ফেব্রুয়ারি ভাবনা: ৩
বায়ান্ন বা একাত্তর পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলন থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একুশ ও একাত্তর সাতচল্লিশেরই ধারাবাহিকতা। তবে বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তি তা অস্বীকার করে। এই অস্বীকারের মধ্য দিয়ে তারা এই দেশের কৃষকদের জমির অধিকার ও মালিকানা লাভের লড়াইকেও অস্বীকার করে।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের কৃষকদের সংগ্রাম ভুলে যাওয়া, শেরে বাংলা ফজলুল হককে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া, শেখ মুজিবরের পাশা পাশি মওলানা ভাসানীর নাম না নেওয়ার বাতিক একান্তই বাংলাদেশের নব্য পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর। এরাই বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের প্রধান ধারক ও পোষক। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হলে এই শ্রেণীকে চেনা এবং হিন্দুত্ববাদসহ সকল প্রকার ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্পষ্ট ও তীব্র করা জরুরি। বাংলাদেশের প্রচলিত বামপন্থার সঙ্গে আমার প্রধান বিরোধের জায়গাও এখানে। নব্য পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর হিন্দুত্ববাদী আদর্শ তারা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে 'সেকুলারিজম' নামে বহন করে। আমার আশা তারা এই ভুল কাটিয়ে উঠবেন এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র সুস্পষ্ট করে তারা জনগণের কাতারে নেমে আসবেন।
বাংলাদেশের কৃষক পাকিস্তান চেয়েছে। শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান কায়েমের জন্য লড়েছেন। এটা তাঁর গৌরবের দিক। বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হচ্ছে পাকিস্তান দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই হিন্দুত্ববাদী প্রপাগাণ্ডা থেকে মুক্ত হতে হবে। সাতচল্লিশ বাংলাদেশের কৃষককে জমির অধিকার ও মালিকানা দিয়েছে। সাতচল্লিশের পর ১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলা জমদারি প্রথা রদ হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান কায়েম না করলে বাংলার কৃষকের পক্ষে এই অর্জন অসম্ভব হোত। জমির অধিকার ও মালিকানা পাবার পর নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা সচেতন ও সজ্ঞান হবার ফুরসত পেয়েছি। অর্থাৎ সাতচল্লিশ না হলে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন অসম্ভব ছিল, তেমনি একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনও দিল্লির হাওয়াই তামাশার অধিক কিছু হতে পারত না। দিল্লির চোখে একাত্তর এখনও 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যে যুদ্ধে পাকিস্তানকে ভারত হারিয়ে আমামদের 'বাংলাদেশ' উপহার দিয়েছে। উপহারের রাজনীতি সিরাম ইন্সটিটিউটের আস্ট্রা-জনিকার ব্যাক্সিন দিয়ে শুরু হয় নি, খোদ বাংলাদেশটাই দিল্লির 'উপহার'।
কিন্তু দিল্লির জন্য মুশকিল হচ্ছে আমরা সাতচল্লিশের জমির অধিকার ও মালিকানার আন্দোলন, বায়ান্ন্রর ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য লড়াই এবং একাত্তরে সম্পূর্ণ স্বত্ন্ত্র এবং নিজস্ব ইতিহাস ধারণ করে বিশ্ব সভায় নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে হাজির হয়েছি। আমাদের রুখে দেবার সাধ্য কারও নাই। আমরা এগিয়ে যাবই।
তাই বুঝতে হবে একাত্তরের পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের জনগণের লড়াই মূলত বর্ণ হিন্দু – বিশেষ ভাবে জমিদার-মহাজন-বাবুদের ‘বাঙালি’ ধারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই। বর্ণবাদী হিন্দুর 'বাঙালি' ধারণার মধ্যে শুরু থেকেই মুসলমান, শূদ্র বা নিম্ন বর্ণের মানুষ, আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতি সত্তা এবং স্বাধীন কর্তাসত্তা সম্পন্ন নারী অনুপস্থিত। তাদের কারোরই জীবন, জগত আশা আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা বা ঐতিহাসিক অভিপ্রায় বর্ণ হিন্দুর মতো হতে পারে না। অতএব যে দিকটা পরিষ্কার আমাদের বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই মূলত মুসলমান, শূদ্র, আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, পুরুষতান্ত্রিক শোষণে নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত নারী এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নে সর্বস্বহারা জনগণের যৌথ বা ঐক্যবদ্ধ লড়াই।
