কেন ইসলাম নিয়ানিরন্তর কথা কৈতে হবে: ৩
কেন ইসলামকে নিয়া আপনাকে বার বার নিরন্তর কথা কৈতে হবে? কারন ইসলামের আগে আর কোন ধর্ম বা দ্বীন বলে নাই আমি মানুষকে 'খলিফা' হিশাবে দুনিয়ায় পাঠামু। ইসলামে মানুষের ধারণা দিব্যতাযুক্ত, দিব্যতা বিযুক্ত নয়। তাই ইসলামের পরে মানুষের মহিমা নতুন করে ঘোষণা করার আর দরকার পড়ে না। সেটা ঘোষিত হৈয়াই আছে। আপনি আমি বুঝি নাই কিম্বা শুনেও শুনি নাই -- সেখানেই সমস্যা। রিলিজিয়নের যুগে এই ভুলভুলানি সমস্যা মোচনের জন্যই ইসলামের কথা নিরন্তর কৈতে হবে। ইসলামের কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
ইসলামে মানুষ স্বয়ং 'ঐশ্বরিক', ডিভাইন। কারণ মানুষ আল্লার 'খলিফা'। তাই মানুষের জন্য খ্রিস্টধর্মের মতো আলাদা করে ঐশ্বরিক হবার প্রকল্প বা 'রিলিজিয়ন'-এর দরকার পড়ে না। ডিভাইন হবার সম্ভাবনা নিয়াই মানুষ জগতে বর্তমান। মানুষের অভাব থাকলে সেটা মানুষই কাটিয়ে উঠতে পারে, মানুষের অপূর্ণতা থাকলে মানুষের পক্ষেই নিজেকে পূর্ণ করা সম্ভব। ব্যবস্থা জালিম হলে মানুষই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, জালিমশাহী উৎখাত করে।
জালিমশাহী নিপাত যাক। ইসলামাবাদ যদি শিক্ষা পেয়ে গিয়ে থাকে দিল্লিও বাদ যাবে না। বাংলাদেশের কথা আলাদা বলার দরকার নাই।
মানুষ জন্মসূত্রেই পাপী, আদিপাপ থেকে তার জন্ম, তাই আল্লার নিষ্পাপ পুত্র ঈসা ছাড়া, যিনি মানুষের পাপ নিজের দেহে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে বরণ করেছেন -- তিনি ছাড়া পাপ মোচনের কোন সম্ভাবনা মানুষের নাই। মানুষ মাত্রই 'পাপী', তার জন্মই আদি পাপের ধারাবাহিকতা, ইসলাম সে কথা বলে না। ইসলাম ঈসা সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে রসু্ল মানে, কিন্তু মানুষ সম্পর্কে আদি পাপের তত্ত্ব মানে না। অথচ আদম হাওয়ার গল্প সকল ইব্রাহিমি ধর্মে একই।
কিম্বা মানুষ পূর্বজন্মে পাপ করেছিল, তাই তার দুনিয়ায় আসতে হয়েছে, মানুষকে এমন প্রকার পূর্ব জন্মের ফল ভোগকারী পাপিষ্ঠ বলেও ইসলাম গণ্য করে না। মানুষ তার ধর্ম বা স্বভাব নিয়েই দুনিয়ায় আসে। স হ জ। ইসলাম এই 'সহজ' ধর্ম মানে, কিন্তু মনুবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদ মানে না।
দুনিয়ায় মানুষ আল্লার খলিফা -- দুর্দান্ত ঘোষনা। আর কেউ বলে না, আর কেউ বলে নি। অতএব এই ইসলামের কথাই আপনাকে বারবার বলতে হবে।
মানুষের 'ফিতরাত' বা স্বভাবের বিকাশই ইসলাম। মানুষের স্বভাব মাত্রই দিব্যগুণ সম্পন্ন। এই জন্যই বলা হয় ইসলাম হজরত আদম আলাইহে ওয়াসাল্লামের মূহূর্ত থেকেই হাজির। দুনিয়ায় মানুষ কেন এসেছে, সে কে, কি তার কর্তব্য ইত্যাদি মনুষ্যজনোচিত জিজ্ঞাসাই মানুষকে দ্বীনের অর্থাৎ তার নিজের স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির দিকে নিষ্ঠ করে।
অতএব মানুষের বাইরে কোন রিলিজিয়ন নাই। এ কথা বারবার বলার দরকার আছে। মানুষের তথাকথিত 'পাপমোচন' বা 'মুক্তির' কোন তরিকা অন্যান্য রিলিজিয়নের মতো আলাদা ভাবে ইসলামে বাৎলাবার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ মানেই মুক্ত, দিব্যগুন সম্পন্ন। শয়তানের সঙ্গেই মানুষের প্রতিযোগিতা, আল্লা তার সহায়।
