চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী

রামপালের পক্ষ বা বিপক্ষের বিশেষজ্ঞদের কে ভাড়া খাটে কে খাটে না বাজে তর্ক। যারা করছেন তাদের অনুরোধ করব এই তর্কে ঢুকবেন না। এটা পাতিবুর্জোয়া নীতিবাগীশতা। এটা প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার প্রশ্নে নৈতিক অবস্থান নেবার তর্কের মধ্যেও পড়ে না। তাছাড়া, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। অতএব পরিহার করুন। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় সকলেই পুঁজির ভাড়া খাটে। জেনে, না জেনে কিম্বা বাধ্য হয়ে। এর ভেতর থেকেই প্রতিরোধ তৈরি হয়। এটা রাজনৈতিক কর্তাশক্তি নির্মাণের প্রশ্ন, নীতিবাগীশতার তর্ক নয়।

বিশেষজ্ঞতার তর্কে জেতা বা হার দিয়ে যদি রামপালের পক্ষের শক্তি পার পেয়ে যায় তাহলে কি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যৌক্তিক হয়ে যাবে? বিশেষজ্ঞরা টেকনিকাল যুক্তি দিচ্ছেন, ভারতের বিনিয়োগের ধরণ সহ রাজনৈতিক দিকটাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। আর প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্মাণের আদর্শিক বা নৈতিক প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ প্রযুক্তিবাদী তর্কে নাই। এনভায়রমেন্টাল এসেসমেন্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পরিবেশের ক্ষতি মূল্যায়ন আসলে খারাপ প্রযুক্তি ব্যবহার করবার জন্য জনগণের সম্মতি আদায়ের একটি পদ্ধতি মাত্র। আমরাও ব্যাস্ত হয়ে পড়ছি তাদের সেই টেকনিকাল তথ্য সঠিক না বেঠিক তা প্রমাণ করতে। সেটা কৌশলগত কারণে করতে হবে, কিন্তু রামপালের পুরো বিষয়টা রাজনৈতিক। সেটা বাদ দিয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে আরও অনেক ‘ভাড়া খাটা’ লোক বাড়বে, আর এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনও চলবে। তখন নতুন যুক্তি খাড়া হবে এতো অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ কাজ হয়ে গেছে এখন আর বিরোধিতা করে লাভ নেই।

টেকনিকাল বিশেষজ্ঞবাদিতার তর্ক কারা শুরু করেছে? যারা আন্দোলন করছেন তারাই। তারাই বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খারাপ। সেটা ঠিক আছে, কারেক্ট। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তর্ক এমনই যে রামপালের পক্ষে বিশেষজ্ঞ ভাড়ায় আনার দরকার নাই। আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্রের কারণেই এমনিতেই তাদের পাওয়া যায়। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের উৎপাদন করে। যাকে এখন আমরা ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ বলি সেটা বিজ্ঞানের উন্মেষকালে জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা মেটানোর তাগিদ থেকে জাত জ্ঞানচর্চা নয়, ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ পুঁজিরই ভাড়া খাটে, পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির কাজে তার সর্বস্ব নিয়োগ করে বসে আছে। পুঁজির ভাড়া না খেটে আধুনিক বিজ্ঞান টিকে থাকতে পারে না। জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতার মধ্য দিয়ে মানুষের যে জীবনযাপন পদ্ধতি ও অভ্যাস গড়ে উঠেছে তাই বিস্ময়বোধক ভ্রু তুলে প্রশ্ন ওঠে, বিদ্যুৎ ছাড়া কিভাবে আমরা চলব? আন্দোলনকারীরাও বলে থাকেন, বিদ্যুৎ আমরাও চাই, তবে তা সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়। দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের পক্ষে বা বিপক্ষে উভয়েই জীবাশ্ম ভিত্তিক সভ্যতা ও নগরায়নের পক্ষের শক্তি। প্রাণ ও প্রকৃতির কথা গীতবাদ্য সহকারে বলা আনন্দের, কিন্তু বিষয়টি অতো সহজ নয়।

আপনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে তর্ক করবেন তো বিরোধীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেই আপনার বিপক্ষে খাড়া করবে। জীবাশ্ম ভিত্তিক নগরায়ন ও সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখাই আধুনিক বিজ্ঞানের কাজ। প্রাণ ও প্রকৃতির তর্ক সে কারণে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস ও তার পর্যালোচনা ছাড়া শুরু হতে পারে না। বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ভূমিকাট অস্বীকার করবার জন্য নয়, তার কুসংস্কার মোচন ও পুঁজিতান্ত্রিক চরিত্র অতিক্রম করে যাবার জন্যই আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যালোচনা করতে হবে।

