'বাঙালি' এবং পশ্চিম বাংলার নির্বাচন ১

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমরা যারা তরুণ তখন লেখালিখি করতাম স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অনেকেরই এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু জন্মেছিল যে বাংলাদেশকে যদি কদম বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয় তাহলে কলকাতার দিকে তাকালে চলবে না। হুমায়ূন আহমেদ সেটা ভাষা ও সাহিত্যের জায়গা থেকে বুঝতো, কলকাতার ভাষায় গদ্য লেখা যাবে না, গল্পকে গল্পের মতো সহজ সরল গদ্যে বলবার ধারা তৈরি করতে হবে, যেন ক্লাস এইটের কিশোরও পড়ে আনন্দ পায়, বাংলাভাষাকে যেন তার বিদেশি ভাষা মনে না হয়। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের জুলুম ও আকীর্ণতা থেকে ভাষাকে সকলের কাছে গল্প বলবার মাধ্যমে পরিণত করা যায়।

আহমদ ছফা আরও সামগ্রিক ভাবে বুঝতো যে বাংলাদেশকে কলকাতার আর কিছুই দেবার নাই। বাংলাদেশের মতো একটি সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠির অন্তর ও বাহিরের চাহিদা মেটাবার সামর্থ বাস্তব কারণেই পশ্চিম বাংলার থাকতে পারে না। উপমহাদেশ যদি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকে তাহলে ভারত সেকুলারিজমের পোশাক পরা একটি হিন্দু রাষ্ট্রই কেবল। বাংলাদেশের বিকাশ ও জাতীর নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পশ্চিম বাংলা হিন্দু ভারতের অধীনস্থ একটি হিন্দু রাজ্য মাত্র। ফলে ভাষা বা সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঙালি হবার সাধনা না করে তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু রাষ্ট্রকেই শিরোধার্য গণ্য করবে, এতে অবাক হবারকিছু নাই।

পাকিস্তান আমলে ঢাকা-কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর হঠাৎ অনেকে আসাযাওয়া শুরু করলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা স্পষ্ট বুঝেছিলাম বাংলাদেশের জনগণের জীবন এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার বিশেষ কোন আগ্রহ নাই। আমরা বাঙালি, পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছি, এতে তারা দারুন উৎফুল্ল ছিলেন। যদ্দূর মনে পড়ে নব্বইয়ের শেষের দিকে আহমদ ছফা কলকাতার একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে একাত্তরে আমাদের উপলব্ধির কথা স্পষ্টই বলেছিলেন, কলকাতার দিকে আমরা আর তাকিয়ে থাকব না।

কিন্তু একাত্তরের আগে কি তাকিয়ে থাকতাম? হ্যাঁ থাকতাম। কারন বাঙালি হিশাবে নিজেকে চিনবার ও বুঝবার জরুরি উপাদান ও প্রেরণা আমরা কলকাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। সাবেক পাকিস্তানে আমাদের বাঙালি হবার প্রণোদনা কলকাতা জুটিয়েছে। আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক সত্তার উপলব্ধি সঞ্চারিত করবার ক্ষেত্রে কলকাতার নির্ধারক ভূমিকা আছে। শুধু শরণার্থি হিশাবে আমরা পশ্চিম বাংলার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব তা নয়, বাঙালি হিশাবে কলকাতার তৈরি আয়নায় নিজের মুখ দেখে আমরা বাঙালি হবার সাহস অর্জন করেছি। হোক সেটা উচ্চ বর্ণের হিন্দুর তৈরি আয়না, কিন্তু আমরা গ্রাহ্য করি নি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরপরই কলকাতা থেকে আসা যেসব শিল্পীসাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে তাতেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম কলোনিয়াল আমলে গড়ে ওঠা জাতিবাদী হিন্দুর খাসিলত পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সাহিত্যিক মহল কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা।

হিন্দু রাষ্ট্র ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শক্তি বাড়ছে, অতএব এতে অবাক হবার কিছু নাই। পার্থ চ্যাটার্জির ভাষায় বলতে পারি এটা হচ্ছে ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ হিন্দু বাঙালি ইতিহাসকে যেভাবে কল্পনা করেছে এবং করে, এখনকার পশ্চিম বাংলা তার ব্যতিক্রম কিছু করছে না। পার্থ চ্যাটার্জি স্বীকার করেছেন, ‘বিকল্প ইতিহাস রচনার জন্য প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত আমাদের নেই’ পশ্চিম বাংলা এক সময় পুরা ভারত নিয়ে ভাববার সামর্থ রাখতো। অখণ্ড ভারত খণ্ডিত হয়েছে বটে, কিন্তু নিদেন পক্ষে সাতচল্লিশের পর পুরা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে সামগ্রিক ভাবে ভাববার সামর্থ কলকাতার অর্জন করার আশা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস, সিপিএম কিম্বা মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল হয়ে এখন হিন্দুত্ববাদের যে চেহারা আমরা বাংলাদেশ থেকে দেখছি তাতে স্পষ্ট সীমান্তের দুই দিকেই ইতিহাস অনেক রক্তপাত, হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস ঘটাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি জিততে যাচ্ছে তার আভাস দিচ্ছেন অনেকে। খবরে দেখছি সিপিএম রাজনীতি করতেন এমন বামেরা বিজেপিতে যোগদান করছেন। এতে অবাক হবার কিছু নাই। আসলেই যদি বিশ্বাস করি যে তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছে, তাহলে মানতেই হবে ভারত সেকুলারিজম ও গণতন্ত্র দিয়ে নিজের লুকিয়ে রাখা হিন্দু রাষ্ট্রের রূপই দেখাবে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার কাছে কোন নতুন উপাদান বা প্রেরণা দুরাশা তো বটেই, বরং হিন্দুত্ববাদের শক্তিবৃদ্ধির পরিণতি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে কী হতে পারে তা নিয়ে আমাদের আতংকিত হতে হচ্ছে।

