ভাব, রাজনীতি ও এবাদতনামা

বাসায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কোরআন শরীফ রাখা হয়। সঙ্গে দুচারটি ধর্মীয় বইও থাকে। ঐ জায়গাটা হাতড়াতে হাতড়াতে নামাজ শিক্ষার একটি বইয়ের ভাঁজ থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ল ‘এবাদতনামা’। ফরহাদ মজহারের ‘এবাদতনামা’। অবাক হলাম। এবাদতনামা পদ্যের পুস্তিকা। এটা কিভাবে কোরআন শরীফ আর নামাজ শিক্ষার বইয়ের সহবতে এল? আমার তখন মনে পড়ল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’ বইটি ধর্মের বইপত্রের তাকে দেখা গেছে বলে একটা লেখা কোথাও পড়েছিলাম। বলাবাহুল্য, এজন্য বইয়ের নামটাই দায়ী। আমার বাসায় 'এবাদতনামা’র বেলায়ও ঐ ব্যাপারটাই খাটে। মানে বইয়ের নাম দেখে এবং প্রচ্ছদে মোনাজাতের হালতে আসমানে তোলা মোমিনের দুহাতের পাতার ছবি দেখে ধোঁকায় পড়ে গিয়ে কেউ এটা কোরআন শরীফের কাছে রেখেছে। মনে মনে খুব হাসলাম। ঢাকায় এসে কাহিনীটা ফরহাদ ভাইকে শুনালাম। তিনিও হা হা করে হেসে ফেললেন।

এবাদতনামা পড়ে আমি আমার কম আকলে কি বুঝেছি তাই বলব। আমার বিদ্যা-বুদ্ধি ও পড়ালেখা নেহায়েত সীমিত। নিজের আরও বুঝাবুঝির জন্য যাতে উপকার হয়, সে জন্যও আলোচনা জরুরী মনে করছি।

এবাদতনামা পড়ে প্রথমবার আমার মাথায় এসেছে যে, সম্পর্কের একটা পর্যায়ে গিয়ে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার দূরত্ব কমে যায়। বান্দা সেই মুহূর্তে আল্লাহকে সন্নিকটে ভাবতে থাকে। আল্লাহকে সামনাসামনি দেখতে পায়। প্রচলিত ভক্তির বদলে বান্দা তখন আল্লাহকে ডাকে অপ্রচলিত শব্দে, আল্লাহকে ধমকায়, রাগ-অভিমান করে, গালাগালি দিতেও কসুর করে না। । জীবাত্না আর  পরমাত্না একাকার হয়ে যায় ভাবের জগতে। দ্বীনদুনিয়ার বিভিন্ন কাজের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে বান্দার দিলে নালিশ চলতে থাকে অহর্নিশ।  এবাদতনামা থেকে কয়েকটা চিহ্ন তুলে ধরছি-

আমি যেন সিধা চলি তাই দাও বেহেশতের লোভ
যদি চলি উল্টা পাল্টা নিমিষেই কুখ্যাত দোজখ
দেখায় আমাকে ভয়, উভয়ের মধ্যবর্তী পথে
নিরীহ ষাঁড়ের মতো দড়ি নাকে সদর রাস্তায়
চলেছি ঈমানদার-এতে কিবা কৃতিত্ব তোমার?
( এবাদতনামা-৩)

 

তিলে হিম্মত নই, আধা ছটাকের নাই তেজ
সাত আসমানে প্রভু, খোদা তা’লা হয়ে বসে আছ
মুখে খালি কহ শুধু দুনিয়ার তুমিই মালিক
অথচ মালিক অন্যে, অন্যে কহিতেছে তারা খোদা।

ধর, আমাদের গ্রামে আলহাজ্ব সামাদ মৌলবি
তিনি খোদ নিজ নামে বাহাত্তর বিঘা  হালটের
জমির মালিক, তেতাল্লিশ চেয়ারম্যান, ষাট  বিঘা
রশিদ কন্ট্রাক্টর, ইটের ভাটার ছরু মিয়া
চৌদ্দ বিঘা বিশ ডেসিমেল, বাকি ছমিরউদ্দি,
চন্দনের বাপ, হারাধন-প্রত্যেকেই তোমার শরিক
তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস?

