সমাজ পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম

১.

১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে (যে অঞ্চলে আমি ছোট বেলা থেকে বড় হয়েছি) আক্ষরিক নাট্য সম্প্রাদয় নামক একটি নাট্য সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম আমরা কয়েকজন তরুন। নাট্য সংগঠনটি শ্লোগান ছিল “নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার” । আজ এই প্রবন্ধটি লিখতে বসে সেই শ্লোগানটির কথা মনে পড়ে গেল। সংস্কৃতিতে রাজনীতির ভাষা এ নতুন কিছু নয়। পূর্বে অনেক রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে  সংস্কৃতিকে অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে দেখেছি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর সৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সফলতার মুখ দেখেছে। আরো একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য ।  ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রাথমিক রুপটি ছিল ব্যায়াম বা শরীর চর্চা ও কুস্তি। এই কুস্তি কিংবা শরীর চর্চার  বিষয়টিকে জনগনের সাহস বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এটাও একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরই অংশ। বর্তমান কালেও চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা অনুষ্ঠিত হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশ হিসেবে। শুধু ভারতবর্ষেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও বিভিন্ন সময় তাদের জাতিসত্তার অধিকার ও সংগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কাজে লাগিয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় চীনের “মাহন সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব” গোটা চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুপ্রেরনার উৎস ছিল যা কিনা সমস্ত পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা দার্শনিক রুশো একটি গানের প্রবর্তন করেছিলেন গানটি হল (ইট দা রিচ)। তার অর্থ হল ধনীদের খাও।

যাই হোক সংস্কৃতি যে সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ন একটি ভূমিকা পালন করে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমার হাটহাজারী নাট্য আন্দোলন ও আক্ষরিক নাট্য সম্প্রাদায়ের ভূমিকা । সংগঠনটির শ্লোগানটি নির্ধারন করেছিলেন আমার ছোট বেলার বন্ধু রাজীব চৌধুরী যে কিনা নাট্য সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। নাটক করে সমাজ পরিবর্তন করতে পেরেছি কিনা জানিনা। তবে চোখের সামনে যে পরিবর্তন গুলো দেখেছি তার সামান্য কিছু বর্ণনা না দিলে নয়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবস্থিত। অতিশয়প্রতিক্রিয়াশীল এই ধর্মীয় মৌলবাদী হেফজতে ইসলামের নাকের ডগায় আক্ষরিকের সংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। শিবিরের আরেক ঘাটি নামে খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র দুই কিলোমিটার দূরুত্বে হাটহাজারী সদর অবস্থিত। শিবিরের চেনাজানা ছোট ভাই,বড় ভাই, বন্ধু-বান্ধব সকলের বিরুপ আচরনের এবং সাংস্কৃতিক প্রতিকূল একটি পরিবেশে আক্ষরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। মুক্ত নাটক নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছুটে চলেছি। গ্রামের সাধারন মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা পেয়েছি। অনেক শিবিরের কর্মীও আমাদের দলে এসে নাটক করেছে। ৯১ সাল থেকে প্রায় ৯৭ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীতে নাট্য সংস্কৃতির একটি জোয়ার লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সম-সাময়িক আরো বেশ কয়েকটি নাট্য সংগঠন , সাংস্কৃতিক সংগঠনের আর্বিভাব হয়েছিল সেই সময়টিতে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক (তৎকালীন) এম.এ সালাম কে আক্ষরিকের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল যা কিনা এস.এ সালামের জন্য হাটহাজারী সদরে পরিচিতিমূলক প্রথম অনুষ্ঠান ছিল। ৯৬ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য আক্ষরিকের নাট্য কর্মীরা বিশেষ অবদান রেখেছিল। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম যে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এটা ছিল তারই একটি উদাহরণ। ৯৩ সাল থেকে ৯৫ পর্যন্ত হাটহাজারীতে আক্ষরিক সহ অন্যান্য আরো অনেক সাংস্কৃতি সংগঠনের কার্যক্রম ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল স্বরুপ হাটাহাজারী কলেজ মাঠে বিজয় মেলার আয়োজন, বৈশাখী মেলার আয়োজন, সদরে শহীদ মিনার নির্মান, ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রভাত ফেরী সহ রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী উৎযাপন সহ নানাবিধ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠাগুলো অনুষ্ঠিত হতে লাগলো যা কিনা এখনো পর্যন্ত প্রবাহিত রয়েছে। যাই হোক সমাজ পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে কথা বলছিলাম ।

২.

