আন্দোলন হচ্ছে, আন্দোলিত হচ্ছি না
একটি পাথরখন্ড ঢিল ছুড়ে বদ্ধপুকুরে ফেললে প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে তরঙ্গায়িত হয়ে শান্ত-স্নিগ্ধ পানি পুকুরতীরে আছড়ে পড়ে।পাথরের আঘাতে শান্ত জলের আকস্মিক আন্দোলন বা নড়াচড়া পুকুরের বাস্তুসংস্থানকেও খানিক নড়াচড়ায় বাধ্য করে।প্রকৃতির সাধারণ পাঠ বা বিজ্ঞানের কার্যকারণসূত্র যেভাবেই আমরা দেখিনা কেন এখানে পানির নড়াচড়া বা আন্দোলন;ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খেলাটা লক্ষণীয়। তরঙ্গ যদি যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলন বা আলোড়নের সঞ্চালনের ফলে শক্তি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হওয়াকে বুঝায় তাহলে আমাদের জাতীয় জীবনের দূর্গতি দেখে নিরব থাকা মানেই মূল্যবোধ,নৈতিকতার স্কেলে নিম্নমুখী সূচকেই আমাদের অবস্থান নির্দেশ করে।
আন্দোলনের আভিধানিক অর্থ আলোড়ন।নিকট অতীতে এর অর্থ ছিল কম্পিত,দোলিত,দোলায়মান ইত্যাদি।সবুজ পাতার মৃদু কম্পন,পূবালী বায়ূতে মগডালের কিশলয়ের অবিরত দোলায়মানতা কবি-সাহিত্যিকদের কল্পনাপ্রিয় মানসপটে নাড়া দিয়েছে।সবুজপত্রের কম্পমানতা্র মতো তেমনি জাতীয় রাজনীতিতে সবুজাভ আভা তৈরি হয়নি। তপ্ত রাজনীতিতে আন্দোলন শব্দের বিবির্তিত রূপ আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি। আমাদের জাতীয় জীবনে আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।আন্দোলনের ঢেউ জাতীয় জীবনে ইতোপূর্বে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসলেও বর্তমানে বদ্ধভাবটাই প্রকট।শতাব্দীর অচলাতয়নের বৃত্তাকারে ধূর্ণায়মান গাঙ্গেয় পলিমিশেল বাংলাদেশি মন। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন Third Wave of Democracy নামক তত্ব দিয়েছিলেন।থার্ড ওয়েভ অব ডেমোক্রেসী বলতে এখানে তিনি গণতন্ত্রের শেষ যে জোয়ারটি বয়ে গেছে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত,এ সময়কালকে বুঝিয়েছেন। এ সময়ে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।আবার, এ ভাটার পর্ব এখনো চলছে বলে মনে করা হয়।অনেকে আরব বসন্তকে Fourth Wave বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।বাস্তবে সেই ঢেউ বেশিদিন টিকে থাকেনি।খুব দ্রুতই স্বৈরাচারী জগদ্দল আবারো ঘাড়ে চেপে বসে (https://www.foreignaffairs.com/…/2011-05-22/fourth-wave-or-….)
