জানা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সেক্ষত্রে তাইমিয়ার ভূমিকা-ই প্রধান । পরবর্তী ইসলামী স্কলারদের মধ্যে তাঁর প্রভাব কোন না কোনভাবে ছিল।

আধুনিককালে যারা তাইমিয়া ব্যাখ্যা করেছেন তারা মোটা দাগে দুইটা ভাগে বিভক্ত। একটা হল ট্র্যাডিশানালি যারা দেখাতে চেয়েছেন যে তাইমিয়া আসলে খিলাফত ধারণাটা বাতিল করে নতুন ধারণা নির্মানের চেষ্টা করেছেন। আরেকটা ধারণা আছে যে তাইমিয়ার চিন্তাটা অনেক বেশি ট্রাডিশনালিস্ট এবং এটা অনেক বেশি হামবলী চিন্তার মধ্যে পড়ে। এরকম অনেকগুলো বয়ান আছে। এ বয়ানগুলো সম্পর্কে শক্ত পর্যালোচনা (স্ট্রং ক্রিটিক) যে কয়েকজন করেছেন তাঁর মধ্যে আইরা লেপিডাস এবং গিবস এরা দুইজন অন্যতম। এর পরবর্তীতে ওবামির আনজুম নামে আরেকজন  করেছেন।

আমাদের আসলে ওবামির আনজুমের থিসিসটা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব। আসলে প্রাথমিক আলোচনাগুলো না করলে পরবর্তীতে যে ডিবেট সেগুলো বুঝাটা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। আনজুম বেসিকালি একটা নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।আনজুমের কাছে তাইমিয়া হল এমন একটা মুহুর্ত যে মুহুর্তে ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তার অনেকগুলো নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে; এবং পরবর্তীতে ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে এর গভীর ও ব্যাপকতর প্রভাব পড়েছে। এ আলোচনায় আজকে আমরা যাব না।

যাই হোক, জোহানসেন এবং অন্য যারা ওয়েশস্টার্ণ স্কলার আছেন তারা ইসলামের পলিটিকাল হিস্ট্রিকে ব্যাখ্যা করে একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখান যে, ইসলামী রাজনীতির এক ধরণের ইনার সেকুলারাইজেশন (inner secularization) ঘটেছে। তারা যখন ‘ইনার সেকুলারাইজেশনের’ কথা বলেন, তখন দেখান যে, উলেমা শ্রেণির সাথে রাষ্ট্রের একটা পরিষ্কার তফাৎ ছিল; এবং এ দুইয়ের এখতিয়ারের জায়গাটা আলাদা ছিল। কিন্তু তারা যে সংজ্ঞা ও অনুমানের উপর নির্ভর করে তা দেখান,সেটা ওয়েস্টার্ণ অনুমান দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। এ অনুমানটা খুব বেশি শক্তিশালী না। ওয়েশস্টার্ণ স্কলাররা পরবর্তীতে আবার দেখাতে চান যে, তাইমিয়ারা এসে এ সেকুলারাইজেশনের পালটা একটা মুভমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এগুলো হল মৌলিক বিতর্কের জায়গা, যেগুলো নিয়ে আমরা পরে কথা বলব।

আরেকটা বিতর্ক হল খিলাফত বনাম তার পরে যে রাজনৈতিক সিস্টেম সেটা। এর আগে পর্যন্ত যে ব্যাখ্যাটা দেয়া হত খিলাফত ধারণাটাই হল ইসলামের সর্বশেষ একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকারের ধারণা। এ কারণে পরবর্তীতে অনেকে এসে আবার খিলাফত ধারণাতেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে বলা হয় যে, তাইমিয়া ছিল ব্যতিক্রম। তিনি আর খিলাফতের ধারণাকে গুরুত্বপুর্ণ মনে করেন নাই।

খিলাফতের ক্ষেত্রে খুব গুরত্বপুর্ণ একটা ডিবেট আছে। খিলাফতের দুটো ধারণা আছে। একটা হল উমাইয়াদের পর্যন্ত যারা ছিল তারা; সেখানে আরব এথনিসিটির অনেক বেশি প্রভাব ছিল, এবং কুরাইশ ধারণাটা অনেক প্রবল ছিল। তারপর আব্বাসিয়রা যখন আসছেন তখন তারা আরব গোত্রীয় কর্তৃত্বের যে বয়ান ছিল, তা থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু তারপরও এটা মোটা দাগে আরব বলয়ের মধ্যে ছিল। তারপর বলা হল যে, খিলাফতের দুটো ব্যাখ্যা আছে। একটা হল খলিফা কার? আল্লাহর খলিফা নাকি  নবীর খলিফা? খলিফাতুল্লাহ না খলিফাতুল রসুল? শাসক যদি আল্লাহর খলিফা হন তাহলে তাঁর অথরেটির সাথে ডিবিনিটির একটা ইমিডিয়েট রিলেশন প্রস্তাব করা হয়। আর যদি বলেন নবীর তাহলে এটা হিস্টরিকাল এবং ডেলিগেটেড।

