'সাব অল্টার্ন' পাঠের সমস্যা
সাব অল্টার্ন বিষয়ের আলাপটা প্রথম শুরু করেন গ্রামসি। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ইতালিতে রাজনৈতিক তৎপরতা করতে গিয়ে গ্রামসি যখন ব্যর্থ হয়ে জেলে বন্দি হন, তখন রাজনৈতিকভাবে কেন ব্যর্থ হলেন এই বিষয়ে একটা বোঝাপড়ায় যেতে চাইলেন। শেষতক মার্ক্সিস্ট রাজনীতি অর্থাৎ সোভিয়েত বিপ্লবের পর লেনিনীয় রাজনীতি আর ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ ইতালিতে ব্যর্থ হওয়ার যে অল্টারনেটিভ বোঝাপড়া সেটাকেই তিনি নাম দেন ‘সাব অল্টার্ন’।
সাব অল্টার্নের পুরো বিষয়টা গ্রামসি যখন ব্যাখ্যা করছেন তিনি ‘শ্রেণী’ ধারণাকে একটা ‘ইকোনোমিক শ্রেণী’ আকারেই পাঠ করেছেন এবং এখানেই জোর দিয়েছেন। সমস্যাটা আসলে আরও গভীরে। খোদ মার্ক্স যখন ‘শ্রেণী’ বিষয়ে আলাপ করেছিলেন তখন তিনি কি এইটাকে ‘রাজনৈতিক আইডিয়া’ (পলিটিক্যাল ক্লাস) আকারে পাঠ করেছেন নাকি ‘ইকোনোমিক’ একটা ক্লাস আকারে পাঠ করেছেন? এই প্রশ্নের মীমাংসাটা দেখবেন, মার্ক্স ‘শ্রমিক’ আর ‘শ্রমিক শ্রেণী’ বলতে আলাদা দুটো শব্দ ব্যবহার করেছেন ঠিকই, কিন্তু ইন্টারচেঞ্জিবিলি । যেমন ‘শ্রমিক’ মানে আক্ষরিক অর্থেই শ্রমিক, ইকোনোমিক। আর ‘শ্রমিক শ্রেণী’ কিন্তু ইকোনোমিক শ্রেণী না, মুক্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক আইডিয়া আকারেই এটি হাজির। ফলে কেউ যদি শ্রেণী ধারণাটা কেবলমাত্র একটা ইকোনোমিক ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ এমন দাবী করতে চান সেই তিনিও মার্কসকে নিজের পক্ষের লোক হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
এই স্কোপ থেকে গেছে। পরবর্তীতে বিষয়টা সম্পর্কে প্রথম তর্ক হিসাবে উঠান লেনিন তাঁর “কী করিতে হইবে” বা “হোয়াট ইস টু বি ডান” রচনাতে। রাজনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ের এই শ্রমিক শ্রেণীকে লেনিন এডভান্স পার্টি, ভ্যানগার্ড বা শ্রমিকের অগ্রভাগ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। “প্রলেটারিয়েতদের ইন্টেলকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট” করে নেবার কথা বলেছেন। কিন্তু কাকে দিয়ে? একাজের জন্য বলছেন, the role of vanguard fighter can be fulfilled only by a party that is guided by the most advanced theory. । এছাড়া বিপ্লবের মধ্যমনি হিসাবে ‘বিপ্লবী তত্ত্বের’ প্রয়োজনীয়তা কেন তা বুঝাতে পরিস্কার করে বলেছেন, Without revolutionary theory there can be no revolutionary movement...। এই বিপ্লবী তত্ত্ব শ্রমিকের কাছে আসবে বাইরে থেকে – সমাজের ইন্টেলিজেন্সিয়া (যারা অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসাবে হয়ত “এলিট” বা বড়লোকের ঘরের থেকে আসা) – এদের কাছ থেকে আসবে। সার কথায় বিপ্লবী তত্ত্ব শ্রমিকের ভিতর থেকে না, বাইরে থেকেই একমাত্র আসতে পারে। কিন্তু সর্বশেষ লেনিনের বিতর্ক নিরসন আর এত কিছু লেখা চর্চার পরও শ্রেণী বলতে কেবল অর্থনৈতিক অর্থে শ্রেণী বুঝার ঝোঁক এই রাজনৈতিক ধারায় কাটে নাই।
