মুক্তচিন্তা চর্চা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
সম্প্রতি মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে তুমুল। নির্দিষ্ট করা হচ্ছে লেখক নামক ব্লগারদের যারা অনলাইনে লেখালেখি করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ব্লগার বিষয়েই আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে বেশী। ব্লগার শব্দটি নতুন সংযোজন আমাদের জগতে। অনলাইনে মুক্তভাবে লেখালেখিতে যুক্ত লেখকদের ব্লগার হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং এর সাথে নাস্তিক শব্দটি ও যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। ব্লগার ও নাস্তিক শব্দ দুইটি খুবই দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে সর্বত্র। মৌলবাদীরা খুব সহজেই এই দুইটি শব্দকে দিয়ে সমগ্র প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর সাধারণ মানুষের মনে অনেক ভ্রান্ত ও ভূল ধারনা জন্ম দিচ্ছে। এই ভূল ধারনা গুলো সাধারণ ধর্মপ্রান মানুষ সঠিকভাবে বুঝতে কিংবা ব্যাখ্যায়িত করতে না পারলে কোন প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখকই এই অপবাদ থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা নববর্ষের অনুষ্ঠানে (১৪২৩ বঙ্গাব্দে) মুক্তচিন্তা চর্চা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সহ্য করা হবে না। তিনি আরো বলেছেন যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। কেউ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে না। ধর্মকে আঘাত করে লেখাকে অনেকে মুক্তচিন্তা বলেন। আমার কাছে এটা নোংরামী মনে হয়।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্যে দুইটি লাইন খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে (১) মুক্তচিন্তা প্রকাশর নামে কোন ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত সহ্য করবেন না। (২) ধর্মকে আঘাত করে লেখাকে অনেকে মুক্তচিন্তা বলেন। আমার কাছে এটা নোংরামী মনে হয়। বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে। বক্তব্যের সারমর্ম যদি আমরা দেখি কোন ধর্মই মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে নয়। বরং প্রত্যেকটি ধর্মই মুক্তচিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সর্বাধিক। কারন চিন্তাই সকল ধর্মের মূল বিষয়। চিন্তাকে একাগ্রচিক্তে মনোনিবেশ করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান গুলো নির্ধারন করে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি মুক্তচিন্তার নাম করে ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা আঘাত সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মপ্রান মুসলমানদের ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ও অস্তিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্মের নাম করে ধর্মীয় মৌলবাদের, গোড়ামীকে উচকানী দেওয়া যেমন নোংরামী ঠিক তেমনি মুক্তচিন্তার নাম করে (মুক্তমনা পরিচয়ে) প্রগতিশীলতাকে বির্তকিত করা সেটাও নোংরামী। সুতরাং প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্যটির মধ্য দিয়ে মুক্তচিন্তা চর্চা বাধাগ্রস্থ হয় নি বরং চর্চার ক্ষেত্রটি আরো প্রসারিত হয়েছে।
মুক্তচিন্তা কি ?
মুক্তচিন্তা শব্দের ইংরেজী (Free Thought) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে যুক্তি তর্কের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই মুক্তচিন্তার প্রাথমিক সংজ্ঞা হিসেবে ধরা যায়। আরো বলা যায় যে মুক্তচিন্তা একটি বিশেষায়িত চিন্তন প্রক্রিয়া যেখানে কোন রকম সীমাবদ্ধ কিংবা প্রতিবন্ধকতার প্রভাব থাকবে না। সামগ্রিক ভাবে যুক্তিবান ও প্রগতিশীল সচেতন চিন্তার প্রতিফলন বা প্রয়োগকেই মুক্তচিন্তার সঠিক সংজ্ঞা হিসেবে আক্ষায়িত করা যায়। তাছাড়াও পৃথিবীতে অনেক মুনীষীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মুক্তচিন্তাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। সেই দিকে বিস্তারিত তর্কবিতর্কে না গিয়ে আপাতত ড. কাজী সাইফুদ্দীনের দৃষ্টি ভঙ্গিকে আমার কাছে উৎকৃষ্ট বলে মনে হয়েছে। তিনি মুক্তচিন্তাকে বলেছেন “Open system of Thought” অর্থাৎ চিন্তার উন্মুক্ততা।
মুক্তমনা করা?
