ফেব্রুয়ারি ভাবনা: ৫
পুরানা সমাজ ভাঙা এবং নতুন করে সমাজ গড়ার ইচ্ছার অর্থ হোল বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে পালটা রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে পরিগঠিত হওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের সামন্ত সমাজ ও প্রাচীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা তত্ত্বগত ভাবে যে ধারণা ব্যবহার করে এসেছেন সেটা হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’।পাশ্চাত্যে গণতন্ত্র আপসে আপ কায়েম হয় নি। দীর্ঘ আন্দোলন, সশশ্ত্র লড়াই এবং গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে কায়েম হয়েছে। আমরা এখন যেভাবে গণতন্ত্র বলতে নির্বাচন বুঝি -- সেই গণতন্ত্র (?) ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে। জনগণ তাদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার আপোষে আদায় করতে পারে নি। অতএব জনগণকে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার থেকে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বঞ্চিত করে সেই রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানের প্রস্তুতিও গণতন্ত্র। কারণ বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে গণভ্যুত্থান নতুন 'গণশক্তি' বা ‘গণতান্ত্রিক শক্তি’র আবির্ভাব ঘটায়। নির্মাণ করে। গণশক্তি নির্মাণের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার উৎখাত এবং মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদাকে গঠনতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কায়েম করাটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র কায়েম করার পর নির্বাচন হচ্ছে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র চর্চা। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র কায়েম করা হয় নি, যা বিদ্যমান আছে আছে তা চরম ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা -- সেখানে নির্বাচন মানে ফ্যাসিস্ট রাষ্টশক্তিকে বৈধতা দেওয়া মাত্র।
গণতান্ত্রিক বিপ্লব ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হিশাবেও পরিচিত।। কারন এর উদ্দেশ্য মানুষকে ব্যক্তি ও ঐতিহাসিক কর্তা হিশাবে উপলব্ধি করবার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শর্ত কায়েম। মাও জে দং একে বলতেন, ‘নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার অভাবে এইসকল গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও বর্গ নিয়ে বাস্তবসম্মত কোন প্রকার তর্কবিতর্ক নাই, এমনকি আলোচনাও নাই বললেই চলে। যা আছে তা ধার করা বুলি আউড়ানো মাত্র। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় গণতন্ত্র কায়েমের নীতি ও কৌশলের প্রয়োগ কিভাবে হবে তা নিয়ে কোন প্রকার আলাপ আলোচনা চোখে পড়ে না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিক থেকে এই অভাব ভয়াবহই বলতে হবে। এর ফলে সমাজে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম মুখ থুবড়ে পড়ছে এবং শক্তিশালী সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক লড়াই তার যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে পারছে না।
তাহলে ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে ফেলে আসা তর্কের সুতা ধরেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। অনেকেই আজকাল দাবি করেন যে ‘গণতন্ত্র’ কথাটা এখন আর কোন ইতিবাচক রাজনৈতিক মর্ম ধারণ করে না। তাঁদের কথার যুক্তি আছে। এই মতের পক্ষে দার্শনিকদের বড় একটা অংশ আজকাল লেখালিখি করছেন। তবে অধিকাংশই আবার কৌশলগত কারনে মনে করেন গণতন্ত্রের দাবি বা রণধ্বনি থেকে সরে আসা ঠিক হবে না। এর কারণ ব্যক্তি হিশাবে মানুষ নিজেকে স্বাধীন ও মুক্ত হিশাবে উপলব্ধির সঙ্গে গণতন্ত্রের দাবি জড়িত। সজ্ঞান, সচেতন স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ শুধু ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে পেরেশান হয় না, ব্যক্তিতান্ত্রিকতায় চিরদিন খাবি খায় না। একমাত্র স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের পক্ষেই সমষ্টির স্বার্থ বোঝা সম্ভব। মানুষ সামাজিক জীব, অতএব সমাজের মধ্যেই মানুষের মুক্তি এই উপলব্ধি ও অঙ্গীকার ছাড়া সমাজ টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব। এই