হাট হাজারি, হেফাজত ও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়: ১

আল্লামা আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন নিয়ে আমার পোস্টটি নিয়ে অনেকে নিজেদের ওয়ালে এবং বিভিন্ন কমেন্ট সেকশানে কিছু মন্তব্য করেছেন। তাদের চিন্তা ও রাজনৈতিক অবস্থান তাদের যার যার বক্তব্য, মন্তব্য ও রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী হয়েছে। ভাল। এ নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা হোক। প্রত্যেকের অবস্থান বিচার করে পাঠক নিজের অবস্থান নির্ণয় করবেন আশা করি।

মোটা দাগে দুটো পক্ষ থেকে কিছু কথা উঠেছে যা নিয়ে কথোপকথন জরুরী। একটি পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করছেন কওমি মাদ্রাসার একজন তরুণ লিখিয়ে, স্নেহ ভাজন ইফতিখার জামিল (Iftekhar Jamil) । কওমি মাদ্রাসায় সবাই জামিলের মতো ভাবেন, তা নয়। আরেকজন কওমি মাদ্রাসার তরুণ আরিফ বিল্লাহ (Md Arif Billah) আলাদা ভাবে তাঁর নিজের টাইমলাইনে জামিলের মন্তব্যের যে সমালোচনা করেছেন তাতে সেটা বুঝেছি। (কমেন্ট সেকশানে দেখুন) । জামিল এখানে আমার আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নন। আমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেন তরুণদের ঐক্য দুর্বল করতে না পারে তার জন্য কিছু বিষয়ের অবতারণা করা, যাতে চিন্তার জায়গাগুলো সাফ করা যায়। সর্বোপরি কওমি পরিমণ্ডলের বাইরে জাতীয় পরিসরে যেন আলোচনাকে উন্নীত করা যায়।

দ্বিতীয় ধারাকে আমরা বলতে পারি ক্লাসিকাল শাহবাগী ধারা। এর প্রতিনিধিত্ব করেন জিয়া হাসান (Zia Hasan)। জিয়া হাসানও আমার স্নেহ ভাজনদের একজন। বলা বাহুল্য এই ক্ষেত্রেও আমি বলে রাখতে চাই জিয়া হাসান মোটেও আমার সমালোচনার লক্ষ্য বস্তু নন। শাহবাগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ কিম্বা সমর্থন করেন বলে আমি কাউকে ‘শাহবাগী’ ট্যাগ মারতে রাজি নই। বরং ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা মোকাবিলার নীতি ও কৌশল নিয়ে সমাজে আলোচনা বিস্তৃত হোক, এটাই আমার কামনা।

‘ক্লাসিকাল শাহবাগী ধারা’কে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা দরকার, কারণ শাহবাগে জিয়া হাসানের ধারা ছাড়াও আরো নানান চিন্তার স্রোত ছিল। তবে শাহবাগ সম্পর্কে ক্লাসিকাল শাহবাগী বয়ানই প্রধান ন্যারেটিভ। শাহবাগ ও শাপলার অভিজ্ঞতা তাদের অনেকের মধ্যে পরবর্তীতে ভিন্ন উপলব্ধি তৈরি করেছে। অনেকেই এখন আমার চিন্তার কাছাকাছি। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নাই, জিয়ার মধ্যে ক্লাসিকাল শাহবাগী চিন্তার প্রকটতা আমাকে ভাবিয়েছে। কারন আমি তাঁকে অনেক ইন্টেলিজেন্ট ভেবেছিলাম।

জিয়া অভিযোগ করেছেন, "শাহবাগ এবং তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনা নিয়ে জনাব মজহার অতি সরলীকৃত বাইনারির বাহিরে যেতে পারেন নাই, সেই ২০১৪ সালেই। এবং আজকে, ২০২০ সালে এসেও আল্লামা শফীর মৃত্যুর পরেও তিনি সেই অতি সরলীকৃত ন্যারেটিভের ভেতরে আটকে আছেন"। তাঁর পোস্টেও স্নেহভাজন খোন্দকার রাকিব (Khandaker Raquib) গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বিভিন্ন ইসলামি ধারা নিয়ে রাকিবের গবেষণা জাত মন্তব্য। জিয়ার এই তথাকথিত সরল ন্যারেটিভের একটা উত্তর রাকিব দিয়েছেন। তারপরও শাহবাগকে আমি আমার সামগ্রিক চিন্তার যে জায়গা থেকে যেভাবে বিচার করি সেই জায়গাটি বারবারই পরিষ্কার করা দরকার মনে করি। শুরুতে সেই বিষয়েই কয়েকটি কথা বলা যাক।

