কাঁটাতারের বেড়া, বর্ডার এবং ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড : ২

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে। ভারত সরকার ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তে ৩৩২৬.১৪ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে। এরমধ্যে ২৭০৮.৭৭ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়ে গিয়েছে।

তো আমি সীমান্তে 'বেড়া' দেওয়া নিয়ে কথা বলব। হোক সেটা সীমান্তের পিলার, কাঁটাতার কিম্বা দেয়া্ল। 'বেড়া দেওয়া' কথাটা স্রেফ ইঁট, পাথর, পিলার জাতীয় প্রত্যক্ষ বস্তু মাত্র নয়। বেড়া অপ্রত্যক্ষ অর্থাৎ মানসিক, সাংবিধানিক বা আইনী বেড়া, কাঁটাতার বা দেয়ালও হতে পারে। ধরুন সংবিধান বা আইনের দ্বারা একটি রাষ্ট্রের নাগরিক এবং নাগরিকদের মাঝখানে 'বেড়া' বা 'দেয়াল' তুলে দেওয়া।

আমার 'বেড়া' নিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্য তাই আরও গভীর জায়গায় প্রবেশের দরজা খোলার চেষ্টা। এই সিরিজ লেখায় বিশেষ ভাবে জোর দেব পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অভিবাসন, শরণার্থী এবং উদ্বাস্তুদের পরিপ্রেক্ষিতে 'বেড়া দেওয়া' ব্যাপারটিকে বোঝা। কারন বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতি বোঝার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং পুরানা ওয়েস্টফালিয়ান (Westphalian Sovereignty) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা ক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে 'বেড়া দেওয়া'র মর্ম বুঝতে হবে। ওয়েস্টফালিয়ান রাষ্ট্র ধারনার গোড়ায় রয়েছে এই অনুমান যে রাষ্ট্র মানেই এক প্রকার মিস্টেরিয়াস সার্বভৌম সত্তা। তাই কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না।

বার্লিন দেয়াল ভেঙে যায় ১৯৮৯ সালে। অনেকেরই ধারণ হয়েছিল পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে পণ্য ও পুঁজির অবাধ চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যাতায়তও অবাধ হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে পণ্য ও পুঁজি অবাধে চলাচল করছে, পণ্য ও পুঁজির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমান্ত ভেঙে পড়ছে, কিন্তু মানুষের চলাচল কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল দিয়ে আটকানো হচ্ছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ক্ষয় ঘটছে, কিন্তু সীমান্তে সীমান্তে রাষ্ট্র তার মিস্টেরিয়াস সার্বভৌমত্ব প্রদর্শনের জন্য কাঁটাতার ও দেয়াল তুলছে। ব্যাপার কী? বিশ্ব ব্যবস্থার এই স্ববিরোধিতা আমাদের বোঝা দরকার।

বিএসএফের নির্বিচার গুলির বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আমরা সবসময়ই তুলে এসেছি। আরও তুলব। কিন্তু বার্লিন ওয়াল ভেঙে যাবার পর নতুন ভাবে কাঁটা তারের বেড়া তোলা বা দেয়াল কেন উঠছে সেটা বুঝে উঠতে পারা সহজ নয়। কারন তার বাহ্যিক অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও মানসিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক দিক রয়েছে। একালে বেড়া দেওয়া ব্যাপারটাকে সামগ্রিক ভাবে গভীরতর জায়গা থেকে না বুঝলে নতুন রাজনীতির উন্মেষ ঘটানো অসম্ভব।

সম্ভাব্য সদর রাস্তা খোঁজার প্রাথমিক ক্ষেত্র হতে পারে? অনেকে বলেন, 'রিফিউজি'। উদ্বাস্তু হাল বা অবস্থাকে রাজনোইতিক ও দার্শনিক ভাবে বোঝা। কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল তোলার মধ্য দিয়ে যাকে রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়েছে। যার কোত্থাও প্রবেশাধিকার নাই। বর্তমান বিশ্ব ব্যস্থার স্ববিরোধিতা বোঝার জন্য রিফিউজি, উদ্বাস্তু, রাষ্ট্রহীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-দার্শনিক ক্যাটাগরি।