শ্রেণী বুঝার এই সমস্যা তৈরি করতে এঙ্গেলস এর অবদানও কম না। এক্ষেত্রে জার্মান ইডিওলজি বইটা দেখা যেতে পারে। এই বইয়ের পান্ডুলিপিতে মাঝে মাঝে অনেক পাতা মিসিং। বইটা মার্কসের জীবিতকালেই অপ্রকাশিত ছিল। পরে এরকম এক খানে তিনটা মিসিং পাতা এঙ্গেলস লিখে দিয়েছেন। রাশিয়ায় তা প্রকাশের সময় সম্পাদক প্রকাশক তা ফুটনোটে উল্লেখ করে রেখেছেন। ঐ তিনটা পাতায় এঙ্গেলস শ্রমিক শ্রেণীর আলাপ একটা ইকোনোমিক শ্রেণীর আলাপ হিসেবেই হাজির করেন, এবং মার্ক্সকে ম্যাটারিয়াল বা ইকোনমিক জায়গায় বেঁধে ফেলার কৃতিত্বটাও বলা চলে এঙ্গেলসেরই। এবং মার্ক্সও এসব বিষয়ে সতর্ক করে রাখা বা ভিন্ন অর্থ হয়ে যাওয়া ঠেকানো অর্থে বক্তব্য খোলাসা করে জান নাই। সময় গড়াতে গড়াতে স্ট্যালিনের আমলেই এই ‘শ্রেণী’ ধারণা মাত্রই এতবেশী ইকোনোমিক কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে যে, শেষতক শ্রেণী ধারণার আলাপ একমাত্র একটা ইকোনোমিক শ্রেণীর আলাপ আকারেই হাজির হয়ে যায়। ফলে “শ্রেণী মানেই ইকোনোমিক শ্রেণী” কথাটাকে বলা যায় এটা আসলে স্টালিনিস্ট রিডিং অব মার্কস।
গ্রামসির সাব অল্টার্ন বা নিম্নবর্গ শ্রেণীর আলাপটাও শেষতক শ্রেণীর আলাপকে ইকোনোমিক শ্রেণীর গণ্ডিতে আটকায়ে রাখার বিষয়টাকে আরও পোক্ত করে। এটা স্টালিনের মার্কসের শ্রেণী ধারণা পাঠের কন্টিনিউয়েশন। গ্রামসির উদ্দেশ্য ছিল, এক ভিন্ন বয়ান তৈরি, এলিটের বয়ান ন্যারেটিভের বাইরে এক নতুন বয়ান তৈরি – এই অর্থে। তাই সাব অল্টার্ন। গরীবের ভিন্ন বয়ান। যাইহোক, কোন ফেনোমেনাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করার কিছু কারণ এবং যৌক্তিকতাও আছে। একটা ‘এলিট’ জায়গা থেকে কোন একটা ফেনোমেনা ব্যাখ্যা করলে সামগ্রিকভাবে পুরা বিষয়টা পষ্ট হয় না। বরং নিম্নবর্গের জায়গা থেকে এইটা আরো পষ্ট হয়ে উঠে। সমাজের দুঃখ-কষ্ট এই জিনিসটা গরীব মাইনষের কিংবা নিম্নবর্গের জায়গা থেকেই ভালো বুঝা যায়। ফলে গ্রামসির পরে গায়ত্রি যখন বলেন ‘ক্যান দ্যা সাব অল্টার্ন স্পিক’ তখন সেই আলাপের একটা মাজেজা আছে। গায়ত্রী প্রশ্ন ছুঁড়েন, ‘নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে’? এখানে ফিজিক্যালি কথা বলতে পারেন কিনা এমন প্রশ্ন না। রাজনৈতিক পরিসরে আপনার কথা আপনি বলতে ও শোনাতে পারেন কিনা, সেটাই প্রশ্ন। মানে তারা কথা বলতে পারেন। কিন্তু সমাজে তাদের স্বর শোনা যায় না। ফলে সমাজের বিশাল একটা শ্রেণীর দুঃখ-কষ্টের আলাপের যৌক্তিকতা আছে। এর মধ্য দিয়া নিম্নবর্গ শ্রেণীর একটা পার্সপেক্টিভ বা প্রেক্ষিত তৈয়ার হয়।
