হাট হাজারি, হেফাজত ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়: ২
ইফতেখার জামিল লিখেছেন “ফরহাদ মজহার পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোর মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করায় হেফাজতের সমাজ-রাজনীতি চিন্তাটাই ধরতে পারেননি। তিনি হেফাজতকে মার্কসের শ্রেণী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, পাশাপাশি এর সাথে জামাত-বিএনপিকেও সমীকরণে রেখেছেন, যদিও তারা প্রচলিত রাজনৈতিক দল; এই তিন কারণে তিনি হেফাজতকে যেভাবে অতিবিপ্লবী কল্পনা করেছেন, সেটারও আসলে কোন ভিত্তি নেই”। অভিযোগগুলো আরো পরিষ্কার করা যাক।
এক. এই অভিযোগের একটি মানে হচ্ছে, তথাকথিত ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’র বিপরীতে হেফাজতের ‘সমাজ-রাজনীতি চিন্তা’ নামক সুনির্দিষ্ট চিন্তা আছে। হেফাজতের ‘সমাজ-রাজনীতি চিন্তাটা’ কী? আমরা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের মধ্যে বাস করি। হেফাজতে ইসলামের কেউই পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সমাজের বাইরে বাস করেন না। পুঁজির ধর্মই তাঁরা তাঁদের সামাজিক জীবনে পালন করেন। প্রতিটি মাদ্রাসাও পুঁজিতান্ত্রিক বাস্তবতার অভ্যন্তরে স্থাপিত, হেফাজতে ইসলামের মতাদর্শ উৎপাদনের পরিমণ্ডল বিশ্ব বাস্তবতা এবং সমাজে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী শ্রেণির দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে আলাদা না। নিজেদের অবস্থান এবং বিশ্ব বাস্তবতা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য হেফাজতে ইসলাম তাহলে কোন্ সমাজবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র ও রাজনৈতিক বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করে?
দুই. আমি ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ দিয়ে হেফাজতকে ব্যাখ্যা করি, তাই আমি হেফাজতের ‘সমাজ-রাজনীতি চিন্তাটাই’ ধরতে পারি না। ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ অতি বিমূর্ত এবং বিশাল একটি ব্যাপার। সেখানে গ্রিকরা আছেন, মধ্যযুগের দার্শনিকরা আছেন, আধুনিক কালের দার্শনিক রয়েছেন এমনকি উত্তরাধুনিক দার্শনিকও আছে। পাশ্চাত্য চিন্তায় পরস্পর বিরোধী ধারা যেমন রয়েছে তেমনি একটি ধারার মধ্যে নানান স্রোত ও উপস্রোতও রয়েছে। আমি পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামোর কোন ধারায় কিম্বা কোন স্রোতের ধারক যা দিয়ে হেফা্জতে ইসলাম বোঝার চেষ্টা করি বলে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি?
তিন. আমি হেফাজতকে মার্কসের শ্রেণী দিয়ে ব্যাখ্যা করি, এর সাথে পাশাপাশি আমি ‘জামাত-বিএনপিকে সমীকরণে’ রাখি। হেফাজতে ইসলাম কিম্বা যে কোন মতাদর্শ কিম্বা আন্দোলনকে মার্কসের অর্থশাস্ত্রীয় বিচার বা শ্রেণী দিয়ে ব্যখ্যা করলে অসুবিধা কি? ‘সমীকরণে রাখা’ কথাটা নতুন শিখেছি। ভাল।
জামিল বলছেন, এই তিন অভিযোগের ভিত্তিতে আমি হেফাজতকে ‘অতি বিপ্লবী’ কল্পনা করি। এই তিন অভিযোগের সঙ্গে ‘অতি বিপ্লবের’ কি সম্পর্ক?