এদের দলিল যদি মিথ্যা হয়, যাও আদালতে
উকিল ধরিয়া কর দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে।
(এবাদতনামাঃ৬)

 

শিরক ইসলামের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলোর একটি। কোরআনে বলা হয়েছে “শিরক একটি মহান জুলুম(সুরা লোকমান)”।  আরেক জায়গায় বলা হয়েছে “নিশ্চয় আল্লাহ শিরক বাদে সমস্ত গোনাহ মাফ করবেন(নিসা)।” কিন্তু পুঁজির যুগে পুঁজিই এখন আল্লাহ। সমাজের ধনিক শ্রেণিটাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। এমনকি মসজিদ মাদ্রাসার মৌলানারাও ওঠবস করেন তাদের কথায়। আর জান্নাতের যেই দৃশ্যকল্পগুলো পবিত্রগ্রন্থসমুহে অঙ্কিত আছে সেই সব দৃষ্টিনান্দনিকতা টেলিভিশনের কল্যাণে আমাদের বেডরুমেই হাজির। অতএব, হুরপরী তো টিভিতেই নগদ পাচ্ছি। পরকালের আশায় বসে থাকা কেন?

পড়ে আছো কোন গ্রহে? নিজ মখলুকাতে তুমি একা।
আল্লা তোমার লাগি কেবলি বেদনা জাগে মনে।
(এবাদতনামাঃ১৯)

এমন অনেক নজীর আছে এবাদতনামায়। আল্লাহ ও বান্দার ভেতরকার সম্পর্ক, প্রতিশ্রুতি ও দাম্ভিকতার ছবি ওয়াদা নামক ২৭ নম্বর এবাদতনামায় আমরা দেখতে পাই। বান্দা এক কদম এগুলে আল্লাহ দশ কদম আগুয়ান হবেন। এই যে কদম কদম একে অপরের দিকে কিম্বা দৃশ্য ও অদৃশ্যের পারস্পরিক নিকটবর্তী হওয়া, এর মানে কী? এটা কি নিছকই প্রতিশ্রুতি? মানুষ রক্ত-মাংসের পায়ে এগুলে আল্লাহ কিভাবে এগুবেন? আল্লাহর কি মানুষের মত পা আছে। না, নেই। তাহলে, কোন কর্মের দিকে, কোন ভাবুকতার বা পরিণতির দিকে আল্লাহ মানুষকে ইশারা করছেন? এই দার্শনিক প্রশ্নই ফরহাদ মজহার মুমিনের এবং প্রতিটি মানুষের সামনে রেখেছেন। কেননা, দৃশ্যে আমরা এগিয়ে গেলেও আল্লাহকে তো আসতে দেখছি না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিবের ডগায় বহুত সাধক ও মনীষীর নাম স্মরণ হলেও নবী মুহম্মদ (সঃ)’র কথা আকারে ইঙ্গিতেও আসে নাই। তাই ফরহাদ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তাঁকে তাই মাফ করি নাই। কিন্তু আল্লাহর কাছে আরজি জানাচ্ছেন অন্য ভাষায়, ‘ঠাকুরের বেটাটারে তুমি কিন্তু রহমান করে দিও মাফ।’

আল্লাহর মোট নাম বা সিফত নিরানব্বইটি। সেই অনুসারে এবাদতনামাও নিরানব্বইটি চতুদর্শপদী কবিতায় বিভক্ত।

‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কিন্তু সব নিন্দার ভার
যদি মনুষ্যের হয় ওর মধ্যে প্রভু ইনসাফ
নাই, আমি সে কারণে সর্বদা তোমাকে অন্ধভাবে
প্রশংসা করি না; তবু, গোস্বা তুমি কোরোনা মা’বুদ।
(এবাদতনামাঃ৩)

 

মানুষের চেয়ে তারা কেরানি হিশাবে খুব ভালো!
আমার আমল নামা লিখা হয় ফেরেশতার হাতে
কিন্তু রোজ হাসরের দিন যদি বলি প্রভু তুমি
যাদের দলিল দেখে দুনিয়ায় আমার কাজের
হিশাব মেলাচ্ছ তারা কতটুকু বুঝেছে আমার
কাজের মর্মার্থ? যদি মখলুকাতে ইনসান
সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়, তবে ফেরেশতাকে কোন্‌ বলে,
মানুষের কর্মনামা লিখতে তুমি দিয়েছ মা’বুদ?