এই সমস্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন কিংবা সংগ্রামকে ভাবগত সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করেছেন অধ্যাপক যতিন সরকার। বিয়ষটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বটে এই কারণে যে ভাব ও বস্তু দুইটি শব্দ একটির পরবর্তী ধাপ অন্যটি। অথাৎ ভাব থেকেই বস্তুর উৎপত্তি। ভাবগত কার্যক্রমের মাধ্যমেই বস্তুগত প্রাপ্তিতার সফলতা হাতাছানি দেয়। সাংস্কৃতি আন্দোলন সংগ্রামের ভাবগত কার্যক্রমই একটা সময় বস্তুগত হয়ে উঠে। যে বস্তুগত বিষয়টি আমাদের সমাজ ও জনজীবনের সাথে জড়িত । সমাজের মনোগত- অসম, বিচ্ছিন্ন, বৈষম্য, অপকর্ম, অপসংস্কৃতি, অধর্ম, কুসংস্কার ইত্যাদিকে সাংস্কৃতিক ভাষায় প্রকাশ করা সাংস্কৃতির ভাবগত প্রকাশ। আর যখনি সে বৈষম্য, অপকর্ম, অধর্ম, অপসংস্কৃতিকে জয় করে সুন্দর,সুশৃঙ্খল সমাজ তৈরি হয় তখনই দেখা যায় সাংস্কৃতিক বস্তুগত বিষয় ফুঠে উঠে। সংস্কৃতিতে ভাব এবং সমাজে বস্তু এই চর্চাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে যে সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয় সেই সমাজই একটি সফল ও জন সহায়ক ও কৃষ্টি সাংস্কৃতিক সমাজে পরিণত হয় নিসন্দেহে। কিন্তু উপরোক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনীতি ভাব ও বস্তু যাই বলি না কেন এই সবের কি দৃঢ় কার্যকারিতা কিংবা ফলপ্রসু সফলতা বর্তমান কালে আমরা দেখতে পাই? এই ক্ষেত্রে একটি কথা বলা দরকার স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। আমরা যে স্বাধীনতাকে এবং যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম কিংবা স্বাধীনতার যে মুলমন্ত্রসমূহ আমাদের বিজয়ের সাথে য্ক্তু হয়ে আছে সেই মুলমন্ত্রগুলো কি আমাদের সমাজ কিংবা রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে বা হচ্ছে? আমি বলব মোটেও না আমরা অনেকে বলছি আমার বিজয় অর্জন করেছি তাই আমরা সফল। অনেকে ভেবে থাকেন যে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক যে বিজয় তার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক বিজয় হয়ে গেছে। আমি বলব মোটেও না। তেমনটি ভাবলে ভুল হবে। এই জন্যই পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। এই কথাটি বঙ্গবঙ্গুকে দিয়েই বলা যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল ৭৫ সালে । মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা আমাদের শত্রুদের সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধুর উদার মন মানুষিকাতার সুযোগে তৎকালীন অতিবাম দলগুলোর সহযোগীয় খাপটি মেরে থাকা শত্রুরা খুব সহজেই আবারও আক্রমন করল বাঙালির চেতনার উপর । হত্যা করল সহপরিবারের বঙ্গবন্ধুকে । ৭৫ এর পরবর্তীতে মেজর জিয়া ও এরশাদের সহযোগীতায় আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেতে থাকল বাঙালির ও স্বাধীনতার শত্রু রাজাকার আলবদরা। জাতি আবারোও পর্যবশিত হল পাকিস্তানের চেয়েও আরও ভয়াবহ এক জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মুখে । বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামক বির্তর্কিত মতবাদ সহ নানাবিধ কার্যক্রম মেজর জিয়া সরকারের নতুন ধারার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন স্বাধীনতার মূলধারা থেকে বিকল্প ধারার প্রবর্তন করেন । যা কিনা বর্তমানকাল পর্যন্ত এই প্রাপ্ত ধারা রাজনৈতিক কার্যক্রম বাঙালির চেতনায় আত্মবিশ্বাসের আঘাত আনছে। যদিও বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিক বিকাশ ও শিক্ষার প্রসারের গতিধারা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা, খালেদা জিয়া মিথ্যা জন্মদিন পালন সহ হাজারো অসত্য ও মিথ্যাকে সত্য বলে মানুষের চেতনাগত বিশ্বাস কে ধোকা দেওয়া সাধারণ মানুষের কাছে আষাঢ়ে গল্পে প্রমাণিত হয়েচে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নেত্রীতে মুক্তিযুদ্ধের সহপক্ষে শক্তির ক্ষমতায় আগমন অবশ্য বাংলার প্রগতিশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সুদূরপ্রসারী কার্যক্রমেরই ফসল। এখানে উল্লেখ্য যে ক্ষমতার বিজয় মানে সামগ্রিক  ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বিজয় নয়। আমাদের বিকাশমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগ্রামের পথ সুগম হয়েছে বটে কিন্তু শেষ হয়নি। প্রগতি ও শিক্ষার প্রসার সামাজিক ভাবে অন্তহীন সুদূরপ্রসারি কার্যক্রম।