মুক্তমনা তারা যারা প্রতিটি ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মতবাদকে স্ব স্ব স্থানে মর্যাদা ও সম্মানের মাধ্যমে নিজের প্রগতিশীলতা, মননশীলতাকে ধারন ও লালন করে। মুক্তমনরা নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হতেও পারে আবার অবিশ্বাসীও (নাস্তিক) হতে পারে। একজন নাস্তিক যিনি নাকি কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না তিনি মুক্তমনা হতে পারেন এবং ধার্মীক মুক্তমনা যে সকল চিন্তা চেতনায় জনসম্পৃক্ততায় নিজের মতামতকে উপস্থাপন করতে পারেন ঠিক তেমনি নাস্তিক মুক্তমনাও সেই সমান অধিকার ভোগ করতে পারেন। কোন ধর্মে বিশ্বাসী না হয়েও সমাজে, জন মানুষের জন্য কল্যানকর চিন্তা কর্ম উপস্থাপন করতে পারেন। উদাহরন হিসাবে আমরা “ব্রাহ্ম” সমাজ বা গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করতে পারি। তারা মূর্তিপূজাকে এড়িয়ে প্রচলিত সনাতন ধর্মগুলোর নিগ্রড় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ধর্মের অনুসারিদের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন, এদের মধ্যে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরীশচন্দ্র সেন (যিনি পবিত্র কোরাআন শরীফকে বাংলায় অনুবাদ করেন) উল্লেখযোগ্য। এরা দু’জনেই বাংলা ভাষার সংস্কৃতিকে নিজেদের কর্মদিয়ে একটি সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং করেছেনও। সুতারাং প্রচলিত ধর্মকে বিশ্বাস না করেও কিংবা ধর্মের বাইরে থেকেও সমাজে শান্তির বাণী প্রচার করা যায়। এটাও মুক্তচিন্তার বা মুক্তমনার পরিচয় বহন করে। সুতারাং নাস্তিকরা যেমন বলে থাকেন ধার্মীকরা মুক্তমনা হতে পারেন না এটা যেমন ঠিক না আবার ধার্মীকরা সেটা বলেন নাস্তিকরা মুক্তমনা নয় সেটাও সঠিক নয়। মানব কল্যাণের জন্য সে সকল তত্ত্ব ও মতবাদ কিংবা কার্যপ্রনালী যারাই উপস্থাপন করতে না কেন সঠিক বিচার বিশ্লেষন পূর্বক প্রদান ও উপস্থাপনার অধিকার রাখে। হোক সে নাস্তিক কিংবা আস্তিক তাতে কিছু আসে যায় না। এই প্রসঙ্গে অতি সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি বক্তব্যকে খুবই সমসাময়িক উল্লেখ করা যায়। ৩১ শে জানুয়ারি ২০১৬ ইং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তব্যে তিনি বলেন “বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সবধর্মের সব সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মমতের স্বাধীনতা থাকবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ধর্ম মানার স্বাধীনতা থাকলে কোন ধর্ম না মানার স্বাধীনতাও থাকবে। অর্থাৎ যে ধর্ম মানবে না সে অবশ্যই নাস্তিক। সুতারাং নাস্তিকদেরও স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাসের অধিকার থাকতে হবে। আস্তিকরা যেমন তাদের যুক্তি তর্ক দিয়ে ধর্মকে বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য প্রমান হাসিল করতে পারে ঠিক তেমনী নাস্তিকরাও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ও যুক্তিতর্ক দিয়ে ধর্মকে অসার প্রমানিত করার চেষ্টা করতে পারবেন। বিষয়টি সম্পূর্ণ যুক্তিতর্কের মধ্যেই তর্কবিতর্ক হতে পারে কখনই বিদ্ধেষপূর্ণ আক্রামনাত্মক, বিদ্রুপাত্ব্যক কিংবা হানাহানির মত বিষয়গুলো যাতে না ঘটে। সম্প্রতি মুক্তমনা হওয়ার জন্য একটি গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছেমত মনগড়া সংজ্ঞা নির্ণয় করেছে এবং মুক্তমনা হতে গেলে এই এই শর্ত পূরণ পূর্বক তাদের গোষ্ঠীর অর্ন্তভূক্ত হতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি এমন যে ইচ্ছে করেই নিজেদেরকে নাস্তিক সাজানো কিংবা ফ্যাসনিক নাস্তিক হিসাবে নিজেদের জাহির করা। এটি একদম ঠিক নয়। নাস্তিকতারও একটি আদর্শ রয়েছে। ধর্মহীনতা আর ধর্মবিদ্বেষ এক জিনিস নয়। ধর্মহীনতাকে নাস্তিকতা বলা যেতে পারে কিন্তু ধর্মবিদ্বেষকে নয়। এই খান থেকেই নাস্তিকতার আদর্শকে প্রমান করা যায়। এবার দেখা যায় নাস্তিক্যবাদ ও মুক্তমনার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ।
নাস্তিক্যবাদ কি ? মুক্তমনার সাথে নাস্তিক্যবাদের সম্পর্ক
নাস্তিক্যবাদ বা নাস্তিকতা শব্দটির সংজ্ঞা ব্যপক। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রকম করে নাস্তিকতার সংজ্ঞা নিরূপন করা যায়। তবে সংক্ষিপ্ত ও সাধারন ভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, যে ব্যক্তির কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট ও সংকোচন কিংবা সংকীর্ণতাকে উপচিয়ে সাম্য,ঐক্যকে সামনে রেখে আস্তাবান হওয়া বা নিক্তের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করা। হতে পারে বিষয়টি জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীগত। এখানে আমরা সচরাচর যে কথাটি শুনে থাকি – নাস্তিক মানে ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস না করাকে বুঝানো হয়ে থাকে। বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রচলিত একটি ধারনা। কারন নাস্তিকতা শব্দটির সাথে ইশ্বরের আস্থা বা অনাস্তার বিষয়টি গৌণ, অন্তত মূখ্য নয়। আংশিক সম্পর্কযুক্ত থাকলেও মুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে ইশ্বরের অবিশ্বাসকে নাস্তিকতা/নাস্তিব্যবাদ বলা যায় না। কারন একজন নাস্তিক সার্বিকভাবে মানবতার কথা বলেন। তিনি ভাবেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সুতারাং সকল ধর্মই মানুষ ও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তাই একজন নাস্তিককে ধর্ম বিদ্ধেসী বলাটা বোধ হয় যুক্তিতর্ক নয়। মুক্তমনা কারা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে , প্রতিটি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মতবাদকে স্ব স্ব স্থানে মর্যাদায় ও সম্মানের মাধ্যমে নিজের প্রগতিশীলতা মননশীলতাকে ধারন ও লালন করে। মুক্তমনারা নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হতেও পারে আবার অবিশ্বাসীও ( নাস্তিক ) হতে পারে। তাহলে দেখা যাছে মুক্তমনার সাথে নাস্তিকতার সম্পর্কটি এমনি এমনি চলে আসে। মূলত: মুক্তমনা ও নাস্তিকতার মধ্যে কোন বিচ্ছেদ কিংবা অবিচ্ছেদও নেই। মুক্তমনা ও নাস্তিকতা শব্দ দুইটি একে অপরটি পরিপূরক। এই বলে একজন মুক্তমনা কিংবা নাস্তিক কখনও অধার্মীক নয়। নাস্তিকতার সংজ্ঞার মধ্যে ও আমরা ধার্মীকতার উপাদানগুলো খুজে পেয়েছি।
মুক্তমনা, মুক্তচিন্তা, প্রগতি, নাস্তিক্যবাদ, এই শব্দগুলোকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর সুবিধাবাদীরা নিজস্ব শ্রেণী স্বার্থের কারনে পৃথকভবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন রকম সুবিধা ও স্বার্থ হাসিল ব্যবহার করেছেন মাত্র। বিশেষত শব্দগুলোর মদ্যে সংজ্ঞাগত দিক থেকে তেমন পার্থক্য নেই।
মুক্তচিন্তা চর্চা ও ধর্ম :