যে কেউই বুঝবে এই সব নিছকই আমার বিরোধিতার জন্য এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়া। আন্তরিক আলোচনা এখানে উদ্দেশ্য নয়। মতপার্থক্য মোচন করার জন্য আন্তরিকতা এবং সততার সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। চিন্তার পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করাই উত্তম। কে ঠিক কে বেঠিক সেটা ইতিহাসই নির্ণয় করে দেবে। তথাকথিত মত পার্থক্য আদৌ মোচন সম্ভব কিনা নিদেন পক্ষে সেই সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি। আরিফ বিল্লাহ এই কারণে ঠিকই ধরেছেন ইফতেখার জামিলের এই এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়ার অর্থ “ইসলামপন্থী বা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে ফরহাদ মজহারকে দূরে রাখবার পরিকল্পিত প্রপাগান্ডার অধিক কিছু না। কারণ এর কোন ভিত্তি নাই”। কোন অভিযোগের পক্ষে ইফতেখার জামিল কোন যুক্তি বা প্রমাণ হাজির করেন নি।
আলোচনা হওয়া উচিত ছিল সুনির্দিষ্ট ভাবে আল্লামা আহমদ শফি সম্পর্কে আমার লেখা পোস্ট নিয়ে, কিন্তু তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে এলেন যাতে মাদ্রাসা পড়ুয়া এবং ইসলামপন্থি ছাত্রদের ইনিয়ে বিনিয়ে বলা হোল, আল্লামা আহমদ শফি সম্পর্কে ফরহাদ মজহারের লেখায় খুশি হবার কিছু নাই, কারণ তিনি আদতে ‘পশ্চিমা চিন্তা কাঠামো’ দিয়ে হেফাজতকে দেখেন, তিনি মার্কিস্ট, শ্রেণী সংগ্রাম দিয়ে হেফাজত বিচার করেন। আবার তিনি জামাত এবং বিএনপিকে ‘সমীকরণে’ রাখেন।
‘সমীকরণে রাখা’ কী জিনিস আমি জানি না। তবে বুঝতে পারি ইফতেখার স্মার্ট। আমাকে সরাসরি জামাত-বিএনপি বলেন নি, কারণ প্রমাণ করতে পারবেন না। তাই ‘সমীকরণ’ কথাটা তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিরোধকে জামাত-বিএনপির আন্দোলন বলে ট্যাগ করবার রাজনীতিটা মনে রাখলে এই ‘সমীকরণ’ শব্দের অন্তর্নিহিত মানে আমরা বুঝব। জামিল কি মাদ্রাসা ছাত্রদের বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে ফরহাদ মজহার আদতে বিএনপি-জামাত, কিন্তু আমরা হেফাজত, ওদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে? অতএব ফরহাদ মজহারের কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার দরকার নাই। এই অভিযোগ নিছকই ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের প্রপাগাণ্ডা, যারা যে কোন মূল্যে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার জন্য যে কোন যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে বিএনপি-জামাত ট্যাগ দেয়। ইফতেখারের এই কৌশল নেওয়া ঠিক হয় নি। ‘স্মার্ট’ হলেও তাঁর অভিযোগের সার কথা কি দাঁড়ায় সেটা হয়তো ইফতেখার জামিল নিজেও ভেবে দেখেন নি। অকাতরে গুলি ছুঁড়েছেন।
এটা আমি গায়ে মাখছি না। কিন্তু ইফতেখার জামিলের চিন্তার ভয়ানক বিপজ্জনক দিক হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামপন্থীদের নিজের পক্ষে আনা এবং দেশে দেশে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের প্রপাগান্ডা ও সামরিক-মতাদর্শিক নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে যে মার্কস এবং কমিউনিস্টরা ‘নাস্তিক’ অতএব তারা ইসলামের শত্রু। ইসলামপন্থীদের মধ্যে এই প্রপাগান্ডার কুফল স্থায়ী হয়ে গিয়েছে, যার ফল মুসলিম উম্মাহর জন্য হয়েছে মারাত্মক করুণ এবং আত্মঘাতী বিপর্যয়ের কারণ। ঔপনিবেশিক দখলদারি এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে শক্ত ঐক্য গড়ে তোলা জরুরী ছিল, সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডা খুব সহজেই সেই ঐক্যের সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছে।
