চিন্তার উচ্চারণ
"আপনারা দোকানে গিয়ে বসেন। চা নাস্তা খান। দোকানে মেয়েছেলে আছে। পছন্দ হলে ঘরে যাবেন, না হলে চলে যাবেন। এদিকেই থাইকেন। ঐদিকে গেলে মেয়েরা টানাটানি করবে। তখন ছুটতে পারবেন না। তবে দোকানে ভালো মাল আছে। আপনাদের পছন্দ হবে।" মংলা থেকে সুন্দরবনের করমজল পয়েন্টে যাওয়ার পথেই বাইনশান্তা গ্রাম। স্বাধীনতার পর পরই সেখানে গড়ে ওঠে নারীকে পণ্য বানানোর বহুজাতিক ব্যবসা পতিতাপল্লী। সেখানেই শুনলাম কথাগুলো। কৌতুহলী চোখে দোকানের মেয়েগুলোকে দেখি। পায়ে আলতা, মুখে পাউডার, কপালে টিপ। চোখে-মুখে গভীর আকুতি, অস্ফূট ক্রন্দন, প্রিয় কিছু হারানোর অব্যক্ত প্রকাশ। তারপরও নিজেকে মোহনীয় করে তোলার তীব্র প্রয়াস। এখানে এখনো ফেয়ার এন্ড লাভলী ও লাক্সের ব্যবহারের প্রসার বাড়েনি, পেপসোডেন্টের ফেনায় ঝকঝক করেনা এখানকার মেয়েগুলোর দাঁত, ডোভ কিংবা ভীট-এর নামও অনেকে শোনেনি। অবাক হয়ে দেখি নারীকে পণ্য বানানোর এই বহুজাতিক পণ্যগুলোর আধিক্য না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এখানে নারীকে পুরুষের কামনা-বাসনা-লালসা চরিতার্থ করার পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। নারী এখানে পুরুষালী উন্মাদনার সামগ্রী। তাইতো নারীর কোমল পরিসরে চলে পাশবিক বাহাদুরী, নিষ্ঠুর অভিযান। ওরাও তো গ্রামের গরীব কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান কিংবা রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের আদরের ধন। মায়েরা-বাবারা কত আদর-সোহাগ দিয়ে বড় করে তোলে ওদের। অভাবের তাড়নায়, মনের মানুষটির প্রেমের ছলনায় অথবা জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্নের ফাদেঁ পড়ে ওদের স্থান হয় ঐ নোংরা অস্বাস্থ্যকর খুপড়ি ঘরগুলোতে। লোকালয় হতে দূরের ঐ আবাসে অস্পৃশ্য করে রাখা হয় 'নিশিপরী'-দের। ওদের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় সমাজ-রাষ্ট্র-সবাই। নির্দ্বিধায় ওদের অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গোয়েন্দা-পুলিশ-বুদ্ধিজীবী-প্রগতিশীল-রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ। সংস্কারকদের যত ঘৃণা ওদের নিয়ে। অথচ রাতের অন্ধকারে উদ্দীপনার উন্মাদনায় সমাজের প্রভূরাই ছুটে যায় ওদের কাছে-মনোরঞ্জনের জন্য। ওরা হয় পাশবিক পুরুষের আঁধারের চাদর। তবে ওদের এত ঘৃণা কেন??? বলুনতো মনের গভীরে পাহাড় সমান দুঃখ পুষে রাখা অসহায় নয়না, নিষ্পাপ মুখের মেয়েগুলো কি 'পাপ' না 'পাপী'? আমরা কাকে ঘৃণা করব 'পাপ'-কে না 'পাপী'-কে? নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করার জন্য, 'পাপ'-কে টিকিয়ে রাখার জন্য আর কতকাল 'পাপী'-কে ঘৃণা করা হবে, সমাজ থেকে অস্পৃশ্য করে রাখা হবে.......?????