'বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন ২
তৃণমূল, কিন্তু বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রধান অভিযোগ হচ্ছে তিনি মুসলিম তোষণ করেছেন, এরই প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম বাংলায় বিজেপির উত্থানের শর্ত তৈরি হয়েছে। এই অভিযোগ সিপিএমের বিরুদ্ধেও আমরা আগে শুনেছি। এমনকি কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও। বিজেপির উত্থানের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মুসলমান আতংক,সেটা হোল মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাবার ভীতি। এই ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির কোন হাত আছে কিনা জানি না, কিন্তু অনেকের মন্তব্য ও লেখালিখি পড়ে মনে হয় মুসলমান পরিবারে সন্তান জন্ম নেবার অপরাধও যেন মমতা ব্যানার্জির! কারণ তাদের অভিযোগ তৃণমূল আমলে মুসলমান সংখ্যার ভীতি হিন্দু ভোটারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, তাই তারা বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে।
তাহলে মুসলমান তোষণের গল্পে পরে আসি। এখন সংখ্যাভীতি। কারন মুসলমান জনসংখ্যার তর্ক এবং সংখ্যাভীতি এখনকার নয়, পুরানা। পুরানা কেচ্ছা একটু বলি।
আরে, উচ্চবর্ণ ও অভিজাত হিন্দু তো বাংলা ভাগ করলো মুসলমান জনসংখ্যার ভয়ে।উনিশ শো পাঁচ সালে প্রশাসনিক কাজ সহজ করবার যুক্তি দিয়ে কার্জন বাংলা ভাগ করেছিলেন। উচ্চ বর্ণ এবং অভিজাত হিন্দু তার ঘোর প্রতিবাদ জানালেন।ভাল। ঐ সময়েই বঙ্গে অখণ্ড ভারতের কল্পনা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রোপিত হোল:ভারত ভাগ করা যাবে না, অখণ্ড রাখতে হবে। বাংলা ভাগের মধ্যে বাঙালি হিন্দুর মনে ভারত ভাগের ভীতি তৈরি হয়েছিল। কারন ততোদিনে বঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী ধারা তৈরি হয়েছে, যার গোড়ায় রয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২),অরবিন্দ ঘোষ ১৮৭২ - ১৯৫০) প্রমুখের রচনার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভূরি ভূরি মজুদ রয়েছে। মুসলমান দেখেছে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণি কিভাবে ‘বাঙালি’ ধারণার পরিগঠন থেকে বাঙলা প্রদেশের অর্ধেক বাঙালি জনসংখ্যাকেই নির্বিচারে বাদ দিচ্ছে। মুখে যাই বলুক, বাঙালি মুসলমান আজ অবধি হিন্দুর চোখে ‘বাঙালি’ না। মুসলমান।
সেই সময় পশ্চিমবাংলা ছিল হিন্দু প্রধান ভূগোল, মুসলমানরা সেখানে সংখ্যালঘু, অন্যদিকে পূর্ববাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশি, অখণ্ড বাংলায় মুসলমান কিন্তু সংখ্যালঘু ছিল না, বরং সামান্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল। কিন্তু শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অগ্রগামী ও আধিপত্য ছিল বর্ণ হিন্দু এবং আর্থসামাজিক দিক থেকে পূর্ব বাংলার জমিদারি মহাজনি টাকায় গড়ে ওঠা কলকাতার অভিজাত বাবু মহল বা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হিন্দু শ্রেণির। পূর্ববাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল, কারণ তাদের উপলব্ধি ছিল ভিন্ন, তারা আশা করেছিল, ক্ষতাবান হিন্দু যখন তাকে বাঙালি বলেই মানে না, বাংলা ভাগ হলে তারা তাদের নিজস্ব একটি প্রদেশ পাবে। প্রশাসনিক স্বাধীনতা পাওয়া, নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের সুপ্ত তাগিদ থেকে জাত। পরে পাকিস্তান যখন প্রাদেশীক স্বায়ত্ব শাসন মানল না, উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইল, বাঙালি অস্ত্র ধরতে দ্বিধা করে নি। স্বাধীনতার বাসনা হঠাৎ একদিন হুজুগে তৈরি হয় নি।
সংখ্যার তর্ক, দেখা যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন কোন তর্ক না। একই সঙ্গে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়, জাতিবাদ ইত্যাদি তর্কের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অতএব সংখ্যার তর্ককে ইতিহাস থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে তোলা পদ্ধতি হিশাবে ভুল। সংখ্যার হিশাব নিকাশ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রাজনীতির জন্য নির্ধারক ধারণাগুলোর পরিগঠন থেকে আলাদা নয়। সেই ধারণাগুলো তৈরি হয় ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে, বয়ান তৈরির ভাঙা গড়ার মধ্যে। জাতি, জাতিরাষ্ট্র ইত্যাদির ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে বয়ানের ভূমিকা নির্ধারক। অতএব হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা নিয়ে তর্ককে আমরা জাতিবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ থেকে একদমই আলাদা করতে পারি না। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেই সম্ভাব্য রাষ্ট্রের ভ্রূণ তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডলে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল বিভেদের পাটাতনে দাঁড়িয়ে, ঐক্যের না।
