ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি

মওলানা এসেছিলেন ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০, আর আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬।

আজ ১৭ নভেম্বর। এখন রাত। অথচ মনে হচ্ছে সকাল বেলায় কেউ বুঝি 'খামোশ' বলে হুংকার দিয়ে উঠবে আবার। কে আবার? মওলানা।

কেন এই আশা সেটা ভাসানী সপর্কে যারা জানেন না তাঁদের সহজ ভাবে বুঝিয়ে বলা মুশকিল।

মওলানাকে বোঝার কিছু সহজ উপায় আছে। প্রথম কথা, তিনি দেওবন্দী, কিন্তু কমিউনিস্ট। সেটা কোন অর্থে এবং কিভাবে সম্ভব সেটা তাহলে তাঁর জীবন ও ইতিহাস পাঠ করেই বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্র কায়েম তাঁর স্বপ্ন ছিলনা, তিনি চেয়েছেন, হুকুমতে রব্বানিয়া – প্রতিপালনের গুণ সম্পন্ন এমন এক শাসন ব্যবস্থা যার প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে সকলের লালন পালন নিশ্চিত করা। একে তিনি ইসলামি সমাজতন্ত্র বলতেন, কারন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলকে আল্লাহ লালন পালন করেন। বিধর্মী বলে কারো জন্য আলো, বাতাস, খাদ্য, পানি বন্ধ করেন নি। সেটা করে জালিম, তার কোন ধর্ম নাই। জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। মানুষের রিজিক বা জীবন ধারণের শর্তের ওপর হস্তক্ষেপ করা ইসলাম বরদাশত করে না। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই সহজ রাজনীতির দীক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি হুকুমতে রব্বানিয়া চেয়েছেন, কোন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন বুর্জোয়া কিম্বা সোভিয়েত বা চিনা মডেলের রাষ্ট্র না।

ভাসানীকে বুঝতে গিয়ে আজ নতুন প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে কমিউনিস্টরা আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের অনুকরণে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠন গড়ে তোলাকেই তাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য গণ্য করেছে, সেখানে মওলানা' হুকুমতে রাব্বানিয়া' বা প্রতিপালনের গুণ সম্পন্ন নতুন ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবলেন কেন? তিনি কি বুঝে গিয়েছিলেন যে কমিউনিস্টরা আসলে পাশ্চাত্য চিন্তার ধারাবাহিকতার অধিক কিছু নয়? আলোকিত পাশ্চাত্যের শেষ ব্যর্থ প্রকল্প কি কমিউনিজম? বিশ্ব ইতিহাস নতুন ভাবে ভাববার ও নতুন পুনর্গঠনের কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষমতা তারা হারিয়েছে অনেক আগেই। এই প্রশ্ন আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই।

ভাসানী দেওবন্দী, তবে দেওবন্দ থেকে পাশ করা আলেম অর্থে না, বরং তার চেয়ে বেশী। তিনি দেওবন্দী রাজনৈতিক ঐতিহ্য ধারণ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম ব্যাচের ছাত্র শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের কাছে শাহ ওয়ালি উল্লাহর রাজনৈতিক ও দার্শনিক বইপত্র পড়েছে তিনি। তখন আব্দুল হামিদ খান যুবক। দেওবন্দ তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে কিভাবে প্রভাবিত করেছে সেটা গভীর ভাবে ভাববার বিষয়। দেওবন্দ ঔপনিবেশিক পরাধীনতা এবং পাশ্চাত্যের প্রতি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে অধীনস্থ থাকার বিরুদ্ধে লড়াই করবার আত্মিক শক্তি অর্জনের পথ দেখাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল। সেটা নিশ্চয়ই মওলানাকে প্রভাবিত করেছে। ইসলাম ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বার আত্মিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে এটা তাঁর মনে দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল, শুধু ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, কিম্বা মাদ্রাসা শিক্ষা সেই বিকাশের পথ দেখাতে পারে কিনা সেটা তাঁকে ভাবিয়েছে। রাজনীতিতে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ে জালিমের পক্ষাবলম্বন ছাড়া ইসলামের প্রস্তাবিত রূহানি শক্তির বিকাশ সম্ভব না। এই ভাবনাই তাঁকে কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু কমিউনিস্টদের নাস্তিকতায় তিনি ভোলেন নি। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে তাদের অবিচল অবস্থানের ওপর ভরসা করেছেন।

