কাঁটাতারের বেড়া, বর্ডার এবং ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড : ১
২০০৯ থেকে ২০১৮ -- এই দশ বছরে সীমান্তে ভারতের ট্রিগার হ্যাপি বি এস এফ ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে, এটা বন্ধু রাষ্ট্রের কীর্তি সম্বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কম করে করা সরকারী হিশাব। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিশাব আলাদা। তুলনার জন্য ইমেজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অধিকারের তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিয়েছি। গত পাঁচ বছরের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান হচ্ছে ৪৬ (২০১৫), ৩১ (২০১৬), ২৪ (২০১৭), ১৪ (২০১৮), এবং ৪৩ (২০১৯)। একটি ইংরেজি দৈনিক আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই বলে সংবাদ শিরোনাম করেছে যে ২০১৮ থেকে ২০১৯ --এই দুইবছরেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের খুনলিপ্সা তিনগুণ বেড়েছে। সীমান্ত হত্যা আবারও সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে কারণ নতুন বছরে জানুয়ারি ২২ এবং ২৩ তারিখের মধ্যে, ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী ৫ জনকে হত্যা করেছে। সীমান্তে বিএসএফের হাতে পরপর তিনদিনে মোট সাত বাংলাদেশি খুন হয়েছে। নওগাঁ পোরশা সীমান্তের তিনজন। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার গোতামারী ইউনিয়নের দইখাওয়া সীমান্তে দুজন। যশোরের বন্যাবাড়িয়া সীমান্তে একজন। পঞ্চগড়ের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের মমিন পাড়া সীমান্তে একজন। নতুন বছরে দুই বন্ধু রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব হত্যার উৎসব দিয়ে শুরু হোল।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অপারেশন বিভাগের পরিচালক লে: কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারাও উদ্বিগ্ন। তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সেটা হোল, এসব ঘটনার ব্যাপারে ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়’ (দেখুন, বিবিসি ২৪ জানুয়ারি ২০২০)। অর্থাৎ গরুপাচারকারী বা স্মাগলারদের বিএসএফ মারছে এটা সত্য নয়।
ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং এন আর সি ও নাগরিকত্ব সংশোধন বিল এবং তার বিরুদ্ধে ভারতে গণ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত হত্যার এই উৎসবকে আর স্রেফ মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন, কিম্বা কুটনীতি দিয়ে বোঝার উপায় নাই। অতীতে কুটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। কাজ হয় নি। দেশী ও বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো মানবাধিকারের জায়গা থেকে বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের কাছে দেন দরবার করে সমাধান চেয়েছে। তাতেও কোন কাজ হয় নি। আমরা কয়েকটি পর্বে সীমান্তে ভারতীয় হত্যাকাণ্ড, বর্ডার এবং কাঁটাতার নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব।
প্রথমত ভাবা দরকার ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই হত্যাকাণ্ড নতুন কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে কিনা। এই হত্যাকাণ্ড শুধু হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা দিয়ে বোঝা যাবে না। ভারতে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখে হিন্দুত্ববাদীদের নতুন করে প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ থেকে সব সবময়ই অনুপ্রবেশ ঘটছে, তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত এই অনুপ্রবেশকারীরা ‘গরুচোর’ এবং এদের আরশোলার মতো মারাই সঠিক। এই বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিস্ট চিন্তা ভারতীয়দের মধ্যে পোক্ত করা। এন আর সি ও নাগরিকপঞ্জীর বিরুদ্ধে ভারতব্যাপী আন্দোলনের মুখে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুটিকে চাঙা রাখা ছাড়া হিন্দুত্ববাদীদের আর পথ নাই।
সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের দিক থেকে ভিন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভাবা দরকার, মুজিববর্ষে এই হত্যাকাণ্ড শেখ হাসিনার প্রতি দিল্লীর ম্যাসেজ কিনা। কে জানে! চিনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার মাশুল দিল্লি কি শেখ হাসিনার কাছ থেকে আদায় করতে চায়? নাকি নতুন করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে ভারতের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থের বাইরে বাংলাদেশের কোন স্বাধীন নীতি হতে পারবে না। অনেকে সন্দেহ করছেন পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠানোয় দিল্লি গোস্বা করে মানুষ মারছে।
পাকিস্তানে সরাসরি কোন ফ্লাইট না থাকার কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের জন্য বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ভাড়া করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিবি দু'টো দল পাঠিয়েছিল পাকিস্তানে - অনুর্ধ ১৯ এবং নারী ক্রিকেট দল। ২০১৯ সালে এই দল দুটো পাকিস্তানে গিয়েছিল কাতার হয়ে। পাকিস্তান বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম যাচ্ছেন না, কারণ দেখিয়েছেন পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। ভারতীয় আগ্রাসনের বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বার এই অতি প্রাথমিক গুড উইল মিশনে বাগড়া দেবার লোকের অভাব নাই। কিন্তু ক্রিকেট টিম শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে গিয়েছে। এদিকে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ৭ জন বাংলাদেশীকে রাতারাতি গুলি ও নির্যাতন করে মারল।
