ফেব্রুয়ারি ভাবনা: ৪
মতাদর্শিক ভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াই মূলত বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। বিদ্যমান ফ্যসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার যা মতাদর্শিক ভিত্তি। শ্রেণী হিশাবে জনগণের শত্রু হচ্ছে শহর ও মফস্বলের আধাখেঁচড়া ‘শিক্ষিত’ পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী, যারা বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ বোঝে। শেখ মুজিবর রহমানকেও এরা তাঁর ঐতিহাসিক তাৎপর্যের আলোকে বোঝে না। ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলমানের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় লড়াইয়ের পরিণতি হিশাবে কিভাবে একজন তরুণ মুসলিম লীগ সমর্থক একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠলেন সেটা বোঝার ক্ষমতা এই শ্রেণীর নাই। কোন সমাজ বা ইতিহাস স্রেফ ব্যক্তির তৈরি ঘটনাঘটন না, বরং ব্যক্তি নিজেও সেই ইতিহাসের পরিণতি। শেখ মুজিবর রহমানকে বাঙালি মুসলমানের লড়াই-সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্রেফ ‘ব্যক্তি’ হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করার মতাদর্শ মূলত ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ। ইতিহাস চেতনার অভাবে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি শেখ মুজিবর রহমানকে হিটলার বা মুসোলিনীর মতোই একজন মহানায়ক গণ্য করে।
একই সত্য উপলব্ধি বা ইতিহাস চেতনার অভাব মারাত্মক ভাবে বাংলাদেশের প্রচলিত বামপন্থার মধ্যেও বর্তমান। বামপন্থার পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি ভিত্তিই তার জন্য মূলত দায়ী। বিপ্লবী রাজনীতিতে শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হলে এই শ্রেণীদোষ কেটে যাবার শর্ত তৈরি হতে পারে। কিন্তু ক্ষতি যা ঘটার তা ঘটে গিয়েছে। ইতিহাস চেতনার অভাব বামপন্থাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
এ লড়াইয়ে জিততে হলে এই পেটি বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট শ্রেণির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই শূদ্র বা নিম্ন বর্ণের সবাইকে, আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসম্পন্ন জনগোষ্ঠিকে, পুরুষতান্ত্রিক শোষণে নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত নারী সমাজকে এবং সর্বোপরি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নে সর্বস্বহারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আগে খোদ আন্দোলনে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সবার আগে নিপীড়িত শ্রেণী ও জনগোষ্ঠির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র মানে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বৈধতা দেবার জন্য নির্বাচন নয়, তাকে উৎখাত করার গণ আন্দোলনই গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করে। গণতন্ত্র আগে আন্দোলন হিশাবে হাজির হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ নেওয়া আন্দোলনের পরিণতি। তাই আসল কাজের জায়গা বাদ দিয়ে হাওয়াই কথাবার্তা বলে লাভ নাই।
বিপ্লবী রাজনীতিতে বিদ্যমান ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য বা মৈত্রী 'বিপ্লবী মৈত্রী' নামে খ্যাত। এই মৈত্রীর অনুমান ও শর্ত হচ্ছে আন্দোলনে শরিক প্রত্যকের নিজস্ব সত্তা ও ঐতিহাসিক কর্তাবোধ আছে, সেটা আগাম স্বীকার করা। অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষকের যেমন নিজ নিজ স্বার্থ আছে, তেমনি নিম্ন বর্ণের মানুষ, আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিরও সুনির্দিষ্ট স্বার্থ ও অধিকার রয়েছে। একই ভাবে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের বাইরে নারীরও নিজস্ব সত্তা ও কর্তাবোধ আছে যার বিকাশ সমাজের সাধারণ স্বার্থ রক্ষার জন্য জরুরি। নারীকে পুরুষদের সকল সংগ্রামে আলুপটলের মতো যুক্ত করে নেওয়া যায় না। নারী আন্দোলনের নিজস্ব স্বকীয়তা থাকে, আছে এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর লড়াইকে তার নিজস্ব রূপ ও গতিতে বিকশিত হতে না দিলে তা ‘গণশক্তি’ নির্মাণের সহায়ক হয় না। ফলাফল হিশাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমও অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিপ্লবী মৈত্রী এই আগাম স্বীকৃতি ও পারস্পরিকতার ওপর নির্ভরশীল।
