'বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন ৪
অবশেষে ভারতে নির্বাচনের ফলাফল বেরুতে শুরু করেছে। বিজেপি জিতেছে। মোদী ক্ষমতায় রইলেন। যারা আমার লেখা অনুসরণ করেছেন তাদের কাছে এটা অবাক হবার মতো কোন খবর না। মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের ৪২টি আসনে জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখা যাচ্ছে ২৩টির মতো আসনে তিনি জিততে যাচ্ছেন । বোঝ যাচ্ছে মুসলমান ভোটের সংখ্যার নিজের ঝুলিতে ভরাবার জন্য মুসলমান তোষণের ফল শেষাবধি ভাল হয় নি। ভাল হয় নি কারো সঙ্গে জোট না করবার অহংকারও। তাঁর হার হোল। বামদের হেরে যাওয়া নিয়ে যতো না আক্ষেপ, তার চেয়ে তৃণমূলকে ঠেকাতে বামদের বিজেপি সমর্থন প্রবল নিন্দার কারণ হয়েছে। ‘রামবাম’ নামে বাংলা ভাষায় একটি নতুন বাগধারার সংযোজন ঘটেছে। ভালই।
নির্বাচনে সংখ্যার রাজনীতি নিয়ে যে কথা বলছি যদি সেটা আমরা মনে রাখি, তাহলে নির্বাচনবাদী পার্লামেন্টারি রাজনীতির পর্যালোচনা বাদ দিয়ে, শুধু মতাদর্শিক মানদণ্ড দ্বারা বামের সমালোচনা আসলে অর্থহীন। বাম ভেবেছে ভোট দিয়ে মমতাকে সরানোই এখন মহান বিপ্লবী কাজ। এটা সংখ্যার রাজনীতি, মতাদর্শিক লড়াই না। ভোটের জন্য তোষণ কিম্বা ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে থাকবেই। তাই নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে পশ্চিম বাংলা কিম্বা ভারতের বাস্তবতা বোঝা যাবে না। তারপরও বামের এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে আমি সাহসের সঙ্গে বলি, ‘বাম’ শেষ হয়ে যাচ্ছে বা যাবে, আমি তা মনে করি না। কোন্ অর্থে? ভারতে জাতপাত, শ্রেণি, সাম্প্রদায়িকতা, নারীর প্রতি হিংসা এখনও গেঁড়ে বসে আছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই কি থামবে? অসম্ভব, এটা ফালতু কথা। ভিন্ন রূপে বা মোড়কে তা চলবে। এই অর্থেই বলা, সিপিএম আবার ভোটাভুটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে সেটা আশা করে বলা নয়।
তবে যে আবর্জনা শেষ হয়ে যাবে, যাচ্ছে এবং যেতে বাধ্য, সেটা হোল নির্বিচার জাতিবাদী এবং নির্বাচন সর্বস্ব বাম ধারা। বলা হোত, জাতীয় বুর্জোয়ার কাজ নিপীড়িত জাতি সত্তার গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রতিবন্ধক প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক প্রাচীন সম্পর্ক বিনাশ। আসল কাজ বাদ দিয়ে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে বামকুল যত্র তত্র খালি ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে। তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ধর্ম ভিত্তিক জাতিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা এবং প্রতিশোধ নেওয়া। এই শাস্তি বরাদ্দ ছিল।
মতাদর্শিক জায়গা থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জন্ম থেকে আগাগোড়াই ছিল মূলত হিন্দুত্ববাদ। এটা নতুন কোন খবর বা তত্ত্ব নয়। অনেকেই এ কথা আগে বলেছেন। পার্থক্য হচ্ছে আগে জাতীয়তাবাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদ আড়াল করা হোত। এখন হিন্দুত্ববাদীরা প্রমাণ করলেন জোব্বা পরে আড়াল আবডালের কোন দরকার নাই। ভারত হিন্দুদের দেশ, অতএব হিন্দত্ববাদই ছহি রাজনৈতিক আদর্শ। ভারতকে এম্পপায়ার বানাবার সুপ্ত হিন্দু বাসনা জাগিয়ে তোলাই এখনকার কাজ। অথচ এই কাজ করতে গিয়ে যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও হিংসা তৈরি হোল তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। ভারত নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারছে।
হিন্দু জাতিবাদের জন্ম পাকিস্তানিদের মতো একই দ্বিজাতিতত্ত্বে, আধুনিক জাতীয়তাবাদের গর্ভে। জাতিবাদের জন্য বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায় একটা স্বপ্ন বা কল্পিত জনগোষ্ঠির (Imagined Community) কেচ্ছা লাগে। যেন জাতপাত, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আড়াল, অস্পষ্ট বা তার নিরাকরণ ঘটিয়ে দাবি করা যায় আমরা সকলেই 'হিন্দু'। জাতিবাদী মুসলমানের দাবিও একই, আমরা সবাই 'মুসলমান'। যেন মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের গোত্র, গোষ্ঠি, ভূগোল, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতপাত, শ্রেণী ও লিঙ্গ ভেদ নাই। সবাই মুসলমান। বিশেষত যেন আরবের ইতিহাসই সকল মুসলমানের ইতিহাস, স্থানীয় কোন ইতিহাস নাই, ভূগোল নাই, শেকড় নাই।
