তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
‘দেখা দিয়ে ওহে রসুল ছেড়ে যেও না
তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
তোমা বিনে পারের লক্ষ্য আর তো দেখি না।।
রসুল দেখা দিয়ে যেন আবার ছেড়ে না যান, সেই আকুতি ও আর্তনাদে ভারী এই গান। সহজ অথচ গভীর। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির নিত্য গাওয়া সকলের অতি প্রিয় এই গানটি সন্ধ্যায় দৈন্য গানের অনুষ্ঠানে গাইছে নবপ্রাণের ছাত্রী পূর্ণিমা দাস।
নদিয়ার জাতপাত বা বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধিতা বোঝার সঙ্গে সরাসরি ইসলাম ও বঙ্গে ইসলামের ইতিহাস – বিশেষত সুলতানী আমলের ভূমিকা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদিয়া ইসলামের জাতপাত বিরোধিতার আদর্শ মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে অবশ্যই। জাতপাত বিরোধিতার চর্চাই নদিয়ার ভাবের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক। যে কারণে ধর্ম পরিচয় থেকে জাত জাতিভেদ বা সাম্প্রদায়িকতারও ঘোর বিরোধী নদিয়া।
আখেরি নবীর মধ্য দিয়ে যে জ্ঞান বা প্রজ্ঞার মুহূর্ত ইতিহাসে দেখা গিয়েছিল তার প্রতি নদিয়ার আকুতি প্রবল এবং আশেকানি দৃঢ়। নবীর প্রতি অকুন্ঠ প্রেম এবং তাঁর তাৎপর্য ফকির লালন শাহের নবীতত্ত্বমূলক কালামগুলো্র মধ্য দিয়ে নানা ভাবে ব্যক্ত। যে কারণে নদিয়া অনায়াসেই ঘোষণা দিতে পারে
দ্বীনের ডংকা বাজে মক্কা-মদিনে
আয় গো যাই নবীর দ্বীনে।
ধর্মের জয়ডংকা বাজছে মদিনায়, চলো আমরা মদিনায় যাই …।
যারা ধর্মের নামে ‘জাত’ বিচার করে, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে বিবেক বিসর্জন দিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্গে নদিয়ার ফারাক দুস্তর। ধর্মের দ্বারা নির্ণিত আত্ম-পরিচয় সহ সকল প্রকার আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি -- যা বিভেদ ও বিভাজন তৈরি করে -- নদিয়া তার ঘোর বিরোধী। হিংসা ও হানাহানির বিপরীতে 'শান্তি'র জ্ঞানটুকু তারা রসুলের কাছ থেকেই পেয়েছে। তাই, ‘তোমা হতে জ্ঞান পেয়েছি আছি সান্ত্বণা’।
বলা হচ্ছে আমরা মদিনাবাসীরা তো আসলে নানান গোত্র, গোষ্ঠি, রক্তের সম্পর্কে নির্ণয় করা সম্পর্কে বিভক্ত ছিলাম। হানাহানিতে, পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসায় ও হত্যায়। সকল জাতপাত রক্ত সম্বন্ধের সম্পর্ক, ভূমি, ভাষা কিম্বা অন্য কোন চিহ্ন দ্বারা নিজেকে অপরের কাছ থেকে ভিন্ন একটি ‘জাতি’ বা ‘সম্প্রদায়’ হিসাবে পরিচয় নির্মাণের উর্ধে উঠে দুনিয়ার সকল মানুষকে একই ‘উম্মাহ’ বা সমাজের অন্তর্গত করবার শিক্ষা তো তুমিই আমাদের দিয়েছ। তাই, ‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না’। সকলের সঙ্গে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হবার পথ তো তুমই আমাদের দেখালে।
নদিয়ার নবীতত্ত্ব নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। কিন্তু গানের মধ্য দিয়ে তার ভাবের শক্তি মানুষের মন জয় করে চলেছে।
তবে যে বিষয়ে নদিয়া সবসময়ই সতর্ক সেটা হচ্ছে নদিয়ার ভাবুকতা কখনই নিজেকে ইসলামের নতুন কোন ব্যাখ্যা হিসাবে হাজির করে না। এটা নদিয়ার ভাবচর্চার কাজও নয়। ইসলাম যাদের বিশ্বাস ও আকিদার অঙ্গ সেটা একান্তই তাদের নিজস্ব ক্ষেত্র। ইতিহাস ও দর্শনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক অতোটুকুই যতোটুকু ইসলাম ধর্ম কিম্বা দর্শন হিসাবে এবং বঙ্গে ইসলামের ইতিহাস হবার সুবাদে নদিয়ার ভাবচর্চাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। নবীতত্ত্বের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে নবী মানুষ পশু পাখি কীটপতঙ্গসহ সারা বিশ্বজগতের জন্য 'রহমত' হিসাবে অবতীর্ণ। ফলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্ম নির্বিশেষে নবীর গুণগান গাওয়াই নদিয়ার রীতি। ধর্মপ্রাণ মানুষের মন জয় করাই নদিয়ার সাধনা, তার বিকল্প হওয়া নয়। লালন কোন ধর্ম প্রচারক নন, ধর্মের সংস্কারও তাঁর কাজ ছিল না। মানুষের জীবন ও জগতের নানানবিধ গভীর জিজ্ঞাসা তিনি তাঁর মতো করে হাজির করতে চেষ্টা করেছেন।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।