আর্থ ধর্মকথা এবং 'কোরবানি': ৪

এবার আমরা দ্বিতীয় ‘বিশ্বাস-ব্যবস্থা’র কথা বলব, অর্থাৎ আধুনিক সমাজে যে নতুন বিশ্বাস ধর্মের ভূমিকা পালন করে।

মানুষের সমাজ গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে ধর্ম একসময় সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, আইন, বিধিবিধান ইত্যাদির উৎস ছিল এবং একই সঙ্গে সমাজের ভিত্তি হিশাবেও ভূমিকা রেখেছে। ধর্ম ও ধর্ম চর্চা নানান প্রতীক, আচার ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে মানুষ একা নয়, সে একটা সমষ্টি বা সমাজের অন্তর্গত। ধর্মের সেই ভূমিকা বহু আগেই অপসৃত হয়েছে। সেখানে স্থান নিয়েছে বাজার-ব্যবস্থা। নিত্যদিন আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝি আমরা বাজার ব্যবস্থার অধীনেই বাস করি, বাজারের নিয়মই আমাদের নীতি-নৈতিকতা আচার-আচরণ নির্ণয় করে। বাজার-ব্যবস্থাই আমাদের সমাজ। প্রচলিত ধর্মচর্চাও বাজার বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন, হয়ে পড়েছে।

ফলে পুঁজিতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থাই নব্য বিশ্বাস-ব্যবস্থা বা ধর্ম হয়ে উঠছে। প্রচলিত ও প্রাচীন ধর্মকে আধুনিক ধর্মের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছে। বাজার ব্যবস্থার সার্বভৌমত্ব ধর্মকে অনিবার্য ভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করেছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে নিছকই ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণ চর্চা মাত্র। সেকুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা বাজার-ব্যবস্থার সার্বভৌমত্ব কায়েমের আবশ্যিক মতাদর্শ। পুরানা ধর্ম পালনের কোন নৈতিক কিম্বা আইনী বাধ্যবাধকতা নাই, কিন্তু নতুন ধর্ম পালনের জন্য আইন-আদালত, রাষ্ট্র এবং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

আধুনিক বাজার ব্যবস্থাকে মার্কসের অনুসারীরা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে থাকেন। কিন্তু মার্কস এই নতুন ধর্মকে শুধু আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা হিশাবে দেখেন নি, বরং মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে সার্বভৌম শক্তি হিশাবে দেখেছেন যার সামনে অতীতের কোন আসমানি আইন, নীতিনৈতিকতা বা ধর্ম টিকে থাকতে পারে নি। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নীতি-নৈতিকতা নির্ণয়ের ক্ষমতার বাইরে সক্রিয় এই নৈর্ব্যক্তিক সার্বভৌম শক্তির নাম ‘পুঁজি’। মার্কস বলেছেন আবির্ভাব মাত্রই পুঁজি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’। এই সার্বভৌম শক্তি কিভাবে গঠিত হয়েছে, তার বিচলনের ধরণ, মানুষের বৈষয়িক জীবনকে প্রতি পলে প্রতি পদে কিভাবে পুঁজি প্রত্যেকটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ব্যাখ্যা করতেই মার্কস সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। দেখিয়েছেন সার্বভৌম পুঁজি নিজেই নিজের আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবন সম্পন্ন করতে সক্ষম। এ এক অসীম সার্বভৌম শক্তি।

