ভাসানী পাঠ ও পর্যালোচনা: ৩

বাঙালির ইতিহাস বলতে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তি শুধু নয় মাসের ইতিহাস বোঝে, কারন তারা বাংলার অন্য সকল মনীষী ও নেতাদের বাঙালির ইতিহাস থেকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে শুধু একজনকে একমাত্র নেতা হিশাবে প্রমাণ ও কায়েম করতে চায়। এই রকম একজনকে আইকন বানানো এবং তার প্রতি সকলের নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি ফ্যাসিবাদের প্রধান চরিত্র লক্ষন। শেখ মুজিবর আমাদের ইতিহাসে অনন্য কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তিনি হাওয়া থেকে জন্ম লাভ করেন নি। তাঁর আগে আরও অনেক বাঘের বাচ্চা এই ভূগোলে জন্ম গ্রহণ করেছে। শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি, শরৎ বোস, যোগেন মণ্ডল, মানবেন্দ্র নারায়ন লার্মা এবং আরো অনেকে।

ভাসানীকে ইতিহাস ও রাজনীতি থেকে গৌণ করে ফেলার প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করা ফ্যসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত। কাজটি তাই এই গৌণকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করা এখন খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। একটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিকাশ একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়া, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ব্যক্তির অবদান থাকে। রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে আমরা বড় মাপের অনেক ব্যক্তিত্বকে জানি, যাদের ভূমিকা বাদ দিলে বাংলাদেশের ইতিহাস বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

বাংলাভাষী ও বাঙালীর নেতা যদি কেউ থাকেন তবে তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হক (২৬ অক্টোবর ১৮৭৩ - ২৭ এপ্রিল ১৯৬২)। বাংলার বাঘ। শেরে বাংলা খণ্ডিত বাংলার না, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩) ছিলেন। বড় বাংলার ইতিহাস নতুন ভাবে লিখতে বসলে বাংলার বাঘসকল ঠিকই সামনে হাজির হয়ে যাবেন। তীতুমীর ও সূর্যসেন সহ আরও অনেকে। এমনকি সিধো মুরমু (১৮১৫- ২৪ শে ফেব্রুয়ারি (১৮৫৬) ও কানহু মুরমু (১৮২০ - ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬) সহ আরও অনেকে। দুই ভাই যুগপৎ ইংরেজ ও অত্যাচারী বাঙালি ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শহিদ হয়েছেন।

যদি এই ভূখণ্ডের সকল অধিবাসীদের নিয়ে বড় বাংলাকে ভাবি, তাহলে সম্প্রতি কালের মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে অনেক উঁচু জায়গায় স্থান দিতে হবে। পাহাড়ি বলে নয়, বড় বাংলার বড় নেতা হিশাবে। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের সময় বাঘের বাচ্চার মতো বলতে পেরেছিলেন, “বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করা উচিত নয়। কিন্তু সেই সব জাতির কথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই খসড়া সংবিধানে নাই... আমার যে আপত্তি আছে, সে আপত্তি হলো আমার বিবেক, আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা পুরোপুরি এই খসড়া সংবিধানে নাই”। কথাটি খেয়াল করুন।

মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের পরিগঠিত হবার শুরুতেই বলেছিলেন, শক্তিশালী পরিগঠনের জন্য যেটা দরকার সেটা হচ্ছে ‘বিবেক’। সংকীর্ণ জাতিবাদ বা সাম্প্রদায়িকতা শক্তিশালী জনগোষ্ঠী গড়তে পারে না। দরকার ‘বিবেক’। সংবিধান প্রণয়নের সময় তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন ‘জাতিবাদ’ বিবেক বর্জিত হয়। কারন বিবেকের চেয়ে একটি বিশেষ জাতির স্বার্থ সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে। আমরা এখন বিবেকহীনতার কাফফারা গুণছি।

ছোটবড় সকল জাতিসত্তার অস্তিত্ব সুরক্ষা এবং বিকাশের নিশ্চয়তা ছাড়া ‘বড় বাংলা’ কথাটা অর্থহীন। ধারনাটি নিছকই ভৌগলিক নয়, বরং চিন্তা ও সংবেদনার ভূগোল থেকে যাদের সজ্ঞানে বাদ দিয়ে ‘বাঙালি’ নিজের পরিচয় বানাবার কু-অভ্যাস গড়ে তুলেছে সেই ‘দিকু’দের সংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা এবং বর্ণাশ্রমী জাতপাত প্রথা ভেঙে ফেলা প্রথম কাজ। সেই সব ভাংচুর তছ নছ করে সমূলে ধ্বংস করার জন্যই বড় বাংলা। তার জন্য বড় পরিসরে আমাদের চেতনার বিকাশ আগে ঘটাতে হবে। বড় বাংলা জিন্দাবাদ।

বড় বাংলা ‘বাঙালি’র ইতিহাস হবে না, সকলের ইতিহাস হবে। ভাসানীর কথা উঠলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কথা আসবেই। কারণ ভাসানীর ভূগোল বিশাল। পুরা দুনিয়া তিনি তাঁর তালপাতার টুপির তলায় বয়ে বেড়িয়েছেন। দুনিয়ার সকল নিপীড়িতের তিনি মুর্শিদ, দুনিয়ার সকল শূদ্র ও মজলুমের নেতা। কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতির না। তাঁর সাধনা ছিল সকল নিপীড়িতের মুক্তি, শুধু বাঙালীদের নয়।

শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতার মেয়র (১৯৩৫) , এমনকি সাতচল্লিশের পরে পাকিস্তান গঠিত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী(১৯৫৪), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫) এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরও (১৯৫৬ - ১৯৫৮) ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে তিনি একজন। তেমনি আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। তেমনি মওলানা আবদুল খান ভাসানীও বড় বাংলার নেতা হিশাবেই গড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভাসানী, আগেই বলেছি, আবারও বলি, 'বাঙালী'র নেতা হননি। হয়েছিলেন ‘মজলুম জননেতা’: দুনিয়ার সকল নিপীড়িত মজলুমের জিহাদি নেতা তিনি। জাতিবাদী দাপট ও ফ্যাসিজমের উত্থানের ফলে ভাসানী সাময়িক অস্পষ্ট হয়ে আছেন। বাঙালি যতোই তার জাতিগত অহংকার, সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ থেকে মুক্ত হবে ততোই তাঁর হুংকার শোনা যাবে: খামোশ।

9,547

People reached

792

Engagements

 

Boost post

 

 

 

510510

15 comments

31 shares

Like

Comment

Share

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।