সীমান্তের এদিকে ফুটতে থাকবে হিন্দুত্ববাদ বা জাতিবাদী হিন্দুর বিপরীতে জাতিবাদী মুসলমানদের রূপ। জাতিবাদী মুসলমান নিজেকে আরব, ইরানি বা তুরানি ভাবে; অথচ বাংলা আমামদের ভাষা, বাঙালি মুসলমানেরই ভাষা, বাংলা তার সংস্কৃতি। বঙ্গে তো বটেই, ভারতবর্ষে ইসলামের নিজস্ব ইতিহাস আছে। কিন্তু জাতিবাদী মুসলমান সেই ইতিহাস জেনে এখনকার বাস্তব চ্যালেঞ্জ মীমাংসায় আগ্রহী না। সে চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যেতে চায়। নিজের গৌরবকেও অস্বীকার করে। সুলতানি আমলের বৃহৎ বাংলার স্মৃতি সে ভুলে গিয়েছে। অতএব ইসলামের সঙ্গে স্থানীয়তা ও লোকায়তিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাবার কর্তব্য থুয়ে ধর্মকে সে স্রেফ আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার ভাবে। হিন্দু বা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদকেই সে পরম পূন্য জ্ঞান করে। চ্যালেঞ্জ মীমাংসা করে বাঙালি হিন্দুকে বৃহত্তর বাঙালির অন্তর্গত করে নেওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সে ধরতে পারে না। এই অজ্ঞানতা যতোই গাঢ় হবে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু আর পরস্পরকে চিনতে পারবে না।

হিন্দু বাঙালি মুসলমানের গড়ে ওঠার ইতিহাস জানে না। এতোকাল তারা গীতা, মহাভারত উপনিষদে ডুবে ছিল, তাদের আত্মপরিচয় তারা তাদের ধর্মীয় কেতাবে ঢুঁড়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যাটা তাদের নিজেদের না। ঋষি আর তপোবনের হিন্দুত্বের জগত ওরিয়ান্টিলস্টদের তৈয়ারি জিনিস। সনাতন ধর্মের বিচিত্র্, বিভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী সমৃদ্ধ ধারা সম্পর্কে তার বিশেষ জ্ঞান নাই। হিন্দু যে একাট্টা কেতাবি ধর্ম না, এটা অধিকাংশ হিন্দু জানে কিনা সন্দেহ। খ্রিস্টান আর মুসলমানদের মতো তারাও বিশ্বাস করতে শিখেছে যে রামায়ন মহাভারত গীতা উপনিষদ ভগবানের তরফে আসমান থেকে তাদের প্রতি নাজেল হয়েছে।

ইংরেজের তাঁবেদারি আর পূর্ব বাংলায় জমিদারি করে বাঙালি হিন্দু জমিদার, মহাজন ও বেনিয়ারা কলকাতার বাবু সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এখন বাঙালি মুসলমান যখন স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ মীমাংসার জন্য ইসলাম নিয়ে, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে, বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ নিয়ে কিম্বা কোরান হাদিস নিয়ে দুই এক কথা বলতে চায়, বাঙালি হিন্দু তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। তাদের চোখে সবাই মৌলবাদী। তারা নিরন্তর জিহাদের আতংকে ভোগে।

আমি সব সময়ই বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের পারস্পরিক বোঝাবুঝির জায়গা তৈরি করার ওপর ‘বাঙালি’ হিশাবে উভয়ের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে বলে দাবি করি। যদি আদৌ তেমন কিছু থাকে। না, পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে দেওয়া না। পরস্পরকে বোঝা। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও বাঙালি হিন্দু কিম্বা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে গভীর কোন বোঝাবুঝি বা সম্বন্ধ গড়ে ওঠে নি। এটা বিস্ময়কর। এতে আমরা কী বুঝি? ‘বাঙালি’ নামক কোর্তা পরিয়ে হিন্দুকে যেমন বাঙালি বানানো যায় না, কোর্তার নীচে সে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুই থেকে যায়, তেমনি মু্সলমানকেও সেকুলার বাঙালির পোষাক পরালে সে মুসলমানই থাকে। কারণ ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মীমাংসায় দুইয়ের কারুরই এখন অবধি আগ্রহ নাই।

'বাঙালি' নামক কিছু আসলে বাস্তবে নাই। বাঙালি আগামিতে হয়ে ওঠার ব্যাপার। একটা স্বপ্ন, একটা প্রকল্প, যা আমরা একাত্তরে দেখেছিলাম। তার বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় হিন্দুত্ববাদের শক্তি বৃদ্ধি দেখে মনে হচ্ছে হিন্দুত্ববাদ বাঙালির কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতে চাইছে।


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।