কওমি মাদ্রাসার বিপ্লবী চেহারা কোথায়?

বেশ কিছুদিন যাবত একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে । শুধু আমিই না, আমার মত তরুণ নাগরিক এবং কওমি মাদ্রাসা-পড়ুয়া যে কোন তরুণের সামনে এখন কিছু বিষয়-আশয় ভেবে দেখার সময় এসে গেছে। বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাধারা হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা। এই ধারার শিক্ষার শেকড় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ। ১৮৬৮ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি, সংগ্রাম ও আন্দোলনের ভেতর দিয়েই উপমহাদেশের প্রধান ইসলাম-ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা। এ মহান প্রতিষ্ঠানটি তার জন্মলগ্ন থেকে বরাবরই সাম্রাজ্যবাদী, জালেম ও কুফরি অপশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ নির্যাতিত-নিপীড়িত গণমানুষের পক্ষে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত সেই দেওবন্দি শিক্ষারই ধারাবাহিকতা। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ৯/১১কে কেন্দ্র করে জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র আওতায় বাংলাদেশকে ফেলে এবং বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-প্রাণবৈচিত্র প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করতে পরাশক্তিগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে। অথচ এ ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন মহল উদ্বিগ্ন হলেও কওমি মাদ্রাসা বা আলেম সমাজের তেমন মাথাব্যথা নেই। মাদ্রাসাগুলোর পক্ষ থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ-স্বরূপ দেশের স্বার্থে কোন সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বা বিবৃতি আমাদের চোখে পড়ে নি। ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামুদ্রিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই আধিপত্যবাদী, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ও লোভী ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই এ অঞ্চলের উপর সুকৌশলে দখল কায়েম করতে সদাতৎপর। এবং ভারতের সংগে বাংলাদেশের জনগণের একটা বায়বীয় বা নীরব যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আ.লীগ সরকার শুরু থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আপোষহীন। ক্ষমতাসীন সরকারের মত এদেশের কওমি মাদ্রাসা ও আলেম সমাজ এখনো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব আলেম সমাজও ভারতের সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির পক্ষে একমত? জন্মভূমি, ইসলাম এবং অধিকারহারা মানুষের জন্যে তারা কিছুই করবেন না? তারা তাদের লেখাপড়া ও কার্যক্রম মাদ্রাসার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন? ক্রসফায়ায়ের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী র‌্যাব-পুলিশ যখন বেছে বেছে একের পর এক রাজনৈতিক কর্মীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে চলেছে তখনও আলেমগণ চুপচাপ থাকছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ একটি রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন দেখা যাচ্ছে দেওবন্দপন্থী আলেমগণ রাজনীতির ব্যাপারে নিস্পৃহ। আসলে গোলকায়নের (গ্লোবালাইজেশন) এই যুগে মাদ্রাসাগুলোর বহুমাত্রিক চিন্তার দৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চার দশকের মাথায় এসেও দেখা যাচেছ কওমি মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যপুস্তকে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় যেমন অনুপস্থিত, তেমনিভাবে মাতৃভাষা বাংলার প্রতিও রয়েছে কিছুটা অবহেলা। তবে ইদানীং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের আওতায় নিচের শ্রেণীগুলোতে বাংলা পাঠ্যপুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চিন্তার সীমিত অবয়ব থেকে বেরিয়ে আমরা যদি দ্রুত অগ্রসর হতে না পারি তাহলে ‘পশ্চাদপদ’ তকমা পাকাপোক্তভাবে স্থায়ী হয়ে যাবে আমাদের গায়ে। কিছুদিন আগে সরকার ‘কওমি মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র’ বলে ঘোষণা দিয়ে জঙ্গি ধরার অভিযানে নেমেছিল। তখন মাদ্রাসাগুলো থেকে সম্মিলিত আওয়াজ উঠল না, না আমরা জঙ্গি না। আমরা জঙ্গিবাদ সমর্থন করি না। ইসলাম নিরীহ মানুষহত্যা সমর্থন করে না। আমরাও আপনাদের মত জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে চাই। ইসলাম শান্তির ধর্ম.....। আমরা একটু ভেতরে খতিয়ে দেখলে দেখতে পাব পিঠ বাচানোর জন্য কওমি মাদ্রাসার দেয়া বক্তব্য আর দুনিয়াব্যাপী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের দুশমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের যে ব্যাখ্যা দেয়, তা হুবহু একই রকম। যারা ইসলামের এ ধরনের শান্তিবাদী ব্যাখ্যা দেয় তাদের ব্যাখ্যা ভুল। তারা খুবই কৌশলে ইসলামের বিপ্লবী, সংগ্রামী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেহারা পর্দার আবরণে ঢেকে ফেলতে চায়। ইসলাম কখনোই ‘শান্তি’র ধর্ম ছিল না। ইসলাম সবসময়ই ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’র ধর্ম। এবং সময়ানুগ ও প্রগতিশীল। ইসলাম নিছকই মাদ্রাসা-মসজিদে চর্চিত ধর্ম নয়। বাংলাদেশে যা আমরা দেখছি। বরং নাগরিকের অর্থজীবন, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সামাজিকতা সবই ইসলামের মধ্যে রয়েছে। ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস পাঠ করলে আমরা একথা জানতে পারি। কিন্তু দু:খের কথা এই যে, ইসলামপন্থিগণ বা আলেমউলামা এ ব্যাপারটা জনগণকে বোঝাতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছেন। এই লেখা যখন লিখছি তখন সরকার ধর্মহীন শিক্ষার নীতিমালা গোটা দেশে বাস্তবায়ন করতে যাচেছ। ভাবতে অবাক লাগে, সরকারের এ সিদ্ধান্তে ধর্মপ্রাণ জনগণকে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেলেও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেদেরকে আমার কাছে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে না । এখন পর্যন্ত দেখা গেল না কোন মাদ্রাসার ছাত্রশিক্ষক ধর্মহীন শিক্ষানীতি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। অথবা এবিষয়ে আলেমদের প্রতিনিধিদল সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। কিছুদিন আগে আমি আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোয় এখন যে 'ইসলাম' আছে বর্তমান তা পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের আজ্ঞাবহ। হোক জেনে অথবা না-জেনে। তারা ভ্যাবাচ্যাকা চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের চোখ দেখেই বুঝলাম ভেতরে ভেতরে সবাই ধাক্কা খেয়েছে। আমি বন্ধুদের বললাম, গোটা দেশের মানুষ যদি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যায়, একেকজন মহান আল্লামা বনে যায়, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী যায় আসে? সৌদি আরব বা আরব রাষ্ট্রগুলোর মানুষ তো চেহারা-সুরতে, পোশাকে-লেবাসে হয়ত বা মনে-দিলে বাংলাদেশের মানুষের চেয়েও অধিক ধার্মিক। ধর্মচর্চাও সেখানে আমাদের দেশের চেয়ে বেশি হয়। কই, তাদের নিয়ে তো বারাক হোসেন ওবামার দেশের মাথাব্যথা নেই। যতসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র আমাদের এই পুচকে মাতৃভূমি ঘিরে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তখনই যখন এদেশের জনগণ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, লুটতরাজ ও আগ্রাসী সামরিক অবস্থানের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে। আমরা মাদ্রাসায়-মসজিদে ধর্ম চর্চা ও পালন করব, টুপি মাথায় পাঞ্জাবি গায়ে ঘুরে বেড়াব আর চোখ বুজে, দেখেও না-দেখার ভান করে তেল-গ্যাস-জীববৈচিত্র এমন কি শ্রমলুণ্ঠন এবং বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলোর দেশের টাকা বিদেশে পাচার দেখে যাব। আমরা ধার্মিক-নাস্তিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল-প্রগতিশীল সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকব আর পশ্চিমা পরাশক্তি আমাদের বেকুবি দেখে আনন্দে বগল বাজাবে। এ ইসলামই এখন আমাদের দেশে চর্চা হচ্ছে। চলুক এভাবে পরাশক্তির তাবেদারগিরি করে। এই মুহূর্তে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটছে। পুলিশ সন্দেজনকভাবে যাকে তাকে গ্রেফতার করে হাজতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সন্দেহের ডানায় ভর করে মিনহাজ রশিদ নামের এ নারীকে চার মাসের শিশুসহ রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, মাস চারেক আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনই নারী সেদেশে একজন নারীকে শুধুমাত্রা সন্দেহের ভিত্তিতে রিমান্ডে নেয়াটা দেশের প্রতিটি নাগরিককে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের মানবিকতা বোধ বলে কিছু আছে কি না সেটাই এখন ভাববার বিষয়। যারা এদেশে ইসলাম কায়েম করতে চান সেই আলেম সমাজও এতোটা নির্বিকার কেন। এক নির্যাতিত নারীর করুণ হাহাকার শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিম সুদূর আরব থেকে সিন্ধুতে এসে অভিযান চালিয়েছিলেন। জালেম বাদশাকে পরাজিত করে সেই নারীকে উদ্ধার করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নিয়ে যারা গর্ব করেন সেই আলেমদের আজ এই দুরবস্থা কেন? তাদের ধমনীতে রক্তের তেজ ঠান্ডা হয়ে গেছে। কওমি মাদ্রাসার তরুণদের বলছি, আপনারা চিন্তা করুন, ভাবতে শিখুন, আর চুপ করে থাকবেন না। সভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শ্যেনদৃষ্টি এখন ইসলামপ্রধান দেশগুলোর ওপর। ফিলিস্তিন-ইরাক-আফগানিস্তান-পাকিস্তান এই ধারাবাহিকতায় এখন তাদের টার্গেট হলো বাংলাদেশ। সম্প্রতি হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম তাদের পছন্দ না হওয়া কোনো যৌক্তিক অভিযোগ ছাড়াই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ হিযবুত তাহরীর বহির্শক্তির পরিকল্পনার কথা জনগণের সামনে ফাঁস করে দিয়েছিল। এটাও আপনাদের ভেবে দেখতে হবে। আপনার জনগণকে বোঝান, তাদেরকে এক কাতারে দাঁড় করবার আপ্রাণ চেষ্টা করুন, আপনার এখন যে অবস্থায় আছেন এভাবে কোনো মতাদর্শ কিংবা গোষ্ঠী টিকে থাকতে পারেনা, বিশেষত গোলকায়নের এই যুগে। পায়ের তলার মাটি অবিচল ও স্থায়ী রাখতে চাইলে সময়ানুগ রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রহণ করুন।


নিজের সম্পর্কে লেখক

madrasha student



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।