শাহবাগের আন্দোলনই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের একমাত্র রূপ নয়। বাকশালের ইতিহাস আমাদের রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘ঘোষণা’ কিম্বা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় – যার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে – অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার-- সেই ঘোষণাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে সাংবিধানিক ভাবে এমন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, যা শুরুটাই ছিল জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির নামে সাংবিধানিক ভাবে ফ্যাসিবাদ চর্চার চার স্তম্ভ (ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতিবাদ এবং গণতন্ত্র (?) বাংলাদেশের জনগণের ওপর আরোপ করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান ঘিরে দীর্ঘ সাংবিধানিক বিতর্কের ইতিহাস জমা হয়ে আছে।

ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক রণধ্বণি ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। শাহবাগে এর পরিষ্কার ভাষ্যটা শ্লোগানে শ্লোগানে বাংলাদেশের জনগণ এবং এই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অন্তর্গত নাগরিকরা শুনেছে। সেটা হোল “আমি কে তুমি কে, বাঙালি বাঙালি’। বাঙালি বর্ণ হিন্দুর ‘বাঙালি’ সংজ্ঞা নির্মান থেকে ইসলাম ও মুসলমান কর্তা সত্তা ছাঁটাই হয়ে ছিল ঔপনিবেশিক আমলেই, একই ভাবে 'বাঙালি' ধারণা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতি সত্তার অন্তর্ভূক্তিও খারিজ করে দিয়েছিল।

তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কিম্বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দুই হাজার তেরো সালে গড়ে ওঠে নি। কিম্বা হাতে গোনা কয়েকটি নাস্তিকের হাতের মোয়া হিশাবে পয়দা হয় নি। মাহমুদুর রহমানের 'উসকানি'র জন্যও গড়ে ওঠে নি। এর ভিত্তি ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে বর্ণ হিন্দুর ‘বাঙালি’ ধারণা এবং বাঙালি মুসলমানকে বর্ণ হিন্দুর রচিত বাঙালির ইতিহাস থেকে উহ্য রাখা, বাদ দেওয়া, মুসলমান বিদ্বেষী হওয়া এবং ঘোরতর ইসলাম ভীতি চর্চার মধ্যে। উপমহাদেশের হিন্দুত্ববাদের জন্ম উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালির চিন্তা, সংস্কৃতি লেখালিখি ও রাজনীতি থেকে পয়দা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে শাহবাগ বোঝা যাবে না, জিয়া হাসানের ক্লাসিকাল শাহবাগী ন্যারেটিভও আমরা বুঝব না। কেন ফরহাদ মজহারের ন্যারেটিভকে সে 'বাইনারি' ভাবে কিম্বা বাইনারিতে পর্যবসিত করে সেটা আমরা বুঝব না। লক্ষ্য করবার বিষয়, জিয়া শাহবাগকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা হিশাবে দেখে। শাহবাগী রঙ্গমঞ্চ উপমহাদেশের ঐতিহাসিক কোন ময়দানে অভিনীত হচ্ছে সেটা না বুঝলে বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভ কিম্বা শাহবাগের বিরুদ্ধে বিপুল গণ প্রতিরোধের মর্মও বোঝা যাবে না। ইতিহাস বোধের অভাব এতোটা হওয়া উচিত নয় যাতে বিশুদ্ধ ইডিয়টের মতো দাবি করতে হয় মাহমুদুর রহমানের দৈনিক আমার দেশ কতিপয় নাস্তিকের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছে বলে হেফাজতে ইসলামের ডাকে মানুষ পিল পিল করে রাস্তায় চিড়াগুঁড় নিয়ে নেমে পড়েছে। স্টুপিডিটিরও কিছু মাত্রা থাকা চাই।