তিউনিসিয়ার বুয়া আজিজির গায়ে আগুন দেয়ার মাধ্যমে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বেন আলীর মসনদ তছনছ করে মিসরে একটি আপাত সফল বিপ্লব সম্পন্ন করেছিল-তার ঘোর বেশিদিন টিকেনি।সিরিয়ার আসাদ এখনো বাহুবলে, জটিল বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণে এখনো বহাল আছে। বাংলাদেশে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে এক নূর হোসেনের রক্তদান-এরশাদের তখত ভেঙ্গে দিয়েছিল।জনজীবনে আন্দোলন ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল ডাঃ মিলনের রক্তের বিনিময়ে।১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে।বহমান সময়ে বাংলাদেশে যেন রক্তগঙ্গা।নূর হোসেন আর মিলনের মতো স্বাপ্নিক তরুণেরা মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে প্রতিনিয়ত।খাল-বিল আর নদীতে,সবুজ দূর্বাঘাসে সফেদ চামড়া ভেদিয়া রক্তজমাট লাশ-এটাই যেন আমাদের বাংলাদেশ।হিটলারের গেস্টাপ তরীকায় নিখোজ বনি আদম সন্তান-মেহেদীরাঙ্গা স্ত্রীর অনাগত নির্বাক চাহনী,মায়ের নাড়ীছেড়া ধন হারানোর গগণবিদারী সুকরুণ আর্তনাদ, অবুঝ শিশুর ঢুকরে ঢুকরে বোবাকান্নার ন্যায় বাবা-বাবা বলে চিতকারই যেন বর্তমান জাতীয় মনস্তত্ব। এ যেন রোমান সভ্যতা সম্বন্ধে এস্কিলাসের কবিতার মতো- একের পর এক ভেঙ্গে পড়া ঢেউগুলোর মতো এক আর্তনাদ,এক কান্না মৃত্যুর গুহা থেকে ভেসে আসে বিলাপ। পবিত্র নদীর জোয়ারগুলো মনোবেদনা ও দুঃখ বেদনার কাতরতা নিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। ক্রোধের অনলে দংশিত না হয়ে,বিবেক-বুদ্ধি,নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি না দিয়ে,অনাগত সুখের আলপনা আকি।মহররমের হৃদয়বিদারক কারবালা রচনা বন্ধ করি।প্রতিনিয়ত কারবালাসম যে বর্নণাসূত্রের উদ্ভব হচ্ছে তা বন্ধ করা দরকার।কারবালায় ব্যথিত হয়ে নজরুল যেমন বলেছিলেন- নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া আম্মা লাল তেরি, খুন কিয়া খুনিয়া। কবি কাহলিল জিবরানের ক’টি চরণ - ‘তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের সন্তান নয়’, তোমরা তাদের দিতে পার তোমাদের ভালবাসা, কিন্তু তোমাদের ভাবনা নয়, কেননা তাদের রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাবনা। তোমরা তাদের শরীরকে আশ্রয় দিতে পার বটে, কিন্তু আত্মাকে নয় কেননা তাদের আত্মা থাকে, আগামী দিনের ঘরে।”
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে পড়া রক্তকণিকা আমার মতো কোন এক মানুষের।আমি যে মায়ের জঠর ভেদিয়া আলোর মুখ দেখেছি- সেও তো এরকম কোন এক জননীর প্রাণ আকুল করা চক্ষুশীতল সন্তান।আমার মা আমাকে শত প্রতিকূলতার মাঝেও যে বুকে আগলে রেখেছে- কনকনে শীতের তীব্র কাঠিন্য যার কোমলতা আর সন্তানের প্রতি মমতাকে কভূ পরাজিত করতে পারেনি সেও তো ঐরকম এক মায়ের সন্তান।আমার মা যেমন আমার কষ্টে ব্যথিত হন- আমি কেন মায়ের মতো আরেকজনের জন্য ব্যথিত হইনা,বুক কেন ফেটে চৌচির হয়না মানবিক আর ভ্রাতৃসুলভ নিখাদ ভালোবাসায়।জার্মান দার্শনিক মার্টিন নেমলারের সেই বিখ্যাত উক্তি-“যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিলো, আমি কোন কথা বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই। তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই। তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনও চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই। আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই। শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে, আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।" তাই আসুন, আন্দোলিত হই।অন্তত মানবিকতার জন্য।রোম যখন পুড়ছে নিরো তখন মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছিল।কিন্তু সেই বাঁশির সুর পরে সুখদায়ক হয়নি।শহরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায়না তেমনি মনের নিভৃত গুহায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন তৈরি না হলে কালক্রমে তা আমাকেই আঘাত করতে পারে।