লেনিন নাই, কিন্তু আছেন!

লেনিন নাই। তাই কি? লেনিন আসলে কিন্তু আছেন। কারন কোন অগ্রসর চিন্তাকেই তার পূর্ণ বাস্তবায়নের আগে দাফন করা যায় না। তাই অক্টোবর বিপ্লবের একশ বছর উপলক্ষে আপনাদের লেনিন পড়তে উৎসাহিত করছি।

ধরুন, লেনিনের 'গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির দুই রণকৌশল' বইতে কী আছে যা আপনার জানা দরকার? যার জন্য রুশ বিপ্লবের একশ বছর পর এই প্রায় ভুলে যাওয়া বইটি পড়তে আপনাদের ফুসলাচ্ছি?

কী আছে বলবেন না, বরং বলুন কী নাই? একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে 'বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান' সফল করবার জন্য যে নীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত থাকা দরকার তার সারকথাগুলো আপনি এই ছোট বইতে পাবেন। সংক্ষেপে, ছাক্কা জিনিস হিসাবে।

একই ভাবে মুখে বিপ্লবী বুলি, কিন্তু রণকৌশলে গণতন্ত্র বিরোধীদের মিত্র – এমন রাজনীতিকে কিভাবে সমালোচনা করে জনগণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হয় এই পুস্তিকাটি তার দুর্দান্ত উদাহরণ। বাজে বই পড়ে আয়ু ও সময়ের অপচয় করবেন না। বিশেষত যারা রাজনীতি করেন, তারা এমন বই পড়বেন না, যা আপনার কাজে লাগে না। এ ধরনের বই পড়লে লক্ষ লক্ষ বেদরকারি রাজনীতির বই পড়ার হাত থেকে আপনি বেঁচে যাবেন।

জ্ঞান বই পড়লে বাড়ে না, একমাত্র সেই লেখা পড়লেই জ্ঞান হয় যে বইয়ে ইতিহাস ও প্রজ্ঞা যুগপৎ দুটোই থাকে। বইটি একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে তত্ত্ব। হাতে নিলে জীবন্ত মনে হয়।

গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার ক্ষেত্রে লেনিনের নীতি ও কৌশল নিয়ে তর্ক সামান্যই, আর তর্ক করবেনই বা কি নিয়ে, কারন লেনিনের নীতি ও কৌশল সফল হয়েছিল, লেনিন ও তার দল ক্ষমতায় গিয়েছিল। এটাই ইতিহাসের বাস্তব সত্য। মূল তর্ক লেনিন কি আসলেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ শেষ না করেই সমাজতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে ভুল পথে গিয়েছিলেন? ছহি তর্ক। সেটা করুন।

‘সোশ্যাল ডেমোক্রাসি'? রাশিয়ায় মার্কসপন্থি কমিউনিস্টরা শুরুতে নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচয় দিতেন না। তাদের পার্টির নাম ছিল, ‘রুশ সোশ্যাল ডেমক্রটিক লেবার পার্টি’। কারন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা গণতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন, যা একই সঙ্গে দ্রুত কিছু অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাবে, যেন তাড়াতাড়ি সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায়।

তাঁরা চেয়েছিলেন সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রোগ্রামের ভাষায়, “…সম্ভাব্য পরিপূর্ণ মাত্রার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, এবং ফলশ্রুতি স্বরূপ, স্বৈরতান্ত্রিক রূপের সরকারের বদলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (democratic republic) কায়েম”। কেউ কেউ ডেমোক্রাটিক রিপাবলিককে জনগণতন্ত্র বলেন। তাতে অসুবিধা নাই।

গণতন্ত্র তো বুর্জোয়াদের ব্যাপার। কিন্তু কেন সর্বহারা শ্রেণির গণতন্ত্র দরকার লেনিন তাঁর বইতে সেটাই ব্যাখ্য করেছেন। দরকার, কারণ গণতন্ত্রে শ্রমিকের ‘প্রত্যক্ষ স্বার্থ’ আছে।

গণতন্ত্রে শ্রমিকের কী ‘প্রত্যক্ষ স্বার্থ’ থাকতে পারে!!! খুবই আজিব ব্যাপার!

শ্রমিকের তো নাকি দরকার অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান? তাই না? ভেবে দেখুন, তাহলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। কেন শ্রমিক, কৃষক সর্বহারার গণতন্ত্র দরকার? যার কিছুই নাই তারও ‘প্রত্যক্ষ স্বার্থ’ গণতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। লেনিনের চেয়ে বড় গণতন্ত্রী খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

দ্বিতীয় তর্ক্ হচ্ছে কিভাবে গণতন্ত্র কায়েম সম্ভব? লেনিন এবং তার পার্টি দাবি করেছিল, “সেটা সম্ভব একমাত্র বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের ফলশ্রুতিতে"। সেই ফল শ্রুতি কি? সেটা হোল একটি ‘সাময়িক বিপ্লবী সরকার’ -- কোন সহায়ক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার না।

কেন সাময়িক বিপ্লবী সরকার দরকার? কারণ স্বৈররতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের রূপান্তরের জন্য এটা খুবই আবশ্যিক, খুবই জরুরী। সাময়িক বিপ্লবী সরকারের কাজ কি হবে? সর্বজনীন, সম ভোটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও গোপন ব্যালটের মাধ্যমে একটি গণ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। গণ পরিষদের কাজ কি হবে? প্রধান ও একমাত্র কাজ স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান ফেলে দিয়ে তার পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন।

কিন্তু লেনিন ও তার সমর্থকরা এটাও বলছিলেন, গণতান্ত্রিক বিপ্লব “বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্য দুর্বল করবে না, বরং সবলই করবে’!!!

আরে!!! এ কেমন কথা!!!

লেনিন কমিউনিস্ট, অথচ এমন এক বিপ্লব করতে চান যেখানে গরিব মেহনতি সর্বহারা নয়, সবল হবে ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণি!! এটা কি মিলল? কিন্তু এই হুঁশিয়ারিও রয়েছে যে বুর্জোয়া শ্রেণি সুযোগ পেলেই বিপ্লবের সাফল্য জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে। তাহলে সেই অবস্থা থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই। সেটা কি হবে??? কী হবে সেই প্রতিরক্ষা?

আসুন আমরা তাহলে নিজেরাই পড়ে দেখি, এবং সেই সময়ের ইতিহাস একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমাদের মাথা বিস্তর আজে বাজে প্রপাগাণ্ডা আর কমিউনিজম সম্পর্কে ভুলভাল ধারণায় আচ্ছন্ন।

আসুন আবর্জনা সাফ করি, যাতে ‘কমিউনিজম’ নামে যা কিছু আছে সবকিছুরই আমরা পর্যালোচনা করতে পারি।

মনে রাখবেন লেনিন নাই, কিন্তু লেনিন আছেন, কারন কোন অগ্রসর চিন্তাকেই তার পূর্ণ বাস্তবায়নের আগে দাফন করা যায় না।


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।