আর্থ ধর্মকথা এবং 'কোরবানি': ৩
22 August 18
‘ধর্ম', 'দ্বীন' বা 'রিলিজিয়ন' আসলে কী সেটা ব্যাখ্যা করা যারপরনাই কঠিন এটা পণ্ডিত, বিশেষত ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক মহলে এখন কমবেশি স্বীকৃত। তবে ধর্মের সমাজতত্ত্বে যাদের আগ্রহ তাঁদের অধিকাংশই বলেন, সুনির্দিষ্ট ভাবে ধর্ম যে জাগতিক ভূমিকা পালন করে তার পর্যালোচনা ধর্ম ব্যাখ্যার একটা ভাল পথ হতে পারে। এই পদ্ধতি ধর্মের ফাংশানালিস্ট ব্যাখ্যা বলেও পরিচিত।
ধর্মের সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায় ধর্ম এক সময় জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা দিতো, এবং জগতে মানুষের কর্তব্য নির্ণয় করে দেবার ভূমিকা রাখত। মোটা দাগে দুটো ভূমিকা ধর্ম পালন করতো। একটি হচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভূমিকা। আরেকটি হচ্ছে নীতিনৈতিকতা নির্ণয়ের ভূমিকা। মানুষের কর্তব্য নির্ণয় করবার ক্ষেত্রে কীসে মানুষের মঙ্গল সেই মূল্যবোধ তৈরি বা নীতিনৈতিকতা নির্ধারণ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে আমরা দেখি এবং অনায়াসেই বুঝতে পারি ধর্মের এই দুইটি ঐতিহ্যগত ভূমিকা প্রায় অপসৃত। ধর্ম আগের সেই ভূমিকা এখন পালন করে না। ধর্মের সেই স্থান দখল করে নিয়েছে অন্যান্য ‘বিশ্বাস’। তার মধ্যে দুটি ‘বিশ্বাস’ আধুনিকতা বা আধুনিক সমাজকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক সমাজ এবং আধুনিক নব্য বিশ্বাস-ব্যবস্থায় তারা নির্ধারক ভূমিকা রাখে। ধর্মকে যে জ্ঞান-তাত্ত্বিক ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বাস-ব্যবস্থা হিশাবে প্রতিস্থাপন করতে চায় আগে তার কথা বলা যাক।
প্রথম ‘বিশ্বাস’ হচ্ছে বিজ্ঞান (Empirical Science)। জগত সম্পর্কে ধর্মীয় ব্যাখ্যার স্থান নিয়েছে বিজ্ঞান। প্রশ্ন উঠতে পারে, একে ‘বিশ্বাস’ বলছি কেন? ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই একমাত্র সত্য আধুনিক বিজ্ঞান এই ‘বিশ্বাস’কেই সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। এমনই যে মনে হয় মানুষ নিছকই এক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব জীব। মানুষের অপরাপর বৃত্তি এবং তাদের ভূমিকা অস্বীকার এবং স্রেফ ইন্দিয়বৃত্তিতে বিশ্বাস আদতে নতুন এক বিশ্বাস ব্যবস্থা, যা ধর্মের জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে।
আমরা এখন ধর্ম ‘পালন’ করি বটে, কিন্তু ধর্ম আর ‘বিশ্বাস’ করি না। যতোই ধার্মিকতার ভান করি না কেন বরং বিশ্বাস করি শুধু বিজ্ঞানকেই। বড়জোর এমন এক জীবন যাপন করি যা দুই ভাবে বিভক্ত। একদিকে ব্যক্তিগত জীবন। সেখানে ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরি। অথচ অপরদিকে জাগতিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সত্য ও টেকনলজির দ্বারাই জীবন পরিচালনা করি। ফলে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস আধুনিক জীবনে একটা ক্যারিকেচারে পর্যবসিত হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞান নব্য বিশ্বাস-ব্যবস্থা হয়ে ওঠার কারনে মানুষের অপরাপর ইন্দ্রিয় ও বৃত্তি অস্বীকার করা হয় কিম্বা গৌণ হয়ে যায়। এর সামাজিক ফল কী হতে পারে সেটা আধুনিক বিজ্ঞানে বিশ্বাসী সমাজ বিবেচনা করে না। বিজ্ঞান ও টেকনলজিতে নির্বিচার বিশ্বাসই নতুন ধর্ম হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিগ্রহ, পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরি, ক্ষতিকর টেকনলজি উৎপাদন ও ব্যবহার সর্বব্যাপী ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
