ভাসানী পাঠ ও পর্যালোচনা: ২

তরুণ বন্ধু জ্যোতি পোদ্দার লিখেছেন: মাওলানা পাঠ জরুরি এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সময়ের সুর ও স্বর তিনি অনুভব করেছিলেন।

একত্ব ধারনাটি চমৎকার। দ্বৈত ভাব ভাবনা ভেদগ্রস্ত করে। অপরের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া অথবা অপর নিকৃষ্ট এমন ধারনা পোষণ ছাড়া তার চলে না।

এখন যে নানা রঙ দেখি সকলই ভেদগ্রস্ত। অভেদের ইশারা আছে বলে দাবি করে কিন্ত চর্চা কই?

চর্চা আর চিন্তাও কিন্তু অভেদ। ভেদগ্রস্ত হলেই সর্বনাশ।

আমার বক্তব্য হচ্ছে অবশ্যই। একদম। অর্থাৎ ভেদগ্রস্ত হলেই সর্বনাশ! চিন্তা ও চর্চা অভেদ কথাটা আলাদা ব্যখ্যার দাবি রাখে। সেটা অন্যসময় আলোচনা করব।

বিভেদবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই একালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। তবে বাংলার ভাবান্দোলনে 'ভেদবিচার', 'দ্বৈতাদ্বৈতবাদ' এবং 'অচিন্ত্যভেদাভেদ' ইত্যাদি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারা বিদ্যমান।

জ্ঞানতত্ত্বে ভেদজ্ঞান বা ভেদবুদ্ধি মানেই খারাপ তা নয়। মানুষ যখন কোন বিষয় নিয়ে ভাবে তখন একদিকে তার ভাবনার 'বিষয়' আর অন্যদিকে সে নিজে ভাবুক বা 'জ্ঞানের কর্তা' হিশাবে আপনা আপনি আলাদা হয়ে যায়। অর্থৎ জ্ঞানের বিষয়কে জ্ঞানের কর্তা থেকে আলাদা না করতে শিখলে জ্ঞানচর্চা সম্ভব না। সেটা হোক বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব কিম্বা দর্শন -- সব ক্ষেত্রেই এই ভেদবুদ্ধির দরকার হয়। কিন্তু মানুষ ভেদকেই সত্য মনে করে। তাই ভেদ্গ্রস্ত হয়। মনে রাখে না যে ভেদবুদ্ধির আগে তার সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের কোন ভেদ ছিল না।

সবে কালি পূজা গেল, যদিও আজকাল আমরা কালী সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানিনা বলা যায়। রামদুলালের খুব বিখ্যাত একটি শ্যমাসঙ্গীত আছে, যার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, 'এক ব্রহ্ম দ্বিধা হয়ে মন আমার হয়েছে পাজী । অর্থাৎ ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়, মানুষের চিন্তার অনিবার্য প্রক্রিয়া হিশাবে আমরা 'দুই' হয়ে যাই। তখন সবই যে ‘এক’ এটা আমরা আর বুঝতে পারি না। তাই ভেদ বা ভেদবিচার দর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাংলার ভাবচর্চায়।

এ নিয়ে আমাদের অন্যত্র আলোচনা করতে হবে। অর্থাৎ 'দুই'বা দ্বিত্ববাদের আলোকে 'এক'-এর ভেদবিচারও। দুইকে বোঝা সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুই বোঝা মানে আসলে মানুষ ও আল্লার সম্বন্ধ বিচার। সাংখ্যদর্শনে এটাই প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব হিশাবে মজুদ রয়েছে। তবে আপাতত আমরা ইসলাম ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে আমাদের আলোচনা সীমিত রাখতে চাইছি। বাংলার ভাবান্দোলন বিভিন্ন ধর্মচিন্তার মধ্যে আল্লা ও মানুষের মধ্যে এই সদানন্দ সম্বন্ধ আবিষ্কার করে সহজেই, তাই বাংলার ভাবুক বা রসিক আনন্দে গেয়ে ওঠে ‘দয়াল নবীর দয়া হলে দেখবি লীলা কি চমৎকার!” যারা নবীর প্রেমিক, যারা তাঁর আশেকান - তারাই এই মজায় তুমুল ঐশ্বরিক আনন্দ উপভোগ করেন।