মুক্তচিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে ধর্ম একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। যদিও এই প্রতিবন্ধকতাটা আমাদের সমাজেরই সৃষ্টি। মূলত মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোন বিধিনিষেদ কোথাও নেই। এবং ধর্ম মুক্তচিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সবচেয়ে বেশী। তথাকথিত ফ্যাসনিক মুক্তমনারা ধর্মের সাথে মুক্তচিন্তাচর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন মাত্র। ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ , নবী, রসুলকে নিয়ে কুটক্তি, মহান সৃষ্টিকর্তাকে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই সব মুক্তচিন্তা চর্চার আওতাভূক্ত নয়। এই সব আলোচনা সমালোচনা করে ব্যক্তি হিসাবে নিজেদেও ফ্যাসনিক নাস্তিক্যবাদী হিসাবে পরিচিতি হওয়া ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আসে বলে মনে হয় না। প্রকৃত পক্ষে ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক তর্ক বিতর্ক তথ্যজ্ঞান সমৃদ্দ আলোচনা ও সমালোচনা করা যৌক্তিক। কখনও কটাক্ষ, দুর্নাম, হটকারিতাকে বুঝায় না। ধর্মের সাথে যুক্তিবাদের সম্পর্কটি খুবই ঘনিষ্ঠ। যুক্তিবাদ (Rationalism) যেমন একটি জীবনাদর্শ ও ব্যক্তিগত দর্শন যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তি ও প্রমানকেই প্রাধান্য দেয়। ধর্ম ও তাই। তাহলে ধর্ম ও যুক্তিবাদ দিয়ে যদি আমরা আমাদের চিন্তা চেতনা চর্চাকে সমৃদ্ধ করতে পারি তাহলে বোধ হয় মুক্তচিন্তাটাকে ধর্মের সে প্রতিবন্ধকতা মনে করা হয় সেটি আর থাকবে না। প্রশ্ন আসতে পারে ধর্মের ক্ষেত্রে সেই আদেশ বা ধর্মীয় বিধানকে কিভাবে যুক্তিবাদ দিয়ে বিচার বিশ্লেশন করা যাবে? আসুন ধর্মের দৈব আদেশ বিষয়টি কি ? এই দৈব আদেশ বলতে কিছুই নেই। যদিও অনেক ধার্মীকরা সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক দৈব বিষয়টি ধর্মীয় বিধিবিধান হিসাবে মেনে নিয়েছেন। বিষয়টি সেরকম নয়। যে গুলোকে আমরা দৈব/ অলৌকিক বলছি সেগুলোর পিছনে কোন না কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্যই রয়েছে। আর এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই যুক্তিবাদের কাজ। যুক্তিবাদীরা বিজ্ঞানের আলোকেই বিচার বিশ্লেষন ও সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ধর্ম কখনও বিজ্ঞানের বাইরে নয়। বর্তমান শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ধর্মের অনেক দৈব ঘটনাকে বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষন করা গেছে। যা নাকি কয়েক শত বছর পূর্বের দৈব ও অলৌকিক হিসাবে মানুষের বদ্দ ধারনা ছিল।
ধর্মে প্রতিষ্ঠিত কিছু বিশ্বাস ও অনুভূতি ধার্মীকদের ভেতর কাজ করে। এই বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত বা কটাক্ষ করা মুক্তচিন্তা সমর্থন করে না। যদিও পূর্বে উল্লেখ করেছি যে এই বিশ্বাস ও অনুভূতি গুলোকেও যুক্তিবাদের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা যায়। মুক্তচিন্তা ও বিশ্বাস বা অনুভূতিকে আঘাত বা বিদ্রুপ করা দুইটি দুই রকম ভিন্ন বিষয়। কোন ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতিতে আঘাত বা বিদ্রুপ করাটা সম্পূর্ণ উসকানী বা গোষ্ঠিগত উত্তেজনার যোগান দেয়। আর মুক্তচিন্তা সম্পূর্ণ একটি প্রগতিশীল ধারনা প্রগতিশীলতা অর্থ এই নয় যে কোন রকম বিশ্বাস আদর্শ, অনুভূতিকে বিসর্জন দিতে হবে। এই সব বিষয়গুলো (বিশ্বাস, অনুভূতি ইত্যাদি) একজন মানুষের চারিত্রিক অলংকার। বিষয়টি এমন নয় যে মুক্তমনা কিংবা প্রগতিশীল বলেই ধর্মবিদ্দেশী হতে হবে তা নয়। