ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কস: আসুন পর্যালোচনা করি
মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ধর্ম সম্পর্কে কার্ল মার্কসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে ফেইসবুকে একটি স্টেটাস দিয়েছিলেন। ধর্মে বিশেষত মার্কস কিভাবে ধর্মকে বিচার করেছেন সেই দিকে তার আগ্রহের জন্য আমি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। তিনি অবশ্য ঠিক ভাবে উদ্ধৃতিটি দেন নি, উদ্ধৃতিটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও তিনি ঠিক বলেন নি। ধর্মের প্রশ্নে মার্কসের অবস্থান আসলে কী ছিল এবং এখন যাঁরা নিজেদের মার্কসের অনুসারী বলে দাবি করেন তাঁদের অবস্থান বাংলাদেশে আদৌ মার্কসের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ন কিনা তা নিয়ে কথা খুবই জরুরী। তার একটা সুযোগ তৈরি হতে পারে ভেবেই আমি উৎসাহিত হয়েছি। অন্যরা আগ্রহী হতে পারেন ভেবে কমরেড মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্যটি হুবহু পেশ করছি।
"শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরুপ "
কার্ল মার্কস এই উক্তিটির মাধ্যমে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু কেন ?
এই বিষয়টির গভীরে না গিয়ে মোল্লা, পুরোহিত,ধর্ম ব্যাবসায়ীর দল বুঝে কিংবা না বুঝে একরৈখিকভাবে সরল মানুষগুলোর কাছে উপস্থাপন করে মানুষকে কমিউনিস্ট (সমাজতন্ত্রী) বিদ্বেষী হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে, এমনকি অনেক কমিউনিস্ট (সমাজতন্ত্রী) কর্মীও এই বিষয়টির সঠিক মর্মার্থ উদ্ধার করতে ব্যার্থ হয়ে পুরো বিষয়টিকেই লেজে গুবরে ফেলেন।
আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে, আজকালকার মতো তখনকার সময়ে আফিম কোন নেশাদ্রব্য ছিল না, তখনকার চিকিৎসকরা ব্যাথা বা চেতনা নাশক হিসাবে আফিমকে ব্যাবহার করতেন। আর মার্কস নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরুপ বলতে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে- সমাজ থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ,যন্ত্রনা,কষ্ট, অন্যায়,নির্যাতন লাঘবের চেষ্টায় যখন কোন ব্যাক্তি ব্যর্থ হয়, তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে সমস্ত অন্যায়ের বিচারের ভার সে অর্পন করে।
ধর্মকে আশ্রয় করেই তার সকল যন্ত্রনা লাঘবের চেষ্টা করে কিংবা ভুলে থাকে। নিজে যখন বদলা নিতে ব্যর্থ হয় তখন সে মনে করে এক দিন না একদিন তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তা করবেন ই। এ প্রেক্ষাপটেই মার্কস এ উক্তিটি করেছিলেন।"
আমি লিখেছি,
“ধর্ম নিয়ে আপনার এই আগ্রহের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
তবে আপনি যেভাবে উদ্ধৃতি চিহ্নে মার্কসের বরাতে বলেছেন, কার্ল মার্কস এভাবে কথাটা বলেন নি। ইংরেজি অনুবাদে: Religious suffering is, at one and the same time, the expression of real suffering and a protest against real suffering. Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people. এখানে দেখুন,
A contribution to the Critique of Hegel's Philosophy of Right
https://www.marxists.org/archive/marx/works/1843/critique-hpr/intro.htm
দেখা যাচ্ছে মার্কস ধর্মকে মানুষের সত্যিকারের মর্মযাতনার অভিব্যাক্তি এবং বাস্তবের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গণ্য করতেন। কমিউনিজমের নামে এবং কমিউনিস্ট হবার সুবাদে যে প্রকট ধর্ম বিদ্বেষের চর্চা আমরা বাংলাদেশে দেখি মার্কস, কিম্বা লেনিনের মধ্যে আমরা তা দেখি না। লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। আর, ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে বিভ্রান্তি না বাড়ানোই দায়িত্বশীল কাজ।
কার্ল মার্কসের ধর্ম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা একান্তই কমিউনিস্ট আর অন্যদিকে স্নায়ু যুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যবাদীদের প্রপাগান্ডার ফল। উভয়েই মার্কস ধর্মকে আফিম বলেছেন এই প্রচারই চালাতো। কমিউনিস্ট চালাতো কারন তারা মনে করে (এবং এখনও) ধর্ম থেকে মুক্ত হয়ে নাস্তিক হওয়াটাই প্রগতিশীলতা। কমিউনিস্ট হতে হলে নাস্তিক -- বিশেষত ইসলাম বিদ্বেষী হতে হবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডার প্রধান অস্ত্র ছিল ধর্ম। তারা প্রচার করতো কমিউনিস্টরা আল্লাখোদা মানে না, তারা ধর্ম বিদ্বেষী। এই অস্ত্র দিয়েই তারা কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট উভয়কে সফল ভাবে ঘায়েল করতে পেরেছে।