 

এরপর কবি আল্লাহকে সওয়াল করছেন,

তবে কি আমাকে তুমি দোজখে পাঠাবে? তাই হোক
কবিকে শাস্তি দিয়ে এ সওয়াল মীমাংসা হবে না।

বোঝা যাচ্ছে, কবি এখানে আল্লাহর সঙ্গে রাগারাগি করে জাহান্নামে যাত্রা করতেও পিছপা হবেন না। তথাপি  কবিরা যে হঠকারী, তারও আলামত আমরা পাচ্ছি। পবিত্র কোরআনেও কবিদের পরিচয় এভাবে দেয়া হয়েছে। কবিরা উদভ্রান্ত, তাদের ভক্তরাও উদভ্রান্ত, তারা সকলেই উপত্যকায় উপত্যকায় পথহারা ঘুরে বেড়ায়।

এবাদতনামার প্রতিটি চতুদর্শপদী আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সবকটি আমাদের মনোযোগ বা অভিনিবেশ এবং রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দাবি করে। এবাদতনামার বিখ্যাতগুলোর অন্যতম হল ‘বিবি খাদিজা’। পুরোটাই এখানে তুলে দিচ্ছি-

বিবি খাদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি,
বিসমিল্লাহ কহিব না,শুধু খাদিজার নাম নেবো।
প্রভু, অনুমতি দাও। গোস্বা করিও না, একবার
শুধু তাঁর নামে এই পদ্যখানি লিখিব মা’বুদ।

নবীজীর নাম? উহু,তার নামও নেবোনা মালিক
শুধু খাদিজার নামে- অপরূপ খাদিজার নামে
একবার দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাব
তোমাকেও ভুলে যাবো,ভুলে যাবো নবীকে আমার।
একমাত্র তিনি, প্রভু, একমাত্র তাঁর চাকুরিতে
উট ও ব্যবসা লয়ে ছিল মোর নবীজী বহাল।
তুমি ডাঁট মারিও না - নবী ছিল তোমার হাবিব
কিন্তু খাদিজার ছিল বেতনে বাঁধা কর্মচারী -

সব নারী জানে, তুমি খাটো হয়ে আছো এইখানে
তোমার খাতিরে তবু প্রকাশ্যে তা জাহির করে না।

পাঠক, এ কবিতাটি বারবার পড়ুন। যতবার পড়বেন ততবারই নতুন নতুন সমঝ আপনার কলবে পয়দা হবে। এই কবিতায় নারীকে যে অভাবনীয় উচ্চতায় ওঠানো হয়েছে প্রতিটি নারীর এজন্য ফরহাদ মজহারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। নারীর সামনে ভাবের যে নতুন বয়ান হাজির করা হয়েছে তা অকল্পনীয়। এই কবিতাটি আমাদের চিন্তায় নাড়া দিয়ে গেছে। আল্লাহ এবং নবীজীর মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে হাবিবের  বা প্রিয়বন্ধুর সম্পর্ক। আল্লাহ নবী (স)কে ডাকতেন হাবিব সম্বোধন করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর প্রিয় হাবিব যুবক বয়সে একজন নারীর ব্যবসা দেখভাল করতেন। এবং নিশ্চয় নির্দিষ্ট একটা পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন। ইসলাম নারীর মর্যাদা দিয়েছে নাকি দেয় নাই নারীবাদীরা এখান থেকে ভাল অনুমান করতে পারবেন।