আব্বাসিয়রা ব্যাখ্যা করেছেন যে, নবী এসেছেন নবুয়তের চুড়ান্ত ও শেষ হিসেবে। কিন্তু শাসন বা রাজনৈতিক ক্ষমতার সূচনা হল নবী মৃত্যুর পর থেকে। ফলে নবীর সময়কালটা এবং তাঁর পরের সময়কালটাকে তারা দুই ভাগ করেছেন। এ দুই ভাগ নিয়ে একটা লম্বা তর্ক আছে; এবং এর উপর ভিত্তি করে ইসলামের রাজনৈতিক বয়ান দুটো ধারাই ভাগ হল। এরপরের ঘটনা হল, আব্বাসিয় শাসনকালটা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন খিলাফত ধারণাটাও ভেঙ্গে পড়ে। এই ভেঙ্গে পড়ার পর ইউরোপিয় স্কলাররা এই সময়কে ‘লেজিটেমেসির’ প্রশ্ন আকারে পাঠ করেন। প্রফেটের সময়টাকে তারা বলেন যে, এটা ছিল ডিবাইনলি লেজিটিমাইজ। তারপর হিস্টরিকাল লেজিটিমাইজকে তারা বিভিন্ন রেফারেন্সে ব্যাখ্যা করেছেন। এ তর্কগুলো আমাদের জন্য বোঝা গুরুত্বপুর্ণ।

যাই হোক, খিলাফত যখন ভেঙ্গে গেল তখন নতুন ধরণের একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা  বা সালতানাত তৈরি হল এবং একটা নতুন সম্প্রদায় ক্ষমতায় আসল। মামলুকরা  ককেশিয়ান জায়গা থেকে এসেছে; প্রফেশন হিসাবে তারা মিলিটারি ছিল। এরা আসলে এক ধরণের কন্সপ্রিপ্ট সোলজার ছিল। আব্বাসিয় শাসন ভেঙ্গে পড়ার পর বিভিন্ন জায়গায় যে মিলিটারি গভর্নর ছিল, তারা একত্রিত হয়ে ক্ষমতা দখল করে। লেজিটেমিসির জায়গা থেকে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়। যেহেতু তারা আরব না ফলে তারা নিজেদেরকে মুসলিম শাসক হিসাবে কিভাবে লেজিটিমাইজ করলেন? এবং খিলাফত ধারণার বাইরে এসে যে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা করলেন, সে বয়ানটা কি? এ তর্কগুলো মাথায় রেখে পড়লে মনে হয় যেন, তাইমিয়ারা বোধ হয় এই দুইটা প্রশ্নকে সামনে রেখে তাঁদের বয়ানটা দাঁড় করাচ্ছিলেন। এটা একটা হিস্টরিকাল পার্ট অবশ্যই হতে পারে। আমরা যখন কোন ওয়েস্টার্ণ স্কলারের লেখা পড়ি, তখন আমরা কন্টেক্সচুয়াল হিস্ট্রিটা পড়ি; তার সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্কটা কি ছিল সেটা দেখি। কিন্তু ঐ সময়ের বাস্তবতাটা বোঝা দরকার। ঐ চিন্তার মধ্যে বা দর্শনের মধ্যে তাঁর নিজস্ব যে ট্রাডিশন ও তর্ক ছিল তা বোঝাটাও জরুরী। আপনি যখন হবস পড়বেন, আপনি বলতে পারেন যে, সে সময় একটা সিভিল ওয়ার হচ্ছিল, এনার্কি হচ্ছিল; তার মধ্যে সভরেইন একটা স্টেটের নোশন তৈরি করেছে। কিন্তু হবসের রাজনৈতিক দর্শনটা এখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায় না। এটা রাজনৈতিক চিন্তার সিলসিলার মধ্যে একটা গুরুত্বপুর্ণ রাজনৈতিক দার্শনিক প্রস্তাবনা। ইসলামী চিন্তার ধারার মধ্যে সেই কাজটা একইভাবে করতে হবে।