শাহবাগ আন্দোলন বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক ভূগোলের মধ্যেই দানা বেঁধেছে। তার আগে পরাশক্তির হস্তক্ষেপে এক এগারো বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করেছে। শাহবাগ এক এগারোর ঔরসেই দুই বছরের মধ্যে জন্ম লাভ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পরাশক্তি সমূহের হিশাব নিকাশ এবং ফ্যাসিস্টদের অনুমানের বাইরে একটি যুগান্তকারী মূহূর্ত উৎপাদন করেছে। সেটা হোল, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের গণ প্রতিরোধ এবং জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে দুর্দান্ত হাজির হওয়া। এরকম কিছু ঘটতে পারে সেটা ছিল অসম্ভব কল্পনা। কিন্তু ঘটেছে। বাংলাদেশের জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা হঠাৎ ঘটে নি। একাত্তরের জামায়াতে ইসলামের হঠকারী রাজনীতি এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায় নিয়ে যে ‘ইসলাম’কে নিত্যদিন নিন্দা করা হোত, জামায়াতে ইসলামের রাজনীতির দোহাই দিয়ে যে ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি একাত্তর থেকে দিনের পর দিন চলে আসছিল, যে ইসলাম নির্মূলের রাজনীতিকে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে যাবার জন্য দিল্লী শাহবাগ আন্দোলনকে সকল কূটনৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করে সমর্থন করেছিলো -- বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ অতি সাধারণ মানুষ চিড়াগুঁড় বেঁধে ঢাকায় দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এসে পরাশক্তি সমূহের দূতাবাস এবং শহরবাসীদের জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, ঢাকা শহরই বাংলাদেশ নয়। ঢাকার কতিপয় গণমাধ্যমের বানোয়াট প্রপাগান্ডা, মার্কিন সফট ডিপ্লোমেসির প্রডাক্ট মার্কিন দূতাবাস পরিচালিত ইয়ুথ লীডারশিপ বা তথাকথিত ‘তরুণ প্রজন্ম’ বুশ-ব্লেয়ারের ফুট সোলজার মাত্র। বাংলাদেশের সত্যিকারের ‘তরুণ প্রজন্ম’ কাদামাটি ভেঙে খোদ গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে এসেছে টুপি আর কোর্তা পরে। তাদের পদভারে ঢাকা কেঁপে উঠেছে। শাহবাগীদের পক্ষে এদের মোকাবিলা ছিল অসম্ভব। অতএব রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা শাপলা চত্বরে রক্তপাত ঘটাতে হয়েছে। কিন্তু ৫ এবং ৬ মে থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল গুণগত ভাবে বদলে গিয়েছে। আমরা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ দিয়ে জনগণকে আর ঘোল খাওয়ানো সম্ভব না। খোদ ফ্যাসিস্ট সরকারকেও তথাকথিত ‘নাস্তিক’দের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়েছে। দেশ ছাড়া হয়েছে অধিকাংশই। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদেরকেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হেফাজতে ইসলামের কতিপয় লোভী, দুর্নীতিবাজ নেতাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। তবে মইনুল ইসলাম হাটহাজারির ঘটনায় স্পষ্ট তরুণ মাদ্রাসার ছাত্ররা এদের হাত থেকে মাদ্রাসা মুক্ত করবার জন্য বদ্ধ পরিকর। এটা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নতুন উপাদান।

মঈনুল ইসলাম হাটহাজারিতে ছাত্রদের বিক্ষোভ ও আন্দোলন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে কওমি মাদ্রাসা এবং হেফাজতে ইসলামের মধ্যেই দুটো পরস্পর বিরোধী ধারা বিদ্যমান। একটি ধারা ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির দালাল, চরম দুর্নীতিবাজ, অর্থ লোভী এবং কওমি মাদ্রাসার ঐতিহ্যের পরিপন্থি। সার কথায় তারা মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও রাষ্ট্রের অধীনস্থ করতে আগ্রহী। এর আগে আমি বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যাখ্যা করেছি, ধর্মশিক্ষা পাওয়া এবং নিজেদের কারিকুলাম অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা পাওয়ার অধিকার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। তেমনি ধর্ম প্রচার এবং ধর্ম শিক্ষা প্রসারও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে। হেফাজতে ইসলামের কিম্বা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের আন্দোলন বলে একে কোন ভাবেই 'ধর্মীয় আন্দোলন' বলে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নাই। মইনুল ইসলাম হাটহাজারির ছাত্র বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে আমরা দেখি পরিষ্কার একটি ধারা কওমি মাদ্রাসার ওপর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং সাময়িক বিজয়ী হয়েছে। একে নিছকই মাদ্রাসা ছাত্রদের বিক্ষোভ জ্ঞান করা ভুল হবে। তাদের লড়াই গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের ধর্ম শিক্ষা ও ধর্ম চর্চার অধিকার নিশ্চিত করবার গণতান্ত্রিক আদর্শ ও নীতির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ বাহ্যিক দিক থেকে কওমি মাদ্রাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের লড়াই হওয়া সত্ত্বেও মর্মের দিক থেকে এটি হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই। গণমানুষের লড়াই। বাংলাদেশে গণ প্রতিরোধের বিশেষ ঐতিহাসিক ধরণ।