কিন্তু এইসব দুঃখ-কষ্ট-অনুভব ইত্যাদিকে দেখার পারস্পেকটিভ তৈরি করা এক জিনিস আর আর বিপ্লবী তত্ত্ব তৈরি যেটা লেনিন ভ্যানগার্ড বা পার্টি কাজ অর্থে বলছেন - এই দুইটা এক জিনিষ না। একই বিষয়ে কথা নয়। এই অর্থ বুঝলে এটা পরিস্কার, বিপ্লবী তত্ত্ব তৈরির কাজ অর্থে রাজনৈতিক মুক্তির চিন্তা তৎপরতা করা সাব অল্টার্ন বা ইকোনকিম শ্রেণীর কাজ না। আইডিয়ার জগত কখনো সাব-অলটার্নরা পরিবর্তন করে না, তারা বরং সর্বোচ্চ একটা অ্যাপ্লিক্যাবল ফোর্স হতে পারে। ফলে এইখানে রাজনৈতিক আইডিয়া তৈয়ার করা কিংবা চিন্তার ততপরতা এই কাজটা পুরোদস্তুর ইন্টেল্যাকচুয়ালদের। কাজটা ইন্টেলেকচুয়াল কাজ। আর এই ইন্টেলেকচুয়াল এলিট না সাব অল্টার্ন সেইটাও এখানে ইস্যু বা ফোকাস না।
যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যে কারখানার শ্রমিক সে ঘটনাচক্রে নিম্নবর্গ, গরীব কিংবা সে বস্তিতে থাকে। তার পক্ষে আইডিয়া হাজির করা কঠিন ব্যপার। তার যে জীবন পদ্ধতি, জানাশোনার পরিধি সবই সীমিত। ফলে আইডিয়া তৈয়ার করার মত প্রফেশনাল কাজ তার পক্ষে করা অনেক দুষ্কর। আবার ধরেন, গরীবের ছেলে ভার্সিটির শিক্ষক। তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। ফলে, এই আইডিয়া তৈরির যে কাজ সেখানে স্বভাবতই ইন্টেল্যাকচুয়াল হিশাবে ‘এলিট’ টাইপের মানুষেরাই প্রাধান্য বিস্তার করবে। এইখানে যেকোন ইস্যুতে ‘এলিট’ আর ‘সাব অল্টার্ন’ বাইনারী তৈয়ার করে যেকোন ব্যাখ্যা হাজির করাটা একরকম জোর জবরদস্তি-ই।
একটা উদাহরণ দিই। ১৯৪৭ ফেনোমেনাকে কেউ সাব অল্টার্ন তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে যে ফলাফল পাবে তাতে নিম্নবর্গ হিশাবে নমঃশূদ্র শ্রেণী এই ফেনোমেনাতে কেমন সাফারার হইল কিংবা এই ঘটনার ভিকটিম হইল এইসব বিস্তারিত হাজির হবে। কিন্তু কিভাবে এই ঘটনায় ‘মুসলমান’ নামক একটা ‘রাজনৈতিক শ্রেণী’ তৈরি হইল, কিভাবে তারা রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন খাড়া করে জমিদারী উচ্ছেদে সক্ষম হইল এইসব আলাপ সামগ্রিক আকারে সেখানে হাজির হবে না। আবার ধরেন সাব অল্টার্ন স্টাডি আকারে গৌতম ভদ্রের ‘ঈমান ও নিশান’ নিয়ে আলাপ তুললে আপনি পীর ফকিরদের নিয়ে একটা নৃতাত্ত্বিক স্টাডি পাবেন, যার কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য পাওয়া যাবে না। যেহেতু নৃতাত্ত্বিক বিষয়াদি মানে প্রাকৃতিক অর্থে ‘গিভেন’, ফলে এর কোন রাজনৈতিক দিক অর্থাৎ মানুষের সক্রিয় চিন্তা তৎপরতা – এসব দিকের কোন আলাপ বা হদিস ওখানে পাওয়া যাবে না।
শেষে লেনিনের ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড, টু স্টেপ ব্যাক’ থেকে একটা উদ্ধৃতি দি- ‘Theory comes from without’। তত্ত্ব শ্রমিকের বাইরে থেকে আসে। মানে মোটাদাগে শ্রমিক বা সাব অল্টার্ন নামক ইকোনোমিক শ্রেণীর বাইরে থেকে তত্ত্ব আসবে। এই তত্ত্ব বা আইডিয়া তৈরির কাজটা চিন্তার কাজ। আর চিন্তার কাজ মানেই ইন্টেল্যাকচুয়াল ব্যপার স্যাপার……।