কুসংস্কার? হ্যাঁ। যখন আমরা অনুমান করি কিম্বা দাবি করি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের সব সমস্যার সমাধান করেতে পারে – সেটা অবশ্যই একালের চরম কুসংস্কার।

প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি শুধু ব্যবহারের আর ভোগের? এটা বিজ্ঞানের প্রশ্ন নয়, এটাই আদত নীতিনৈতিকতার প্রশ্ন। বামপন্থা এই অসুখ থেকে মুক্ত নয়। কারন প্রকৃতি মার্কসবাদীদের কাছে স্রেফ উৎপাদনের কাঁচামাল কিম্বা উৎপাদনের উপায়। প্রকৃতিকে কাঁচামালে কিম্বা আমাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের উপায় মাত্র গণ্য করা আধুনিকতা বা আধুনিক সভ্যতার মধ্যে গড়ে ওঠা গভীর একটি অসুখ।

রামপাল আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই যে এই অসুখ ও তার নিরাময়ের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা কথা শুরু করতে পারছি। বলে যাব।

রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সুন্দরবন ধ্বংস হবে। কিন্তু কথাটা এখানে ফুলস্টপ দিলে হবে না। এর সাথে যুক্ত করতে হবে যে সুন্দরবন নতুন ধ্বংস হচ্ছে না। চকরিয়া অংশে যা কিছুটা অবশিষ্ট ছিল তা চিংড়ি ঘেরের ফলে এখন আর নাই বললেই চলে। সমুদ্র উপকূলের বাকি জায়গাগুলোও বিনাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে। এখন যারা আন্দোলন করছেন সেই তরুণ প্রজন্ম সেই বিষয়ে না জানতে পারে। সেটা দোষের নয়। সুন্দরবন রক্ষার জন্য আন্দোলন তাই ‘শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গান বাদ্য সহকারে রোমান্টিক আন্দোলন’ হোক অসুবিধা নাই। কিন্তু এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একে কেন্দ্র করে প্রাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যারা এই আন্দোলন করছেন তাদের প্রতি তাই নিঃশর্ত সমর্থন জানানোই কর্তব্য।

মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের বন কিম্বা সামগ্রিক ভাবে প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলছে। নগরায়ন, আধুনিক কৃষি, সোস্যাল ফরেস্ট্রির নামে ‘এলিয়েন’ বা ‘ইনভেসিভ’ প্রজাতির গাছপালা লাগানো, ইঁটের ভাটা, তামাক চাষ ইত্যাদি নানান কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির বিনাশ ঘটে চলেছে। ভারতে ও ফিলিপাইনসে আইনী ও সরকারী বাধানিষেধের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিকৃত বীজের বেগুন বা জেনেটিকালি মডিফাইড বিটিবেগুন ঘটা করে কৃষকদের দিয়ে চাষ করানো হচ্ছে। জিএমও প্রবর্তন প্রাণ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ। এখানে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন আর জিএমও বিরোধি আন্দোলনকে আলাদা করে দেখা যাবে না। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে প্রাণ ও প্রকৃতির কথা  সামগ্রিক ভাবে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।

‘সুন্দরবন’ রোমান্টিক জায়গা, কল্পনার বস্তু – এই ইমোশন তো আমাদের থাকবেই। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি তামাক চাষ করতে গিয়ে যে পরিমান গাছ কাটে ও বন উজাড় করে তা অবিশ্বাস্য। সেদিকে এখন একই সঙ্গে নজর ফেরাতে হবে। খেয়াল করুন, শুধু 'বন' নিয়ে আমাদের রোমান্টিকতা নাই, কারন সব বনে বাঘ থাকে না। তাই সুন্দরবন রক্ষা কর্তব্য গণ্য করলেও অন্য বন রক্ষার জন্য কর্তব্য বোধ করি না। আমরা বাঘ বাঁচাই, সুন্দরবন রক্ষা করি। তাই এট মধ্যবিত্তের সচেতনতার শুরু, শেষ নয়।

রামপাল আন্দোলনের গুরুত্ব রাজনৈতিক। ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’ এই শ্লোগান দিতে পারার মধ্যেই এই আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, একে রাজনৈতিকভাবেই আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।

 

 

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।