এই ক্ষেত্রে মোল্লা পুরোহিতদের অবদান এতোটুকুই যে তারা কমিউনিস্ট ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডা তোতাপাখির মতো আঊড়িয়ে গিয়েছে। কার্ল মার্কসের 'A Contribution to the Critique of Hegel's Philosophy of Rights পড়ে জনগণকে বোঝাবার দায় ছিল কমিউনিস্টদের। দুই একজন ব্যাতিক্রম ছাড়া সাধারণ ভাবে কমিউনিস্টরা সেটা করে নি। বাংলাদেশে তো নয়ই। সেটা ত আর মোল্লা পুরোহিতদের কাজ ছিল না। মার্কসের এই লেখাটি বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা আদৌ পড়েছে কিনা সন্দেহ। কমিউনিস্টদের কাজ হচ্ছে নিপীড়িত মজলুম জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো ও তাদের পক্ষে জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করা। মতাদর্শিক লড়াই দরকার আছে, কিন্তু বাস্তবে মজলুমের পক্ষে না থেকে তার বিশ্বাসকে অন্ধ ক্রোধে ক্রমাগত আহত করে কিভাবে জনগনকে প্রগতিশীল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব? একটু ভেবে দেখবেন।
সেকুলারিজমের নামে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা কি প্রগতিশীল কাজ?
আপনি লিখেছেন, "নিজে যখন বদলা নিতে ব্যার্থ হয় তখন সে মনে করে এক দিন না একদিন তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তা করবেন ই। এ প্রেক্ষাপটেই মার্কস এ উক্তি টি করেছিলেন"। এ কথাটাও ঠিক নয়। হেগেলের রাষ্ট্রতত্ত্ব অর্থাৎ অধিকার শাস্ত্র পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বলা। মার্কস শুরু করেছেন এই বলে যে জর্মন দেশে ধর্মের পর্যালোচনা মোটামুটি সম্পূর্ণ, আর ধর্মের পর্যালোচনা আর সব কিছু পর্যালোচনার পূর্বশর্ত। জর্মন ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে মার্কস কথাটি বলেছিলেন। আপনি যেভাবে বলেছেন সেটা ঠিক নয়। এতে ভুল বোঝার অবকাশ আছে"।
... .. ...
এই সকল বিষয় নিয়ে আমি আমার ‘মোকাবিলা’ বইতে বহু আগেই কিছু আলোচনা করেছি।
যাঁরা নিজেদের মার্কস-লেনিন অনুসারী কমিউনিস্ট বলে দাবি করেন তাঁদের উচিত ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসের পর্যালোচনা ঘনিষ্ঠ ভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করা। নতুন বিশ্ব বাস্তবতা বিচারের ক্ষেত্রে এই পর্যালোচনা কিভাবে দার্শনিক তর্কে এবং ব্যবহারিক রাজনীতিতে বাস্তবোচিত ভাবে প্রয়োগ করা যায় তা নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে সন্দেহ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধর্ম প্রসঙ্গে পর্যালোচনামূলক ও সঠিক শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া ফ্যসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলয় ঘটানো অসম্ভব। কারন প্রথমেই ফ্যসিস্ট রাষত্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণমানুষের বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। ফলে যারা শ্রমিক কৃষক ও শোষিত মানুষের রাজনীতি করেন তারা পেটিবুর্জোয়া অনুমান ও ধর্মের প্রতি চরম প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ পরিহার করে মার্কসের পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী আয়ত্ব করবেন, আত্মঘাতী ধর্ম বিদ্বেষী অবস্থান গ্রহণ করে গণমানুষের বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির পিঠে ছুরি মারবেন না। এটাই প্রত্যাশা।
আশা করব শোষিত নিপীড়িত খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যে সকল তরুণ রাজনীতিতে সক্রিয় তাঁরা এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন।
আসুন আমরা কথা বলি এবং ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণমানুষের ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো দ্রুত চিহ্নিত করি।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।