প্রহসন হোল, এই ক্ষেত্রে মার্কস ও কমিউনিজম সম্পর্কে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট, ইসলামপন্থি ধারা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডার অমিল নাই বললেই চলে। এরা প্রত্যেকেই মনে করে কার্ল মার্কস ‘নাস্তিক’ ছিলেন এবং কমিউনিস্ট হওয়া মানে ‘নাস্তিক’ হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও গণমানুষের ঐক্যের মধ্য দিয়ে গণশক্তি নির্মাণের জন্য ইসলামের দিক থেকে নাস্তিক্যবাদ, কমিউনিজম ও কার্ল মার্কসের পর্যালোচনা অবশ্যই করা দরকার। করা উচিত। ইফতেখার জামিল ‘মোকাবিলা’, কিম্বা ‘মার্কস, ফুকো, রুহানিয়াত’ পড়লে কিভাবে তা সম্ভব তার পথ হয়তো ধরতে পারতেন। আফসোস তিনি তা করেন নি। তারপরও আমার আশা মার্কসকে মোকাবিলা করবার জন্য নিদেন পক্ষে মার্কস ও নির্বিচার কমিউনিজম ভীতি থেকে ইফতেখার জামিলের মতো তরুণরা মুক্ত হবে। মার্কস আতংক কাটিয়ে উঠবে এবং মার্কস বিদ্বেষ পরিহার করবে। এই অবস্থান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে ইসলামপন্থীদের যোগসাজস ও আঁতাতের শর্ত তৈরি করে। মার্কস কিম্বা তথাকথিত ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পাশ্চাত্য চিন্তা ও চিন্তা কাঠামো মোকাবিলার উপাদান খোদ ইসলাম এবং তার আভ্যন্তরীন তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যে মওজুদ আছে, ইনশাল্লাহ।
ইফতেখার জামিল ‘পাশ্চাত্যচিন্তা-কাঠামো’ ব্যাপারটা আসলে কী সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেন নি। শোনা কথা আউড়ে গিয়েছেন। আমি বুঝতে চাই, আমার ইসলাম কিম্বা হেফাজত সংক্রান্ত আলোচনা কিভাবে ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’? পাশ্চাত্য একটি বিশাল ব্যাপার, তার চিন্তার ধারাও তেমনি বিশাল। বিভিন্ন এবং অনেক সময় পরস্পর বিরোধী। তাকে কোন একটি কাঠামোতে খাপবদ্ধ করা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। দেকার্তে, কান্ট, হেগেল, হুসার্ল, হেইডেগার , মার্কস প্রমুখ -- প্রত্যেকের চিন্তা আলাদা এবং পরস্পরের বিরোধীও বটে। তাই গড়ে হরিবোল মার্কা কোন ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ নাই। এই ধরণের মন্তব্য পাশ্চাত্য চিন্তাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা ও বোঝার অভাব শুধু নয়, জানা ও বোঝার চেষ্টা না করা, বুদ্ধির আলস্য। আলস্য থেকে অজ্ঞানতা তৈরি হয়। মুসলিম উম্মাহকে পাশ্চাত্য ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চার ধারা সম্পর্কে অজ্ঞ রেখে এবং কার সঙ্গে কোথায় ইসলামের অনুমান, চিন্তা প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তের ফারাক রয়েছে, কোথায় বিরোধ -- ইত্যাদি ধরিয়ে না দিয়ে গড়ে হরিবোল মার্কা ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ অনুমান করা অর্থহীন।
তাছাড়া ‘ইসলাম’ নিয়ে কথা বললেই ইফতেখার জামিল পাশ্চাত্য চিন্তার বিপরীতে প্রাচ্য চিন্তার ধারক হয়ে যান না। কোন প্রকার পর্যালোচনা ছাড়া নিজেকে প্রাচ্য চিন্তা কাঠামোর মধ্যে দাবি করা কিম্বা ইসলামি চিন্তা কাঠামোর অন্তর্গত ভাবাও ভুল। যেমন ধরুন, ইহকালীন দায়-দায়িত্ব বাদ দিয়ে ইসলামকে শুধু পারলৌকিক ব্যাপার গণ্য করা , কিম্বা আধুনিক সমাজ যেভাবে ‘পাবলিক’ ও ‘প্রাইভেট’ ভেদ মানে, তেমনি ইসলামকেও সেই ভেদ মেনে স্রেফ প্রাইভেট রিলিজিয়ন বা বিশ্বাসে পর্যবসিত করা – এসব ধারণা এবং চর্চা মূলত পাশ্চাত্যে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সঙ্গে গড়ে উঠেছে। আফসোস, ইসলামপন্থী চিন্তার মধ্যে তার শক্তিশালী নিবাস তৈরি হয়েছে। যেমন ইসলামের ঈমান-আকিদা চর্চাকে স্রেফ মসজিদ ও মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ ও কেন্দ্রীভূত গণ্য করা, এবাদতকে ইহলৌকিক জীবন যাপন থেকে পৃথক করা। এ সবই পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া সমাজে আবির্ভাবের কারণে ঘটেছে। ইসলামপন্থীদের প্রভাবশালী অংশ কিভাবে পাশ্চাত্য চিন্তার গোলাম এবং পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থার দাস হয়ে উঠেছে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায়। তাই নির্দিষ্ট ভাবে চিনিয়ে না দিলে ‘পশ্চিমা চিন্তা কাঠামো’ নামক বিমূর্ত ও একাট্টা কিছু নাই। নিজেকে ইসলামের রক্ষাকর্তা ভেবে ডন কিয়োটির মতো খড়ের তৈরি সৈনিকের বিরুদ্ধে লড়ারও কোন মানে হয় না।