আমরা যে তিনটি বিষয় বললাম; এক. হিস্টরিকাল কন্টেক্স, দুই. চিন্তার নিজস্ব ট্রাডিশন এবং তিন. কনসেপচুয়ালি রাজনীতি।–এ চিন্তাগুলোর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি কি? এই তিনটা বিষয়কে নজরে রেখে যদি আমরা পড়ি তাহলে জোহানসেনের লেখায় দেখব যে, সে প্রথমটা নিয়ে আলোচনা করে, সেকেন্ডটা কিছুটা করে বাকিটার কোন আনসার দেয় না। অর্থাৎ ইসলামী চিন্তার মধ্যে এর ভিতরগত যে বিতর্কটা কি এবং এসব বিতর্ক কি ধরণের ভূমিকা পালন করে, তা আমদের বোঝা দরকার। আরো অনেকগুলো জায়গা আছে আমরা যখন পরের আলোচনা যাব সেখানে করব।

তাইমিয়ার রাজনৈতিক শরিয়াহ এ কথাটা বলা একটা নতুন ঘটনা। শরিয়াহ এবং সিয়াসাহকে একপদবদ্ধ করা, এটাকে একটা ধারণা হিসাবে আলোচনা করাটাকে ইসলামী চিন্তার মধ্যে নতুন ধরণের মোড় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ঐ সময়ে রেশনালিস্টদের বিপক্ষে তাইমিয়ার আরেকটা বিরোধের জায়গা ছিল। আমরা ধরে নিচ্ছি যে, সে আলোচনাগুলো কম বেশি মাজহাবের মধ্যে সেটেল হয়ে গেছে। তাইমিয়া বলছেন যে, আলোচনার পদ্ধতি মাজহাব কেদ্রিক হবে না। বরং আমাদেরকে বুঝতে হবে প্রথমত কোরান, হাদীস এবং সুন্নাহ। সুন্নাহ মানে যা নবী করেছেন, সাহাবারা করেছেন, তাবেঈনরা করেছেন, এবং তারপরে তাবেতাবেঈনরা করেছেন। অর্থাৎ ইসলামের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উনি একটা হিস্টরিকাল প্র্যাকটিসকে ইভালুয়েট করার কথা বলেছেন।

এরপরে আছে সেকরেড ল এর ধারণা। প্র্যাকটিকাল জায়গা থেকে শরিয়াহকে তিনি তিনটা ক্যাটাগরি করেছেন।  শরিয়াহ বলতে সাধারণ অর্থে যা বোঝা হয় তা আসলে তিন রকম। একটা হল রিভিল্ড, যা মানতে হবেই। এরপরে বড় অংশটা হল স্কলারলি ইন্টারপ্রিটিশন বেইজড অন উসুল। তিনি বলছেন, এটা হল ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যাটা পালনের ক্ষেত্রে কেউ যদি মানতে চায় মানবে; কিন্তু এটাকে কোনভাবে বাধ্য করা যাবে না। আরেকটা হল পার্ভাট। সাধারণ অর্থে এই তিনটাকে নিয়েই শরিয়াহর একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে। তার জায়গা থেকে প্রথম দুইটাকে গ্রহণ করা যায় বাকিটাকে যায় না। ফলে কেউ যেন আবার মনে না করে পার্ভাট ল কেও তিনি সেকরেড ল বলছেন।

আলোচনা শুরু করেছি মাকাসিদ থেকে। ল এবং পলিটিক্সের পারপাসটা কি এটাই মাকাসিদের বিষয়। আর তাইমিয়ার আলোচনায় সবাই এক জায়গায় একমত যে, তাইমিয়া আলোচনা করেছেন  একজন শাসক ইসলামের এই নীতির জায়গাগুলো মানবেন তিনি অন্যদেরকে কিভাবে নিয়োগ দেবেন এবং অন্যদের ক্ষমতার চর্চার ধরণটা কি হবে। কিন্তু  খোদ যিনি শাসক বা সরকারকে কে নির্ধারণ করবে এটা সম্পর্কে উনার কোন স্পষ্ট আলোচনা আসে নি। গভর্ন্যান্স পরিচালনা সম্পর্কে আলোচনা আছে কিন্তু ফর্ম অফ গভর্ন্যান্সটা কি হবে এবং এটা কিভাবে গঠিত হবে (ডিসাইডেড) হবে সেটা নাই। আধুনিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হল সরকার কিভাবে নির্ধারিত হয়। ফলে পাবলিক স্ফেয়ারটা কিভাবে ডিসাইডেড হয় এবং কে ডিসাইড করবে এবং তাঁর ক্রাইটেরিয়াটা কি হবে, তাইমিয়ার মধ্যে আমরা এ প্রশ্নটার সুরাহা পাচ্ছি না। যদিও আনজুমের দাবি হল এর একটা গাইডেন্স পাওয়া যায়। আমরা আনজুমের আলোচনায় এটা আরো বিস্তারিত বলার চেষ্টা করব।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।