তাহলে ‘বিপ্লবী মৈত্রী’ মানে আন্দোলনে শরিক প্রতিটি পক্ষের স্বার্থ, অবস্থান ও মতাদর্শ সম্পর্কে সজ্ঞান ও সচেতন থাকা। ‘মৈত্রী’ বা ‘ঐক্যবদ্ধ’ আন্দোলনের নামে সেই ফারাক বা পার্থক্যের নিরাকরণ ঘটানো যাবে না। আসলে ঘটেও না। বরং বিপ্লবী রণনীতি ও কৌশলের সারকথা হচ্ছে সমাজের সকল নিপীড়িত শ্রেণি বা পক্ষের সঙ্গে সক্রিয় কথোপকথন জোরদার করা এবং নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব, বিরোধ বা সংঘাত মীমাংসার শর্ত জারি রাখা। কারণ সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই স্পষ্ট করা এবং সেই লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যের ক্ষত্র মজবুত করত পারাই আসল কাজ। বাস্তবে নিজেদের মধ্যে নানান সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারনে পার্থক্য থাকে বা আছে বলেই কোন বিমূর্ত 'জাতি'র কেচ্ছা বা জাতীয়তাবাদের রণধ্বণি দিয়ে শ্রমিক, কৃষক , নিম্ন বর্ণ বা জাতের মানুষ, ভিন্ন জাতিসত্তা এবং নারীর অধিকার হরণ চলবে না। এই ক্ষেত্রে আমরা মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে আছি। তবে 'আমি কে তুমি কে, বাঙালি বাঙালি’ -- এই প্রকার নাচনকুদনের কালপর্ব আমরা পার হয়ে এসেছি, আশা করি। বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে বাস্তব সমস্যার মোকাবিলা করেই আমাদের বিপ্লবী শক্তি হয়ে উঠতে হবে। এখানে রোমান্টিকতার কোন সুযোগ নাই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে 'বৈপ্লবিক মৈত্রী' নামক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা আছে। একুশের বিপ্লবী চেতনার পুনর্নিমানের জন্য সেই বিষয়ে দুই একটি কথা বলা যাক।
গণশক্তি বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সমাজে বিভিন্ন আন্দোলনরত শ্রেণী বা পক্ষের সঙ্গে মৈত্রীর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। বিপ্লবী রাজনীতি সেই মৈত্রী গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুনির্দিষ্ট ভাবে বর্তমানের কর্তব্য নির্দেশ করা যেমন জরুরি, তেমনি ভবিষ্যতের কাজ মনে রাখাও বিপ্লবী দায় বা দায়িত্বের অন্তর্গত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিপীড়িত শ্রেণী ও গোষ্ঠির মধ্যে কথোপকথন দ্বারা সামষ্টিক ইচ্ছা বা অভিপ্রায় নির্মাণ এবং দ্বন্দ্বের মীমাংসা সম্ভব । গণতন্ত্রের ইতিবাচক মর্ম কথোপকথন সংক্রান্ত এই প্রধান অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে রাজনীতি ও আমলের জন্ম দেয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেই কথোপকথন ও রাজনৈতিক পরিসরকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। জারি রাখে। ‘জাতীয় সংসদ’ সেই পরিসরের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মাত্র। কিন্তু পার্লআমেন্ত বা জাতীয় সন্সদ আগেই রাস্তার লড়াই-সংগ্রামে তৈরি হয়ে ওঠে। কথোপকথনের এই অপরিসিম গুরুত্বের জন্য গণতন্ত্র সে কারণে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং নির্ভয়ে মত প্রকাশের নিশ্চয়তা বিধানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। কথোপকথন ও বিপ্লবী মৈত্রীর কোন বিকল্প নাই।
‘গণতন্ত্র’ ‘আন্দোলন-সংগ্রাম’, ‘মৈত্রী’ ইত্যাদি অতএব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও অবিচ্ছিন্ন। নিপীড়িত বা মজলুম শ্রেণি ও গোষ্ঠির মধ্যে মৈত্রী সবার আগে দরকার, কারণ ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার এটাই একমাত্র পথ। জনগণের বিজয় নিশ্চিত করবার সদর রাস্তা।
একুশ আমাদের বিপ্লবী চেতনা ফিরিয়ে আনুক। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।