ভাসানী এক মানুষ যাকে চিহ্ন ধরে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগণের লড়াই সংগ্রাম নতুন করে পাঠ করা সম্ভব। সেই লড়াই সংগ্রাম বুঝলে উপমহাদেশে নির্যাতীত মানুষের ইতিহাস বাস্তবে একই সঙ্গে কেন ইসলামের ইতিহাস ছিল সেটা আমরা  বুঝতে শিখি। ইসলাম আরব আর মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস মাত্র নয়, ইসলাম ভারতবর্ষের জনগণের ইতিহাস -- আর এই সত্য কমিউনিস্ট বলি কি ইসলামপন্থি বলি উভয়েই আমাদের সুযোগ পেলেই ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। উপ মহাদেশের আরেকজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন দেওবন্দী হজরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর যখন বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা একাত্তর ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রাম -- তিনি তখন ইসলামকে ধর্মতত্ত্বের পাটাতন থেকে ইতিহাসের পাটাতনে নিয়ে আসেন, আর ফারাক তৈরি করেন তাদের সঙ্গে যারা একাত্তরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপমহাদেশে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখেছে। একই ভাবে ফারাক করেন তাদের সঙ্গেও যারা একে জাতিবাদী হিংসা ও প্রতিহিংসা দিয়ে বুঝতে চায়। কিন্তু দেওবন্দীরা কি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হাফেজ্জী হুজুর এই দুই দেওবন্দীর কাছ থেকে কিছু শিক্ষা নিয়েছে? আজ আমাদের সকলকেই এই দেশের ষোল কোটি মানুষকে পথ দেখাতে হলে বিনয়ের সঙ্গে নিজ নিজ অবস্থান পর্যালোচনা করতে হবে।

ইসলাম একই সঙ্গে ভারতবর্ষের জনগণের ইতিহাস এই সত্য উপলব্ধি না করলে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চায় তাদের হাতকেই আমরা শক্তিশালী করি। এই সত্য উপলব্ধি করলে দুনিয়াব্যাপী জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ে আমাদের এখনকার কর্তব্য কাজটুকুও আমরা সহজে বুঝতে শিখব।

ভাসানি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ নন, তিনি ইসলামের বৈশ্বিক আবেদনে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ফলে তিনি আন্তর্জাতিক নেতা। কোন জাতীয়তাবাদী নেতার স্তরের মানুষ তিনি নন। তাই বলে জাতি নিপীড়ন বরদাশত করেন নি, অতএব ইসলামের যে ঐতিহাসিক মূর্ত রূপ আমরা তাঁর মধ্যে দেখি তাকে সেই ভাবেই -- তার ঐতিহাসিক সত্যের জায়গা থেকেই -- বিচার করতে শিখতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতা তিনি, কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের দুষমন। শেখ হাসিনা তাই তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিয়েছে, কিন্তু জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই এতে থেমে থাকবে না।

বাংলাদেশে নতুন বৈপ্লবিক রাজনীতি পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে যারা উপনিবেশ বিরোধী দেওবন্দী ঐতিহ্য ধারণ করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাইরে সমাজকে আত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাকেই সত্যকারের শিক্ষা বলে গণ্য করেন তারা মওলানা ভাসানীর গৌরবকে দেওবন্দী ঐতিহের সঙ্গে মেলাতে পারেন না; কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট ভীতি তার প্রধান কারণ। এই ভীতি কাটিয়ে তোলা দরকার। ইসলামপন্থী ও বামপন্থী উভয় পক্ষে মওলানা সম্পর্কে ভুল ধারণার ক্ষেত্রগুলো আমাদের চিহ্নিত করা দরকার এবং মওলানার রাজনৈতিক চিন্তা আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যালোচনা আজ আমাদের কর্তব্য হয়ে উঠেছে।

এবার ১৭ নভেম্বর সেই কাজ শুরুর প্রতিজ্ঞা দিবস হয়ে উঠুক। আসুন আমরা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিজ নিজ খোপে বসে দরজা জানালা বন্ধ করে নয়, খোলা জায়গায় খোলা মনে পড়ি ও বোঝার চেষ্টা করি।

ভাসানী সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু লেখা চিন্তা ওয়েবে প্রকাশিত হয়েছে। এক সঙ্গে এখানে সেই লেখাগুলোর লিঙ্ক দিচ্ছি, পড়ার সুবিধা হতে পারে।

'সবুজ ভাসানি', 'লাল ভাসানি'
মওলানা ভাসানী ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
ফারাক্কা দিবস:লংমার্চ ও মওলানা ভাসানীর দর্শন
ফারাক্কা মিছিল এগিয়ে চলুক
ইনডিয়ার পানি আগ্রাসন ও নিরাপত্তা ঝুঁকি
মওলানা ভাসানীর পথরেখা
পানি ও রবুবিয়াতের রাজনীতি


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।