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক , যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত দিয়ে ধর্মীয় কোন কুসংস্কারকে বিলুপ্ত করে প্রগতির প্রয়োগকে সমর্থন করে মাত্র। প্রগতি কিংবা মুক্তচিন্তা কোনটিই ধর্ম বিশ্বাসের ধর্মীয় অনুভূতির বিপরীতে নয়। মুক্তচিন্তা, মুক্তমনা, প্রগতি, প্রগতীশীলতা, আধুনিকতা, সংস্কার, পরিবর্তন এই বিষয়গুলোকে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত করে যে নির্যাস পাওয়া যায় তাই মূলত অলংকার, পরিধান ও পোশাক। এই অলংকার আছে বলেই ধর্ম এত সুন্দর ও গ্রহনযোগ্য। ধর্মের উপরোক্ত নির্যাসিত উপাদান গুলোকে কখনও ধর্মের মুখোমুখি দাড় করানো উচিত নয়। উচিত নয় এই সব বিষয়গুলোকে নিয়ে কটাক্ষ কিংবা বিদ্রুপাত্তক মন্তব্য করা।
মুক্তচিন্তা চর্চার ইতিবৃত্তঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বিবিন্ন ভাবে এই মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটে ছিল। অষ্টাদশ শতকের আমেরিকাতে প্যানাজ (pensce) নামে একটি ফুলকে মুক্তচিন্তার প্রতীক হিসাবে ধরা হত। কারন ছিল ফুলটির নাম (pensce) শব্দের অর্থ চিন্তা আর ফুলটির আকৃতি মানুষের চেহারার সদৃশ হওয়ায় একটা সময় ফুলটি সামনে হেলে পড়ে, যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। সুতারাং প্রাক আধুনিক সময় মুক্তচিন্তার সে আন্দোলন হয়েছিল সেটিকে একমাত্র প্রতীক হিসাবে ধরা হত এই প্যানাজ (pensce) ফুলকে। ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বেন বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় উন্মদনার যে কষাঘাতের বিশেষ কনে খৃষ্টীয় ধর্মজাজকে যারা সমাজের রক্ষক তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বলে তারা নতুন সত্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই নতুন সত্য জায়গা করে নিয়েছিল। এমনিভাবেই মধ্যযুগের অন্ধকার ছিন্ন করে ইউরোপে একদিন মুক্তজ্ঞানের সূর্য উদিত হয়েছিল। বিজ্ঞান আর যক্তির বিপ্লবী জোয়ারে অন্ধবিশ্বাস আর শাস্ত্রীয় আনুগত্যকে ভেঙ্গে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ভাবে মানুষের নতুন চিন্তার ও ভাবের বিশাল এবং জাগরন ঘটেছিল। গণজাগরণ ঘটে গেল সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতি এমনকি রাজনৈতিক পরিমন্ডলেও। ইতিহাসে এটিকেই আমরা রেঁেনসা হিসাবে আঙ্খায়িত করে থাকি। রেনেঁসা অর্থ ”পুনরজন্ম”। ইউরোপের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ”পুনরজন্ম” হয়েছিল। এই পূর্ণজন্ম বা রেনেঁসার জন্য মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহকরা যাজকতন্ত্রের কম বিষদগারে পরতে হয়নি। দার্শনিক ব্রনোকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল ধর্মযাজক জর্দাবো (ইতালী)।
ভারতবের্ষ তথা উপমহাদেশে এই মুক্তচিন্তার প্রসার শুরু হয়েছিল মূলত রাজা রামমোহন রায়ের সময় কালে। রাজা রামমোহনই এই অঞ্চলে রেনেঁসাস আন্দোলনের জন্ম দেন। তার থিম ছিল। ইউরোপের বুর্জোয়া মানবতাবাদী ধ্যানধারনা চিন্তাভাবনাগুলোকে ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথে আনায়ন করা। রামমোহনের রেনেঁসাস মূলত ধর্মীয় সংস্কারের পথে অগ্রসর হয়েছিল। পরবর্তীতে বিদ্যা সাগর এসে পরিপূর্ণতা দেন যেটি ছিল নাকি অভূতপূর্ব ঘটনা। বিদ্যাসাগরই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামী আর অজ্ঞতা থেকে মুক্ত উদার মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন শিক্ষা পদ্ধতিতেও। তিনি মনে করতেন শিক্ষার মাধ্যমে অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে যদি সর্ব মতের দর্শন পাঠ করার সুযোগ দেওয়া হয় ছাত্রদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত গড়ে উঠবে। বার্কলের দর্শন না পড়িয়ে মিলের লজিক পড়ানোর জন্য ইংরেজদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবেই বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন সমস্তরকম পূর্ব ধারনা, সংস্কার মুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জগৎ জীবনকে দেখার বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিবোধ গড়ে উঠুক। তাহলেই তারা যথার্থ মুক্তমনের অধিকারী হবে। স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে। মুক্তচিন্তার রক্ষনশীল মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে। মুক্তচিন্তার রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলিম সমাজের সমাজপতিদেও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের কৃতকর্মে অটল থেকেছেন। কখনও আপস করেননি কিংবা পিছিয়ে আসেননি আদর্শ থেকে। বিদ্যাসাগর বলতেন আমি দেসাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্তে যাহা উচিৎ বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব। লোকের বা কুটস্বের ভয়ে কদাচিতৎ সংকুচিত হইব না ” । সেই থেকে ভারতীয় হিন্দু সমাজের অধিকাংশরা ইংরেজী শিক্ষায় এগিয়ে যান এবং পশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে যতটা আলোকিত হয়েছিল, সেই সময়েই ভারতীয়/ বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ ইউরোপীয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান বর্জন করে আধুনিক জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। এই পেক্ষাপটে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কারো মতে ৩০- এর দশকে ঢাকায় যে “বুদ্ধির মুক্তি” আন্দোলন পরিচালিত হয় তাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহের হোসেন ছিলেন অন্যতম। তারা “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতেন। এদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এই “বুদ্ধির মুক্তি” আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তার প্রকাশিত গ্রন্থ “শ্বাসত বঙ্গ” এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দলিল হয়ে আছে। পশ্চাদপদ বাঙ্গালি মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণ যোগ্য। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সাথে সম্পৃক্ত আরেক জন ব্যক্তিত্ব যার কথা না বললে একটু অসম্পূনই রয়ে যাবে তিনি হলেন ঐ সংগঠনের অন্যতম তরুন সদস্য আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ধর্মীয় সংস্কার পরিত্যাগ করতে হয়েছিলেন। যাই হোক মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর আন্দোলনও এদেশের মানুষের মন থেকে বুদ্ধির আরষ্টতা ও কুপমন্ডুতাকে দূর করতে পারেনি। সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের এই আন্দোলন রাজনৈতিক ভাবে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে ৬০, ৭০ এর দশকেও এ দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতটুকু এগিয়েছিল পরবর্তী দশক গুলোতে ততটুকু পিছিয়েছে। যদিও বিশ্ব রাজনীতি বদলেছে অনেকখানি। ৬০ ও ৭০- এর বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আর বর্তমান দশকের বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বিপরীত। পরিবর্তন