'সাধুসঙ্গ', 'সেবা', ও নদিয়ায় 'দেহ'

যাঁরা ছেঁউড়িয়া গিয়েছেন এবং সত্যিকারের সাধুসঙ্গ করেছেন তাঁরা ‘সেবা’ কথাটা শুনেছেন। আমরা ভাবি এটা বুঝি নিছকই ভাষা ব্যবহারের ব্যাপার। ‘খাওয়া’ কথাটা খুব খাদক খদক মনে হয়, বিপরীতে সাধু যখন করজোড়ে শুধায়, ‘আপনার কি সেবাশান্তি হয়েছে?’ এই মোলায়েম, বিনয়ে ভেজা সম্ভাষণ আমাদের ভাল লাগে।

‘সেবা’ ও ‘সেবা-ব্যবস্থা’ লালনের ঘরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। কথা আছে যে সেবার নিয়ম বা এর চর্চাবিধি প্রবর্তন করেছেন নিত্যানন্দ। গৌরাঙ্গ নদিয়া ছেড়ে চলে যাবার পর নিত্যানন্দ থেকে যান এবং তাঁর শিষ্যপরম্পরার ধারা বেয়েই নদিয়ার ভাবের বিকাশ। এই ইতিহাস মনে রাখলে আমরা বুঝব বৈষ্ণব সেবাবিধি বা নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের সেবাবিধির সঙ্গে নদিয়ার সেবাবিধির পার্থক্য রয়েছে।

আমার সৌভাগ্য যে ফকির লবান শাহ আমাকে তাঁর সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং আমি তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছি। তাঁর মাধ্যমে আমি তাঁর সমসাময়িক নদিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল মহতের সঙ্গেই সম্পর্ক করতে পেরেছি। তবে সবাই একে একে চলে গিয়েছেন। তাঁরই নেতৃত্বে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি আমরা গড়ে তুলি। যাঁরা ফকির লবান শাহের ( ফকির আব্দুর রব) সঙ্গে সঙ্গ করেছেন তাঁরা জানেন সেবার ক্ষেত্রে তিনি কী পরিমাণ কঠোর ছিলেন। লালন মাছ খেতেন, লালনপন্থীদের মধ্যে মাছ নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ফকির লবান শাহ তাঁর জীবনের এক পর্যায়ে এসে দোল এবং কার্তিক – এই দুই দিন ছাড়া কোন জীবজাত আমিষ গ্রহণ করতেন না। এই সময় থেকে তিনি ‘সেবাবাদী’ হতে চান নি আর-- সেবাবাদী না হবার সংকল্প তাঁর মধ্যে দৃঢ় হতে থাকে। 'সেবাবাদী' হওয়ার অর্থ হচ্ছে এমন কোন সেবা তিনি গ্রহণ করতেন না যা কোন সম্প্রদায় বা ভিন্ন বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ গ্রহণ করে না। তবে তাঁর সেবা চর্চার কথা অন্য সময় বলা যাবে।

 

অনেকেই নদিয়ার সেবা-ব্যবস্থা নিয়ে এখন আগ্রহী। এই দিকটা অনেক বিস্তারিত ও বিশ্লেষণ করে না বুঝালে ভুল বুঝবার অবকাশ থাকতে পারে বলে লিখবার অবসর পাই নি। আমার নিজের আলস্যকেও দায়ী করা যায়। তবে সেবাব্যবস্থার সঙ্গে ফকির লবান শাহ ‘বীজরক্ষা’ – অর্থাৎ প্রাণের বৈচিত্র্য ও প্রাণের স্বাভাবিক স্ফূর্তি বা প্রকাশের শক্তির সুরক্ষা বা হেফাজতের ওপর জোর দিতেন। তিনি ছিলেন নয়াকৃষি আন্দোলনের একজন দৃঢ় সমর্থক, এবং একালে লালনচর্চার প্রধাণ ক্ষেত্র প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণের বৈচিত্র – এ কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর প্রাণের যোগটা ছিল এই ধরণের কাজের ক্ষেত্রে। তিনি কৃষকদের নয়াকৃষি সার্টিফিকেট বিতরণ করেছেন এবং নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির বীজঘরটি তাঁর উপস্থিতিতে গুরু মা ফকির রিজিয়া বেগম উদ্বোধন করেন। আখড়াবাড়ির দোতলা বীজঘরটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল।

 

যাঁরা লালন নিয়ে আসলেই আগ্রহী তাঁদের ভাবতে বলি, নদিয়ার ভাবান্দোলনের এই সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে ফকিরদের 'গুহ্য চর্চা' ও গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য নিয়ে এতো মাতামাতি কারা করে? কেন করে? কেন তারা নদিয়ার ভাবচর্চার অনুসারীদের সম্পর্কে এমন এক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে যাতে মনে হয় ছেঁঊড়িয়াতে বুঝি গাঁজা এবং গুহ্যবিদ্যার চর্চা ছাড়া আর কিছু নাই।

 

আসুন আমরা এইসব ভুল ধারণা ভাঙি। লালনের পথ ঘোরতর ভাবে যে কোন নেশাদ্রব্য ব্যবহার বিরোধী ধারা, ভাবের নেশাই তার সাধনা, কল্কি না। কিন্তু একই সঙ্গে গাঁজা খায় বলে কাউকে ক্রিমিনাইলজ করারও আমরা ঘোর বিরোধী। এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় হচ্ছে ছেঁঊড়িয়ায় সাধকের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা।

 

নদিয়ার সেবা-ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ ও বিস্তারিত লিখবার আগে, নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে ফকির লবান শাহের জীবিতাবস্থায় যেভাবে সেবা দেওয়া হোত তার কিছু ছবি তুলে দিচ্ছি। যাঁরা এই বিষয়ে কিছুই জানেন না, মূলত তাঁদের জন্যই, যাতে কিছু ধারণা তাঁরা করতে পারেন। এটা দিচ্ছি আনাড়ি ভাবে ভিডিও ফর্মেটে – আসলে দেখার সুবিধার জন্য। সঙ্গে নবপ্রাণের আয়েশা আক্তারের একটি গান।

আয়েশা ২০১০ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। একটি অনুষ্ঠানে সোভাগ্যক্রমে রেকর্ড করে রাখা তার এই গানটি আপনাদের ভাল লাগলে খুশি হব।


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।