বিপরীতে তুলনা করুন, বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ চায় সবার জন্য একই রকম শিক্ষা। তারা তাই দাবি করে মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দেওয়া হোক। তারা একটি কথা বারবারই বলে যে ধর্ম শিক্ষা কোন অর্থকরী ভূমিকা পালন করে না। অতএব মাদ্রাসা শিক্ষার দরকার নাই। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষার অর্থ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও সরবরাহ করা। অনেকে আবার ঘুরিয়ে একই কথা বলে, - মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা হোক’। এর অর্থ হোল মাদ্রাসা শিক্ষার খোলনলচে বদলে দিতে হবে। তারা নামেই শুধু 'মাদ্রাসা' থাকবে কিন্তু হয়ে উঠবে আধুনিক কালের উপযোগী মতাদর্শ তৈরির কারখানা।

বাম, প্রগতিশীল বা আধুনিকতার নামে সবার জন্য বাধ্যতামূলক একই রকম শিক্ষার দাবি তুলবার বিপজ্জনক আরেকটি কারণ আছে, যার সঙ্গে আধুনিক জাতীয়তাবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা জড়িত। এই দাবির উদ্দেশ্য, পরিণতি কিম্বা ফলাফল হচ্ছে সামাজিক মনোগঠন ও মতাদর্শ উৎপাদন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের হাতেই একচেটিয়া কেন্দ্রীভূত করা। এই আলোকে অনেক দার্শনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় দমন নিপীড়নের মতাদর্শিক হাতিয়ার (Ideological State Apparatus) বলে দাবি করেন। সন্ত্রাস ও সহিংসতা যেমন রাষ্ট্রের একচেটিয়া তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থা ও মতাদর্শ উৎপাদনের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম ছাড়া আধুনিক জালিম শাহী টিকে থাকতে পারে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই লড়াই তীব্রতর হয়। বাংলাদেশ এখন যার নজির। মইনুল ইসলাম হাটজারির বিক্ষোভের সাময়িক সফলতার জাতীয় তাৎপর্য এখানে। তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের লড়াইয়ের প্রতি আমার আগ্রহের জায়গাটাও এইখানেই।

তবুও এই বিজয়কে আমি সাময়িক বলতে বাধ্য হচ্ছি। যতক্ষণ না মাদ্রাসার ছাত্ররা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা -- বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র বুঝতে অক্ষম থাকবে ততদিন রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিক্ষা সনদ পাওয়া ও গ্রহণ করার বিপদ তারা ধরতে পারবে না। সেটা আদতে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারা এবং মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক সার্বভৌমত্বকে ক্ষমতার বাজারে বেচাবিক্রির জন্য তোলা। এই রহস্য তারা যতো তাড়াতাড়ি ধরতে পারবেন ততোই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল।