মজার ব্যাপার খেয়াল করুন, আমরা নিজেরা ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দী হয়ে আছি, অথচ আমরা নিজেরা রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছি। দারুন ব্যাপার না? তাহলে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে বেড়া দেওয়া ব্যাপারটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে রিফিউজি, শরণার্থী এবং অভিবাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। নতুন রাজনৈতিক-দার্শনিক চিন্তার অন্তর্গত বিষয়। 'রিফিউজি' বা উদ্বাস্তু শুধু রাজনীতি ও দর্শনের নির্ধারক ক্যাটাগরি মাত্র নয়। বরং বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবার নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের ক্ষেত্র।

কিন্তু এহ বাহ্য। অর্থাৎ এটা বাইরের বেড়া দেওয়া বেড়া ভাঙার ছবি। আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। অন্দর মহলে বা অন্তরের দিকে তাকাতে হবে।

তাই, বাইরের বাড়া দেওয়ার বিচার করলে আমাদের চলছে না। দর্শন, মনস্তত্ব্ব ও ধর্মতত্ত্বের জায়গা থেকে আমাদের ভেতরে -- অনুমান, বিশ্বাস, চিন্তা ও ধর্মের জায়গা থেকে 'বেড়া দেওয়া' ব্যাপারটিকে দার্শনিক পর্যালোচনার অধীন করা দরকার। বোঝার দরজা, যতোই কঠিন হোক, আমাদের উন্মুক্ত করতে হবে। কোন ভূখণ্ড কিম্বা সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে কাউকে বাইরে রাখবার জন্য 'বেড়া দেওয়া' কিম্বা নতুন আইন করে বহিষ্কার করা এবং 'অপরাধী' জ্ঞান করে ডিটেনশান ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা আমরা চোখে দেখছি। চোখে দেখছি বলে 'বেড়া দেওয়া' বা 'দেয়াল তোলা' ব্যাপারটা আমরা কিছুটা হয়তো বুঝতে শিখছি। কিন্তু যখন আমাদের চিন্তায় কিম্বা হৃদয়ে আমরা বেড়া তুলে অন্য মানুষদের 'অপর' করি, সেই বিভাজন আমরা খুব সহজে ধরতে পারি না।

প্রশ্ন উঠেছে, প্রথাগত অর্থে শত্রু/মিত্র নির্ধারণের রাজনীতির দিন কি দ্রুত শেষ হয়ে আসছে? নাকি বাড়ছে? গুরুতর প্রশ্ন। শত্রুমিত্র নির্ণয় মানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বেড়া দেওয়া, দেয়াল তোলা। বন্দুক হাতে 'অপর'কে হত্যার জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকা। শত্রু না থাকলেও নতুন করে শত্রু বানানো।

তাই গোলকায়নের ফলে নতুন ভাবে মানুষ নিয়ে সামগ্রিক ভাবে ভাবনার নতুন কোন বাস্তবতা তৈরি হোল কিনা আমরা তা বিচার করে দেখতে চাই। আমার মনে হয়, হয়েছে। তার সদ্ব্যবহারের সুযোগ আছে কিনা সেটা বিচার করে দেখাই আমার উদ্দেশ্য। তাই, আমার দাবি, আগামি রাজনীতির প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া, লম্বা লম্বা শক্ত ও কঠিন দেয়াল সহ বাহিরে অন্তরে সকল প্রকার 'বেড়া' ভাঙা, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এক নতুন বিশ্ব মানুষকে হাতছানি দিচ্ছে।