এখনো আমাদের সমাজে শিশু ও নারীরা নির্যাতিত, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় অনিরাপদ, সাওতাল সহ সকল আদিবাসীরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাতেই বুঝা যায় রাজনৈতিক বিজয় মানে সামাজি ও সাংস্কৃতিক বিজয় নয়। আমরা এখনো চেতনাগত বন্ধ্যাত্বায় ভুগছি। এসবের মুল কারণ মূলত রাজনীতির সাথে সাংস্কৃতির দূরত্ব সৃষ্টি। রাজনীতি চর্চা ও সংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। দলগত রাজনীতি ক্ষমতা ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতাপে সংস্কৃতিগত উন্নয়ন ও মানুষিক-মানবিক  বিকাশ অগ্রসর হচ্ছে না, এ যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপর্যয়। তাই বলেই আমাদের সমাজ জীবন প্রতিনিয়ত বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। যেমন- দূর্বলের উপর সবলের আক্রমন, অথাৎ সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন, আদিবাসীদের উপর আক্রমন, ধনী-দারিদ্রের বৈষম্য, শিক্ষার নীতিহীন লক্ষ্য ইত্যাদি।

৩.

আমাদের রাজনীতি যে সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন তার অনেক প্রমান আছে। রাজনীতিবিদরা সংস্কৃতির ধার ধারেনা। তারা মনে করেন সংস্কৃতি মানে নাচ, গান ইত্যাদিকে। রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক অজ্ঞতা, সাংস্কৃতির মুলচেতনাগত চর্চার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি। রাজনীতির সাথে সংস্কৃতির দূর্বল সংযুক্তকরণ ও ক্ষমতা ও অর্থনীতির পুঁজিবাদীকরণ, আমাদের সমাজ কাঠামোতে সুদৃঢ়ভাবে ভড় করে আছে। এই জন্য সংস্কৃতি চর্চার ধারক ও বাহকরা অনেকাংশে দায়ী।  সংস্কৃতির চর্চারও একটা যোগ্যতা লাগে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে নীতিযুক্ত কোন লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দরকার সেই নেতৃত্বে দূর্বলতা রয়েছে। একান্তভাবে সমাজ পরিবর্তন, সমাজ সংস্কার, সামাজিক সচেতনার জন্য সংস্কৃতিক চর্চাবোধকে জাগ্রত করতে সংস্কৃতি কর্মী কিংবা সাংস্কৃতিক নেতৃত্বকে লক্ষ্য বস্তুর মমার্থ ও যৌক্তিক জ্ঞানবোধ খুবই জরুরী । নাটকের প্রধান হাতিয়ার পথ নাটক ও মুক্তনাটক। এই মাধ্যমটির বর্তমান সময়ে তেমন একটা চোখে পড়েনা। প্রসোনিয়াম থিয়েটারের শিল্পও তাত্ত্বিকতার চর্চায় মনোনিবেশ এখন যেন সকল নাট্য কর্মীদের ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। রসাত্বক, কৌতুক,আমোদ ও প্রমোদ সম্পর্কীত, দুর্বল গল্প সম্মৃদ্ধ মঞ্চনাকট ও টিভি নাকট নির্মান, বার্ণিজ্যিক ধারার সংস্কৃতিক চর্চা কমিটমেন্টাল সমাজবোধের নাটক এখন নাই বললেই হয়। সাধারণ মানুষও নাটক বলতে শুধুমাত্র টিভি নাটক ও ক্যামেরায় নির্মিত নাটককেই চেনে। আমি এমন লোকেরও সন্ধান পেয়েছি  যে কিনা মঞ্চ নাকট  কি তাই চিনে না। সে মনে করে নাটক মানেই আনন্দ যোগানো। ক্ষনস্থায়ী একটি পর্ব দেখলাম,হাসলাম, আনন্দ পেলাম এবং ভুলে গেলাম ইত্যাদি। এটাতো আমাদের সংস্কৃতিক কর্মীদেরই ব্যর্থতা । নাটকেরও যে বক্তব্য আছে সে বিষয়টি আমরা আমাদের দর্শকদের সামনে সঠিক ভাবে আনতে পারছিনা। ঠিক একই ভাবে গান ও নৃত্যের বেলাতেও বিষয়টি স্পষ্ট যে গন সংগীতের কিংবা লোক নৃত্যের চর্চাটা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। গানের নানাবিধ চর্চা ও গবেষণার ফলস্বরুপ রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুল সংগীতের মৃত্যু হতে চলছে। লোক সংগীতের আধুনিক ফরম গ্রাম বাংলার লোকজ কৃষ্টি থেকে গান কে অনেক দুরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সত্যিকারের মাটির গান, মাটির সুর আর এখন পাওয়া যায় না। যে কারণে এখনো কাতর হয়ে শুনি শচীন দেব বর্মনের ভাঙা ভাঙা ডঙ্গে গাওয়া পুরনো গানগুলো । যাই হোক আলোচনা করছিলাম রাজনীতির সাথে সংস্কৃতির মেলবন্ধন বিষয়ে।