মানুষই আল্লা, ঈশ্বর ইত্যাদি নিয়ে ভাবে এবং তার ভাবনা বা চিন্তার পরিণতি হিশাবে আল্লা বা ঈশ্বর সম্পর্কে নানান সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। কেউ আল্লা আছে মানে, কেউ মানে না। এই ক্ষেত্রে ইসলামের দাবি হচ্ছে এই ভাবনা বা চিন্তা দোষের নয়, চিন্তাশীলতা ছাড়া 'মানুষ' কথাটারও কোন মানে হয় না। চিন্তা ও কথা বলার সামর্থের মধ্যে ইসলাম মানুষের দিব্য সম্ভাবনা, অর্থাৎ 'আল্লার খলিফা' হবার সামর্থ নিহিত রয়েছে দাবি করে। কারন আদম 'নাম' বা ভাষা শিখেছে খোদ আল্লার কাছ থেকে। তাই তথাকথিত 'বিজ্ঞান' আজ অবধি মানুষ কেন কথা বলে তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে নি। কিন্তু কথা বলা, অর্থাৎ কোন উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে ভাষা বা কোন না কোন চিহ্ন ব্যবস্থায় প্রকাশ করবার শর্ত আছে। কি সেই শর্ত?

শর্ত হচ্ছে 'আল্লাহ'কে কোন মূর্তিতে পর্যবসিত করা যাবে না। ইসলামি শরিয়তের ভাষায় সেটা হবে শির্ক বা শেরেকি। এর মধ্যে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ মূর্তি যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে কল্পনা বা বুদ্ধির দ্বারা তৈরি মূর্তি, -- আল্লা বা ঈশ্বর সম্পর্কে নানান ধারনা নির্মাণ। কিন্তু নিত্যদিন মানুষ ইহলৌকিক ভাষায় আল্লাকে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা, কল্পনা বা বুদ্ধির মূর্তি বানিয়েই এবাদত করে, এটাই নশ্বর মানুষের জন্য স্বাভাবিক, কিন্তু ইসলাম দাবি করে আল্লাকে কোন দেশকালপাত্রাধীন মূর্তিতে পর্যবসিত করা যাবে না। কারন তিনি দেশকালপাত্রের অতীত। ইসলাম যে 'আল্লা'র কথা বলে তিনি শুধু ‘এক' না,তিনি একই সঙ্গে ‘গায়েব' বা নিরন্তর অনুপস্থিত। তাঁকে কোন সুনির্দিষ্ট মূর্তিতে রূপ দিলে তিনি দেশকালপাত্রের অধীন হয়ে পড়েন, তিনি আর 'আল্লা' থাকেন না।

দেখা যাচ্ছে ইসলামের একত্ববাদ মানুষের ভাষা বা পরমকে ব্যক্ত বা প্রকাশ করবার তর্কের সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই লেখা যাবে, কিন্তু আল্লার অলি, আউলিয়া, সুফি দরবেশরা কথা বলতে পছন্দ করেন না। আমলটাই আসল। মানুষ কি করছে তার দ্বারাই মানুষটিকে চেনা যায়। রসুল (সা) ইহলৌকিক জীবনে কি করেছেন তার দ্বারা যেমন তাকে চিনি, ভাসানীকেও তার জীবন যাপন ও কাজের দ্বারা আমরা চিনি।

ভাসানীর যে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেখানে তিনি রাসুলে করিমের ‘একত্ববাদ’কে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে বিচার করেছেন, ‘একত্ববাদ’-এর ইতিহাস দীর্ঘ, বৈচিত্র অনেক। কিন্তু তিনি রাসুলে করিম (সা)-এর আদর্শ অনুসরণ করেন ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে নয়, বরং রাজনীতির আলোকে – অর্থাৎ ইসলামের একত্ববাদ মানব জাতির মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ভাষাগত, বর্ণগত বিভেদের’ সকল ‘প্রাচীরের মূলে কুঠারাঘাত’ করে, এই সত্যই তিনি কায়েম করতে চেয়েছেন। এখানে মওলানা অনন্য। তিনি আল্লার রসুলের অনুসারী। এখন যে জাতিবাদী বা পরিচয়বাদী মুসল্মান্দের আমরা দেখি, তারা বহু আগেই ইসলামের শিক্ষা থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে।

আমিও কাজের মানুষ। ওপরের কথাগুলো বুঝলে একালে আমাদের কর্তব্য নির্ণয় সহজ হয়। নীতিগত এবং কৌশল্গত পদক্ষেপে কিভাবে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ভাষাগত, বর্ণগত বিভেদের মূলে কুঠারাঘাত করব, লড়াই এগিয়ে নেব তার একটা ছক দরকার। আমি এভাবে ভাবছি:

১. জ্ঞানতাত্ত্বিক: একত্ববাদের (Monotheism) দার্শনিক বা বৌদ্ধিক পর্যালোচনা। এর মধ্যে ইব্রাহিমী একত্ববাদের নানান রূপ তো বটেই, একই সঙ্গে. বৈদিক, শংকরাচার্য এমনকি আধুনিক কালের রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ বা ব্রাহ্মদের একত্ববাদও বিচারের অধীনে আনা দরকার। তারপর রয়েছে ভক্তিবাদীদের, যেমন সুফি, শাক্ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া, নদীয়ার ফকির, বাংলার বয়াতি বা বাউলদের 'একত্ববাদ, ইত্যাদি।

কেন দরকার? কারন চরম সাম্প্রদায়িক জাতিবাদী মুসলমানদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে শুধু ইসলামই একত্ববাদের কথা বলেছে, আর কোন অনারব বা অনৈস্লামিক ধর্মে একত্ববাদ নাই। আসলে একত্ববাদ দিয়ে ইসলামের বৈশিষ্ট্য বিশেষ বোঝা যাবে না, আসলে ইসলামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার রাজনৈতিক দিক। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ভাষাগত, বর্ণগত বিভেদের মূলে কুঠারাঘাত করে বিশশ্ব 'উম্মাহ' কায়েম করা। মানব্জাতিকে ঐক্যবধ করা। রাজনৈতিক কর্তব্যের দিক থেকে একত্ববাদকে বোঝা তাই একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।। ভাসানী যা মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন। 'ইসলাম' বলতে তিনি বৈচিত্রের মধ্যে মানবজাতির ঐক্য বুঝেছেন। তিনি রাসুলে করিমের (সা।) কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তাই 'দ্বীন'কে মসজিদে বন্দী করতে চান নি। 'দ্বীন'কে মসজিদে বন্দী করার পরিণতি দাঁড়িয়েছে ইঁটপাথর দিয়ে মুসলমানদের তৈরি মসজিদকেই শুধু আল্লার ঘর জ্ঞান করা। যেন আল্লাহ মসজিদ ছাড়া আর কোথাও নাই। এটা মসজিদ পূজা বা মূর্তিপূজা। জাতিবাদী মুসলমানদের মধ্যে 'পৌত্তলিকতা' ও 'জাতিপূজা' প্রবল বিপদ তৈরি করেছে। নিজেদের বিচ্যূতি আড়াল করবার জন্য শুধু পুতুলপূজাকেই তাই তারা আজকাল পৌত্তলিকতা বলে, নিজেরা বহু আগে 'পৌত্তলিক' হয়ে গিয়েছে সেটা স্বীকার করে না।

২. ঐতিহাসিক: বিভিন্ন একত্ববাদের ইতিহাস, বিশেষত যে বৈষয়িক ও বাস্তবিক পরিস্থিতিতে তারা গড়ে উঠেছে তার হদিস নেওয়া। ঐতিহাসিক বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝব আমাদের সাম্প্রদায়িক পরিচিতি কিম্বা ধর্মীয় পরিচিতিবাদের উৎপত্তি ধর্ম থেকে নয়, বাস্তব ইতিহাস থেকে। অতএব ইতিহাস বাদ দিয়ে এই ভেদ অতিক্রম করা যাবে না। ঐতিহাসিক ভাবেই তার উচ্ছেদ বা তার মোচন সম্ভব এবং সেটাই আমাদের কাজ।।

অসাম্প্রদায়িকতার কেচ্ছা আর অন্তঃসারশূন্য মানবতাবাদের গান গাইলেই বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং জাতিসমূহের ভেতর থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ বা জাতিবাদী হানাহানি যাবে না। ইতিহাস চেতনা খুবই জরুরী। বুঝতে হবে আমরা কি ছিলাম, কি হয়েছি এবং আসলে কি হতে চাই।

৩. স্থানকালপাত্র ভেদে বর্তমানে নিজ নিজ কাজ বা কর্তব্য যথাসম্ভব পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ভাবে বোঝা এবং করা জরুরী। কাজ না করবার অজুহাত বাদ দিতে হবে।

৪. বকোয়াজি কিম্বা ঘুরিয়ে কথা বলা বাদ দেওয়া দরকার। কথা বলতে হবে স্পষ্ট ভাবে।

দীর্ঘ লিখছি, যাতে অন্যরাও ভাবতে পারে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।