এই সূত্রে আমরা বাংলার ভক্তি আন্দোলনের বিচারেও কিছুটা প্রবেশ করতে চাই। বাংলার ভক্তি আন্দোলন যখন 'ধর্ম' বলতে রাজনৈতিক শত্রু/মিত্র নির্ণয়ের ধারা অস্বীকার করে, আমরা তা হঠাৎ বুঝতে পারি না। তারা প্রেম দিয়ে জগত জয় করতে চায়, কাউকে অপর বা শত্রু বানিয়ে না। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মানুষের বেড়া বা দেয়াল তার ভেঙ্গে ফেলতে চায়। সে কারনে ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তারা তার উলটা বোঝে -- অর্থাৎ তারা বলে ধর্ম বেড়া ভেঙ্গে দেয়, ধর্মের কাজ দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের অনুমান যেহেতু ভিন্ন, আমরা তাদের কথা বুঝতে পারি না। ভক্তি আন্দোলনের রাজনৈতিক মর্ম আমরা ধরতে পারি না। একে আপনি ভক্তি আন্দোলন না বলে রুহানিয়াতের রাজনীতিও বলতে পারেন। অসুবিধা নাই। এই রাজনীতি মানুষের সঙ্গে মানুষের কোন পরিচয়বাদ বা জাতিবাদের বেড়া তোলা বরদাশত করে না। বাংলার সুফি-দরবেশ-ফকিরদের কাছ থেকে আমি রুহানিয়াত-এর মর্ম শিখেছি। বাংলার ভাবান্দোলনে একই জিনিস 'ভক্তি আন্দোলন' নামে পরিচিত।

সীমান্তের দুই পাশের বাঙালি ও বাংলাভাষী ভক্তি বা রুহানিয়াতের পরিভাষা এখন আর বোঝে না। এক সময় সুলতানি আমলে কিছুটা বুঝেছিল। খুশির কথা ধর্ম মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন জোড়া দেয়, বন্ধন ভাঙা ধর্মের কাজ না। ভারতে ভক্তিবাদীদের কেউ কেউ একথা এখন বলছেন। ভারতে বিভাজন, বাঁটোয়ারা, হিংসা হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে এঁদের কথা ভাল লাগল। আমাদের ফকির লালন শাহ আছেন। বেড়ার আলোচনায় তাঁকেও আমরা ডাকব। তবে ভারতের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সময় দেবী চিত্রলেখাজীর লিংক দিচ্ছি। আলোচনার গভীরে প্রবেশ বলতে কি বোঝাচ্ছি সেটা শুরুতে সহজে ধরিয়ে দেবার জন্য কাজে লাগবে।

প্রথাগত রাজনীতি শত্রুমিত্র বিভাজনের মধ্য দিয়ে মানুষকে বিভক্ত করে, মাঝখানে বেড়া তোলে। আর ধর্মের কাজ বেড়া ভেঙে দেওয়া। এই দিকটি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। আপাতত নোক্তা দিয়ে শুরু করলাম।

https://www.facebook.com/Chitralekhaji/videos/254448215238182/UzpfSTcxODAwMDc0MToxMDE1ODEzNDI2NTQ0NTc0Mg/?__xts__[0]=68.ARBlX0weQfElCcBJU1N1jq4WfFjg37CKEUv6ONxe0DZI0I2TveNMeRY_HUprBgIHSQIdB6fTmhkkMKXJPFpRFgOnbgrKwy6PSTcaBZ6SWyrD3XoKOu2VsjFudBBtiao-aK9MKU7dNOV4BvFw6tjFNaY7WY-2JXMRxmnis2yJ-4ZvTOB-u9RW3LHoaoWaP4etvkjcSLEum0gTxIpNSD4J-jpR4-CfAwL2iiZ2kds1oqmKXeSQNZNvkH4MdEuP-R2AGF84FiqOD9GO6jfoSi_EWQ_yYUDboFO4IzPKPZCNrXQh80lhcCCTzVfcK8yMCvDMF0egrPeCGrHEiLHijbnz0fjxxGp92Q&__tn__=K-R

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।