কেন ইসলাম নিয়ানিরন্তর কথা কৈতে হবে: ২
মানি, বাংলাদেশে জাতিবাদী ইসলাম আছে, কিন্তু সেটা শক্তিশালী না। 'ইসলামি মৌলবাদ' নামে সেকুলারদের ইসলাম বিদ্বেষী একটা পরিভাষা আছে, কিন্তু আদতে 'ইসলামী মৌলবাদ' বৈলা কিছু নাই। যেটা আছে সেটা হৈল ইসলামি জাতিবাদ। যার মর্ম হচ্ছে মুসলমানেরা আধুনিক অন্যান্য জাতির মতোই একটি আলাদা জাতি। আধুনিক জাতিবাদের মোকাবিলা ঠিক মতো করা গেলে জাতিবাদী ইসলামও মুখ থুবড়া পইড়া যাইব। ইসলামকে জাতিবাদের আছর থেকে মুক্ত করার জন্যই ইসলাম নিয়া নিরন্তর কথা কৈতে হবে।
'ছহি ইসলাম' বৈলাও কিছু নাই, ইসলামে তর্কবিতর্ক মতবিরোধ সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আপাতত বুঝতে হবে 'ইসলামি মৌলবাদ', 'ছহি ইসলাম' এইগুলা ইসলামের আভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা না। বাইরের ঝামেলা। বাইরের ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলামের কথা নিরন্তর বলতে হবে। বাইরের বিমারি দ্রুত কাটাইয়া ওঠা দরকার। তখন নিজের দিকে তাকাইবার সময় পাওয়া যায় আর তাকাইবার তৌফিকও আমলে আসে।
ইসলামের নবী আখেরি নবী, অর্থাৎ শেষ নবী। অতএব ইসলাম নিয়া নবীর পরে যে যা অতীতে বলেছেন, এখন বলতে আছেন এবং ভবিষ্যতেও বলবেন তারা নিজ নিজ দায়িত্বেই বলেছিলেন, বলছেন এবং আগামিতেও বলবেন। কিন্তু মাইন্ড ইট, কারো কথাই আখেরি নবীর মতো আল্লার তরফের কথা না। তাই আল্লার বরাতে কোন কথা বলার চেষ্টা কইরেন না। কোরান হাদিসে আছে বৈলা কোটেশান দিয়া নিজের ব্যাখ্যাকে আল্লা-রসুলের ব্যাখ্যা বলে চালিয়ে দেবেন না। আপনি ইসলাম আমল করেছেন কিনা, সেটা আপনার কামকাজ দেখেই বোঝা যাবে। ইসলাম মুক্ত মানুষের দ্বীন, তাকে জাহেলিয়ায় পর্যবসিত করবেন না।
আল্লার তরফে কথা বলা এবং সত্যের একচেটিয়া দাবির অধিকার ইসলাম কাউকেই দেয় নাই, কোন আলেম ওলেমা মোল্লা মৌলবিকেও না। ইসলামে কোন ভ্যাটিকান নাই, পোপ-পাদ্রি নাই। তাই বলা হয়, ইসলাম হচ্ছে প্রথাগত ধর্ম ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি। ল্যাটিন-খ্রিস্টিয় অর্থে 'রিলিজিয়ন' নামে আমরা যা জানি ইসলাম হচ্ছে তার পরিসমাপ্তি ঘোষণা। তাই ইসলামকে 'রিলিজিয়ন' বললে সেটা আর ইসলাম থাকে না, ইসলাম হচ্ছে দ্বীন। ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের পরে শেষ সেমিটিক ধর্ম হিশাবে ইসলামের আবির্ভাব। সেই ইসলামের কথাই তাহলে আমাদের নিরন্তর বলতে হবে যে ইসলাম মুসা আলাইহে ওসাল্লাম ও হজরত ঈসা আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর নাজিল হয়েছে এবং আখেরি নবীর মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্ত হয়েছে। ইসলাম প্রথম বারের মতো নতুন নাজিল হয় নাই, কিন্তু আখেরি নবীর পরে প্রাচীন ও প্রথাগত অর্থে ধর্ম বা রিলিজিয়ন অসম্ভব। 'রিলিজিয়নের' যুগ অতিক্রম করে দ্বীনের জগতে কিম্বা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার তর্কে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। যুগপৎ দ্বীন ও দুনিয়ায় বর্তমান হয়ে থাকার সময় এসে গিয়েছে।
'রিলিজিয়ন'-এর দিন শেষ। ইসলাম তাই দারুন ইন্টারেস্টিং। যে কোন বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল মানুষকে ইসলাম আকৃষ্ট করতে বাধ্য। এখন বড় জোর যা হতে পারে সেটা হচ্ছে মানুষের 'দ্বীন' বা 'ধর্ম' নিয়ে ধর্মপ্রাণদের মধ্যে তর্কবিতর্ক। সেই তর্কে 'রিলিজিয়ন' বা ধর্মীয় আত্মপরিচয় গৌণ। পরিচয় নির্বিশেষে এই বাহাসে সকলেই স্বাগতম। সকলের জন্যই দাওয়াত উন্মুক্ত। এই জন্যই ইসলামের কথা আমাদের নিরন্তর বলে যেতে হবে। আমরা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার কথা বলে যাব। যা নাই সেই দিকেই আমাদের রুকু যেন নিষ্ঠ থাকে তার জন্যই ইসলামের কথা বলব। বলে যাব। যেন জনগণ মোদী মার্কা ইসলাম করতে না পারে। জাতিবাদের খপ্পরে না পড়ে। রক্তবাদ, গোষ্ঠিবাদ, জাতিবাদ, সম্প্রদায়বাদ, পরিচয়বাদ ইত্যাদি জাহেলি ও কুফরির আবর্জনা পার হয়ে চিৎকার করে বলতে পারে, লাব্বায়েক, আমি হাজির। আমি আছি। আমি উপস্থিত!
