'বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন ৩

আগের আলোচনায় দেখিয়েছি সংখ্যাভীতি পশ্চিম বাংলায় নতুন কিছু না, হিন্দুত্ববাদি রাজনীতি সবসময়ই সংখ্যাভীতিকে কাজে লাগিয়েছে। আসলে শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, এটা সর্ব ভারতীয় বাস্তবতা। সম্প্রতি কালে দুই হাজার এগারো সালের লোকগণনার ফল বেরুনোর পর থেকেই সংখ্যাভীতি সর্ব ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই হাজার এগারোর লোকগণনার তথ্য জানিয়ে সে সময় একটি বিবৃতি দেয়, তাতে বলা হয়, “পুরা জনসংখ্যার বিচারে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ০.৭ পয়েন্ট কমেছে। আর মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে শতকরা ০.৮ পয়েন্ট’। লোকগণনার তথ্য হিন্দুত্ববাদিদের হাতে ভাল অস্ত্র হয়েছে। যারা সংখ্যা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন তাদের জন্য নীচে একটি পরিসংখ্যান গ্রাফ টুকে দিচ্ছি। ভাবতে থাকুন।

সংখ্যাভীতি সমাজ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তর্ককে আড়াল করে এবং সমস্যাসংকুল করে ফেলে। সংখ্যাভীতি আদর্শিক তর্ক নয়, ভয় বা আতংককে নীতি নৈতিকতার বিধান দিয়ে প্রশমন করা যায় কিনা সন্দেহ। পরস্পরকে জানা বোঝার অভাব, অজানাকে ভয়, নিরাপত্তাবোধের অভাব, ক্ষমতার ক্ষয় বা লোপের আশংকা, ইত্যাদি নানান কিছু থেকে এই ভীতির জন্ম। ফলে সমাধান অন্যত্র। হিন্দু কেন মুসলমানকে নিরাপদ গণ্য করে না, কিম্বা মুসলমান হিন্দুকে? একে কি ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? এটা একটা মানসিক, সাংস্কৃতিক এবং সমাজে কিভাবে আমরা বর্তমান থাকি সেই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত। একই ভাবে আমাদের এই থাকা ধর্ম সম্পর্কে ধারণা এবং ধর্মজাত কর্মকাণ্ডকেও নিয়ন্ত্রণ করে। নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার দ্বারা সবকিছুর মীমাংসা করা যায় না। হয়তো আমাদের মতো দেশে ভক্তি আন্দোলনের আবির্ভাব ও চর্চা এই অমীমাংসার উপলব্ধি থেকে গড়ে উঠেছে। নতুন রাজনৈতিক চর্চার জন্য নিজের দিকে নিষ্ঠার সঙ্গে মুখ ফেরানো জরুরি। গভীর ভাবে ভেবে দেখার বিষয়। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজকে যখন নিরন্তর ভাঙ্গতে থাকে, তখন এর সমাধানও যখন ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।

ভারত কি আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র?—এই প্রশ্ন তুলেও লাভ নাই। ভারতীয় চিন্তক আশীষ নন্দীকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন আমি তো দীর্ঘদিন ধরেই ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সন্দেহ করি, গুজরাটের দাঙ্গার পর খুবই পরিষ্কার ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যর্থ। কিন্তু একথা বলে কি সমস্যার সমাধান হয়? হয় না। আম্বেদকারসহ ভারতের সংবিধান প্রণেতারা সংবিধানে স্পষ্ট করে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা দরকার মনে করেন নি। তাঁরা ভেবেছিলেন সংবিধানের বলবৎযোগ্য অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত হয়েই আছে, তাকে লিখিত করে রাখা অর্থহীন। ইন্দিরা গান্ধী সেটা ঢুকিয়েছেন জরুরি অবস্থা জারির পরে ১৯৭৬ সালে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টের একটি বক্তৃতায় দাবি করেছেন, আম্বেদকার এটা করেছে কারণ তিনি জানতেন হিন্দু ধর্ম আসলে সেকুলার, ফলে আলাদা করে সেকুলারিজমের কথা সংবিধানে লিখবার তিনি কোন প্রয়োজন বোধ করেন নি।

সেকুলারিজম নিয়ে ভারতের সাংবিধানিক তর্ক অমীমাংসিত। একসময় যা মীমাংসিত মনে হয়েছিল, বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে সেটা আদৌ কোন সমাধান ছিল না।

(গ্রাফঃ livemint.com)

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।