ভারতের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা বারবারই বলেছেন বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে তার বিনিময়ে দিল্লী যা করছে তা ভারতের স্বার্থের অনুকুল নয়। তাহলে দিল্লী করছে কেন? দিল্লী কি পূর্বাঞ্চলে নতুন কোন যুদ্ধফ্রন্ট খুলতে চাইছে? হিন্দুত্ববাদ ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি সামাল দেবার জন্য, বিশেষত মোদী-অমিতশাহের কর্পোরেট পুঁজি ও হিন্দুত্ববাদের বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য নতুন যুদ্ধফ্রন্ট খুলতেই পারে। বাংলাদেশকে অবশ্যই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে।
বর্তমান আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান কূটনীতি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এর বিকল্প কি হতে পারে সেটা নির্ণয় করাও কঠিন কাজ। কারন বাস্তবে এখন ভারতীয় আগ্রাসন ও খুন লিপ্সা থেকে সীমান্ত রক্ষা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা জনগোষ্ঠি। রোহিঙ্গাদের চেয়ে আমাদের অবস্থা বিশেষ উন্নত না। দিল্লী আমাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। চাইলেই যে কোন মূহূর্তে মারতে পারে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে কঠোর নীতি অনুসরণ বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব। হিতে বিপরীত হতে পারে। কিভাবে আমরা এই অবস্থায় এসে পড়েছি, সেটা ভিন্ন তর্ক। বরং আমাদের এখন দরকার অবিলম্বে বাস্তবতা উপলব্ধি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আন্তরিক পর্যালোচনা।
আমার মনে হয় জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খুবই দুর্বল। এর প্রধান কারন এক সময় বাংলাদেশের দিল্লীপন্থিরা দাবি করত, আমাদের কোন সেনাবাহিনীরই দরকার নাই। রক্ষীবাহিনী টাইপের ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে আনসার বাহিনী থাকলেই চলবে। একাত্তরের পর পুরা আশি ও নব্বই দশক অবধি এই প্রচার চলেছে।
জাতীয় প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণা নাই বললে মিথ্যা হয় না। একটি জনগোষ্ঠির জন্য এটা মারাত্মক দুর্বলতা এবং ভয়াবহ পরিস্থিতি। সামরিক সংগঠন, কৃৎকৌশল কিম্বা সামরিক সামর্থ্য জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্ধারক নয়। যদি হোত, তাহলে ভিয়েতনামের হাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটত না। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল কিম্বা কৃৎকৌশলগত পিছিয়ে পড়া দেশগুলো তাই সবসময়ই জাতীয় প্রতিরক্ষা হিশাবে গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা ভেবেছে। অর্থাৎ কিভাবে স্থায়ী ও পেশাদার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সাধারণ জনগণও প্রয়োজনে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য তৈরি থাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সেই দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ শত্রুর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। সেইসব অভিজ্ঞতাকে আমরা কখনই গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করি নি। সমরবিদ্যাকে আমরা স্রেফ ‘হত্যাবিদ্যা’ হিশাবে দেখি, রাজনৈতিকতার অবিচ্ছিন্ন সত্তা হিশাবে গণ্য করি না। সৈনিকতার গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝি না। নিকৃষ্ট দাস শ্রেণীতে পর্যবসিত হওয়া আমাদের অনিবার্য পরিণতি হয়ে ওঠে। কোন জনগোষ্ঠির পক্ষেই রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, যদি তাদের প্রতিটি সদস্য কৌম বোধ বা একক রাজনৈতিক সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য নীজের জীবন দানের শিক্ষা না পায়। সেই কারণেই নৈতিক, আদর্শিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার কথা ওঠে। ছোট দেশের জন্য তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের কোন ভাবনাচিন্তা নাই।
ফল হচ্ছে জাতীয় প্রতিরক্ষা, অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে জাতীয় গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চরম উদাসীনতা বিপজ্জনক রূপে এখন হাজির হয়েছে। আমরা ভারতীয় সেনা বাহিনীর ট্রিগার হ্যাপি হত্যালীলার খেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছি। মতাদর্শের দিক থেকে সামরিকতা এবং রাজনীতির সম্বন্ধ বিচার বা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গণপ্রতিরক্ষা বতবস্থা গড়ে ওঠে। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলে এ সম্পর্ক আদৌ কোন হুঁশ নাই। এখন ‘নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ’ নামক কিছু বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের ধারণা জাতীয় নিরাপত্তা বুঝি নিছকই সামরিক এবং কাউন্টার টেররিস্ট কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পুলিশ বিভাগ। তাছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষণা বিদেশী অর্থে হয় না, নাগরিকদের নিজেদেরই নিজেদের স্বার্থে সেটা করতে হবে। এটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান আমরা এখনও অর্জন করতে পারি নি।
এটা অবশ্যই সত্য যে একাত্তরের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের পরিকল্পিত ভাবেই নির্মূল করা হয়েছে। সেটা ভারতপন্থী রাজনৈতিক দল সিপাহি বিদ্রোহের নামে সেনা অফিসার হত্যার নামেই করুক কিম্বা শেখ মুজিবর রহমান ও জিয়াউর রহমান হত্যার আসামী হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেই শেষ হোক। মোট ফল মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদের ট্রাজেডি অনেক গভীর। এ নিয়ে ভাবনার লোকেরও মারাত্মক অভাব। নৈতিক ও আদর্শগত পুঁজি আমরা বহু আগেই হারিয়েছে। তারপরও সামরিক পেশাদারিত্বের ওপরের সারির গুরুত্বপূর্ণ সেনা অফিসারদের বিশাল একটি সংখ্যাকে পিলখানায় নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই সকল ঘটনার ফলে জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা বা গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না।
আমরা কি উপমহাদেশের আসন্ন গণহত্যার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি? দিল্লি কি তার প্রাথমিক চর্চা আরম্ভ করে দিয়েছে?
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।