মানুষের একটাই কাজ শয়তানের কুমন্ত্রণা ও কু-প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকা। চাই শয়তানের কুমন্ত্রণা মুক্ত জীবন। যেন মানুষ তার জীবমূলক প্রবৃত্তির ফাঁদে বন্দী হয়ে না পড়ে, যেন নিজের দিব্য সম্ভাবনার প্রতি যারপরনাই নিষ্ঠ থাকে, এই নিষ্ঠাই তার রুকু, তার এবাদত। তার জন্যই ইসলাম। এর বাইরে আর সবই তথাকথিত 'রিলিজিয়ন'।
তাই 'দ্বীন' বলতে 'রিলিজিয়ন' বুঝবেন না। মানুষ মাত্রই পাপী, নিকৃষ্ট অধঃপতিত গণ্য করবেন না। যদি করেন তাহলে একদিন মানুষকে হীন গণ্য করার খেসারত আপনাকে দিতে হবে। যে 'রিলিজিয়ন' মানুষকে পাপিষ্ঠ অধঃপতত হীন গণ্য করে সেই রিলিজিয়নের বিরুদ্ধে লড়তে আপনি বাধ্য হবেন। মানুষের মহিমা ঘোষণা ও বাস্তবায়নের জন্য 'রিলিজিয়ন' মার্কা চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া আপনি 'মানুষ' হতে পারবেন না। 'রিলিজিয়ন'-এর বিরুদ্ধে মানুষের মহিমা প্রতিষ্ঠার জন্যই নাস্তিকতা আদর্শিক ও রাজনৈতিক ধারা হিশাবে হাজির হতে বাধ্য। অনিবার্য।
কিন্তু যেখানে দ্বীনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের মহিমা প্রতিষ্ঠা সেই ক্ষেত্রে কি করবেন? কার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন? সে দ্বীন কায়েম করাই তখন কাজ, দ্বীন অস্বীকার করা না। সেই ক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতার অর্থ আল্লার খলিফা বা দিব্যগুণসম্পন্ন মানুষের বিরোধিতা, মানুষের মহিমা অস্বীকার করা। আপনি তখন মানুষের দুষমন বনে যাবেন।
বরং ইসলামকে 'রিলিজিয়ন' বানাবেন না। কারন ইসলাম 'রিলিজিয়ন' না।
আচ্ছা বলেন, যে আল্লাহ মানুষকে তার খলিফা বানাইয়া দুনিয়ায় পাঠাইছে সেই আল্লাহকে অস্বীকার করব কোন দুঃখে? আমি বেয়াকুব নাকি? ইহলোকে মানুষের ঐশ্বরিক মহিমা বাস্তবে কায়েমের জন্যই আমার আল্লাহকে দরকার। যিনি আমাকে তাঁর খলিফা গণ্য করেন, তাঁরই গুণে গুণান্বিত হবার সম্ভাবনা যিনি স্বীকার করেন, যিনি তাঁর কর্তব্য একমাত্র মানুষই পালন করতে পারবে বলে ঘোষণা দেন, মানুষ নিঃশর্তে তাঁর কাছেই আত্ম সমর্পন করে এবং করবে। এই ইসলাম সৌদী আরবের মরুভূমিতে হারিয়ে গিয়েছে। খোঁজেন, আপনি যদি মানুষ তাহলে পেয়ে যাবেন।
আমি যার তাঁর হৈয়াই আছি। নিত্যদিন। নিত্য মূহূর্তে।
রিলিজিয়ন মার্কা ইসলাম মানুষ প্রত্যাখান করবেই, রিলিজিয়নে সে অবিশ্বাসী হবেই। ইসলাম যা ঘোষণা করে তার বাইরে মানুষ হিশাবে আমার চূড়ান্ত কী আর চাইবার থাকতে পারে? আমি বেহেশত দিয়ে কি করব? ওটা আপনি আপনার ব্যাংকে রেখে দেন। আমি যাঁর খলিফা তাকে কার দোজখ দেখাইবেন? কি দেখাইয়া ভয় দেখাইবেন? নিজে ভয় খাইয়া ভিমরি খাইতে আছেন।
এই জন্যই বারবারই বলব, ইসলাম 'রিলিজিয়ন' না, আপনি যা খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যের অনুকরণে এতোকাল বুঝে এসেছেন সেই বুঝে কাজ হবে না। মসজিদকে গির্জা বানাবেন না।
রিলিজিয়নের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। ইসলামের নামে পাশ্চাত্য খ্রিস্টীয় রিলিজিয়ন চর্চার দিনও শেষ হয়ে আসছে। আসছে দ্বীন, মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য লড়াই।
এই কথাটাই বারবার বলার জন্য ইসলামের কথা কৈতে হবে।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।