বিবেচনায় গণতন্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সারকথা হচ্ছে সামন্তবাদের ভাঙনের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে যে স্বাধীন চেতনার উন্মেষ ঘটেছে তাতে মানুষ নিজেকে স্বাধীন ব্যক্তি বা ঐতিহাসিক কর্তা হিশাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে – এই উপলব্ধিকে দার্শনিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, গঠনতান্ত্রিক (Constitution) এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পূর্ণ রূপ দেওয়াই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ। অর্থাৎ বিপ্লবী কর্তব্য হচ্ছে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষকে চিন্তাচেতনায়, গঠনতন্ত্রে, আইন ও বিচার ব্যবস্থায়, প্রশাসনে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ ভাবে কায়েম বা প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন এবং প্রত্যেকে রাষ্ট্রের নাগরিক, সেটা মুখে বললে হবে না; তার একটা নৈর্ব্যক্তিক রূপ (objective) দাঁড় করানো চাই। রাষ্ট্র হচ্ছে সেই নৈর্ব্যক্তিক রূপ। নব্য লিবারেলদের নির্বাচন সর্বস্ব ‘গণতন্ত্র’ সে কারণে এখন আর ‘গণতন্ত্র’ না। এমনকি 'গণতন্ত্র’ বলতে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রতত্ত্ব কূটনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার জন্য যে সকল ধ্যানধারণা ও ধান্দাবাজি প্রচার করে সেইসবও 'গণতন্ত্র' নয়। জনগণের 'শক্তি' যেখানে অনুপস্থিত, গণশক্তি যেখানে দৃশ্যমান নয়, সেখানে গণতন্ত্র থাকতে পারে না।
লেনিন রুশ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে নতুন ‘গণশক্তি’ নির্মানের বর্গ হিশাবে ব্যবহার করেছিলেন। বলশেভিকদের সঠিক রণধ্বণি নির্ণয়ে এই বর্গ যেমন সহায়ক হয়েছিল, তেমনি বলশেভিকদের রাজনৈতিক বিজয় নিশ্চিত করেছিল। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লেনিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। অতএব এই বিপ্লবের নীতিগত ও কৌশলগত দিক বোঝা এবং ভুলত্রুটি মেনে নিয়ে তার সার-অভিজ্ঞতা আমাদের অবশ্যই মনে রাখা জরুরি। লেনিনের সমালোচনা-পর্যালোচনা হোক ক্ষতি নাই। কিন্তু বাচ্চাকে গোসল করাতে গিয়ে ময়লা পানির গামলা সহ বাচ্ছাকেও ছুওড়ে ফেলে দেওয়া চরম আহাম্মকি। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণকৌশল হিশাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘গণশক্তি’ নির্মাণের যে নীতি ও কৌশলের শিক্ষা লেনিন দিয়েছিলেন তা আজও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ইতিহাসে অজেয় হয়ে আছে। এই নীতি ও কৌশল বিপ্লবী রাজনীতির মৌলিক অবদান হিশাবে স্বীকৃত। ‘গণশক্তি’র বিকাশ বা বিপ্লবের সফলতা লেনিনের ভাষায় ‘বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান’-এ রূপ নেয়। সঠিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে যা নিপীড়িতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে রূপ লাভ করে।
গণশক্তি নির্মাণের পথ কি? লেনিনের দাবি ছিল সেটা সম্ভব কৃষকদের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর ‘বৈপ্লবিক মৈত্রী’ নির্মানের মধ্য দিয়ে। কৃষককে লেনিন শ্রেণী হিশাবে ‘পেটি বুর্জোয়া’ গণ্য করেছিলেন, সামন্ততন্ত্রের ভাঙন এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশের কারণে কৃষকের মধ্যে মুক্তিকামী স্বাধীন ব্যক্তির চৈতন্য বিকশিত হবার সম্ভাবনা হাজির হয়। লেনিনের কৃষক বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সহযোগী নিপীড়িক শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আলাদা। এই পার্থক্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের আরও ভালভাবে তথ্যে ও তত্ত্বে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে হবে। কিন্তু মোটা দাগে এই ফারাক পরিষ্কার।
তাহলে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক মৈত্রী হচ্ছে নিপীড়িতের আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে রূপ দেবার জন্য রাজনৈতিক মৈত্রী। কিম্বা বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফ্যসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা এবং তাকে গণশক্তিতে রূপান্তরই আমাদের এখনকার প্রধান কাজ।
একুশ আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখাক। আমাদের বহু পথ দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।