সাধারন ভাবে মাদ্রাসা, দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিম্বা ধর্মচর্চা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু না। কওমি মাদ্রাসাও আলাদা বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাববার রোমান্টিক এবং অবাস্তব অনুমান সেকুলারদের মধ্যে যেমন তেমনি ইসলামপন্থীদের মধ্যেও কাজ করে। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি। সজ্ঞানে কিম্বা অজ্ঞানে পুঁজির দাস ছাড়া অন্য কোন স্বাধীন ভূমিকা পালন করবার জন্য যে হিকমত, প্রজ্ঞা, আন্তরিক জিহাদ ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দরকার তা সহজে অর্জন করা কঠিন। তাই কওমি মাদ্রাসায় পড়লেই আমার আধ্যাত্মিক জ্ঞান পাকা হবে, কিম্বা ইসলাম সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে আমার জ্ঞান পোক্ত হয়ে যাবে, এটা দুরাশা মাত্র। যদি হোত, তাহলে ইসলামে ‘জিহাদ’ নামক কোন ধারণার দরকার হোত না, নিজের সঙ্গে নিজের নিত্যদিনের লড়াইয়ের কোন গুরুত্ব থাকত না। এই আন্তরিক জিহাদ অনুপস্থিত বলেই ৫ ও ৬ মের ঘটনার পর হেফাজতে ইসলাম এবং কওমি মাদ্রাসার মধ্যেই ফ্যাসিস্টদের সহযোগী অর্থলোভী দালাল তৈরি হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। যারা এই আঁতাত করেছে, তারা নিজেরাও কওমি আলেম। হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফি এবং হাটহাজারি মাদ্রাসাকে কেন্দ্রে রেখেই তারা এই কাজ করেছে।

তাই ধর্মবেত্তা হলেই কওমি মাদ্রাসার আলেমরা দুনিয়ার হাল হকিকত বুঝে ফেলবেন, জানবেন কিম্বা বাস্তবিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে পারবেন মাদ্রাসার কিছু কিছু ছাত্রের মধ্যে এই অহংকার আছে। এই অহংকার মারাত্মক বিপজ্জনক। রাজনৈতিক ভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে সুনির্দিষ্ট ভাবে ইসলাম এবং ইসলাম প্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জারি রয়েছে। তাদের সামরিক নীতি, মতাদর্শিক প্রপাগাণ্ডা, কিম্বা সুনির্দিষ্ট ভাবে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা বোঝার জন্য আমাদের অনেক নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী চর্চা করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি আল্লামা আহমদ শফিকে অন্যায় ভাবে সমালোচনার হাত থেকে রক্ষ করতে চেয়েছি। এই দেশে কওমি শিক্ষাকে তিনি যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন এবং বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়েছেন তার জন্য আমি তাঁকে প্রশংসা করি। এই দেশের আলেম সমাজ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁকে অহেতুক রাজনৈতিক সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বর্ম হিশাবে বলে রাখা কর্তব্য মনে করেছি যে "আল্লামা শাহ আহমদ শফী মুলত ধর্মবেত্তা বা ধর্মতত্ত্বে আলেম। সমাজ বিজ্ঞান তাঁর বিষয় নয়, এবং তিনি রাজনৈতিক নেতাও নন। কিন্তু বাংলাদেশের এক অদ্ভূত ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ তাঁকে একটি বিশাল জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে টেনে এনেছিল। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শাপলা মঞ্চের তাৎপর্য আল্লামা আহমদ শফি ধরতে পারেন নি। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার জন্য যে এলেম, হিকমত ও আমল জরুরি, তিনি সেই পথ ধরে বেড়ে ওঠেন নি। আমার সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন এবং আল্লামা শফিকে অন্যায় সমালোচনা থেকে রেহাই দেবার এই বুদ্ধিবৃত্তিক সততার গুরুত্ব ইফতেখার জামিল ধরতে পারেন নি। তিনি আমারদোষ ধরেছেন। সেটা অসুবিধার নয়। কিন্তু তিনি আমার কথাকে বিকৃত করে লিখেছেন, আল্লামা শফি সম্পর্কে আমি নাকি লিখেছি, তিনি ছিলেন “নিছক ধর্মবেত্তা, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে দক্ষ কেউ নন। ফলে তিনি দুই হাজার তেরো সালের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি”। 'মূলত' আর 'নিছক' সমার্থক নয়। 'নিছক' শব্দের মধ্যে তুচ্ছার্থ নিহিত রয়েছে। এটা তিনি ঠিক করেন নি। মনে হয়েছে কওমি আলেম হিশাবে অহংকার ইফতেখার জামিলের মধ্যে রয়েছে। আলেম বা ধর্মবেত্তা হলেই কেউ সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে দক্ষ হন না।

পরের কিস্তিতে জামিলের তোলা কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করব। এবং তারপর জিয়া হাসানের দীর্ঘ পোস্ট ও অন্যান্য মন্তব্য দানকারীদের মন্তব্য পর্যালোচনা করার ইচ্ছা রাখি।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।