মানুষ আর বুঝতে পারে না সে যুক্তি ব্যবহার করে কিন্তু যুক্তিসর্বস্ব প্রাণি নয়। মানুষ যন্ত্র বানায় বটে, কিন্তু নিজে যন্ত্র নয়। মানুষ যুক্তি, লজিক, ফর্মাল সিস্টেম, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম ইত্যাদি আবিষ্কার করে বটে কিন্তু নিজে লজিক, ব্যাকরণ বা কম্পিউটার নয়। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা যখন নব্য বিশ্বাস হয়ে ওঠে তখন মানুষের আবেগ, ইন্টুইশান বা স্বজ্ঞা, ভাবুকতা, কল্পনা, সংকল্প ইত্যাদি বিজ্ঞান ও টেকনলজির সামনে অর্থহীন হয়ে ওঠে।
নব্য বিশ্বাস-ব্যবস্থায় ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জগতই সত্য। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ উপলব্ধির বাইরে বুদ্ধি বা কল্পনার স্বাধীন কোন পরিমণ্ডল নাই। বুদ্ধির কাজ হচ্ছে শুধু প্রত্যক্ষ জগতকে ব্যাখ্যা করা। বিশ্বাস-ব্যবস্থা হিশাবে বিজ্ঞানের দাবি হচ্ছে বুদ্ধিসহ মানুষের অপরাপর বৃত্তিকে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের উপায় বা দাস হতে হবে। সেই সকল বৃত্তির আলাদা বা নিজস্ব সত্য আছে বা থাকতে পারে আধুনিক বিজ্ঞান তা অস্বীকার করে বা করতে চায়। এই নব্য বিশ্বাস-ব্যবস্থা দাবি করে অপরাপর মানবিক বৃত্তির কোন উপযোগিতা যদি থেকে থাকে তাহলে তাকে বলি দিতে হবে বিজ্ঞানের মন্দিরে। প্রত্যক্ষ জগতের পায়ে। দাবি করে, প্রত্যক্ষের বাইরে মানুষের আর কোন জগত নাই; প্রত্যক্ষই সত্য এবং প্রত্যক্ষেই মানুষের জগতের পরিসমাপ্তি। আধুনিক বিজ্ঞান নতুন ধর্মই বটে।
বিজ্ঞান যে মাত্রায় নিজেকে নতুন বিশ্বাস-ব্যবস্থা হিশাবে কায়েম করতে পেরেছে ততোই প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসের পরিমণ্ডল ভেঙে পড়েছে। ধর্ম আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে। আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে ধর্ম আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যর্থ ও হাস্যকর অনুকরণ করেছে। নিজের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য দাবি করতে হয়েছে কোরান শরিফ কিম্বা মহাভারতে বিজ্ঞানের সত্যই বিধৃত। কোরান কতোটা বৈজ্ঞানিক অনেকে কোরানের সুরা আর আয়াত ধরে ধরে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন।
এই বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষণীয় কি?
সামাজিক ভূমিকার দিক থেকে বিজ্ঞান ধর্মের মতোই একটি বিশ্বাস-ব্যবস্থা মাত্র। তবে বিজ্ঞান ধর্মের কিম্বা ধর্ম বিজ্ঞানের বিকল্প নয়। কারন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অপরাপর ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের ভূমিকা সীমিত।
দ্বিতীয়ত ধর্মের জগত আদতে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জগত নয়, এই দিকটি আগের চেয়েও এখন আরো পরিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছে। অতএব নিতান্ত বিশুদ্ধ আহাম্মক না হলে আল্লা আছে কি নাই সেটা কেউ দূরবীন দিয়ে চাক্ষুষ পরীক্ষা করে না, বরং মানুষের সামগ্রিক বৃত্তি বারবার কেন মানুষের মধ্যে রুহানিয়াতের অপ্রতিরোধ্য তাগিদ তৈরি করে তার হদিস নিতে বাধ্য করে। রুহানিয়াতের চর্চা, ভক্তি -- অর্থাৎ ইন্দ্রিয়বৃত্তির বাইরে বা ইন্দ্রিয়বৃত্তি অতিক্রম করে অধরাকে ধরবার নানান পথ ও চর্চা আধুনিক কালে প্রবল হয়ে ওঠে। ইন্দ্রিয় ছাড়াও মানুষের অপরাপর বৃত্তি চর্চা ও বিকাশের তাগিদ গড়ে ওঠে।
মানুষ নিছকই ইন্দ্রিয়পরায়ন জীব নয়। তাই প্রতিটি প্রাচীন ও প্রধান ধর্মই একালে ধর্ম জিজ্ঞাসা ও জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা ও অবস্থান নতুন ভাবে নির্ণয় ও নিশ্চিত করতে চাইছে। সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের তর্কও ভিন্ন রূপ নিচ্ছে। সেই সব ভিন্ন আলোচনা।
দ্বিতীয় বিশ্বাস ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় আমরা তা পরের পোস্টে আলোচনা করব।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।