পুঁজিতন্ত্র যে আসলে ধর্ম এটি অবশ্য পণ্ডিত ও দার্শনিক মহলে খুব নতুন কথা নয়। একজন বড় জর্মান দার্শনিক বলেছেন, পুঁজিতন্ত্র আসলেই ধর্ম কারণ “মনুষ্য জীবনের উদ্বিগ্নতা, মানসিক ক্লেশ, অশান্তি ইত্যাদি প্রশমনের উত্তর আগে মানুষ ধর্মের মধ্যে সন্ধান করতো, এখন খোঁজে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়” (ওয়ল্টার বেঞ্জামিন)। পুঁজিতান্ত্রিক ভোগী ব্যবস্থাই মানুষকে ইহলোকে নগদানগদি তৃপ্তি ও আনন্দ দিতে পারে। আখেরাতের জন্য অপেক্ষার দরকার হয় না। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা পার্থিব জীবনের দুঃখ, কষ্ট, শোক, বঞ্চনা প্রশমনের মীমাংসা দিতে পারে এটা রীতিমতো ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন যে কোন ধর্মের চেয়ে এই ধর্ম প্রভূত শক্তিশালী। নতুন ধর্মতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্র হচ্ছে আধুনিক অর্থশাস্ত্র। মাক্স ওয়েবার অবশ্য আগেই দেখিয়েছিলেন কিভাবে খ্রিস্টিয় প্রটেস্টান্ট চেতনা ও নীতি-নৈতিকতা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রূপ দান করেছে (The Pretestant Ethics & the Spirit of Capitalism); কিন্তু ওয়াল্টার বলছেন, ও নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া বা খমাখা তর্কাতর্কির দরকার নাই, বরং বোঝা দরকার ধর্ম শুধু পুঁজিতন্ত্রের রূপ দান করেছে তা না, বরং পুঁজিতন্ত্র নিজেই একটি ধর্ম।

তবে প্রথাগত ধর্মের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে পুঁজিতন্ত্র শুধু ধর্মই নন, রীতিমতো একটা কাল্ট। কোন পারলৌকিক আকাংখা, স্বার্থ বা নাজাত পাবার আশা ছাড়াই এর প্রতি অনুরাগ নেশার মতো। এই ধর্মের কোন ‘শুক্রবার’ নাই। অর্থাৎ শুক্রবার জামাতে নামাজ পড়লাম বাকি দিন বা ওয়াক্তে না পড়লেও চলে, পুঁজিতন্ত্রে সেই সুযোগ নাই। মাফ নাই। এখানে কোন দয়া পাবার বা আপোষের সুযোগ নাই। পুঁজিতন্ত্র শিথিল ধর্ম না। এর দাসদের প্রতি ওয়াক্তে প্রতি দণ্ডে প্রতি পলে পুঁজির শাসন ও নিয়মের অধীনে থাকতে হয়। এবং দাসেরা একে সামাজিক সম্পর্ক বা সামাজিক নিয়ম হিশাবে নয় রীতিমতো প্রাকৃতিক নিয়মের মতো অমোঘ গণ্য করে এবং মান্য করে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা যতোদিন জারি থাকবে ততোদিন এই সার্বভৌম শক্তি ছাড়া, যা মানুষের জীবনের প্রতি ইঞ্চি ও কোনাকাঞ্চি নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য কাউকে প্রভু মান্য করা অসম্ভব। অর্থাৎ পুজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজির ধর্ম ছাড়া আর সব ধর্ম অচল এবং অসম্ভব। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, কে নাস্তিক, কে আস্তিক ইত্যাদি অবান্তর তর্ক। এ কালে ধর্মের তর্ক মূলত পুঁজির বিনাশ ও বিলয় নিশ্চিত করবার নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের লড়াই। প্রাচীন ও প্রচলিত ধর্মের অনুমান ও ব্যাখ্যা এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বদলে যেতে বাধ্য।

এ থেকে শিক্ষণীয় কি?

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম সম্পর্কে প্রাচীন ও প্রচলিত ধ্যান ধারণার বোঝা বহন করে বেড়ানো স্রেফ আহাম্মকি। বরং দরকার তাদের সকলের কঠোর পর্যালোচনা এবং চিন্তা ও পর্যালোচনার হিম্মত গড়ে তোলা।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কাউকে নতুন করে নাস্তিক হতে হয় না, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্তিক কিম্বা নাস্তিক সকলেই পুঁজির ধর্মই পালন করে।

তবে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ছেন তারা মানুষের ধর্ম কী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তৈরি করেন এবং করছেন। আমরা বুঝতে পারছি কিনা সেটা আমাদের ধর্মবোধের পরীক্ষা বলা যায়।

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।