এবাদতনামার প্রতিটি চতুর্দশপদী দার্শনিকতার দিক থেকে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিমেয় শক্তিশালী। এবাদতনামাকে কেউ কবিতা ভেবে যদি পড়েন তাহলে মারাত্মক ভুল করবেন। এবাদতনামা হচ্ছে  রাজনীতি, দর্শন ও বাংলা কাব্য-ধর্মে প্রচলিত রসমের ভাঙন। বঙ্গের একান্ত নিজস্ব ভাব-ভাবনা ধারণ ও বহনের শুরু। সঙ্গে সঙ্গে তা সাম্রাজ্যবাদী খ্রিষ্টিয় ধারার মনোগাঠনিক প্রকল্প এবং স্বর্ণকেশ সাদা চামড়ার প্রীতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান। ফরহাদ বলতে চাচ্ছেন, বঙ্গ দেশের জীবনযাপনের মধ্যে পুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠা ভাব-ভাবনা ইউরোপের ধ্যান-ধারণার চেয়ে কোন অংশেই খাটো নয়। প্রয়োজন শুধু আমাদের চিন্তার আদি বীজগুলোকে বপন করে পূর্ণোদ্যমে মেহনত করা। ইউরোপ ও সাদা মানুষদের ইতিহাসই একমাত্র বিশ্ব-ইতিহাস এইসব উপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী ও বর্ণবাদী ধারণা প্রত্যাখান করা জরুরী। ইউরোপের বাইরেও বিভিন্ন জনগোষ্টির ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার-আচরণ, জীবন ব্যবস্থা এবং ইতিহাসের লড়াই সংগ্রামের মধ্যে বৈশ্বিক উপাদানসমূহ খুঁজে বের করাই এখনকার কর্তব্য। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তবেই আমরা জিতব।

আল মাহমুদ একটা কথা বলেন যে, কবির কবিতা বুঝতে হলে কবির জীবনযাপন, বেড়ে ওঠা ও তাঁর হারজিত সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকা উচিত। আল মাহমুদ যে মিথ্যা বলেন নি এ কথা হলফ করে বলতে পারি। এবাদতনামার বেলায়ও একথা খাটে।  অর্থাৎ ফরহাদ মজহারের অপরাপর কিতাবের সঙ্গে যদি আপনার রিশতা থাকে তাঁর চিন্তা ভাবনা ধ্যান ধারণা সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক প্রগতিশীলতার চর্চার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং খেতের কৃষকদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা সম্পর্কে যদি আপনার ধারণা থাকে তাহলে, এবাদতনামা বুঝতে পারাটা আপনার জন্য খুবই সহজ। তবে আমার মনে হয়, মস্তিষ্কপ্রখর পাঠকের জন্য এত এত শর্ত হাজির না থাকলেও চলবে।

বঙ্গের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকল নাগরিককে ফরহাদ মজহার যে মুক্তির পথ দেখালেন এবং বঙ্গের ভাবজগতে নয়া আন্দোলনের সদর রাস্তা দেখালেন এবাদতনামা তৈরির মধ্য দিয়ে। তাই আমি মনে করি এবাদতনামাকে টপকে গিয়ে আমাদের উত্তরণের কোন উপায় নাই। অথবা এভাবে বলা যেতে পারে যে, বহুবছর আগে ফকির লালন শাহ ও তাঁর আগেকার দার্শনিকবৃন্দ নদিয়ার ভাবপরিমণ্ডলে বঙ্গের নিজস্ব চিন্তাচেতনা ধারণ করে ধর্ম, রাজনীতি, দার্শনিকতা এবং ঔপনিবেশিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসার যে কথা বলেছেন, ফরহাদ এর আলাদা কিছু বয়ান করছেন না। মোমিন-অমোমিন সবার চিন্তাকে ফরহাদ উসকে দিচ্ছেন। মোমিনের সঙ্গেও নিশ্চয়ই আলাদাভাবে তাঁর বোঝাপড়া আছে। যারা আভাস পাই উৎসর্গপত্রের শেষ দুই পংক্তিতে