‘পাশ্চাত্যচিন্তা কাঠামো’ এবং একই সঙ্গে মার্কস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা স্ববিরোধী। অর্থাৎ দুইয়ে মেলে না। প্রাচ্য সম্পর্কে অনুমান ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসের মধ্যেও প্রাচ্যবাদী উপাদান রয়েছে, এই অভিযোগ মিথ্যা নয়, অন্যায়ও নয়। অনেকেই সেই জন্য মার্কসের সমালোচনা করেছেন, কারন মার্কস নবী বা পয়গম্বর নন। কিন্তু তাঁর গৌরবের দিক হচ্ছে পাশ্চাত্য চিন্তার ইতিহাসের অন্দর মহলে বসেই মার্কস তার আগের এবং সমসাময়িক দার্শনিক ও অর্থশাস্ত্রবিদদের পর্যালোচনা করেছেন, নাকচ করেছেন। সেটা তিনি করেছেন বর্ণবাদ, উপবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ যাদের প্রান্তিক, এমনকি খারিজ করে দিয়েছি, বিশ্বব্যাপী পুজির স্ফীতি এবং পুঞ্জিভবন যাদের বেঁচে থাকা অসহনীয় করে তুলেছে -- তাদের মুক্তির লড়াই জোরদার করবার দরকারে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে মুসলমান অন্তর্ভূক্ত। তাহলে ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ নামক আজগবি বা মনগড়া কিছু থাকলেও তার মধ্যে কার্ল মার্কসকে অন্তর্গত করা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা গভীর তর্কের বিষয়।
অতএব বলা রাখা দরকার। মার্কস যদি আমার গুরু হয়ে থাকেন তাহলে আমি ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ দিয়ে হেফাজত বুঝি এই অভিযোগ হাস্যকর। পাশ্চাত্য চিন্তা থেকে আমরা যদি মুক্ত হতে চাই তাহলে পাশ্চাত্যে আমাদের সবচেয়ে কাছের মিত্র কার্ল মার্কস। হাসির পাত্র না হয়ে এবং মার্কসের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডায় ধরা না দিয়ে, আমাদের উচিত সরাসরি মার্কস পড়া। কার্ল মার্কসের কাছ থেকে দূরে থাকা নয়, বরং দরকার মার্কসের পর্যালোচনা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এই কথাটা বলে যদি আমি দোষী হয়ে থাকি, সেই দোষ আমি মানি। ইতিহাস একদিন তার বিচার করবে।
মার্কসের প্রতি ইফতেখার জামিলের এই অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গী মাদ্রাসা ছাত্রদের সেই অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে যারা তাদের চিন্তার অক্ষমতার কারণে জেনে বা না জেনে এদেশে সাম্রাজ্যবাদের লোক লস্কর বা ফুট সোলজারে পরিণত হয়। ফুট সোলজার শুধু শাহবাগীদের মধ্যে নাই ইসলাম পন্থীদের মধ্যেও রয়েছে। এরা ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সহায়ক চিন্তা ধারণ করে ফ্যসিস্ট শক্তির সহায়ক ভূমিকা রাখে, কারন তারা জনগণকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় না। ইসলাম ও কমিউনিজম, কিম্বা ইসলামী চিন্তা ও মার্কসের চিন্তার মধ্যে এক হিমালয় প্রমাণ পার্থক্য আবিষ্কার করে। ক্রমাগত জগণের মধ্যে ফেতনা ও ফ্যাসাদ তৈরি করে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির সঙ্গে হেফাজতের দুর্নীতিবাজ ও লোভী একাংশের আঁতাতের একটি প্রধান কারণ বাংলাদেশে ইসলামপন্থী চিন্তার অক্ষমতা এবং শোচনীয় দুর্দশা। তারা এখনও মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের বোঝা বয়ে বেড়ায় এবং কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে হাওয়ায় তলোয়ার ঘুরায়। পরিণতিতে তারা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার শিকার হয়। আশা করি ইফতেখার জামিল তার অগভীর ও অদূরদর্শী চিন্তার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হবেন।