হয়েছে তথ্য প্রযুক্তিতে ও জ্ঞান বিজ্ঞানে। বিশ্বের এই পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা কি পেরেছি ততটুকু এগুতে ? মনে হয় না। কারণ, ৭৫- পরবর্তী সময়গুলোতে রাজনৈতিক সেভাবে ধর্মকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে এসেছিল। এই বিস্তার সময়টুকুতে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলো সামাজিক ভাবে (কিছুটা সাংস্কৃতিক ভাবেও) এদের শেখর বিস্তৃত করে ফেলেছে সর্বত্র। যার ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে ক্রমশ হত্যা, হুমকি, দেশ ত্যাগের প্রবনতায়। সভ্যতার বিচারে একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পারবো যে মুক্তচিন্তার কারনে ইউরোপের রেনেঁসাস পূর্ববর্তী সময় ইতালিতে দার্শনিক ব্রনোদে আগুনে পুড়িয়ে যেমন মেরেছিল এই সময়ে এসে হুমায়ন আজাদের, অভিজিতের, দিপনের মত মুক্তমনাদের হত্যাকান্ড এটাই প্রমানিত করে যে, রেনেসাস হউক আর মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্দির মুক্তির আন্দোলনই হউক পরিবর্তন কিন্তু তেমন একটা হয়নি। বিশ্ব ব্যপি পুঁজিবাদের বিস্তার ও উত্থানের এই যুগে পুজিতন্ত্র বা পুজি ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পুজিবাদের সাথে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলতার পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই সম্পূর্ণ বিশ্বেই পুজিবাদকে অর্থাৎ সা¤্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখতে সকল রাষ্ট্রগুলোই ধর্মের আশ্রয় গ্রহন করেছে। তাদের শোষনের হাতিয়ার হিসাবে শাসকরাই ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছে, চিন্তার স্বাধীনতাকে হরন করেছে। তাই সমসাময়িক বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমান তন্ত্রের প্রবল মাথাচড়া দিয়ে উঠবে আমরা লক্ষ্য করছি। মুসলিম দেশগুলো সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়ে ইসলামে মুক্তচিন্তার স্থান আছে কিনা এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। পক্ষান্তরে বিশেষত আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলা, ইরাক, আফগানিস্তানে আক্রমন, ক্রমশ মুসলিম দেশগুলোতে অভ্যন্তরীন নৈরাজ্য, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা, মুসলমানদের আত্মসচেতনতা ও ইসলামীকরনের মৌলবাদী চিন্তাচেতনাকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তচিন্তাকে নাস্তিক্যবাদের অপবাদ দিয়ে ক্রমশ মুসলিম সমাজ গভীর প্রগতির বিপরীত অবস্থানে করছে। বাংলাদেশ ও এই প্রবণতা থেকে বিছিন্ন নয়। ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করছে প্রগতিবাদ ও ইসলাম একসাথে চলতে পারে না। যারা প্রগতির কথা বলছে তারা নাস্তিক। ধর্মকে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রেখে মুক্তচিন্তার, প্রগতিচর্চার সুযোগ রয়েছে তা ইসলামের হেফাজত কারীরা সেটাকে সমর্থন করতে নারাজ। তারা সর্বত্র ইসলামী করনসহ শরিয়ত ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থার আদলে কট্টর মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে সর্বক্ষন মসগুল রয়েছে এবং বিভিন্নভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে (আলকায়দা, আই,এস. ইত্যাদি) সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত যেটি কিনা মূল ইসলামই সমর্থন করেনা। এই ইসলামী স¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মূল শক্তির উৎস বিশ্বমোড়ল রাষ্ট্র নামে খ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র তার রাষ্ট্রসমূহ। যারা কিনা ইসলামকে বিনাস/ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে সর্বদা সক্রিয়।