বর্ণ হিন্দুর জাতিবাদ থেকে মুক্ত হতে হলে বর্ণ হিন্দু-জমিদার ও মহাজনদের তৈরি ‘জাতিবাদ’ থেকে মুক্ত হতে হবে। এই জাতিবাদ শুধু ইসলাম বিদ্বেষী নয়, শুধু ইসলাম নির্মূল তার রাজনীতি নয়, বরং বাঙালি জাতিবাদ একই সঙ্গে শূদ্র ও নিম্ন বর্ণের জনগণ, সকল আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং সকল নারীর দুষমণ। কারণ বাঙালি জাতিবাদ এদের প্রত্যকের নিজস্ব অস্তিত্ব এবং বেড়ে ওঠার স্বতন্ত্র ইতিহাস স্বীকার করে না। শুধু তাই নয়, তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রগুলিও ক্রমাগত ‘জাতি’র নামে অস্বীকার করে। এমনকি ‘তোমরা বাঙালি হয়ে যাও’ বলে পাহাড়িদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য করে।
অতএব আমামদের সবার আগে বুঝতে হবে, 'বাঙালি জাতি' নামক হোমোজিনিয়াস বা একাট্টা কোন জনগোষ্ঠি নাই। ওপনিবেশিক বাংলার বর্ণ হিন্দুর জাতিবাদী ইতিহাসকেই 'বাঙালি জাতির ইতিহাস' হিশাবে এ যাবতকাল চালানো হয়েছে। এই ইতিহাস চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী, পুরুষতান্ত্রিক এবং ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। সমাজের বিরোধ ও সংঘাতের বাস্তব ক্ষেত্রগুলি বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে পরিকল্পিত ভাবে ক্রমাগত নিরাকরণ ও অস্বীকার করার ফলে আমরা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যা ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি আমাদের অবশ্যই অতিক্রম করে যেতে হবে। আশার কথা, আমরা পিছিয়ে যাই নি। এগিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু আমাদের কর্তব্য নিজেদের কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার। আমাদের অবশ্যই জাতিবাদী অহং এবং ফ্যাসিস্ট প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মচেতনা বা স্বাতন্ত্রবোধ নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নির্মাণের জন্য পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বলতে হবে। নিজেদের মধ্যে জোর কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। ইতিহাসে উপেক্ষিত, নিপীড়িত এবং নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন জনগণের পরস্পরের সঙ্গে নিষ্ঠা্র সঙ্গে কথা বলা এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নির্ণয় ছাড়া শর্টকাট কোন রাস্তা নাই। বর্ণবাদী জাতিবাদী বাঙালির প্রচার, প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে জনগণের বিপ্লবী মৈত্রীর ক্ষেত্রগুলো সঠিক ভাবে চিহ্নিত না করলে আমরা এক কদমও অগ্রসর হতে পারবো না। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন ভাবে আবির্ভূত বাংলাদেশের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমরা আসলে কারা ইতিহাসে নতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়েছি সেই গোড়ার জিজ্ঞাসা আমাদের নিজেদের কাছে আগে পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
ইতিহাস গায়ে চাপিয়ে দেওয়া কাপড়চোপড় নয় যে খুলে ফেললে বা অস্বীকার করলেই অতীতের ভার থেকে মুক্ত হওয়া যায়। না যায় না। এই অনস্বীকার্য সত্য বা বাস্তবতা মেনেই আমাদের নতুন ইতিহাস তৈরির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
হিন্দুত্ববাদ নিপাত যাক! বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক,
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।