নইলে তর্কের খাতিরে ধরুন, ফরহাদ মজহার ‘পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামো’ দ্বারা দূষিত। তাহলে ইফতেখার জামিলের অভিযোগ থেকে আমরা আন্দাজ ও প্রত্যাশা করতে পারি হেফাজতকে বোঝার ক্ষেত্রে তার কাছে সঠিক ও উন্নত ‘চিন্তা-কাঠামো’ মজুদ রয়েছে। তাহলে হেফাজতের ‘সমাজ-রাজনীতি চিন্তাটা’ আসলে কী? জামিল আশা করি আমাদের তা ব্যাখ্যা করে বলবেন।
এরপর জামিলের আরেকটি মারাত্মক অভিযোগ হচ্ছে আমি হেফাজতকে ‘অতিবিপ্লবী’ কল্পনা করেছি। কেন? জামিলের মূল্যায়নঃ “মূলত হেফাজতের ইতিহাসে এমন অতিবিপ্লবী বা অলআউট খেলার কোন দৃষ্টান্ত নেই। তাই কিছুদূর এগিয়ে গেলেও একপর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পিছু হটতে হটতে একসময় সরকারের সাথে 'ঘনিষ্ঠতা' তৈরি করে। হেফাজতের ইতিহাসে এমন 'ঘনিষ্ঠতা'র দৃষ্টান্তও আর ছিল না। অতিবিপ্লব ও অতিঘনিষ্ঠতা, দুটোই আল্লামা শফীর হেফাজতের বর্তমান বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপট”।
প্রথমত ‘অতি বিপ্লবী’ আমার বিরুদ্ধে নিন্দা হিশাবে জামিল ব্যবহার করেছেন, সেটা না হয় ঠিকই আছে। আমি 'র্যাডিকাল কমিউনিস্ট’, ‘জিহাদি’ ‘অতি বিপ্লবী’ – এইসব অভিযোগ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির দালালদের কাছ থেকে সততই শুনছি। তাই জিহাদি বললে যেমন আপত্তি করি না, অতি বিপ্লবীও গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টা গুরুতর।
আল্লামা আহমদ শফি সম্পর্কে আমি লিখেছি, “ জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্তে তিনি সরে এসেছেন। শাপলা চত্বরে তাঁর হাজির থাকা এবং মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শেষ করবার কথা থাকলেও তিনি যান নি। অর্ধপথ এসে ফিরে এসেছেন”। প্রথমে আমি সব্বাইকে নিশ্চিত করতে চাই যে আল্লামা আহমদ শফির কাছ থেকে আমি কোন ‘বিপ্লব’ আশা করি নি। ‘অতি-বিপ্লব' তো দূরের কথা। একজন আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হিশাবে তিনি জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অর্থাৎ একটি ‘মোনাজাত’-এর মাধ্যমে হেফাজতের সমাবেশ শেষ করা এবং সবাইকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া’ – তিনি তাঁর সেই রুহানি প্রতিশ্রুতি পালন করেন নি। একে আমি ইসলামের দৃষ্টিতেই প্রতিশ্রুতির বরখেলাফ গণ্য করি এবং মানুষ হিশাবে আমাদের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে তাঁকে ক্ষমার জন্য দুই হাত তুলি। যদি তিনি সেটা করতেন তাহলে শাপলা চত্বরে এতোগুলো প্রাণ বলী হোত কিনা সন্দেহ। শাপলা চত্বরের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি নেবার জন্যই তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে অর্ধেক পথ গিয়ে ফিরা আসার রক্তাক্ত পরিণতি বোঝার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতা তাঁর ছিল না। লিখেছি, “শাপলা মঞ্চের তাৎপর্য আল্লামা আহমদ শফি ধরতে পারেন নি। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার জন্য যে এলেম, হিকমত ও আমল জরুরি, তিনি সেই পথ ধরে বেড়ে ওঠেন নি”। এই বাক্যটি আমাকে লিখতে হয়েছে আল্লামার মাসুম চরিত্রের দিকটি তুলে ধরার জন্য। অন্যায় সমালোচনা থেকে তাঁকে রক্ষা করবার জন্য। যা আমি আমার কর্তব্য গণ্য করি। কিন্তু ইফতেখার জামিল মনে করেন, সেটা ঠিক না। আল্লামা শফি সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি বুঝতেন। জামিলের কথা মেনে নিলে আল্লামা আহমদ শফি গোয়েন্দাদের পরামর্শে শাপলা চত্বরে মঞ্চে যান নি, এই অভিযোগও তাহলে মেনে নিতে হয়। অর্থাৎ সেই সিদ্ধান্ত তিনি রাজনৈতিক ভাবে গোয়েন্দাদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে জেনেশুনে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দায়দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। তাহলে শাপলা চত্বরে ৫ ও ৬ই মের হত্যাযজ্ঞের অপরাধে তাঁকেও অপরাধী করতে হয়। নাউজুবিল্লাহ!