পরিশিষ্ট: মুক্তচিন্তা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সভ্যতার ক্রমবিকাশে মুক্তচিন্তাচর্চার কোন বিকল্প নাই। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্দি, মুক্তচিন্তাচর্চার অন্যতম এবং বিকাশমান ক্ষেত্রে বলা যায়। এই চর্চাবৃত্তির ফসল বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির উত্থান এবং মুক্তচিন্তাচর্চার আরেক মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চিন্তা চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, আপোশহীন নেতৃত্ব শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়ক ব্যক্তিত্বকে করেছে আরো সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা সত্যিই বিশ্ব মোড়লদের হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে। মুখে মিষ্টি মধুর বুলি আতলালেও তলে তলে ঠিকই বিনষ্ঠ কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়াশীর বিভিন্ন জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে পৃষ্টপোষকতা করে। যত ষড়যন্ত্রই হউক না কেন কোন অপশক্তিই টলাতে পারবে না বাঙ্গালিকে। একবার যখন মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি, কার ক্ষমতা রুখে এই অগ্রগতি,। অতন্ত্রপ্রহরীর মত পাহারার আছে বাঙ্গালি সংস্কৃতি।
বাঙ্গালিরার যখন এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিতে ঠিক সেই মুহুর্তে অনেকে মুক্তচিন্তার নামে, চিন্তার স্বাধীনতার নামে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে, উশৃঙ্খল আচরন করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে মুক্তচিন্তাচর্চাকে। আর এই সুযোগটি গ্রহন করছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। তারা গড়পরতা সকল প্রগতিশীল লেখক সমাজকে নাস্তিক্যবাদের লেজুর বৃত্তির সহায়ক বলে অপবাদ দিচ্ছে। তার ফলে যারা সৃজনশীল মুক্তচিন্তার লেখক তারাও এই অপবাদ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু মুক্তচিন্তাচর্চা মূলত সমাজকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামী ও কুপমন্ডুতার অন্ধকার গহবর থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে। মুক্তচিন্তাই মুক্ত করবে মানুষকে, তৈরী করতে আত্মমর্যাদাসম্পূর্ণ জাতিতে। যা কিনা জ্ঞানে, গুনে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর মুক্তচিন্তাচর্চার উপর দেওয়া ১লা বৈশাখের (১৪২০ বঙ্গাদ্দ) বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করতেই মুক্তচিন্তার আদি অন্ত আলোচনা করা। সর্বশেষে আবারও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রধান মন্ত্রী মুক্তচিন্তাচর্চাকে বিষদগার করেন নি, মুক্তচিন্তার নাম করে যারা ধর্মীয় উন্মদনাকে উসকে দিতে চাচ্ছে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
সহযোগিতা ও তথ্যসূত্র:
১। কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী
২। নির্বাচিত প্রবন্ধ আবুল ফজল
৩। ভারত বর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য- শিবদাস ঘোষ।
৪। ড. কাজী সাইফুদ্দীন থিসিস ও গভেষণার রূপরেখা।
৫। উইকিপিডিয়া (Wikipidia)
৬। গুগোল (Google)