এই চতুর্দশপদী তুলে দিনু মোমিনের হাতে
আমার কর্জ শোধ আল্লাহর মাশুকের সাথে

এবাদতনামা সম্পর্কে বলতে আরেকটা কথা হচ্ছে যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসেবে আমরা আরো অসফল। আমাদের সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত ইসলামপন্থী ও সেকুলারপন্থী। ইসলাম প্রশ্নটাকে এখনো আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে ওঠতে পারি সক্ষম হই নি। ফলে এবাদতনামা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত প্রগতিশীলরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠল এটা ভেবে যে ফরহাদ মজহার ইসলামিস্ট হয়ে গেল। ইসলাম কায়েম করতে গিয়ে জিহাদ শুরু করে দিল ইত্যাদি। অন্যদিকে ইসলামপন্থিরা যেহেতু ইসলামের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবাদর্শের সঙ্গে পরিচিত নয় তাই তারা ভাবল ফরহাদ মজহার নাস্তিক হয়ে গেছে। এবাদতনামা হচ্ছে নাস্তিকতা ও খোদা-রসুলের বিরুদ্ধে গালাগালির চূড়ান্ত নমুনা। ইসলামপন্থি ও ইসলামবিদ্বেষী উভয় দলই সাম্প্রদায়িক গণবিরোধী ও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিপদজনক।

কেননা সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বুঝি। ধর্মের ভিত্তিতে আমরা নিজেদের পরিচয় বানিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের বিপরীতে অপর গণ্য করি এবং নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে অন্যদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করি। একইভাবে জাতি পরিচয়ে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণ করলে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অপর বা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আসলে কোন তফাৎ নাই।

ধর্মবাদীরা ধর্মনিরপক্ষেতার বয়ান যারা দিচ্ছেন তাদেরকে রাজনৈতিক শত্রু মনে করছেন। আর সেকুলাররাও ইসলামকে ধর্ম হিসেবে বাদ দেয়া ছাড়াও সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের ভেতর ইসলামের ওতপ্রোত সম্পর্কেও অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন। সেকুলাররা যদি ইসলামিস্টদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তরিকায় মোকাবিলা ও হজম করতে না পারেন তাহলে এটা সেকুলারদের নিজেদের অর্থাৎ তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, জীবনপদ্ধতি ও চিন্তাভাবনার সমস্যা। মোটেও এটা ইসলামিস্টদের সমস্যা না। আমি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক দাবি করব আবার ইসলামপন্থিদেরকে সমানে নিচু তলার ও অন্য শ্রেণির মানুষ গণ্য করব সেটা তো হতে পারে না। এবাদতনামা মনোযোগের সাথে পাঠ করা এজন্যই জরুরি। মানুষের ইহলৌকিক যে সকল অধিকার কায়েম করতে ইসলাম বদ্ধপরিকর সেই দিক থেকে ইসলামপন্থিদের কোন আগ্রহ ও মনোযোগ নাই। পরিবার, গোত্র, বর্ণ, জাত, পাত, রক্ত, সম্প্রদায় ইত্যাদি সকল কিছুর উর্দ্ধে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কর্তব্য, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েম কিম্বা রিজিক ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান ইত্যাদি। ইসলামের নীতি ও আদর্শের দ্বারা সর্বজনীন ভাষায় সকলের জন্য সকলের স্বার্থে কিভাবে এবং কতটা করা সম্ভব সেই তর্কে ইসলামপন্থীদের নামতে হবে।

এক্ষণে আমি যে বয়ান করলাম, তা নিছকই আমার ভাবনা। এবাদতনামা তেলাওয়াত করে আমার অনুভূতিতে যা নাজিল হয়েছে তাই আমি ব্যক্ত করেছি। এবাদতনামায় কিছু কিছু বক্তব্য পাবেন যেগুলো পড়ে প্রাথমিকভাবে পাঠকের মনে হবে যে, ফরহাদ মজহার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করেছেন। আসল কথা হল, তিনি চাচ্ছেন মানুষের চিন্তাকে উসকে দিতে, রাজনৈতিক ও দার্শনিক কায়দায় ভাবতে। এ ক্ষেত্রে বিতর্ক ও সাফল্য দুটোই তাঁর কাঁধে চাপতে পারে।

এবাদতনামা  থেকে আরো অনেক কিছু জানার আমার বাকি আছে। এজন্য এটা আমি অনেকবার পড়ব। এখন যা বুঝলাম তাই লিখলাম। পাঠক একমত নাও হতে পারেন।

যখন আরো জানব আপনাদের জানাব।

২০১০  

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

respect the way of thinking of others, rebuild values and utilize inner strengths



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।