একটি রায়ের অপেক্ষায় পুরো দেশ
বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী সেই ১৯১৮ সালে, ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লার হাত ধরে । ১৯২১ সালেও নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষাকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের পূর্বেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিতব্য ‘পূর্ব পাকিস্তান'-এর রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়েছিল। এতদিন অবধি আন্দলোন ছিল কাগজ কলমে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে শুধু মাত্র উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষা করার হীন সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার। "উর্দু বাংলা ভাই ভাই, উর্দুর পাশে বাংলা চাই" শ্লোগান নিয়ে বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে পাকিস্তান সরকার কে স্মারক লিপি প্রদান করে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নেতারা । সরকারের অনড় অবস্থানের কারনে প্রতিবাদ কাগজ কলম থেকে নেমে আসে রাজ পথে । ১৯৫২ থেকে ১৯৭১। বাঙালি পেল একটা রাষ্ট্র, একটা রাষ্ট্র ভাষা ।
ইদানিং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে দেখছি রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম নিয়ে বেশ তর্ক বিতর্ক । রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম পড়ে আছে সরকারী(!) কোর্টের বারান্দায় ! জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার নিয়েই সংবিধানের মুল নীতি । বাঙালি নাকি বাংলাদেশি? জাতীয়তাবাদের এ প্রশ্ন তো রয়েই গেছে । যদি বাঙালি বলি তাহলে খুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উপর বাংলাকে কে কি চাপিয়ে দেওয়া হল না ? আর যদি বাংলাদেশী বলি তাহলে বাংলাদেশর অভ্যান্তরে বসবাসকারী বিহারী দেরকে কি স্ট্যাটাস দেব যারা নিজেদেরকে পাকিস্তানী দাবী করে । রিফিউজি ? সেটা ও তো সম্ভব নয় কারন ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশনে রিফিউজি হওয়ার যে চারটি শর্তের কথা বলা হয়েছে তার প্রথম টিই হল " ন্যাশনাল বর্ডার পার হয়ে অন্য কোন দেশে যাওয়া" কিন্তু বিহারীরা দেশ স্বাধিনের আগে থেকেই এদেশে বসবাস করে আসছে। গণতন্ত্র ! বিরোধী দলের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, হত্যা, বিচারিক হত্যা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের মাধ্যমে গদিতে বসার পাঁয়তারাই এদেশের চর্চিত গণতন্ত্র । তাতেও কোন সমস্যা নেই। সংবিধানে সমাজতন্ত্র রেখে মিশ্র অর্থনিতিতে দেশ পরিচালনা এটাও কোন সমস্যা না । সমস্যা হল সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থাকা অবস্থায় ইসলাম কে রাষ্ট্র ধর্ম রাখা এটা সংবিধান অবমাননাকর, এটা সংবিধানের পরিপন্থী ! এখন প্রশ্ন হল সংবিধানের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য সংবিধান ? ইসলাম কি আদৌ কোন সমস্যা ধর্মনিরপক্ষতাবাদ যার সমাধান ?
"ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম " শব্দটি ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব প্রথম ব্যবহার করেন। জর্জ জ্যাকব ধর্মের কোনো রকম সমালোচনা ছাড়া, সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য তার এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রকাশ করেন।
আধুনিক সংজ্ঞায়নে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে "কিছু নির্দিষ্ট প্রথা বা প্রতিষ্ঠানকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করাকে বোঝানো হয়। এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হবে না।" ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক চর্চা আদৌ কোন সেকুলার স্টেট করতে পারছে বা করছে কি ? ধর্মনিরপক্ষতাবাদ ভারতের সংবিধান থেকেই আমাদের সংবিধানে আমদানি করা হয়েছে । সেখানকার অবস্থা আমরা জানি। এতবেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর কোথাও হয় না। ঘরে গোমাংস রাখার কারনেও যেখানে মানুষের জীবন যায় । ফ্রান্সের কথাও আমরা জানি যেখানে ক্যাথলিক স্কুল গুলো মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার অনুমুতি দিলে ও সে সুজোগটা দেয় না সরকারী স্কুল গুলো।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মীয় স্বাধীনতায় বা অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনে আদৌ কোন ভুমিকা রেখেছি কি ? সেটা সম্ভব ও না । কোন রাষ্ট্র কে ঢাক ঢোল পিটিয়ে সেকুলার করলেই বা কি আর না করলেই বা কি ! সংখ্যালঘুরা তো সংখ্যা লঘুই থাকে । মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন না ঘটা পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক কোন কিছুর চিন্তা করা যায় না। প্রতিবেশী যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কে অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক ও পারস্পারিক সম্প্রীতির দেশ বলা চলে । দেশে যখন হাজার ও সমস্যা সেসবের সমাধান না খুজে রাষ্ট্র ধর্মের পিছনে কেন ? একটা রাষ্ট্রের নাম থাকবে, রাষ্ট্রভাষা থাকবে তাহলে রাষ্ট্র ধর্ম থাকলে দোষ টা কোথায় ?
অনেক বন্ধুবর কেই দেখলাম অনেক টা আবেগের বশবর্তি হয়ে বলছেন, সংবিধানে কোথাও তো ইসলামি আইনের কিছু নেই তাহলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলেই কি বা না থাকলেই কি। আমরা তুরস্কের কথা জানি । যেখানে বড় বড় মসজিদ গুলোতে নামাজ নিষিদ্ধ করে জাদুঘর তৈরি করা হয়, নিষিদ্ধ করা হয় প্রকাশ্যে আযান, নারীর হিজাব, ধর্ম মন্ত্রণালয়,ইসলামী শিক্ষা, হজ্জ-উমরা । আর এসব সম্ভব হয়েছিল কামাল আতাতুর্ক যখন উসমানী খেলাফত ধ্বংস করে তার দেশে কায়েম করেছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা স্যেকুলারিজম।
আমাদের দেশের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বা বেতারে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান দেওয়া হয় বা সংসদের অধিবেশনের পুর্বে কোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত করা হয়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এই দায়বদ্ধতা থেকেই করা হয়। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পর সম্প্রতি বদরুননেসা কলেজেও হিজাব নিষিদ্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে । শুধু হিজাব কেন রাষ্ট্র ধর্ম থেকে ইসলাম বাদ দিতে পারলেই কামাল পাশার মত যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে আর বাধা থাকবে কোথায়? যাইহোক, রাস্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কিনা এই রায়ের অপেক্ষায় দেশবাসী । সংবিধানের মূলনীতি ঠিক রাখতে গেলেই বাদ পড়বে ইসলাম। সেদিন রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমেছিল বাঙালি, রাষ্ট্রধর্মের ক্ষেত্রেও সেরকমটা ঘটবে কিনা ধর্মের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা, অনুভূতি ও আনুগত্যই নির্নয় করে দিবে তা ।