ফেব্রুয়ারি ভাবনা: ২

বাংলাদেশে ‘বাঙালিত্ব’ সংক্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছে ‘বাঙালি’র ঔপনিবেশিক ইতিহাসে; বর্ণ হিন্দুর হাতে তৈরি ‘বাঙালি’ ধারণার রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ হিশাবে। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি -- বিশেষ ভাবে হিন্দু উচ্চ বর্ণের ধ্যান ধারণার মধ্য দিয়ে। এই বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণি একই সঙ্গে জমিদার-মহাজন শ্রেণীর অন্তর্গত, ইংরেজের তাঁবেদারি করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বাগিয়ে নিয়েই তারা ‘বাবু’ বা ‘ভদ্রলোক’ হয়েছে। পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ একদা মূলত তাদের অনেকেরই জমিদারির অন্তর্গত ছিল। সেই জমিদারি তারা আইনী ভাবে ভোগ করতে পেরেছে ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারনে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক সূত্রে জমিদার হওয়া, সুদখোর মহাজন হওয়া, বাবু বা ভদ্রলোক হওয়া, পুর্ব বাংলার কৃষকের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে কলকাতা শহর গড়ে তোলা ইত্যাদিকে আমরা ঔপনিবেশেক শাসন, বর্ণ, শ্রেণী এবং আভিজাত্যের ইতিহাস থেকে আলাদা করতে পারছি না। বাংলা ভহাষা এবং সংস্কৃতিকেও না। বাংলা ভাষা সম্পর্কে ধারণা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি, ‘বাঙালি’ নামক জাতি চেতনা – অর্থাৎ তথাকথিত 'বাঙালি জাতি’ এবং সেই বাঙালি জাতির জাতিরাষ্ট্রের ধারণাও এই ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে আলাদা কিছু নয়।

এই কালপর্বের ঔপনিবেশিক 'আধুনিকায়ন' অনেকের কাছে ‘বাংলার নবজাগরণ’ হিশাবেও পরিচিত ও খ্যাত। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আমলে বর্ণ হিন্দুর হাতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটেছে তার মধ্য দিয়েই ‘বাঙালি’ ধারণার উৎপত্তি ঘটেছে এবং বাঞালির নব্জাগরণ বা আধুনিকায়ন ঘটেছে। 'জাতিবাদ' একটি আধুনিক প্রপঞ্চ।

বাঙালি পরিচয় বর্ণ হিন্দুর ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে আলাদা কিছু না। এই সংস্কৃতির মধ্যে মুসলমান যেমন নাই, তেমনি শূদ্র, আদিবাসী এবং নারীও অনুপস্থিত। বাংলাদেশের আগামি দিনের রাজনৈতিক সম্ভাবনা এবং গতিশীল রাজনীতির সম্ভাব্য ইতিবাচক অভিমুখ বুঝতে হলে এই দিকগুলো নির্মোহ ভাবে আমাদের বুঝতে হবে। এই বোঝাবুঝি স্পষ্ট হলেই আমরা পরিষ্কার বুঝব বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই লড়াই পুরা উপমহাদেশেরই লড়াই। পুরা উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার পথও এখানে নিহিত। আজ বাংলা যা ভাববে, পুরা উপমহাদেশ আগামিতে সেটাই ভাববে। একদিন আগে কিম্বা একদিন পরে। এই যা।

নির্মোহ ভাবে বোঝার অর্থ এই সময়ের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অর্জন অস্বীকার করা নয়, বরং তার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করা, সঠিক ভাবে তার বৈশিষ্ট্য নির্ণয় এবং নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের উপলব্ধি, ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে তার ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যসহ বোঝা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো স্পষ্ট করে তোলাই আমাদের কাজ।

একুশ আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক।

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।