রাজনীতি চর্চাটা বোধ করি সঠিক নয়। মানুষের জন্য রাজনীতি এই ধারনাটা বর্তমানে বেশির ভাগ রাজনৈতিকদের মধ্যে দেখা যায় না। রাজনীতির নীতিগুলোর সম্পর্কে ও অনেক রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদেরধারনা নেই। আমাদের সংবিধানের মুলনীতি ঃÑ

(১) ধর্ম নিরপ্রেক্ষতাবাদ (২) সমাজতন্ত্র (৩) বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও (৪) গণতন্ত্র মূলমর্ম ও সঠিক প্রয়োগিক বিষয়াবলী সম্পর্কীত সুস্পষ্টভাবে আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করছে না। আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলি অথচ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম কে বহাল রেখে। ধর্ম নিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয় কিংবা সঠিক ভাবে ধর্ম মেনে চললে ধর্মনিরপ্রেক্ষতার প্রয়োজন নেই। এই মর্মে কথাগুলো সঠিক ভাবে  জনগনকে বুঝাতে অক্ষম। সমাজতন্ত্রের কথা বললে শুধুই আমতা আমতা করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে সকল জনগোষ্ঠীকে বাঙালি হবার আহবান করেন। তারা জানেন ও না আদিবাসীরা আদি নৃগোষ্ঠীরদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ রয়েছে, রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। গণতন্ত্রের সঠিক রুপরেখা কিংবা গণতান্ত্রিকতা কি, কি এর কার্যকারিতা এই সম্পর্কেও সচেতন নয়। তা না হলে কি গণতন্ত্রের কথা বলে জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে তৃণমুল ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটত! এই অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক নীতিবর্জীত এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, রাজনৈতিক আচরনে বিভ্রান্তির বিস্তার শুভ লক্ষন নয়। এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষভুক্ত সকল রাজনৈতিক দুলগুলোর ব্যর্থতা । মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত মূল চার নীতিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধেল স্বপক্ষে শক্তি হয়েও সাধারণ জনগণের নিকট তুলে ধরতে পারছি না। যে সর্বনাশ ঘটেছিল মুক্তিযুুদ্ধের পরবর্তী সময়। বঙ্গবন্ধু নিজেই একাই কতটুকু বা তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল । হজবরল এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে না পেরে পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধ করে একক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক  শ্রমিক আওয়ামীলীগ (বাকশাল) গঠন করেছিলেন। আর সেটাই হলো বঙ্গবন্ধুর জন্য কাল। যদিও বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও উদ্দেশ্য ছিল ইতিবাচক কিন্তু সেই সময় তিনি আর পেলেন না। বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি সমাজ ও সংস্কৃতি চর্চার বেশ আশা ব্যঞ্জক স্থানে আমরা দাঁড়িয়ে থেকেও সেই যেন পুরানো জায়গায় পড়ে আছি। অথাৎ ৭১ পরবর্তী সময়ের বিভ্রান্তিরকর সময়গুলোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিনা।

উপরোক্ত হতাশার ইঙ্গিতগুলো যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে কিংবা বদ্ধমুল হয়ে না থাকে সেটাই আমাদের কামনা এবং এই জন্যই দরকার সঠিক মূল্যাবোধের সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন বাংলার গরিব মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মৃক্তির জন্য সহায়ক হয়। যে স্বপ্ন দেখিছিলেন বঙ্গবন্ধু কিন্তু সফল করে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের সচেতন বাঙালিদেরই। যার জন্য প্রয়োজন আরো সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতি সচেতনা । যা কিনা আমাদের কাঙ্খিত সমাজ পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এবং স্বাধীনতার মানও রক্ষা পাবে। 

------------------------------------------------------------------০-----------------------------------------------------------------------

সহায়ক গ্রন্থ

(১)বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি-যতীন সরকার


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।