উচ্চবর্ণ এবং অভিজাত হিন্দুগণ ‘বাঙালি’ নামে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত করবার প্রকল্প নিয়েছে এবং সফল হয়েছে সেখানে বাঙালি মুসলমান অনুপস্থিত। একমাত্র হিন্দুই বাঙালি। ‘মুসলমান’ আলাদা জাতি। বাংলা প্রদেশে মুসলমান কিছুটা সংখ্যগরিষ্ঠ হলেও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত হিন্দু শক্তিশালী। ফলে তারা মনে করেছিল বাংলা ভাগ তাদের স্বার্থের অনুকুল নয়। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ বা বাংলা বিভক্তির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে তাদের সাহিত্য ও বাঙালি পরিচয় নির্মাণে যে সাম্প্রদায়িক ভেদ তৈরি করেছে তারই পরিণতিতে জাতিবাদী হিন্দু এবং জাতিবাদী মুসলমানের আবির্ভাব নিশ্চিত হয়েছে। পরিণতি প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং সহিংসতা। ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে বাংলা যখন আবার ভাগ হোল হিন্দু তা সক্রিয় ভাবে সমর্থন করল। কেন? এবারও সংখ্যার ভয়। ১৯৩৩ সালে রামজে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপীয়দের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাব করে সংখ্যার রাজনীতিকে মুখ্য করে তোলেন, মহাত্মা গান্ধী এর প্রতিবাদে অনশন করেন কিন্তু বি আর অম্বেদকার এ রোয়েদাদ সমর্থন করেন। ফলে ভোটার হিশাবে হিন্দু মুসলমানের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য আমূল বদলে যায়। হিন্দু সমাজ একে মেনে নেয় নি। মুসলমান জনসংখ্যার ভীতি হিন্দুর মনে স্থায়ী ভাবে গেঁড়ে বসবার ঐতিহাসিক শর্ত তৈরি হয়।
সংখ্যার ভীতি প্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যা ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রকে যখন একই সমাজের অপরকে জায়গা করে দেওয়া, অপরের অধিকার এবং সমাজের বৈচিত্র ও বিভিন্নতা স্বীকার এবং সকলকে ‘নাগরিক’ হিশাবে অধিকার ও দায় তৈরির উপায় গণ্য না করে স্রেফ নির্বাচনী ব্যবস্থায় পর্যবসিত করা হয়, তখন রাজনীতিতে একমাত্র সংখ্যাই মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়। সংখ্যাই ক্ষমতা লাভের উপার হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট রূপের পর্যালোচনা না করে সংখ্যার আলোচনা অর্থহীন।
মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাবার ভীতি পুরানা জিনিস, এর জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি বেড়েছে,এই অভিযোগের কোন ভিত্তি নাই। পশ্চিম বাংলার বাঙালিগণ 'বাঙালি' ধারণার মধ্যে মুসলমান অনুপস্থিত এর রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞ। একে মোকাবিলার কোন চেষ্টা পশ্চিম বাংলায় ক্ষীণ। যাঁরা করতে চেয়েছেন তাদের রাজনৈতিক প্রভাব নাই বললেই চলে। পশ্চিমবাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ সবসময়ই হিন্দু জাতীয়তাবাদের অধিক কিছু ছিল না। সেটা যতোই স্পষ্ট হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র যতোই বাড়ছে, জাতিবাদী হিন্দু ততোই মুসলমান সংখ্যার কথা ভেবে আতংকিত হচ্ছে।
আমি যেহেতু বাঙালি, ভাষার মধ্যেই আমি বাঁচি, তাই রাজনৈতিক-দার্শনিক কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমার পক্ষপাত রয়েছে। এই ভেদ ও বিভাজন যদি ঐতিহাসিক হয়, তাহলে ঐতিহাসিক ভাবেই তা অতিক্রম করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। প্রাথমিক কাজটা শিল্পী সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু সেটা অন্নদাশংকর রায়ের আবেগ দিয়ে হবে কিনা সন্দেহ, কারন পাশাপাশি দরকার ঔপনিবেবেশিক শাসন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র গঠনের পর্যালোচনা। নিদেন পক্ষে মমতা ব্যানার্জিকে এই ক্ষেত্রে খামাখা দোষারোপ না করে নির্বাচনী রাজনীতি ও সংখ্যাভীতির ঐতিহাসিক কারণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি।
যদি আমরা আদৌ বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল কাটিয়ে তুলতে চাই তাহলে অসুখকে ঠিক জায়গাতেই শনাক্ত করতে জানতে হবে।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।