তাহলে ইসলাম কি স্থানিক না? না, ইসলাম স্থানিক না। ইসলামের পৌত্তলিকতা বিরোধিতাকে এই বৈশ্বিক জমানায় সঠিক ভাবে ভাবতে শিখুন। আপনিও কাবাঘর প্রদক্ষিণ করেন। কালো পাথরে চুমা খান। পৌত্তলিকতার কীইবা আপনি বাকি রাখেন? বাকি রাখলেন? তাই ইসলাম স্থানিক না, কথাটা আপনাকে সার্বজনীনতার আলোকে বুঝতে হবে। ইউনিভার্সাল হওয়া, সবার হওয়া -- সকলের জন্য রহমত হওয়াই ইসলামের বাসনা।
তাই যে ইসলামের কথা আমরা নিরন্তর বলতে চাই সেটা স্থানিক সংকীর্ণতায় ভোগে না। কারণ যা অনুপস্থিত বা যা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ কিম্বা বুদ্ধির মূর্তি হিশাবে হাজির নাই, অনুপস্থিত, -- ইসলাম তারই এবাদতের কথা বলে। যেন মানুষ সংকীর্ণ কোন গহ্বরে ঢুকে গিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে না যায়। বসে না থাকে, বসে না পড়ে। বরং গায়েব বা যা নাই তার কথা সব সময় নতুন করে ভাবতে পারে। ইসলামকে তার গোড়া ধরে ভাবতে না শিখলে আপনিও পৌত্তলিক থাকেন। পোত্তলিকতাই করে যান। ভবিষ্যতে পৌত্তলিকতাই করে যাবেন। সেই পুত্তলি পাথরের, মাটির, কাগজের নাকি আপনার কল্পনার তৈয়ারি, বুদ্ধির নির্মাণ কিম্বা বাসনার বিষয় -- তাতে কিছুই আসে যায় না। আপনি ফ্যারে পৈড়া গেছেন। আপনাকে সুপথে আনার জন্যই ইসলামের কথা নিরন্তর বলে যেতে হবে।
ইসলাম যেমন স্থানীয় ধর্ম না, তেমনি আরবীয় ব্যাপার না। মার্কসকে যেমন আমরা জর্মন জ্ঞান করি না, বিশ্বের ভাবি, তেমনি ইসলামকেও শুধু আরব ও আরব ইতিহাসের বিষয় বানানোর অর্থ ইসলামকে স্থানিক ও সংকীর্ণ করা। এর ফলে ইসলাম আরব বা বিশেষ ভাবে সৌদি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদে পর্যবসিত হবার শর্ত তৈরি হয়। ইনক্লুসিভ অর্থাৎ অন্যদের জন্য তাদের শর্তে প্রয়োজনে জায়গা ছেড়ে না দিতে শিখলে সেটা 'ইসলাম' হতে পারে না। কথা হবে, তর্ক হবে, দাওয়াত দেওয়া নেওয়া চলবে, কিন্তু চিন্তার মিল না হলে, 'লাকুম দ্বীনুকুম ওলিয়া দ্বীন' -- তোমার দ্বীন তোমার থাকুক, আমার দ্বীন আমার। ইসলামের এই বৈপ্লবিক জায়গা গুলো আমরা ভুলে গিয়েছি। ফিরিয়ে আনতে হবে আবার। তাই বারবার আমাদের ইসলামের কথাই বলতে হবে।
অন্য জাতি ও সম্প্রদায়কে ঘৃণা করবার চর্চা একালে আধুনিক জাতিবাদ থেকে এসেছে। তাই বলেছি, মাশাল্লাহ, আমরা পেরেছি। আমরা ঢাকাকে কখনই দিল্লী হতে দেব না। অতীতে চেষ্টা হয়েছে, আমরা রুখে দিয়েছি। গোবিন্দ প্রামাণিক ও প্রিয়া সাহারা এই দেশে বাস করে। করবে। তারা অনেকে বাংলাদেশকে মোদী-অমিত শাহের হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে অখণ্ড ভারত গড়তে চায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা নালিশ জানালেও আইন করে তাদের নাগরিকত্ব বাংলাদেশ কেড়ে নেবে না। আমরা মোদী-অমিত শাহের ছানাপোনা না।
ঠিক। এতকাল পেরেছি, কিন্তু দিল্লির হত্যাকাণ্ড এবং জ্বালানো পোড়ানোর ঘটনার পর আমরা কতোটা পারব জানি না। পেরেছি কারন আমাদের শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিল, মওলানা ভাসানি ছিল, শেখ মুজিবর রহমান ছিল। সর্বোপরি আমাদের লালন শাহ ও নদীয়ার ভাবান্দোলনের ধারাসহ শক্তিশালী বয়াতি, দরবেশী ও ভক্তির ধারা ছিল এবং আছে। এরা কেউই ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন না। বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষ এসেছে বর্ণবাদী, জাতিবাদী ও সেকুলার হিন্দুত্ববাদীর কাছ থেকে। হিন্দু বা সনাতন ধর্মের কোন বিশ্বাস বা ধারা থেকে নয়। আমরা সবাই একই স্রোতে ভাসি। বাংলার ইসলাম আরবীয় নয়, এখানকার মাটি থেকেই এখানকার মানুষজনের মধ্য দিয়ে তার বিকাশ ও ইতিহাস।
জ্বি। আমরা নিরন্তর ইসলামের কথা বারবার বলে যাব।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।