খেয়াল করুন, যখন দাবি করা হয় ’আমরা সবাই বাঙালি’, তখনও বাঙালি জাতিবাদ সেই একই গীতই গায়। বাঙালি জাতিবাদও বাঙালির মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অপরাপর আর্থসামাজিক ও লিঙ্গভেদের নিরাকরণ ঘটিয়ে একটি হোমজিনিয়াস জাতিগোষ্ঠির কাহিনী বানায়। জাতিবাদের এটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত বাণিজ্য ও পুঁজির বিকাশ এবং বিস্তার, তদুপরি সবার বোধগম্য একটি প্রচলিত বা প্রমিত ভাষা গড়ে ওঠা বা বানাতে পারা এবং তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। আধুনিক ছাপাখানা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
হিন্দুত্ববাদের‘কল্পিত কাহিনী’ হচ্ছে, (ক) ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী মানচিত্র তৈরির আগে থেকে, এমনকি মুঘলদের ‘হিন্দুস্তান’ কায়েমেরও আগে থেকেই ‘ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামক চিরায়ত ভূগোল বা সত্য বিরাজিত ছিল এবং চিরকাল থাকবে,; (খ) ভারত হচ্ছে তপস্বী ও ঋষিদের দেশ, সর্বত্র ছিল তপোবন এবং সাধুসন্যাসী ও রাজর্ষিদের কারবার (গ) কিন্তু সব কিছু নষ্ট হবার মূলে হচ্ছে মুসলমান আক্রমণ ও ইসলাম। মুসলমানদের পরাধীনতা ৫০০ বছর হিন্দুকে সহ্য করতে হয়েছে (ঘ) আর্য হামলা ও দখল কিম্বা ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন কোন সমস্যা নয়, হিন্দু আত্মপরিচয় ও জাগরণের প্রধান বাধা বা দুষমণ হচ্ছে মুসলমান ও ইসলাম। অতএব মুঘল ও ইংরেজ শাসন মিলিয়ে সাতশ বছর পরাধীন থাকা হিন্দুর জাগরণ তো ন্যায্য এবং স্বাভাবিক (গিরিলাল জৈন পড়ুন)। সিন্ধু নদীর এপাশে বাস করা জনগণের মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপন, খাদ্যাভাস, চাষাবাদ, লোকগল্প বা পুরাণ ইত্যাদির পার্থক্য বিশাল। হিন্দু জাতিবাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সেইসব পার্থক্য চেপে রেখে সুনির্দিষ্ট ভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপরীতে ‘হিন্দু’ নামক ধারণার সংজ্ঞায়ন। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নাই। কারন হিন্দু কোন ধর্ম না এবং হিন্দু কোন জাতিও না। সিন্ধু নদীর উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে ‘হিন্দু’ শব্দের উদ্ভব, যার মানে সিন্ধু নদীর এপাশে যারা বাস করে তাদের নাম। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজ যখন লোকগণনা করছিল, তখন তারা ‘মোহামেডান’ চিনত, কিন্তু ‘হিন্দু’ কী এটা জানত না। তাই ‘মোহামেডান’ ছাড়া বাকি সবাইকে তাদের পরিসংখ্যানে ‘হিন্দু’ আখ্যা দিল।
অতএব জাতিবাদী হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদ তার ঐতিহাসিক গড়ন ও চরিত্রের কারণেই মুসলমান বা ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি করতে বাধ্য, কারণ এ ছাড়া তার নিজের সত্য প্রতিষ্ঠার আর কোন ভিত্তি নাই। হিন্দুত্ববাদের ‘হিন্দু’ একান্তই মুসলমানের বিপরীতে তৈরি একটি ধারণা মাত্র, তার অধিক কিছু নয়। আর সত্যকারের হিন্দু হচ্ছে সিন্ধু নদীর এপাশে বাস করা বিভিন্ন ও বিচিত্র ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, জাতি ইত্যাদি বিপুল বৈচিত্র নিয়ে হাজির বিশাল এক জনগোষ্ঠি, এই সেই হিন্দুস্তান যেখানে মুসলমান তার ধর্মসহ অন্তর্ভূক্ত। মুঘল, পাঠান, ইরানি, তুরানি হিন্দুস্তানে এসে 'হিন্দুভূত' হয়েছে। মুসলমান অন্য দেশের অধীনে এই ভূগোল বা ভূখণ্ডকে পরাধীন করতে আসে নি, বরং এই দেশে বাস করতে এসেছে। তাই ‘হিন্দুস্তান’-এর জন্ম হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারত থেকে ইসলাম আরবে পারস্যে বা তুর্কিদের দেশে যাবার জন্য আসে নি। থাকবার জন্যই তার আসা।
এই হিন্দুত্ববাদ কি টিকবে? টিকবে যদি এর পাল্টা জবাব হয় মুসলমানদের জাতিবাদ বা ইসলামি জাতিবাদ। জাতিবাদী মুসলমানের ঝাণ্ডা উর্ধে তোলার অর্থ হিন্দু জাতিবাদের ন্যায্যতা প্রমাণ করা। যদি পালটা জবাব হয় সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবাদ, শ্রেণী ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, জাত, শ্রেণি, লিঙ্গ সহ, সকল মজলুমের সঙ্গে একাত্মতা, সংহতি ও ঐক্যের চর্চা, তাহলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ উপমহাদেশে টিকে থাকার যুক্তি খুঁজে পাবে না।
এই ঐক্য গড়ে উঠলেই হিন্দু জাতিবাদ ‘মুসলমান’কে খড়ের সৈনিক খাড়া করে তলোয়ার ও ত্রিশূল ঘুরাতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই পথ দেখাতে হবে।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।