প্রিয় মানুষের প্রতি আবেগ ভাল, কিন্ত আল্লামা আহমদ শফি সমাজ ও রাজনীতিতে সর্বজ্ঞ এই দাবি বিপজ্জনক। তিনি ধর্মবেত্তাই ছিলেন। সমাজ, রাজনীতি, ক্ষমতা, শক্তির মেরুকরণ ইত্যাদি তিনি বুঝতেন না। যেখানে তাঁর আসন সেখানেই তাঁকে সমাসীন রাখলে তাঁর সম্মান বাঁচে।
‘অতি বিপ্লবী’? বেশ। আমি হেফাজতে ইসলামকে ঐতিহাসিক দেওবন্দী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন মনে করি না। ছেদ, বিচ্যূতি, পশ্চাদপসরণ, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপোষ যে কোন আন্দোলনেই থাকে। শেষাবধি সফল আন্দোলন সেই সব ছিন্ন করেই ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেয়। কিন্তু দেওবন্দী ধারার ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য তার বিপ্লবী চেতনা। ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবী ধারার জন্ম হয়েছে। দেওবন্দী আন্দোলনের বিপ্লবী ধারা ও ইতিহাস ভুলে গিয়ে, মুছে ফেলে, যারা কওমি মাদ্রাসা এবং হেফাজতে ইসলামকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির সহায়ক হিশাবে পর্যবসিত করতে চায়, তারাই দাবি করবে, ‘অতিবিপ্লবী’ কিম্বা ‘অল আউট’ খেলা হেফাজত খেলে না বা খেলবে না। এই কথা বলার কোন প্রয়োজন নাই।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে কে কোন খেলা খেলে বা খেলবে সেটা আগাম কেউই বলতে পারে না। আল্লাহ ছাড়া। জাতীয় রাজনীতিতে কওমি মাদ্রাসা ও দেওবন্দী ধারার কাজ কি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও দীর্ঘস্থায়ী করা?
ইফতেখার জামিল লিখেছেন, ‘দ্বিমত থাকলে বা আমি ভুল বুঝে থাকলে জানাবেন দয়া করে”। মত, মতপার্থক্য, দ্বিমত – ইত্যাদি পরিভাষার মুশকিল হচ্ছে ধরে নেওয়া হয় এটা নিছকই ব্যক্তিদের মধ্যে ‘মত’ মাত্র, মতের পার্থক্য। মতের ভুল ধরিয়ে দিলেই চুকে যায়। ওপরের আলোচনায় পরিষ্কার ব্যাপারটা এতো সিম্পল না। তবু স্নেহ ভাজন ইফতেখার জামিলকে তার ভুল ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। যদি তিনি আসলেই একে ‘মতের ভুল’ মনে করেন তাহলে আশা করি তিনি ভুল থেকে বেরিয়ে আসবেন এবং ইনশাল্লাহ একজন তরুণ দেওবন্দী আলেম হিশাবে বাংলাদেশে বিপ্লবী ও জিহাদি ভূমিকা রাখবেন। হেফাজতে ইসলামের চরিত্র ও ঐতিহাসিক দেওবন্দী ঐতিহ্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে দেওবন্দী ধারাকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত করবেন না।
আল্লাহ চাহেন তো ‘অতি বিপ্লবী’ হওয়াটা না হয় আমার কাছেই মওজুদ থাক। সকলের কাছে দোয়ার দরখাস্ত পেশ করছি। আমিন।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।